সুদেষ্ণা মিত্র
“গৃহদাহ জীবনের গল্প — সেদিনের ও আজকের …”
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের সবথেকে বড় গুণ ছিল সুন্দর চরিত্র সৃষ্টি এবং অত্যন্ত জোরালো নারী চরিত্র-চিত্রন।
সে যুগের অনেক ঔপন্যাসিকের তুলনায় শরৎচন্দ্র ছিলেন নারী চরিত্র চিত্রণে সিদ্ধহস্ত। তাদের অনুভূতি ও আবেগ সংক্রান্ত টানাপোড়েন, সবকিছুই সুন্দরভাবে প্রকাশ পেতো লেখকের কলম গুণে।
তাঁর গল্প এবং উপন্যাস হয়তো সেই জন্যেই তৎকালীন অনেক সাহিত্যকের তুলনায় বাঙালীর কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল। পাঠকরা তাঁর বিষয়ের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পেতো।
শরৎচন্দ্র সৃষ্ঠ এমন অনেক সাহিত্যের মধ্যে নারী চরিত্রগুলি আপাতদৃষ্টিতে চেনা মনে হলেও চরিত্রগুলির মনের গভীরে পৌঁছে দেখা যায় তারা অজানা অচেনা।
গৃহদাহ উপন্যাসের নারী চরিত্রটি এমনই এক আধুনিকা নারীর। অচলা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের অনেক নায়িকাদের মধ্যে বিশিষ্টা।
সাধারণতঃ, কথাশিল্পীর নারী চরিত্র গুলি গল্পের প্লট অনুযায়ী অনুভূতির টানাপোড়েন, ব্যঞ্জনা সমস্ত কিছুর বলিষ্ঠ প্রকাশ দেখা যায়।
গৃহদাহ উপন্যাসের অচলা অনেক ক্ষেত্রেই তার মনের বহিঃপ্রকাশ সেভাবে করে উঠতে পারেনি, এখানেই তিনি অচলাকে আর কয়েকজন নারী চরিত্রের থেকে আলাদা মাত্রা দিয়েছেন।
উপন্যাসটির তিনটি চরিত্র মহিম, সুরেশ ও অচলার মানসিক জটিলতার গল্প বিষয়বস্তুর নিরীখেও বিশেষত্বের দাবী রাখে। আপাতদৃষ্টিতে ত্রিকোণ প্রেম মনে হলেও এর গভীরতা আলাদা।
অচলা নামটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, মার্জিত, সংযত অথচ স্পষ্টবাদী এই নারীটি ছোটবেলা থেকে মাতৃহারা। বাবা কেদার মুখোপাধ্যায়ের আদরে এবং শাসনে তার বড় হয়ে ওঠা।
পরে দেখা যায় বাবার ছাত্র মহিমের সাথে তার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুতরাং অচলার জগতে এই দুই পুরুষ ছাড়া সেভাবে আর কারোর বর্ণনা পাওয়া যায় না।
প্রথমদিকে বাবা ছিলেন তার বন্ধু আর মহিম তার মনের সঙ্গী, এভাবেই অতিবাহিত হচ্ছিল অচলার নিস্তরঙ্গ জীবন।
জীবন তৃতীয় পুরুষ সুরেশের আগমনে বয়ে চলা সাজানো গোছানো জীবনটা কেমন যেন ওলট পালট হয়ে যায়।
অচলার দোটানা শুরু হয় কাকে বেছে নেবে সেই প্রশ্নে !
ভাবাবেগহীন মহিম নাকি প্রেমের ঝড় তোলা কথায় কথায় ভালোবাসা জানানো সুপুরুষ সুরেশ? কাকে বরণ করবে অচলার মত বুদ্ধি সংযত চরিত্রের নারী। শান্ত বাতাসকে নাকি কালবৈশাখীর ঝড়কে!
একদিকে ভালোবাসার পুরুষ অন্যদিকে নতুন ভালোলাগার চরম উত্তেজনা, মানসিক দ্বন্দের দোলাচলের মধ্যে সাধারণ নারী চরিত্রের সঙ্গে অচলাকে এক করে দিয়েছেন লেখক। যা প্রাসঙ্গিক আজকের দিনেও।
আধুনিক নারী মন কোনো কোনো সময় বুঝে উঠতে পারে না, কোন আবেগকে বরণ করবে সে; মার্জিত কোমলতাকে নাকি দুরন্ত চঞ্চল অশান্ত মনকে আগাগোড়া।
চাওয়া-পাওয়ার এই টানাপোড়েন মানসিক দ্বন্দ্ব আর দশটা নারীর মতই করে তুলেছে অচলাকে সাধারণ মধ্যে অসাধারণ।
(ক্রমশঃ)
শরৎচন্দ্রের নারী চরিত্রে মানসিক টানাপোড়েন অনেক বেশি, বলিষ্ঠতা কম (অচলা নয়) বলে মনে হয় আমার … তুমি খুব ভালো আলোচনা করেছ… আমার ভালো লেগেছে।
Thank you. লেখা টা সম্পূর্ণ আমার নিজের মনের চিন্তাভাবনার ফল। হয়তো খুব একটা গুছিয়ে বলা হয়ে ওঠেনি। তাও ভালো লাগার জন্য আমি উৎসাহ পেলাম।
যুগের মাপকাঠিতে শরৎচন্দ্রের বেশ কিছু নারী চরিত্র আমার বেশ বলিষ্ঠ মনে হয় । যদিও মনের দ্বন্দ্ব হয়তো তারা ছাপিয়ে উঠতে পারেনি অনেক ক্ষেত্রেই। অবশ্য এর জন্য তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করা যায় না ।