Home বিবিধ, প্রবন্ধ দুর্গাপুজো থিমে বিবর্তন
বিবিধপ্রবন্ধ

দুর্গাপুজো থিমে বিবর্তন

অনন্ত কৃষ্ণ দে

“নমস্কার, ফাইভ বুলেটস আয়োজিত মুড়ি, চিঁড়ে আর চিটেগুড় দিয়ে নির্মিত দুর্গাপ্রতিমার বিসর্জন হবে না, আমাদের প্রতিমা ভক্ষন হবে।” এটা সাতের দশকের একটি নাটকের সংলাপ। প্রেক্ষাপট,  হোস্টেলের ঘর, তিন বন্ধু পরীক্ষার পড়াশুনা করছে। খোলা জানলা দিয়ে নিকটবর্তী পুজামন্ডপ থেকে মাইক্রফোনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। খুব সম্ভবত সাত-আটের দশক থেকেই কলকাতা এবং মফস্বলের বেশ কিছু দুর্গাপূজা মন্ডপে থিমপুজার প্রচলন শুরু হয় বলে মনে করা হয়। যদিও কলকাতার বেশ কিছু বারোয়ারী সরস্বতী পুজা কমিটি সেইসময় যেসব মন্ডপ নির্মাণ করতেন তা পথচলতি মানুষজনদের মন্ডপের সামনে বেশ খানিকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখতো। এখানে পুজামন্ডপ নির্মাণে শিল্পীর সৃজনশীলতা লোকমুখে সমাদৃত হত।  বেতের ধামা, কুলো, চাটাই, মাটির হাঁড়ি, কলসী এবং স্লেটপেন্সিলের ব্যবহার ছিল অনবদ্য। শিল্প ছিল এখানে জীবনভিত্তিক। আর শিল্পী স্বতন্ত্র রচনাশৈলীর দক্ষ রূপকার।

বারোয়ারি দুর্গাপুজোয় সাবেকি থেকে থিমে বিবর্তন হঠাৎ করে হয়নি। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে যেন আচমকাই বদলে গিয়েছে পুজো নিয়ে আলাপ আলোচনা। থিমপুজোর শুরু থেকেই একদল বলছেন পুজোর আসল আবেগ সাবেকি মন্ডপ, প্রতিমা ইত্যাদি। অন্যপক্ষের মত পুজো, উৎসবের সঙ্গে শিল্পের যে নিবিড় যোগাযোগ সেটাই ফুটে ওঠে থিমপুজোয়। সাবেকি বনাম থিমেরএই লড়াই আজও অব্যাহত।

সালটা ১৯৮৫। চাঁদা তুলে সাবেকি পুজোর তখন রমরমা। তার মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমী কাজের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল একটি শুদ্ধসূচি, শুদ্ধরূচি-র স্লোগান। এশিয়ান পেন্টস বারোয়ারী পুজাগুলিকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতে আমন্ত্রন জানালো। সেটাই হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন পুজোকমিটির মধ্যে। শুরু হল আলোর ঝলকানি, রকমারি মন্ডপ আর প্রতিমার বিভিন্ন নান্দনিক রূপ। শুরু হল শারদ সম্মান, আর্থিক পুরস্কার পাওয়ার যুগ। বাড়ল থিমপূজার চল। কর্পোরেট দুনিয়া যাতে সরাসরি অংশগ্রহন করল। যা আজও এগিয়ে চলেছে। প্রতিবছর পুজো সংগঠকরা তাদের দর্শকদের জন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন থিম আবিষ্কার করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে শিল্পীর অপূর্ব থিমের ব্যঞ্জনা, তাদের শিল্পকলা সমাজের নানারকম বার্তাবহন করে। পুজোকর্তা ও শিল্পীরা তাদের নতুন নতুন শিল্পের মাধ্যমে দর্শকদের মন জয় করার চেষ্টা করছে অনবরত। থিমপূজার মূর্তিগুলো সাধারনত কোন ঐতিহ্যের তোয়াক্কা করে না। এক্ষেত্রে শিল্পীর ভাবনা, শহরের বর্তমান ও অতীত ঘটনা, শিক্ষা, অরন্য বাঁচানোর আর্তি, বিশ্বউষ্ণতার পরিবর্তন ইতাদি ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মন্ডপ নির্মাণ করা হয়। যদিও অনেকের মতে থিমপুজোর মধ্যে ঐতিহ্যশালী পুজোর প্রতিফলন দেখা যায় না। কিন্তু থিমপুজোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পুজোকমিটিগুলির মধ্যে যে প্রতিযোগিতা তা কম কি? বাঙালির কাছে এই পার্বণ ধরা দেয় বানিজ্যের সঙ্গে শিল্পের মোড়কে। তা নিয়ে ভিন্ন মত থাকতেই পারে। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে থিমপুজো শিল্পীদের নতুন উপার্জনের পথ খুলে দিয়েছে। নানা ভাবনার প্রকাশ ও প্রসার ঘটেছে। সামনে এসেছে বিকল্প কেরিয়ার। আমরা দর্শকরা তা প্রত্যক্ষ করে রোমাঞ্চিত হই। শিল্পসত্তার তারিফ করি। থিমপুজোয় আসল বিজয়ী হন দর্শক। কারন আমরাই এখানে শেষকথা বলি। বাঁশকাপড়ের সাবেকি পুজোর বদলে কোথাও শুরু হল প্লাস্টিকের বোতল, ফলের বীজ, শুকনো লঙ্কা, দেশলাই কাঠি, সুতো, ব্লেড, ছুরি, বিস্কুট, নানারকম ফেলে দেওয়া সামগ্রী, বরফ ইত্যাদি নানাবিধ জিনিষ এতে ব্যবহার করা হয়। এরকমভাবেই মূর্তিগড়ার কাজে লাগে উৎকর্ষতার ছোঁয়া। মেহগনি কাঠের দুর্গাপ্রতিমা, সোনার গহনা, ট্রেন দুর্ঘটনা, বাহুবলী প্রভৃতি আমাদের বারংবার চমকিত করেছে। পাকিস্তান থেকে আগত শিল্পীরা লরির  টিনের অংশ দিয়ে একটি মন্ডপ করেন। কলকাতার একটি পূজামন্ডপে কেরালার সংস্কৃতি দর্শকদের মন জয় করে। সেখানে হাউসবোটের আকারে মন্ডপ এবং তালপাতার ব্যবহার অপূর্ব। বাংলা এবং মালায়ালী সভ্যতা এখানে মিলেমিশে একাকার।

বর্তমানে থিমপুজোর শিল্পভাবনায় বড় জায়গা নিচ্ছে থিম মিউজিক। সেখানে ওস্তাদ রসিদ খান, নচিকেতা, কবীর সুমন, ইন্দ্রনীলের মতো শিল্পীরা যেমন কাজক রছেন, কাজের সুযোগ বাড়ছে আনকোরা ও  অপরিচিত শিল্পীদেরও। পুজোর থিম হিট করলে যাদের নাম হিট করার দুর্দান্ত সুযোগ। তাই দুর্গাপুজো আজ আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বজনীন আর থিমপুজোই তার জায়গা করে দিচ্ছে।

অপরদিকে, কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বেশ কিছু বারোয়ারী দুর্গাপুজো তাদের সনাতন ঐতিহ্য আজও বজায় রেখে চলেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব। এদের ডাকের সাজের একচালার প্রতিমা দর্শনের জন্য দূরদূরান্ত থেকে বহু দর্শনার্থী বাগবাজারে ভিড় জমান। বেশ কিছু পুরানো বনেদিবাড়িও দুর্গাপুজোয় সনাতনপ্রথা বজায় রেখে চলেছেন। তাদের মধ্যে শোভাবাজার রাজবাড়ি, হাটখোলার দত্তবাড়ি, ভবানীপুরের মল্লিকবাড়ি, পাথুরিয়াঘাটার ঘোষবাড়ি বিখ্যাত। রামকৃষ্ণমঠ ও মিশনের পুজো ও বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকামতে পুরাতন রীতিতে পালন করা হয়।

অতিমারি করোনার মধ্যে দু-দুটো বছর বারোয়ারি দুর্গাপুজোগুলো নিজেদেরকে অনেক প্রশাসনিক নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। এবার তারা আবার পূর্ণউদ্যমে প্রতিযোগিতার ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে। বাংলার ৩৭ হাজার দুর্গাপুজো কমিটির মধ্যে বেশিরভাগই থিমপুজো করে থাকেন। করোনার জন্য স্পনসরে ভাটা পড়েছে, বাজেট হয়েছে কাটছাঁট। তাই এবারে কলকাতার সেরা ৬১টি দুর্গাপুজো মন্ডপ চমকপদ সব থিম নিয়ে এবার সেজে উঠবে। ভ্যাটিকান শহরের আদলে সেজে উঠছে শহরের শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের পুজামন্ডপ। গতবছর বুরজ খালিফা ঘিরে ব্যপক বিতর্কে পড়েছিল এদের পুজো। বড়িশা ক্লাবের থিম সাঁঝবাতি। রাজডাঙ্গায় হচ্ছে অশনিসংকেত। কবিরাজ বাগান সর্বজনীন পুজো এবারে সদ্যপ্রয়াত কেকে থিম। সিন্ধুতীরে মহেঞ্জোদারো সভ্যতা দেখা যাবে হরিদেবপুরে। কেউ আবার সৌরভ গাঙ্গুলীর ৫০তম জন্মদিন পালন করছে তাদের পূজামন্ডপে। সুরুচি সংঘের থিম পৃথিবী আবার শান্ত হবে। সুকিয়া স্ট্রিটের একটি পুজোমন্ডপ হচ্ছে জঙ্গলকন্যার জগতের আদলে। কবিরাজ বাগানের পোষ্যবান্ধব পুজামন্ডপে দুর্গাপূজার মুখ সারমেয়। মন্ডপে মা দুর্গাকে শান্ত এবং মাতৃরূপে দেখা যাবে। এখানে মা দুর্গার কাছে একটি মা কুকুরকে দেখা যাবে যে নিজের সন্তানদের নিরাপত্তা প্রার্থনা করছে। যদিও শহরের বেশ কিছু পুজোকমিটি তাদের চিন্তাভাবনা এখনও নিজেদের আস্তিনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। এরা ভাঙবে তবু মচকাবে না। এখানে একটি বাক্য থেকে থিমের ধাঁধার জট ছাড়াতে হবে। যেমন, টেনে টেনে ধপাস, পৃথিবী আবার শান্ত হবে, যাপনের উদযাপ্‌ন, তারাদের পুজো, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, বজরা এলো দেখতে চলো, তারারা কত আলোকবর্ষ দূরে, পায়ে পায়ে পঞ্চাশ ইত্যাদি। এছাড়া এবারে সঙ্গে আছে স্বাধীনতার ৭৫ বছর। 

থিমপুজো আর প্রচারের দাপটে দুর্গাপুজো এখন আমাদের মননের নিত্যসঙ্গী। পূজো মানেই উৎসব আর এই উৎসবে ভর করে বিভিন্ন প্রতিযোগী ও আমরা গা ভাসিয়ে চলেছি। থিমপুজোর নামে আরো কত রোমাঞ্চ অপেক্ষা করে আছে আমরা তা জানি না। হয়তো ব্লু-হোয়েল, মোমো বা কিকির মতো কোন ভার্চুয়াল গেম ভবিষ্যতে থিমপূজোর বিষয় হবে। কেকে ছাড়া এই বছর গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন। ওঁনাকে নিয়ে কোনো পুজোকমিটি ট্রিবিউট থিম ভাবতেই পারেন। অতি সম্প্রতি চলে গেলেন নির্মলা মিশ্র। এক্ষেত্রে ঝিনুকের প্যান্ডেল না হোক অন্তত তাঁর সুরেলা কন্ঠে গ্রামাফোনে ঝিনুক খোঁজার গান নিশ্চয় শুনতে পাব।

আমরা অপেক্ষায় রইলাম।

চিত্র সৌজন্য : অনন্ত কৃষ্ণ দে

শিরোনাম চিত্র : টীম Du~কলম

লেখক পরিচিতি

 

অনন্ত কৃষ্ণ দে

জন্ম কলকাতার বাগবাজারে। মহারাজা কাসিমবাজার স্কুল ও বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশুনা। বিজ্ঞানে স্নাতক। স্কুল, কলেজ, অণু পত্রিকা ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা। নাটক ও স্কাউটিং এর সাথে যুক্ত।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!