স্থিরা হালদার
মেয়েটা টিংটিঙে রোগা, মুখখানা থ্যাবড়া-থোবড়া, কিন্তু গায়ের রংটা ছিলো বেজায় ফর্সা – তাই টুকটুকি।
ওদের বাড়িটা ছিলো, ষাটের দশকের উত্তর কলকাতার একটা জমজমাট পাড়ায় – ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, তাই একটু বেশী আদুরে।
সকালবেলায় রোজই স্কুলে যাওয়ার সময়ে কান্না – মা বুঝিয়ে সুঝিয়ে স্কুলে পাঠাতেন। গরমের ছুটির দিনগুলোতে তাই খুব মজা – লম্বা ছুটি।
সকালে একটু Home Work করেই ছুটতো বন্ধুর বাড়ি খেলতে। খেলার মধ্যে হয় চোর-চোর, নয় লুকোচুরি আর নয় তো রুমাল-চোর – লিটুদের বাড়ির উঠোনে একবার লুকোচুরি খেলার সময়ে লুকোতে গিয়ে টুকটুকি বসে পড়লো ওদের রান্নাঘরে নামিয়ে রাখা বড় এক গামলা ডালের মধ্যে – আর যায় কোথায়? প্রবল কান্না আর বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি।
টুকটুকি নিজের মনে ঘন্টার পর ঘন্টা খেলতে পারতো। কখনোও এক্কা দোক্কা, কখনোও বা বাবার আলনার তলায় তার ন্যাকড়ার পুতুলের সংসার নিয়ে বসতো, তবে তার সবচেয়ে প্রিয় খেলাটা ছিলো দিদিমনি সেজে এক ক্লাস ভর্তি কাল্পনিক ছাত্রীদের পড়ানো ও শাসন করা – ঠিক যেমন স্কুলের Class Teacher করেন।
ওর মা কাজকর্ম সেরে দুপুরে বিশ্রাম নেওয়ার সময়ে ওকে টেনে নিয়ে যেতেন ঘুম পাড়ানোর বৃথা চেষ্টায় – সে মায়ের পাশে শুয়ে কিছুক্ষণ ছটফট করার পরে যেই শুনতে পেতো Jolly Chap আইসক্রীমওয়ালার হাঁক, ব্যাস্ – আর কে পায় তাকে – কৃষ্ণের বাঁশির সুরে রাধিকার ব্যাকুলতার চেয়ে কিছু কম ব্যাকুল হতো না সে ওই ডাকে – ব্যাঙের পুঁজি ২৫ পয়সার কাঠি আইসক্রীমেই সন্তুষ্ট ছিলো সে – কাপ আইসক্রীমের দাম যে বারো আনা – ওরে বাবা!
ওদের পাড়ার সব বাড়িতেই টুকটুকির গতিবিধি ছিলো অবাধ। বিকেলের দিকে রোজই এক একজন বন্ধুর বাড়ি জমে উঠতো কুমীরডাঙ্গা বা এলাটিং-বেলাটিং খেলা – সন্ধ্যেবেলা বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতের বেলের পানা বা আমপোড়ার সরবৎ।
সন্ধ্যেবেলা পড়ার শেষে মায়ের কাছে গল্প শোনা – আবার কখনোও তার মা হারমোনিয়ম নিয়ে বসতেন তাকে নিয়ে গান শেখাতে। মা ছিলেন সুগায়িকা – সে সময়টুকু ছিলো ওর খুব প্রিয়।
রাত দশটা নাগাদ বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁকে যেতো কুলফি-মালাই – টুকটুকির মনটা একটু চঞ্চল হয়ে উঠতো বৈ কি। মা যে এক-আধদিন ওটা কিনে দিতেন – সেদিন কি খুশী – জর্দার কৌটোর মতো দেখতে কুলফির কৌটোর ধারগুলো ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে কুলফিওয়ালা যখন শালপাতায় ঢেলে ওর সামনে ধরতো তখন টুকটুকির থ্যাবড়া মুখখানা যেন হাজার চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করতো।
তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দ হতো মা যেদিন কলের আইসক্রীম বানাতেন। বার বার ঘুরে এসে জানতে চাইতো আর কতো দেরী – মা বলতেন এখনোও দেরী আছে – শুনেই চোখের পাতা ভারী হয়ে আসতো। ছোট্ট মেয়েটা অপেক্ষা করতে করতে একসময়ে ঘুমের কোলে ঢলে পড়তো। পরদিন সকালে মা বলতেন তিনি ঘুম থেকে তুলে ওকে খাইয়েছিলেন – কিন্তু হায়! মায়ের হাতের তৈরী সেই অপার্থিব হিমসুধার স্বাদ তার স্মৃতিতে অধরাই থেকে যেতো।
ছোট্ট টুকটুকির জীবনে নিজস্ব সম্পদ বলতে ছিলো চার-পাঁচটি ন্যাকড়ার পুতুল আর মনে ছিলো রাশি রাশি আনন্দ।
শিশুদের একটা নিজস্ব জগৎ থাকা উচিত, যেটা আদতে তার সারা জীবনের সম্পদ। নিঃসঙ্গ, হেরে যাওয়া মুহূর্তগুলোয় ছোটবেলার সেই নিজস্ব জগৎ আবার ঘুরে দাঁড়াবার অনুপ্রেরণা যোগায়। আজকের শৈশব বড় কৃত্রিম। মোবাইল। ইন্টারনেট শিশুদের নিজস্ব চেতনার বিকাশ ঘটতে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করে। আরোও বড় কথা ছোট থেকেই তারা এক একজন প্রতিযোগী। ছোটবেলা যে আসলে কতোটা নির্মল আনন্দময় হতে পারে, এখানে সেটাই অত্যন্ত সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলা আছে। এটাই হচ্ছে প্রকৃত ছোটবেলা। আরোও এমন সুন্দর লেখার প্রত্যাশায় থাকলাম।