Home বিবিধ, প্রবন্ধ কালক্রমে শিক্ষক দিবস
বিবিধপ্রবন্ধ

কালক্রমে শিক্ষক দিবস

সুদেষ্ণা মজুমদার

~ TEACHER’S DAY-তে সত্যের ছায়া অবলম্বনে পাঁচটা টক, ঝাল, মিষ্টি ও নোনতা ছোটগল্প ~

১.   বেত্রাঘাত (১৯৪৮)

আধ ময়লা ধুতি আর শার্ট, টিকোলো নাসিকার ওপর একটি প্যাসনে চশমা পরিহিত পটলবাবুকে দেখলেই, স্কুলের সব ছাত্রর খাঁকি প্যান্ট যেন হলুদ হয়ে যেত, কারণ ওঁর সঙ্গে থাকতো একটি লিকলিকে বেত ও একটি গণিতের মোটা বই। একদিন কোনো এক দুষ্টু ছেলে, অঙ্ক হোমওয়ার্ক জমা দিতে না পেরে, ক্লাসে একটি ছুঁচো এনে ছেড়ে দিল,  তারপর সেই ক্ষুদ্র প্রাণীটি সারা ঘর ময়, এদিক ওদিক ছুটতে  লাগলো, আর ছেলে ছোকরার দলও, সমস্বরে চিৎকার করতে লাগলো, “স্যার ছুঁচো, স্যার ছুঁচো!”, “ছুঁচো, স্যার, ছুঁচো, স্যার!” ..সেই থেকে পটলবাবুর নামকরণ হয়ে গেলো ‘ছুঁচো স্যার’।

সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র বিনয়, তার পাটিগণিতের ক্লাস টেস্টের দিনগুলিতে সকাল সকাল উঠে, বাকি আর সকলের আগেই ইস্কুলে পৌঁছনোর জন্য প্রস্তুত হতো, উদেশ্য তার একটাই, ইস্কুলে পৌঁছে যেমন করেই হোক, তাকে ভালো ছেলে অমলের পাশে বসতে হবে, তা না হলে, পিঠে পড়বে পটল স্যারের বেত। সেই চিন্তা থেকেই, একবার পরীক্ষার আগে, সে তার ডবল সেফটির জন্য, ডবল প্যান্টের রক্ষা কবচ টিও ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিলো।তবু সেই যাত্রায় তার শেষ রক্ষা হলো না। অমলের পাশে বসতে পারলেও, পটল স্যার প্রশ্নাদি বোর্ডে লেখবার পরই তাকে অন্যত্র সরিয়ে দিলেন। বলাই বাহুল্য,  সেদিন তার উপরের প্যান্টটি ছিঁড়ে গেছিলো। এই বেদম প্রহারের বহমান ধারা, বাড়িতে ফিরে জ্যাঠাইমার হাতের গুমাগুম কিল, চড় ইত্যাদির মধ্যে দিয়েও বজায় থাকলো।  উপরন্তু, সপ্তাহান্তে পটলবাবু আবার তাদের বাড়িতে এসে, তার জ্যাঠাবাবুকে তার সম্পর্কে অনেক অভিযোগ করে গেলেন। তারই  ফলসরূপ, বাড়িতে বিনয়ের প্রতি নির্মম অত্যাচার চলতে থাকলো। দিন রাত প্রচন্ড রাগ মনের গহ্বরে পোষণ করে রাখলো বিনয়। পটলবাবুকে শিক্ষা না দিতে পেরে, তার মন হয়ে উঠলো অশান্ত, তবু ইস্কুলের বাইরের বখাটে বন্ধুদের প্ররোচনায়, ছুঁচো স্যারকে কোনো শিক্ষেই তার আর দেওয়া হয়ে উঠলো না। এদিকে, বাড়িতে যখন তার টেকা দায় হয়ে উঠলো, সে ঠিক করলো, গণিতে জ্যাঠামহাশয়ের মতনই স্বর্ণপদক না জিতে সে ছাড়বে না। নাহ, স্বর্ণপদক তার ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত জোটে নি, তবু শেষবেলায় পটল স্যরের মান রাখতে পেরেছিলো বিনয়। ইস্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর, রাস্তায় মাস্টারমশাইকে দেখলেই,  সব কিছু ভুলে, তবু প্রণাম করতো সে। শেষবার যখন পটলবাবুর সঙ্গে পথে দেখা হলো, সঙ্গে তখন তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এবং এক বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের রেজিস্ট্রারের চাকরির সাফল্য তার চোখে মুখে। অন্যদিকে, তাকে দেখে, বয়েসের ভারে অনেকটা ঝুঁকে পড়া, ছুঁচো স্যারের  দু’চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল গর্বে। সেদিন বিনয় বোঝে, প্রতিশোধের চেয়ে এই তো ঢের ভালো।

২.  তিরস্কার  (১৯৬৫)

দশম শ্রেণীর ছাত্রী অনিন্দিতাকেই আদর্শ ছাত্রীর পুরস্কারটা দেওয়া হবে ঠিক করা হল। একথা শোভাদি যখন ক্লাসে সকলের সামনে এসে ঘোষণা করলেন, হৈচৈ বেঁধে গেলো সারা ক্লাসে। এতে কোনো বিরোধ নেই, সকলেই শান্ত স্বভাবের অনিন্দিতাকে খুব ভালোবাসে। স্কুলে আজই তাদের শেষ দিন, তারপর মাস খানেক বাদে ফাইনাল পরীক্ষা, স্কুলের পরীক্ষার ফল ও বেশ ভালো হয়েছে সকলের, তাই ক্লাসে আজ একটা খুশির আমেজ। শোভাদি অবশ্য সকলকে থামিয়ে বললেন, “ও কিন্তু আমার আত্মীয় হয় ভেবে তোমরা আবার ধরে বসো না যেন, কোনো পক্ষপাত করা হয়েছে। আমি কিন্তু ওর বিপক্ষেই ভোটটা দিয়েছিলাম। কারণ, ও,  প্রথম ১০ এর মধ্যে থাকলেও, কোনোদিনও প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় হয়নি। ওর ভালো ব্যবহারের জন্যই মূলত বড়দি ওকে পুরস্কারটা দিয়েছেন। তাছাড়া ও তো ছবি আঁকা ও আবৃত্তিতেও ভালো, গানটাও করে মোটামুটি, তাই না? নাচটা অবশ্য ও একদমই পারেনা, আর SMARTNESS টাও যেন কম। তবে তোমরা জানতো, ওর মা খুবই অসুস্থ থাকেন প্রায়ই? ওকেই রান্না-বান্না সেরে স্কুলে আসতে হয়! আমি অবশ্য জানিনা ওর বাবা এইকুটু মেয়েকে দিয়ে কি করেই বা রান্না করান! এই যে অনিন্দিতা! তোমার মায়ের জানি কি অসুখ?” ততক্ষনে, বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে অনিন্দিতা, পুরস্কারের খবরে খুশি হবে, না, দুঃখ পাবে বুঝতে পারছেনা সে- একটু আমতা আমতা করেই সে বললো, “আসলে আমার বাবাই রান্না করে অফিস যান। তাও, মা যখন অসুস্থ হন তখন, বাকি সময় মা-ই সামলান, তাই আমি মাকে একটু আধটু সাহায্য করি”। সেসব কথায় কর্ণপাত না করেই শোভাদি বলে চলেন, “হয়তো তোমার মায়ের রোগটা মনেরই। আমি জানি, মৃগী রোগটা মনেরই অসুখ। অনেক সময়ে পারিবারিক অশান্তি থাকলেও এইরকমটা  হয়। তা, সে রকম কিছু!!……”  উত্তরের অপেক্ষা না করেই, উনি অনিন্দিতাদের আরও অনেক পারিবারিক প্রসঙ্গ টেনে আনতে থাকলেন। এতক্ষনে বাকি ছাত্রীদের মধ্যে একটা গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে, তারই মধ্যে ক্লাস শেষের ঘন্টাও পড়ে গেছে! বাকি কথা শেষ না করেই, শোভাদি তড়িঘড়ি ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। সারাদিনটা লজ্জায়, ঘৃনায়, মাটিতে মিশে পার করে দিলো অনিন্দিতা। ক্লাসে সকলের দৃষ্টি যেন ওরই দিকে এসে আটকে  রইলো বাকিটা সময়। তবু সে জানে আজকের পর আর তাকে শোভাদির কোনো কথা শুনতে হবে না।  বাড়ি ফিরে অনিন্দিতা দেখলো, মা তার জন্য কাস্টার্ড বানাচ্ছেন। কিচ্ছু খাবে না জানিয়ে অনিন্দিতা নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। তার তখন গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করছে…ইউনিফর্মটা না বদলেই বিছানায় একরাশ কান্নায় ভেঙে পড়লো অনিন্দিতা। বাইরে থেকে তার মা অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো সারা পেলেন না। সে শুধু আস্তে করে মাকে জানালো, “আমাকে একটু সময় একা থাকতে দাও”। তারপর সন্ধ্যেবেলায় যখন তার বাবা অফিস থেকে ফিরে তাকে ডাকতে এলেন, কোনো উত্তর পেলেন না।  অনেক্ষন কোনো উত্তর না পেয়ে, অবশেষে তাঁরা যখন দরজা ভেঙে ঢুকলেন, ততক্ষণে সব শেষ। শুধু বিছানার পাশে পড়ে ছিল একটা চিঠি, তাতে লেখা: 

মা,
এই পৃথিবীতে তুমিই আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। তোমার গায়ে কাদার ছিটে লেগেছে আজ, যে কাদা আমি ইচ্ছা থাকলেও ধুয়ে ফেলতে পারলাম না। এই অক্ষমতা নিয়ে আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। এই নৃশংস পৃথিবীতে আমি খুবই বেমানান, তাই তোমাকে ছেড়ে চললাম। জানি, তুমিও এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুকেই বেছে নেবে একদিন। যারা জীবনে আলো দেখাবেন তারাই যদি সব আলো নিভিয়ে দেন, তাহলে বেঁচে থাকা আরোও বেশি যন্ত্রণার।
ইতি,
অনিন্দিতা

৩. পক্ষপাত (১৯৮২)

আমিই আমার তৃতীয় গল্পের PROTAGONIST. আমার স্কুল জীবনের শুরুটা হয়েছিল পক্ষপাত দিয়েই আর শেষটাও তাই। প্রথম পক্ষপাতটি আমি একদমই উপভোগ করিনি বরং বিব্রত বোধ করেছি, আর শেষটা আজও আমার মনে, একটা শ্রদ্ধা মাখানো মধুর স্মৃতি হয়ে আছে।

আমার মাসি ছিলেন একটি স্কুলের শিক্ষিকা। তার সুবাদেই যখন আমি প্রথম স্কুলে ভর্তি হতে যাই, পরীক্ষায় একটি উল্টো “ব” আর একটি উল্টো “D” লিখে আসি। যিনি পরীক্ষা নিচ্ছিলেন তিনি আমার মাসির বিশেষ বন্ধু ছিলেন, তাই বারবার তিনি আমাকে বানানটি শুধরে নিতে ইঙ্গিত করছিলেন। প্রথমটায়ে, আমি একেবারেই বুঝিনি উনি কি বলতে চাইছেন, তারপর যখন বুঝলাম, আমার মনে হয়েছিল, এটা পক্ষপাত, অন্য পরীক্ষার্থীরা সবাই দেখছে, এই পরীক্ষায় যদি আমি অসৎ উপায়ে পাশ করি তাহলে কোনোদিন আমার বন্ধুরা আমার প্রতি সমদর্শী মনোভাব রাখবে না। বয়সটা তখন ছয়। এতোটা পরিষ্কার করে না ভাবতে পারলেও নিজের অবচেতনেই SHORT CUT রাস্তাটা বাদ দিয়েছিলাম সেদিন। প্রত্যেক বাচ্ছার মন এমনই শুদ্ধ থাকে, সমাজ তাকে কলুষিত করে তোলে একটু একটু করে।

ক্লাস ফোরের অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময়ে খুব অসুখ করেছিল, তাই পরীক্ষা দিতে পারিনি। আমার হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার ভিত্তিতেই, ক্লাস ফাইভ এ উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। কিছুদিন দেরিতে ক্লাসে গিয়ে দেখলাম অংকের শিক্ষয়িত্রীই আমাদের ক্লাস টিচার। প্রথমেই সব উলোট পালট করে দিয়ে ETHNIC CLEANSING-এর মতন সব কৃতি ছাত্রীদের আমাদের A সেকশন এ জোগাড় করেছেন তিনি, তারপর B ও C সাজানো হয়েছে। দেখলাম নতুন একটা D সেকশন বানানো হয়েছে, যেখানে আগে থেকে কিছু ফেল করা, বুকে রবি শাস্ত্রীর ছবি আর পকেটে ছুরি নিয়ে ঘোরাফেরা করা, বয়েসে বড় ছাত্রীদের নিয়ে একটা ক্লাস সাজানো হয়েছে আর তাতে জ্বলজ্বল করছি আমি আর আমার ক্লাসের আর এক বন্ধু। আমরা দুজনেই পড়াশুনায় ভালো ছিলাম তবু কেন যে আমরা এই নরকে ঠাঁই পেলাম বুঝতেই পারছিলাম না। এদিকে অংকের টিচার সবকটা সেকশনেই পড়াতেন, ক্লাসে এসেই একটা নতুন ধরণের কোনো অঙ্ক বোর্ডে লিখে জিজ্ঞেস করতেন কেউ ওটা SOLVE করতে পারবে কি না। ক্লাসে সবসময়ে একটি দুটি STUDENT থাকতো যারা সিলেবাসের থেকে এগিয়েই থাকতো সর্বদা, সেই রকম প্রাইভেট টিউটর-ওয়ালা দু-তিন জন যেই হাত তুলতো, উনি তাদেরই অঙ্কটা কষতে দিয়ে, বাকিদের দু চার কথা শোনাতে শুরু করতেন। শেষে যদি কেউ সাহস করে বলতাম, অঙ্কটা বুঝিনি, ততক্ষনে পিরিয়ডটা শেষ হয়ে যেত, আর উনি একজন কৃতি ছাত্রীকে সেই গুরুভার দিয়ে চলে যেতেন। আমাদের অভাগার গতি D সেকশনেও, সদ্য স্কুলে ভর্তি হওয়া, এক নামজাদা স্কুলের থেকে আগত, অংকে ভালো এক আজব জীব বাস করতো। তারই ওপর দায়িত্ব বর্তাতো আমাদের মানুষ করে তোলার। এ আমার সহ্য হলো না বেশী দিন, কিছুদিন বাদেই, আমি বাধ্য হয়ে, আমার বাবাকে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে বললাম। এর আগে আমার মা-বাবাকে আমার স্কুলে কখনোই কোনো ব্যাপারে যেতে হয়নি, তাই দেখলাম বাবা একটু গররাজি। এদিকে প্রচন্ড ব্যক্তিত্বময়ী ছিলেন আমাদের প্রিন্সিপাল, দুধে আলতার মতন রং, গোলগাল মোটা সোটা, গলার স্বর তেমনি গুরু গম্ভীর, ওঁর দাদা ছিলেন একজন খুব বিখ্যাত উকিল, যিনি পরে নামকরা জাজ ও হয়েছিলেন, আমার বাবা একসময়ে তাঁরই জুনিয়র হিসেবে প্রাকটিস করতেন। তাই কিছুটা সেই জোরেই পৌঁছে গেলেন আর আমাকে বললেন, আমি কিন্তু প্রথমেই  ওঁর দাদার সাথে পরিচয়ের ব্যাপারটা বলবো না। তাতে যদি কাজ হয় হবে,  তুমি কোনো আশা রেখো না। তবে উনি যদি কোনো কারণে ক্ষুব্ধ হন বা রুক্ষ ব্যবহার করেন, তাহলেই আমি সেই পরিচয় প্রকাশ করবো।  বাবা ওঁকে ঘরে ঢুকেই বলেছিলেন, “আমার মেয়ে মনে করছে যে, সে বিনা দোষে শাস্তি পাচ্ছে”। সব শুনে উনি রেগে না গিয়ে, বরং খুব CONCERNED হয়ে, আমাকে ডেকে পাঠিয়ে সব শুনেছিলেন। তখন বাবা সম্পূর্ণ পরিচয়টাও প্রকাশ করেন।  সেদিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন আর মাঝে মাঝেই আমি ঠিক পড়াশুনো করছি কি না, জানার জন্য ডেকে পাঠাতেন। পড়াশুনা আমি ঠিকই করতাম একমাত্র ভূগোলটা ছাড়া, ভূগোল মুখস্থ করা আমার দ্বারা হতোনা একদম। আমি বরং পরীক্ষার খাতায় ছবি এঁকে, MAP POINTING করেই কাটাতাম। আমার শিক্ষিকা কিন্তু তবু আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তারপর যখন ২০ নম্বরের VIVA নেওয়া শুরু হলো, উনি বললেন, “এবার কি করবি? কোথায় কি খনিজ পাওয়া যায় বলতে পারবি?” আমার তো মুখ কাঁচুমাঁচু! উনি বললেন, “পাশ করে যাবি, নো পরোয়া, শুধু রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা শোনা দিকি!” আমার এখনো মনে আছে, আমি কবিতা শোনাচ্ছি আর উনি চোখ বুজে শুনছেন আর কাঁদছেন…..

আজ এতবছর বাদে, TEACHER’S DAY তে ওঁর মতন শিক্ষিকাদের শত কোটি প্রণাম জানাই।

৪. খোলা বোতাম (১৯৯৮)

এই গল্পে, সম্রাট, রাহুল আর চাঁদ তিন জন একটা নামজাদা CO-ED ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র। তারা তিনজন একে অপরের পরম বন্ধু। এককথায় ওদের কাছে ওদের বন্ধুত্বের DEFINITION ছিলো: “THREE IS A COMPANY “.  সেই ছোট্টবেলা থেকেই চাঁদের গার্ল ফ্রেন্ড ছিল রোশনি। ওদের তাতে কারুরই কোনো অসুবিধে হতোনা কখনো, কারণ রোশনি ছিল খুবই TOMBOYISH, ও ওদের সঙ্গে ফুটবল খেলতো, বাইক চালাতো, ইংরিজি সিনেমা দেখতে যেত। ওদের দুজনের মধ্যে যে একটা ব্যাপার আছে, সেটা শিক্ষক শিক্ষিকারাও প্রায় সবাই বুঝতেন। হাই-স্কুলের কারোরই অজানা ছিল না ব্যাপারটা।

প্রত্যেক বছর ওদের স্কুলে একটা FETE ORGANISE করা হত, সেদিন সকালে, একটা FRIENDLY FOOTBALL MATCH খেলা হত, ম্যাচটা হতো TEACHERS আর STUDENTS দের মধ্যে। ম্যাচটা নামেই ছিল ফ্রেন্ডলি, সেদিন স্পোর্টস স্যর রিকি আর FINAL YEAR STUDENTS দের মারপিটের আর বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেত ১২ বছরের জমিয়ে রাখা EGO-র লড়াই।

ইয়ং রিকি স্যর ওদের স্পোর্টের কোচিং দেবার সাথে সাথে সারা স্কুলকে DISCIPLINISE করার দায়িত্বও পালন করতো। আর তাতেই বাঁধতো যত গন্ডগোল। রোশনির মধ্যে একটা চাপা ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেত ওর বাকি সব গুণকে ছাপিয়ে, খেলার মাঠে তার শার্টের কলারটা ও তুলে রাখতো সবসময় আর ওর শার্টের ওপরের বোতামটা রাখতো খোলা। রোশনির ঔদ্ধত্য একদম সহ্য করতে পারতোনা রিকি, সুযোগ পেলেই WARN করত। রোশনি সে ব্যাপারে ছিল একেবারে উদাসীন। FETE’এর দিন, মেয়েদের মধ্যে খেলছিল একমাত্র রোশনিই। খেলার মাঠেই রিকি স্যর পেয়ে গেলো সুবর্ণ সুযোগ। রোশনির পায়ের থেকে বল ছিনিয়ে নিতে, হঠাৎ করেই রিকি স্যর চলে গেল ওর খুব কাছে। চাঁদরা তখন MIDFIELD এ। রিকির দুটো নোংরা মন্তব্য শোনার পর, রোশনি যেই পাল্টা উত্তর দিয়েছে, প্রচন্ড রেগে গিয়ে, এক মাঠ ভর্তি লোকের মাঝে, টেনে ছিঁড়ে দিলো রিকি রোশনির শার্টটা। চাঁদ, সম্রাট আর রাহুল দেখতে দেখতে ঘিরে ধরলো ওদের স্পোর্টস টিচারকে। ইতিমধ্যে চাঁদ, রোশনিকে পরিয়ে দিয়েছে নিজের শার্টটা। একটা বিশ্রী হাতাহাতির মধ্যে দিয়ে, অন্য টিচারদের হস্তক্ষেপে, শেষ হলো সেদিনের ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’।

তারপর সন্ধ্যে বেলায়, যখন FETE জমে উঠেছে, ছোট বড় সব STUDENTS রা তাদের বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে এসেছে স্কুলে, কোথা থেকে হঠাৎ পিলপিল করে ঢুকলো এক দল ছেলে, হাতে তাদের হকি স্টিক। দেখতে দেখতে নিমেষের মধ্যে সারা স্কুল তারা ভাংচুর করে দিয়ে গেলো। ভয় পেয়ে দৌড়োদৌড়ি করতে গিয়ে অনেক বাচ্ছা ভিড়ের তলায় চাপা পড়ে গেলো।অনেক বাচ্ছাকে হাসপাতালেও নিয়ে যেতে হলো। লজ্জাজনক ভাবে শেষ হলো কিছু ছাত্র ছাত্রীর স্কুল জীবন সে বছর। সেদিনের সেই ঘটনাতে লেখা ছিল দিন বদলের গল্প। এতো গোলযোগের মধ্যে টিচারদের সাথে স্টুডেন্টদের  সম্পর্কে চিরকালের জন্য লাগলো লাল কালির দাগ।

৫. দোহার (২০২০)

টিচার্স-ডে’তে, ওদের ফ্ল্যাটের দুই ঘরে অনলাইন ক্লাস নিচ্ছিলো এক দম্পতি, মনোজবা (জোবি) আর যীশু।

সেদিন সকালে বাচ্ছারা LOG-IN করেছে যে যার ল্যাপটপে। প্রথম ক্লাসটাই ছিল ENGLISH. ওদের টিচার মনোজবা পড়াবে একটা নতুন COMPREHENSION PIECE. অন্যদিকে যীশু পড়াচ্ছে, ভারতের মানচিত্র। হঠাৎ জোবি দেখলো, ওর ক্লাসের আরিয়ান বলে একটি ছেলে, খুব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে, জানালা  দিয়ে পাশের বাড়ির এক বন্ধুর সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। জোবি ওকে মাইক্রোফোনটা MUTE করতে বললো, কিন্তু তাতে কোনোই  ফল হলো না। এদিকে যীশুর ক্লাসেও শালিনীকে নিয়ে কি যেন একটা গোলমাল চলছে, যেটা জোবি অন্য ঘরে বসেও শুনতে পাচ্ছে কিছুটা। অনেক্ষন বাদে BORED হয়ে যখন আরিয়ান ক্লাসে মন ফেরালো, বেশ কিছু SILLY QUESTION করে মনোজবার ক্লাসটা DISRUPT করা শুরু করে দিলো। কিছু করার নেই, জোবি বুঝলো আজকের পড়াশুনার এইখানেই ইতি টানতে হবে। ক্লাসের শেষে TEACHER’S DAY সেলেব্রেশনের আর কোনো ইচ্ছেই বাকি রইলো না ওর। যীশু তখনও অন্য ঘরে লড়ে যাচ্ছে, সে বারবার শালিনীকে উঠে বসতে বলছে আর ততবারই শালিনী ক্লাসের মধ্যে শুয়ে পড়ছে। ভারতের মানচিত্রে শালিনীর কোনো ইন্টারেস্টই নেই। ছোট বেলায় হয়তো ক্লাসে যীশুও ঘুমিয়েছে কিন্তু ক্লাসের মধ্যে এমন চাদর মুড়ি দিয়ে  ঘুমোবার সুযোগ এক PANDEMIC ই এনে দিতে পারে। সে অনেকবার করে শালিনীকে মুখে জল দিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করলো, তবু শালিনী একটুও নড়লো না বিছানা থেকে। ক্লাস LEAVE করতে বলায় সে বললো, “আমি বাবা-মা কে বলে দেব, আপনি আমাকে ক্লাস করতে দিচ্ছেন না”। আজকাল বাবা মায়েরা সবই দেখেন, বোঝেন, টিচারদের গতিবিধিও লক্ষ্য রাখেন, কিন্তু এতো সব করেও, তাদের সন্তানদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে যে তারা ভুলে যান, সেটা জোবি আর যীশুর মতন টিচাররা হাড়েহাড়ে বোঝে। সেই দিনগুলো, যখন মাস্টারমশায়রা চক ছুঁড়ে মারতেন, হয়তো একটু অমানবিকই ছিল; কিন্তু আজকাল স্টুডেন্টদের বিরুদ্ধে কোনো CONSTRUCTIVE FEEDBACK দিতে গেলোও টিচারদের দশবার অন্তত ভাবতে হয়। চাকাটা যে একেবারেই ঘুরে যাবে, কে ভেবেছিলো!

হঠাৎই একটি ছেলে বলে উঠলো, স্যর শালিনী যদি শুয়ে শুয়ে ক্লাস করে আমরাও করবো! যীশু ছেলেটিকে শান্ত করে, শালিনীকে বললো, “তুমি যদি চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোও, তাহলে আমারও যে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে শালিনী!” তাই শুনে শালিনী খিলখিল করে হেসে উঠে বললো, কি বোকা আপনি, এটা চাদর নয় এটাকে বলে দোহার। A.C তে এটাই BEST. জোবি এসে দাঁড়িয়েছে যীশুর দরজার সামনে। HUSBAND-এর অপমান সে শুনছে, আর রাগে গড়গড় করছে মনে মনে। যীশু আস্তে আস্তে ক্লাসের সবাইকে বললো: “A WRAPPER IS A WRAPPER, WHICH COVERS US FROM COLD AND ALL OUR WRONG-DOINGS”. ক্লাসের বাকি বাচ্ছারা সবাই একসাথে CLAPPING করে বলে উঠলো, “HAPPY TEACHER’S DAY SIR.” মনোজবার বুকটা গর্বে ভোরে উঠলো যীশুর জন্যে।

বাবা মায়েরা চোখে ঠুলি এঁটেছেন আর টিচারদের কেউ যেন করেছে কণ্ঠরোধ। শিক্ষা এখন একটা বাজারের সামগ্রী; আর ছাত্র-ছাত্রীরা হলো CUSTOMERS. যেখানে মুখের মিষ্টি হাসিটা শিক্ষক শিক্ষিকাদের জন্যে JUST একটা ড্রেস কোড, সেখানে কি এখনো – “HAPPY TEACHER’S DAY” হয়?!

লেখিকা পরিচিতি

 

 

সুদেষ্ণা মজুমদার

যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নাতক এবং জন-সংযোগে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা পাশ করে, সমাজসেবা মূলক প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন ও পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে প্রশিক্ষণ বিভাগে দীর্ঘ সময় কর্মদক্ষতা অর্জন করার পর, একজন শখের চিত্র-গ্রাহক এবং লেখিকা। বর্তমানে চেন্নাই নিবাসী।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!