Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৬
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৬

গোপা মিত্র

কাশ্মীর
।। বিশেষ পর্ব ।।

আমার দ্বিতীয়বার কাশ্মীর ভ্রমণ প্রথমবারের অনেক অনেক বছর পরে ২০০৯ সালে। এই ভ্রমণ আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে বা থাকবে কারণ এবারেই হয়েছিলো আমার মনের সঙ্গোপনে রক্ষিত দীর্ঘলালিত এক স্বপ্নপূরণ।

২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসের এক সকালে ছোট বোন আনুর (অঞ্জনা দত্ত) আমন্ত্রণে রাজধানী এক্সপ্রেসে আমরা এসে পৌঁছলাম দিল্লীতে। বেশ কিছুদিন ওদের বাড়িতে অতিথি হয়ে থাকবো – ফিরে যাবো জানুয়ারী মাসের প্রথম দিকে।

আমাদের আরোও একটা উদ্দেশ্য অবশ্য ছিলো – আর আনুও সেটা জানতো। এতোদিনের মধ্যে কয়েকটা দিন বার করে নিয়ে আমরা একসঙ্গে বেড়িয়ে আসবো কোনোও বরফাবৃত পাহাড়ে – সে উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ বা কাশ্মীরও হতে পারে।

সন্ধ্যেবেলা সবাই মিলে বসে স্থির হলো – আমরা যাবো কাশ্মীরের স্বল্প পরিচিত ছোট শৈল শহর পাটনিটপ এবং বাটোট-এ। এর জন্যে শ্রীনগরে প্রবেশ করতেই হবে না। যদিও ডিসেম্বরের শেষে বরফাবৃত গুলমার্গ যে কতোটা আকর্ষণীয়, সে ধারনা আমাদের সবারই ছিলো। কিন্তু সুনীতের (আনুর স্বামী) প্রবল আপত্তিতে গুলমার্গ আমাদের আগেই বাতিল করতে হয়েছে। সুনীতের অবশ্য যুক্তিও ছিলো – কাশ্মীর তখন ভীষণ ভাবে অস্থির, সমস্যাসঙ্কুল – আরোও ভালো করে বললে বলা যায় বিপদসঙ্কুল। অবশ্য গত বছর ঠিক এই সময়েই পাটনিটপে প্রবল তুষারপাত হয়েছে। কে বলতে পারে, ভাগ্যে থাকলে এবারেও আমরা হয়তঃ তুষারপাত উপভোগ করবো।

যা হোক, দিল্লী-জম্মু রাজধানী এক্সপ্রেসে ২১শে ডিসেম্বর ভোরবেলা ৪/৪:৩০-এ কনকনে ঠাণ্ডায় আমরা এসে নামলাম জম্মুতে। আমরা বলতে – আমি, কল্যাণ, আনু, সুনীত আর ওদের ছেলে ঋজু। শুধু আমরাই ক’জন সিভিলিয়ান আর বাকি সব জওয়ান।

স্টেশনের বাইরে কিছু জওয়ান ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে বসেছিলো হয়তঃ কোনোও ট্রেন বা গাড়ির অপেক্ষায়। হয়তঃ ভাবলো, এই শীতের রাতে ষাটোর্ধ চারজন ‘যুবক-যুবতী’ এখানে আবার কেন? তারা এগিয়ে এসে আমাদের জিজ্ঞেস করলো যে, তারা আমাদের কোনোও সাহায্য করতে পারে কি না। এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কথা অবশ্যই বলতে হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের অতন্দ্র প্রহরাই আমাদের রাতের নিশ্চিন্ত নিরাপদ ঘুমে সাহায্য করে। ভাবতে পারা যায় না, মাইনাস তাপমাত্রায় সারারাত ব্যপী প্রহরায় কি কষ্টকর কঠিন জীবন তাঁরা যাপন করেন। আমি আমার এই লেখার মাধ্যমে আমাদের দেশের এই সব জওয়ানদের কৃতজ্ঞতা জানাই। তাদের স্যালুট করি।

ওই সেনারাই আমাদের জন্যে এক TAVERA গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলো। আমরা রওনা হলাম পাটনিটপের পথে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা সুনীতই করেছিলো, বাটোটে। যদিও ঠিক ছিলো পাটনিটপ পছন্দ হলে সেখানে আমরা দিনদুয়েক কাটিয়ে ফিরবো বাটোটে।

উধমপুর জেলায় অবস্থিত ছোট্ট পাহাড়ী জনপদ পাটনিটপ জম্মু থেকে ১১২ কিলোমিটার দূরত্বে, জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়ক সন্নিহিত। অবশেষে পাটনিটপ। কিন্তু কোথায় বরফ? হ্যাঁ, বরফ অবশ্য দেখতে পাচ্ছি দূরের পর্বতশিখরগুলোয়। উপস্থিত হলাম ট্যুরিস্ট বাংলোর রিসেপশনে। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় গেলে বরফ দেখা যাবে! তাদের উত্তর, “কেন, দূরের ওই পাহাড়চূড়াগুলো আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না?” হতাশ আমরা ফিরে চললাম বাটোটের পথে।

শ্রীনগরের দিকে যেতে গেলে রামবন জেলায় বাটোটের অবস্থান, পাটনিটপের ঠিক পিছনে। ছোট্ট এই জনপদ বাটোট, একেবারেই আধুনিক নয়। ছোট ছোট দোকান, স্থানীয় লোকজন আর প্রায় নির্জন রাস্তাঘাট – এই নিয়েই বাটোট। তাতে বাটোটের শহুরে সৌন্দর্যের অভাব থাকলেও, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কিন্তু অভাব নেই। সব সময়ে দৃশ্যমান দূরের বরফাবৃত পর্বতশ্রেনী আর মাঝে মাঝে অযত্নবর্ধিত বৃক্ষরাজি। এইসব বৃক্ষরাজির পাশ দিয়ে বরফাবৃত পাহাড় সঙ্গী করে আমরা হেঁটে বেড়াতাম নির্জন জনপদ দিয়ে।

যে দোতলা বাংলোয় সুনীত আমাদের আস্তানা স্থির করেছিলো তা বড়ই সুন্দর। দোতলায় অ্যাটাচড বাথ সহ সাজানো দুটি ঘর, সঙ্গে সোফাসেট, টি.ভি.-তে সাজানো একটি ড্রয়িংরুম। আমাদের স্যুটের কাঁচের দরজা খুললেই সামনে চেয়ার-টেবিল দিয়ে সাজানো টেরেস। দোতলায় আমাদেরটা ছাড়া আর কোনোও স্যুট রয়েছে বলে মনে হলো না। টেরেসের অবস্থানটি এতোটাই চমৎকার যে, এখানেই সারাদিন শীতের মিঠেকড়া রোদে পিঠ দিয়ে বসে আমরা উপভোগ করতাম সামনের বরফাবৃত পাহাড়গুলির রং বদল। সঙ্গে চলতো আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া আর বিভিন্ন ইন্ডোর-গেম্‌স্‌। ঘরে যেতাম একেবারে রাতে। তখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় লেপ-কম্বলে নিজেদের আপাদমস্তক মুড়ে গল্প করতাম।

পরদিন ২২শে ডিসেম্বর বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে সুনীত আর ঋজু আনুর জন্যে নিয়ে এলো কেক। কারণ ২৩শে আনুর জন্মদিন। আশ্চর্য এটাই – সচরাচর সব পাহাড়ী জায়গাতেই খুব ভালো কেক-পেস্ট্রি পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে অনেক খুঁজে একটিমাত্র দোকানের সন্ধান পেয়ে ওরা সেখান থেকে কেক নিয়ে আসতে বাধ্য হলো।

সন্ধ্যেবেলা আমরা সবাই আবার আলোচনায় বসলাম। ডিসেম্বরের শেষে কাশ্মীরে এসেও বরফে না হেঁটে শুধুমাত্র দূরের বফাবৃত পাহাড় দেখেই আর ঘরে বসে গল্প করেই ফিরে যাবো যে যার বাড়িতে? এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। গাড়ীর পাঞ্জাবী চালক আমাদের আলোচনা শুনে অনেক আগেই বলে দিয়েছে পছন্দমতো বরফ আমরা পাবো শুধুমাত্র গুলমার্গে গেলেই। অন্য কোথাও নয়।

স্থির হলো আমরা আগামীকাল গুলমার্গেই যাবো। সঙ্গে গাড়ি রয়েছে, অসুবিধে নেই। ওখানে একরাত থেকে ফিরে আসবো এখানেই। দুদিন থেকে এখান থেকেই ফিরে যাবো দিল্লীতে।

কাল ভোরে গুলমার্গ যাচ্ছি। বরফের ওপর হাঁটছি। আমার অনেক দিনের স্বপ্নপূরণের আর একটা মাত্র রাতই বাকি। আমি তো ভাবতেই পারছি না। রাত বারোটায় মোমবাতি জ্বালিয়ে, কেক কেটে আমরা আনুর জন্মদিন পালন করলাম। কনকনে ঠাণ্ডায় কম্বল জড়িয়ে বিছানায় বসে আমরা জন্মদিন পালন করছি – ভাবা যায়!

পরদিন ভোরে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা রওনা দিলাম গুলমার্গের পথে। যতো অগ্রসর হচ্ছি, ততোই উত্তেজনার পারদ চড়ছে। বানিহাল টানেল পেরিয়ে আমরা উপস্থিত হলাম শ্রীনগরের দরজায়। কিন্তু শ্রীনগর না গিয়ে, বাইপাস করে, আমরা এগিয়ে চললাম গুলমার্গের দিকে। আমাদের এগোবার সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে যেতে লাগলো সারবন্দী গাছপালা, বাড়ীঘর, ফলন্ত আপেলবাগান আর উইলো গাছের সারি। শুনলাম, এই উইলো গাছের কাঠ দিয়েই তৈরী হয় ক্রিকেট ব্যাট। ফেরার পথে ঋজুর জন্যে দুখানা ব্যাট কেনা হয়েছিলো।

বুঝতে পারছি গুলমার্গ এসে গেছে। কারণ রাস্তার দুপাশেই তখন বরফ দেখছি। যতো এগোচ্ছি দুপাশের বরফ ততোই কাছে এগিয়ে আসছে। আমরা সবাই উত্তেজিত কিন্তু নিশ্চুপ। শুধু দেখছি আর দেখছি। ক্যামেরা ছাড়াও মনের ক্যামেরাতেও ছবি তুলে রাখছি। তখনোও জানি না, সামনে কোন্‌ স্বর্গে আমরা পৌঁছবো।

এ কি! কোথায় এলাম আমি! ঢেউ ওঠা নীল সমুদ্রের চঞ্চল রূপ তো অনেক আগেই আমার দেখা। কিন্তু দিগন্ত বিস্তৃত এমন উজ্জ্বলশুভ্র স্থির সমুদ্রের যে এতো মনোমুগ্ধকর রূপ হতে পারে, তা কি কখনোও ভাবতে পেরেছি? শুভ্র অসমান ঢেউগুলি নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থির অচঞ্চল।

কিন্তু আমাদের এখানে তো দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। উঠতে হবে উঁচুতে, পৌঁছতে হবে আমাদের আস্তানায়। গাড়ি আর যাবে না। উঠতে হবে পায়ে হেঁটে।

স্লেজগাড়ির মতো কিছু কাঠের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে। সেগুলির চালক আমাদের দিকে এগিয়ে এলো আমাদের নিয়ে যাবে বলে। কিন্তু আমরা কেন যাবো? আমরা তো বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতেই এসেছি। তাদের গাড়িতে আমাদের মালগুলো শুধু তুলে দিলাম আর সঙ্গে আমরা হেঁটে উঠতে লাগলাম।

আমাদের সকলের পায়েই বরফের ওপর দিয়ে হাঁটার উপযুক্ত স্নীকার্স্‌। শুধুমাত্র কল্যাণের পায়েই বাটার চামড়ার শ্যূ। তাকে অনেকবার স্নীকার্সের কথা বলা হলেও সে জেদ করে এই শ্যূ-ই নিয়ে এসেছে। আমরা সবাই, আমি, আনু, সুনীত, ঋজু – চারজনই এই পিচ্ছিল বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে আছাড় খেলাম। কিন্তু কল্যাণ একবারও পড়ে গেলো না – আমাদের সবাইকে বললো যে, দেখছো তো বাটার জুতোর কতো সুবিধে! হ্যাঁ। সুবিধেই বটে। সেটা বোঝা গেলো দিল্লীতে ফিরে। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলদুটো লাল হয়ে ফুলে ঢোল। ফ্রস্ট বাইট (Frost Bite)। আনু দেখে সঙ্গে সঙ্গে গরম জলে নুন দিয়ে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে হলো। এভাবে কিছুদিন করাতে পায়ের আঙ্গুলদুটো বেঁচে গেলো। চামড়ার জুতো পরার ‘সুবিধে’ কল্যাণ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলো।

অবশেষে পৌঁছে গেলাম আমাদের আস্তানা ফুড হাট (Food Hut)-এ। তারপর সামনের ত্রিভুজাকৃতি বরফের পাঁচিল ডিঙিয়ে উঠে এলাম দরজায়। দুজন কাশ্মীরী যুবক আমাদের দুটো অ্যাটাচড বাথ দেওয়া ঘর খুলে দিয়ে আমাদের মালপত্র তুলে দিলো। দেখলাম বাথরুমে এক বালতি করে জল রয়েছে – কিন্তু কলে কোনোও জল নেই। জিজ্ঞেস করাতে বললো যে, পাইপে জল জমে বরফ হয়ে গেছে। তাই জল আসবে না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে দেখলাম, ঘরের পিছনদিকে একটা কল খুলে, ওরা তার তলায় একটা বালতি বসিয়ে রেখেছে। কল বন্ধ করলেই এই পাইপের জলও জমে বরফ হয়ে যাবে – তাই এই ব্যবস্থা। গরম জল চাইতে ওরা দিয়ে গেলো। আমরা হাতমুখ ধুয়ে একটা ঘরে সবাই এসে জড়ো হলাম আর চা বিস্কুট খেতে খেতে গল্প করতে লাগলাম। রাতে তাড়াতাড়ি রুটি তরকারী খেয়ে আমরা সবাই যে যার ঘরে শুয়ে পড়লাম। লেপ কম্বলের সঙ্গে ওরা একটা করে ইলেকট্রিক কম্বলও দিয়ে গেলো। পরণের গরমজামা কেউই খুলিনি। সবকিছু পরেই কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। মাঝরাতে ইলেকট্রিক চলে গেলো। আমাদেরও ঘুম ভেঙে গেলো। টর্চ জ্বেলে সময় দেখে, মাইনাস ৬ ডিগ্রী তাপমাত্রায় কাঁপতে কাঁপতে আবার কম্বল মুড়ি দিয়ে সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন না জানি ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন এক নতুন দিন, নতুন সকাল। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে জলখাবার খেয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম বাইরে। “আহা, কি দেখিলাম, জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিবো না।” সামনেই বিস্তৃত স্বর্গরাজ্য আমাদের অভ্যর্থনার অপেক্ষায় – কিন্তু দেবতা বিহীন। আমরা ক’জনই এখন এই স্বর্গরাজ্যের একমাত্র মালিক। আমরা এখানে এখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। আহা, কি আনন্দ! আমরা লাফাচ্ছি, ঝাঁপাচ্ছি, উঠছি, পড়ছি, হাঁটছি, দৌড়চ্ছি, হাসছি, চিৎকার করছি – কেউ বাধা দিচ্ছে না। তুলে নিয়ে বরফ ছুঁড়ছি, স্নোম্যান তৈরী করে অপছন্দে ভেঙে ফেলে আবার নতুন করে তৈরী করছি।

কিছুটা বেলায় আমরা চললাম স্কী করতে। স্কী করার বিশেষ জুতো, লাঠি (Stick) সব দেওয়া হলো আমাদের। সেই সব পরে ও নিয়ে আমরা পাশে লোক নিয়ে চেষ্টা করলাম, কিন্তু হায় – ঠিকঠাক পারলাম না।

এবার আমরা চললাম স্বর্গ ভ্রমণে – আমাদের বাহন গুলমার্গ গন্ডোলা। গন্ডোলা শুনলেই ভেনিসের জলে ভাসা গন্ডোলার কথাই মনে হয়। কিন্তু গুলমার্গ গন্ডোলা আকাশে ভাসা কেবলকার। আনুরা গেলো গন্ডোলার টিকিট কাটতে আর আমরা ছবি তুলতে লাগলাম। কল্যাণ পছন্দসই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমায় ছবি তুলতে বললো। আমি ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করতে করতে পিছোচ্ছি এমন সময়ে কল্যাণের চিৎকার, “গোপা, শিগগির আনুদের ডাকো, আমায় ধরো। আমি বরফে ডুবে যাচ্ছি। পা তুলতে পারছি না।”

বরফের এই এক মুশকিল। কতোটা গভীর তা যেমন বোঝা যায় না। তেমনই তার তলায় কোনোও গর্ত আছে কি না, তাও বোঝা যায় না। ফলে অজান্তে সেখানে পা পড়লেই বিপদ অবশ্যম্ভাবী। ভালো হয় হাতে একটা লাঠি থাকলে, সেটা দিয়ে বরফের গভীরতা বুঝে নিয়ে সেখানে পা ফেলা। যা হোক্‌, আমি নিজেই যথাসম্ভব দূরে দাঁড়িয়ে আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম। সেই হাত ধরে কল্যাণ কোনোও রকমে উঠে এলো।

আকাশপথে গুলমার্গ গন্ডোলা ৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এবং শেষদিকে এটি প্রায় ৪০০০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় উঠে যায়। শূণ্যে ভাসমান যেকোনোও গন্ডোলার ক্ষেত্রে এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম (দ্বিতীয় উচ্চতমও বটে) পথ অতিক্রম করে।

নিচের সেই স্বর্গরাজ্যের অতুলনীয় সৌন্দর্যের বর্ণনা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। যতো উঠছি, পাহাড়চূড়াগুলি ততোই কাছে চলে আসছে – তারই মাঝে মাঝে বরফে ঢাকা ফারগাছগুলি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যতোই এগোচ্ছি ততোই মনে একটা প্রশ্ন জাগছে – পৃথিবীর উচ্চতম হিমালয় পর্বতের সৌন্দর্য না দেখে আমরা কেন যে ইউরোপের আল্পস পর্বত দেখতে যাই!

আমাদের স্বর্গভ্রমণ শেষ হলো। পাশের একটা রেস্তোরাঁয় অন্তিম দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা বিদায় জানালাম গুলমার্গকে।

এবার বেশ খানিকটা নিচে নামতে হবে। ফিরে চললাম যে পথে এসেছিলাম, সেই পথ দিয়েই। কিন্তু এবার আর কেউ আছাড় খেলাম না। কারণ, বরফ আর জমাট তুষারের তফাৎটা এখন আমাদের জানা হয়ে গেছে। ঠাণ্ডায় জল জমে তৈরী হয় বরফ যা কোনোওমতেই চাপ দিয়েও আকারের পরিবর্তন করা যায় না – পিচ্ছিল হয়। তুষার তৈরী হয় বাতাসের জলীয় বাষ্প ঠাণ্ডায় জমে। এরা ছোট ছোট স্ফটিকাকার হয় এবং চাপে একসঙ্গে আটকে থাকে। কিন্তু চাপ দিয়ে এদের আকৃতির পরিবর্তন করা যায়। এইজন্যে পায়ের চাপে তুষারের গর্তের মধ্যে আমাদের পা ডুবে যায় ঠিকই, কিন্তু পিচ্ছিল নয় বলে আমরা পড়ে যাই না। আমরা এবার কাঠের গাড়ির সঙ্গে ওই পিচ্ছিল বরফের পথ না ধরে, পাশের তুষারে পা ডুবিয়ে নিচে নেমে এলাম।

ফেরার পথে এক জায়গায় থেমে কাশ্মীরের বিশেষ চা ‘কাওয়া’ পান করা হলো। এই চা অবশ্য চা পাতা দিয়ে নয়, তৈরী হয় দারচিনি, এলাচ আর কেশর দিয়ে। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য টুকরো করা ড্রাই ফ্রুটসও দেওয়া হয়। কাওয়া শীতে শরীর গরম করে, তাই কাশ্মীরীরা এই চা পানেই অভ্যস্ত।

পথে সুনীতের একজন পরিচিত দু-পেটি আপেল আমাদের গাড়িতে তুলে দিলো। দিল্লীতে এসে সেই আপেল দিয়ে ক’দিন আমাদের দারুন ভোজ চললো – ঘুরতে ফিরতে আপেল খাওয়া। সেই আপেল যেমন সুমিষ্ট, তেমনই সুস্বাদু – এমন কোনোওদিনও আমরা খাইনি। কারণ এই আপেল বিদেশে রপ্তানী হয়।

সন্ধ্যার অন্ধকারে বানিহাল টানেল পেরিয়েই কনকনে ঠাণ্ডায় আমরা পড়লাম জ্যামে। সামনেই একটা পর্যটক বাস পাশের খাদের ওপর অর্ধেক ঝুলে রয়েছে। বাসের যাত্রীরা সব নিচে নেমে এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুদিকের আসা যাওয়ার গাড়িতে রাস্তা বন্ধ। ওই ঠাণ্ডায় ক্লান্ত আমরা গাড়িতে বসে আছি, জানি না কখন ছাড়া পাবো। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে হঠাৎ দেখি আর্মির এক গাড়ি সেখানে এলো আর অদ্ভুত দক্ষতায় রাস্তার সমস্ত জ্যাম ছাড়িয়ে দিলো।

পরদিন আমরা পাটনিটপ ভ্রমণে বেরোলাম। পাটনিটপ তো এখনোও আমাদের দেখাই হয়নি। অফুরন্ত নীল আকাশের পটভূমিতে দূরের শুভ্র পাহাড়, দীর্ঘ দেওদারের অরণ্যে সাজানো শান্ত, স্নিগ্ধ, সবুজ উপত্যকার পাটনিটপ অবশ্যই সুন্দর। কিন্তু চাটনি খাওয়ার পর কি পছন্দের সুক্তোও ভালো লাগতে পারে?

পরদিন ২৬শে ডিসেম্বর ফিরে চলেছি জম্মু। সেখান থেকে যাবো দিল্লী। পথে কুঁদ-এ গাড়ি দাঁড় করিয়ে এদের এখানের বিখ্যাত কিছু মিষ্টি কেনা হলো। মিষ্টি একেবারেই অন্য রকম কিন্তু খুবই সুস্বাদু।

দিল্লীর ট্রেনে যখন উঠলাম, তখন পকেটে কিছু খুচরো টাকাপয়সা। কিন্তু স্মৃতির এক গোপন কক্ষে যে সম্পদ বহন করে নিয়ে চলেছি তা কি টাকায় মূল্যায়ণ করা সম্ভব? ভাগ্যিস গিয়েছিলাম গুলমার্গ। তাই তো বুঝতে পারলাম কাশ্মীর কেন ভূস্বর্গ। সেদিনের সেই সন্ধ্যায় পূর্ণচাঁদের মায়ায় মোহময় পৃথিবীর যে অপার্থিব রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলাম তা রয়ে গেলো আমার স্মৃতির মণিকোঠার এক গোপন কোণে যা বর্ণনা করা আমার অসাধ্য।

ছোটবেলা থেকেই শুনেছিলাম জীবনে সুযোগ একবারই মাত্র আসে। কি হতো যদি আমরা ঝুঁকি নিয়ে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করতাম? হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে দিতাম? তবে তো যে সম্পদ আজ সঙ্গে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি, তা কি আর কোনোওদিনও অর্জন করা সম্ভব হতো?

(কাশ্মীর পর্ব সমাপ্ত)

 

পরবর্তী আকর্ষণ কেদার-বদ্রী

লেখিকা পরিচিতি
গোপা মিত্র

 

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. DOWN MEMORY LANE.
    Being a group-member of this unforgettable trip I convey my gratitude to my wife Gopa for remembering n enjoying a Flash-back show after 11 years. Style of description is very live. Looking forward for next post.
    Best Wishes.

  2. খুব ভাল লাগল। পরের লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

  3. সকলকেই ধন্যবাদ । সবার উৎসাহ আমায় আরো ভালো লিখতে অনুপ্রাণিত করবে ।

  4. অনেক পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। খুব ভালো লাগলো।

  5. ভীষণ ভালো লেখা। খুব সুন্দর বর্ণনা। আমি গুলমার্গ চলে গিয়েছিলাম যেন বরফের স্বর্গরাজ্যে। অপূর্ব !

  6. আমি চেষ্টা করেছি , মানসভ্রমণ করাতে । সফল যদি হই আমি সবচেয়ে খুশী হবো ।

  7. গোপা,লেখা খুব ই ভালো হয়েছে। এই ভাবে এগিয়ে চলো।আমার ভারত ভ্রমণ হচ্ছে ।very vivid descriptions

  8. বেশ ভালো হয়েছে। ছাপার সময় দু টো অনিচ্ছকৃত ত্রুটি রয়ে গেছে। উল্লেখ‍্যনীয় নয়।

    1. ধন্যবাদ। ছাপার ভুল হতেই পারে। যেমন –অনিচ্ছকৃত ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!