সুদেষ্ণা চক্রবর্তী
(১)
আজ প্রায় ছয় মাস পর কার্শিয়াং এর ডাউহিলের পথে রওনা দিলো রাজিতা।
লোকে বলে ভূতুড়ে গ্রাম……।
ভূত ???সেটা আবার কি???
ছোটোবেলায় ঠাকুমা যখন দুই ভাই বোনকে ভূত-পেত্নীর গল্প বলতো, ভাইটা ভয় পেতো খুউউউউব….. আর দুষ্টু মেয়েটা খিলখিল করে হাসতো…….।
আর অন্ধকার হলেই ভাইকে চোখ উল্টে ভয় দেখানোর কথা মনে হলে আজও ভাইয়ের ভয় পাওয়া মুখটাই মনে হয় রাজিতার…..কষ্ট হয় মনে মনে।
করোনা নামের মহামারীকে সকলে প্রায় হারিয়েই দিয়েছি আমরা….তবু মানুষ কি আদতেও বুঝেছে মনুষ্যত্বের ওপরে আর কিচ্ছুটি নেই…..প্রকৃতি হোক বা যে কোনো জীব …..তাদের বুকে আঘাত দিলে তা বুমেরাং হয়েই ফেরে।
একটা পাইন গাছের নিচে ঠেস দিয়ে কত কিছু ভাবতে থাকে মেয়েটা …..
এই শীত শীত পরার মুখে এই শান্ত পাহাড়ী গ্রামটায় কোনোদিন আসা হয়নি তার….
চারদিক বড়ো সুন্দর দেখাচ্ছে…..হেমন্তেও যেনো বসন্তের ছোঁয়া।
আজকাল নির্জন নিস্তব্ধ জায়গাগুলি বড্ড ভালো লাগে রাজিতার…..
ভাবনার জল তরঙ্গে ডুব দেওয়া যায় মন দিয়ে…..মাঝে মাঝে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকা ডাক দিয়ে যায়।
হঠাৎ চমকে ওঠে রাহিলের ডাকে …..
“কিরে উঠবি না??? ঝিরঝিরে বৃষ্টি এলো যে….
চা-ওয়ালা কাকুটাও যাওয়ার আগে বলে গেলো এখানে চারটের পর কেউ থাকেনা”….. ….
“তুই যে বলিস ভূত আমাকে দেখলেই বাপ বাপ বলে পালাবে”………
“তা পালাবে…..আর তোর সেই বিদঘুটে রঙের লিপস্টিকটা ঠোঁটে ঘষে নিলে পর এই ত্রিসীমানায় ভূত আসবে না”……
দুজনেই এবার হেসে ফেললো……….
কতদিন এই ভাবে প্রাণ খুলে হাসেনি ওরা…..
ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে রাহিলের হাতে ধরিয়ে মনের কথাটা বলেই ফেললো এতক্ষণে……
“তবে চল যাই চার্চের ভেতর, একটা ছবি তুলেই চলে আসবো….”
“তুই না সত্যি একখানা পিস বটে……..চল যাই তবে…..”।
“ছবি তোলার সময় মাস্ক অন্তত খোল রাহিল।
আমি দ্যাখ তো দিব্যি মাস্ক ছাড়া। যত ভয় পাবি রোগ তত চেপে ধরবে তোকে”।
“বলিহারি সাহস তোর”।
“আমার সাহসেই যে তোর সাহস বাড়ে এটা মুখ ফুটে স্বীকার করতে তোর লজ্জা কোথায়”??
তৃতীয় ঢেউ কিন্তু আবার আসবে রাজি”।
“কেমন ঢেউ রে?? পুরীর সমুদ্রের মতন।”
ধূর! এর সাথে কথায় কে পারবে ওর সাথে?
চুপ করে গেল রাহিল।
দুজনে ধীরে ধীরে চার্চের গেটের দিকে এগোতে লাগলো…………..।
(২)
ছবি তুলে এদিক ওদিক ফাঁকা জায়গায় ভূত টুত খুঁজে ঘন পাইন গাছের সারি সাজানো কুয়াশা মোড়া সরু রাস্তা ধরে পার্ক অবধি হেঁটেছিল দুজনে। ততক্ষণে পার্কটা বন্ধ হয়ে গেছে।
একটা মধ্য বয়েসী আন্টি তখন সবে টিনের চালার দোকানটার ঝাঁপ নামাবে। ঠিক সেই মুহূর্তে রাজিতার থুকপা খাওয়ার মন হয়।
“আন্টি মোমো থুকপা মোমো কুছ মিলেগা?”
“সির্ফ ম্যাগী মিলেগা”
দুজনকে তড়িঘড়ি ম্যাগী দিয়ে পয়সা নিয়ে আন্টি নিচের গ্রামের রাস্তা ধরলো।
যাওয়ার আগে চোখ গোল গোল করে হিন্দিতে বলে গেলো সন্ধ্যে হয়ে গেছে এখানে থেকো না।
“ওই আন্টিটাই ভূত নয় তো রাহিল”?
“হ্যাঁ ভূত। তবে ভাল ভূত।
“আমি মরে গেলে হবো পাজি ভূত।
তোর ঘাড়ে করে পৃথিবী দেখবো। কোনো মেয়ে তোর ত্রিসীমানায় আসলেই ঘাড় মটকে দেবো।”
(৩)
ঘুরে আসার দিন সাতেক পর থেকেই রাজিতার জ্বর। প্রথমে পাত্তা না দিলেও রাহিলের কথায় ডাক্তারের কাছে যায় রাজিতা। পৃথিবীতে এই একটা মানুষই আছে যার কথা রাজিতা কখনো না করে না।
সমস্ত টেস্ট করে নিমুনিয়া ধরা পরে রাজির।
“ধূর! দিন সাতেক অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। একটুতেই বড্ড ঘাবড়ে যাস তুই।”
মুখটা কালো হয়ে যায় রাহিলের।
এই প্রথম রাহিলের চোখে জল দেখতে পায় রাজি।
পনেরো দিনের লড়াই এর পর অবশেষে হার মৃত্যুর কাছে হার মেনে নেয় মেয়েটা।
শেষ রাতে শ্বাস কষ্টটা বড্ড বেড়েছিল।
জরা জরা গলায় শেষ কথাটা ছিল এই কোভিড শরীরের ভেতরটা বড্ড দুর্বল করে দিল রে।
(৪)
গান্ধী জয়ন্তীর পরে, পর পর দুদিন ছুটি….
তিনটে দিন বেশ চেনা পাহাড়ের কোলে কাটানোই যায়……হাতের কাছেই বাগোরা, চিমনি আর নয় চটকপুর……সবুজে ঘেরা এক টুকরো স্বর্গ।
ঘোরার নেশাটা ওর মাথায় চাপিয়েছিল রাজিতাই।
দু’দিন ছুটি পেলেই নাছোড়বান্দা মেয়েটা পাহাড়ে যাবেই। ঘরে বসে একটু শুয়ে বসে, ল্যাদ খেয়ে সময় কাটানোর উপায় ছিল না।
নাহ, এই পূজোর মুখে কেউ সাথ দিলো না রাহিলের…..।
অগত্যা সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে দামী তোয়ালে দিয়ে মুছে নিয়েই রওনা দিলো……জীবনে কেউ সাথ দিক বা না দিক এই দু চাকার বন্ধু ৮০২৩ সাথ ছাড়েনি কোনোদিন।……।
বহুদিন এই রাস্তায় আসা হয়নি……কার্শিয়াং টুরিস্ট লজের একদম কোনায় এক সিটের টেবিলটাতে বসে পাহাড়, মেঘ আর রোদের লুকোচুরি দেখতে বেশ লাগে……..।
তিন প্লেট মোমো খেয়ে উঠতে উঠতে অনেকটাই সন্ধ্যে হয়ে গেলো…..
পাশে রাজিতা থাকলেই বলতো, “তোকে এইবার ঠিক ভূতে ধরবে…..”বলেই সেই বিখ্যাত হাসিটা…….।
“তোর থেকে বড়ো ভূত এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই”….
ব্যাস! অমনি গাল ফুলিয়ে নিমেষের মধ্যে হাসি উবে গেলো মেয়েটার…..ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই হাসে রাহিল… ..।
চার্চটা পেরিয়ে আর চার কিলোমিটার গেলেই তো দিলেরাম…আর সেখান থেকেই সরু রাস্তা উঁকি মারে চটকপুরের দিকে………….তবু পথ কেন আজ শেষ হচ্ছেনা……..।
ওই দূরে একটা ছায়ার মত কি দেখতে পায় রাহিল।
বুকটা কেমন ভারি হয়ে আসে। ঠিক যেন রাজির মতন। কাছে যেতেই উধাও।
কে যেন রাহিলের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,
“ধূর বোকা! ভূত বলে কিচ্ছু হয় না রে।”
………স্থির পাহাড়টা দেখে কেমন যেন অপেক্ষারত মনে হয়…..একদৃষ্টে পাহাড়টাকে দেখতে থাকে রাহিল ……..।
“তবু পৃথিবীতে রাত নামে
নিবিড় তুষারের মতো
তুমি শুধু উড়ে চলো ক্লান্তিহীন”…..।
চিত্রাঙ্কন : সৌমেন দাস