Home সামাজিক, গল্প গল্প কথায় স্বপ্ন ভাসে
সামাজিকগল্প

গল্প কথায় স্বপ্ন ভাসে

অলোক মুখোপাধ্যায়

ভাইফোঁটার পরদিন সকালে বাজারে গিয়ে ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। চারদিক শুনশান। গতকাল একবেলা ভালো মন্দ খেয়ে রাতে নো মিল। নেহাত ওষুধ খেতে হয় তাই জলমুড়ি খেয়ে ঘুম দিয়েছি। কালজিরে কাঁচালংকা সহযোগে চারাপোনার পাতলা ঝোল দিয়ে দুটো ভাত খাব ভেবেছিলাম, কিন্তু কোথায় চারাপোনা! মাছ বাজার এক্কেবার ফাঁকা। সবজি পট্টিতে গিয়ে দেখি পাঁচ সাতজন বসেছে। ডালায় শুকনো ঝটতি পরতি সবজি যেগুলো গরু ছাগলেও খাবে না। পাশেই দেখি এক বুড়ি প্লাস্টিকের ওপর পেটগলা মাঝারি সাইজের ট্যাংরা আর খান দশেক ফ্যাসা নিয়ে বসেছে। ফ্যাসা মাছ কড়া করে ভেজে মুসুর ডাল আর গরম ভাতে যা লাগে না! এক টুকরো গন্ধরাজ লেবু পেলে তো মজাই মজা। ভাবছি খান চারেক নেব কিনা ঠিক তক্ষুনি পিঠে টুকুস করে টোকা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি কিশোর বেলার বন্ধু কুমার দুর্গেশ। অফিসিয়াল নাম দুর্গাদাস চক্রবর্তী কিন্তু কুমার দুর্গেশ নামে ডাকি আমরা সিলেক্টিভ কয়েকজন। স্কুলে উঁচু ক্লাসে আমাদের স্ট্রীম আলাদা হলেও মেলামেশা ছিল অবাধ। নাটক এবং সিরিয়ালের পরিচিত মুখ। চলতে ফিরতে দেখা হয় কিন্তু সেভাবে কথা হয় না। আছিস কেমন দিয়ে শুরুটা আমিই করলাম।

দুর্গেশ গম্ভীর গলায় উত্তর দিল -বেঁচে আছি, তবে মাঝে মাঝে মনে হয় নেই!

এটা কোন নাটকের সংলাপ না কি তোর নিজের?

কেন রে বা…..। সরি ইয়ে.. মানে সব কিছুতেই নাটক খুঁজিস কেন অলোক? ব্যক্তিজীবন সমাজজীবন এসব তো আছে না কি! মুড়ির প্যাকেট কুড়িতেই আছে কিন্তু সাইজ ছোট হয়েছে। মিনি থেকে সুপার সেভার বিস্কুটের প্যাকেট আগে রাউন্ড ফিগারে পাওয়া যেত এখন বারো আঠাশ তেত্রিশ আটচল্লিশ থেকে তিপান্ন।

তো কি হয়েছে! মানি পার্সের সাথে খুচরো কয়েনের একটা বটুয়া রাখতে হবে। পাবলিক এখন সবেতেই অভ্যস্ত।

তোর পাবলিকের ইয়ে মারি…..। শালা ডি এ নেই, পেনশন ফিক্সড। দুজনের সংসার চালাতে গিয়ে প্রত্যেক মাসে জমানো টাকার পাঁচ থেকে ছয় চলে যাচ্ছে।

সবারই তো সেই একই অবস্থা কুমার দুর্গেশ। এক মিনিট, গিন্নি ফোন করছে। হ্যাঁ বলো…. না মাছ পাইনি। পালং শাক আছে কিন্তু নিলে তোমার পছন্দ হবে না। ও আচ্ছা…. বলছি আমার না ফিরতে একটু….হ্যালো আছ না গেছ। হ্যালো…..

কি হলো ফোন কেটে দিল কেন রে?

ও কিছ না। পুজোর ফুল আর আধগোজ মিষ্টি পানপাতা নিতে হবে সেটাই মনে করিয়ে ছিল। ওনার মেজদি ভাইফোঁটার একসেস রান্না মাছ আর কি সব যেন পাঠিয়েছে। হ্যাঁ যেটা বলছিলাম পাবলিক কিন্তু এখন ভেরি মাচ আপডেটেড। যখন যেমন ঠিক তখন তেমন! আজকের বাজারটাই দ্যাখ না, কোনও লোকজন নেই! ন’টা বাজতে যায় বেশিরভাগ দোকানের ঝাঁপ খোলেনি। এক সেকেন্ড দুর্গেশ, তুই কার্তিকের দোকানে দুটো চা বল, আমি আসছি।

বেশ! কিন্তু দেরী করিস না। বেশিক্ষণ একা বোকা হয়ে থাকতে ভাল্লাগে না।

আরে বেশিক্ষণ লাগবে না, জাস্ট যাবো আর আসবো।

কার্তিক ভাই। ধীরে সুস্থে দুটো চা বানাও দেখি। অলোকবাবু কি চা খায় তুমি জানো?

চিনি ছাড়া হালকা লিকার, পরিমাণ বেশি। আপনি?

চিনি ছাড়া। দুধ থাকবে কিন্তু একটু কড়া। পরিমাণ তুমি যেমন বোঝ। কি রে হয়ে গেল?

হ্যাঁ, পাশের বাড়ির প্রশান্ত বাবুর হাতে পান আর ফুলের প্যাকেট ধরিয়ে দিলাম। তোর সাথে আড্ডা মারছি সেটাও বলে দিলাম। চা বলেছিস?

বলেছি।

ওদিকে কি দেখছিস, দুর্গেশ?

কালীপুজোর ভাসান তো হয়ে গেছে?

হ্যাঁ, তবে দু চারটে বাকি। আজকের মধ্যেই হয়ে যাবে। কেন?

দুটো ম্যাটাডোর বোঝাই এল ই ডি টুনি লাইটের সেট, বড় বড় লোহার থাম্বা খাল পাড়ের দিকে গেল কি না তাই দেখছিলাম আর ভাবছিলাম নতুন আবার কোন ধামাকা!

আচ্ছা, বুঝেছি। এ এক নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে। কাল বাদে পরশু তো ছট পুজো। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে মিত্তিরদের বেওয়ারিশ বড় দীঘিতে বছর খানেক ধরে ছট পুজোর আয়োজন হচ্ছে। কোথা থেকে যে সব আসে কে জানে! দিনভর মাইকে ভোজপুরী গান আর ভোররাত থেকে কান ফাটানো বোম পটকার আওয়াজ। নে ভাই, কার্তিকের চা এসে গিয়েছে। খেতে খেতে কথা চলুক।

তুই বল অলোক, আমাদের বাংলায় এসব আগে ছিল?

ছিল না, তা নয়! তবে আমাদের এলাকায় সেভাবে ছিল না। কসমোপলিটান সিটির উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিকেই অবাঙালীর ভিড় যেভাবে বাড়ছে তাতে করে যা হবার তাই হচ্ছে!

শালা পাগলও নিজের ভালো বোঝে কিন্তু বা-এর পরে যুক্তাক্ষর খন্ড ত বাঙালী সেই চার অক্ষর আকার ওকার হয়েই থাকল। মিক্সড কালচারের দোহাই দিয়ে ভিন রাজ্যের যা কিছু দেখছে সব গোগ্রাসে গিলছে।  ঠাকুমা বলতেন -নাই  কাজ তো খই ভাজ; তো আমাদের ভেতো বাঙালীর এখন সেই অবস্থা। দুঃখের কথা আর কি বলব রে অলোক তোকে! কালীপুজোর আগের দিন বা তার আগের দিন হবে, নাটকের রিহার্সাল দিয়ে মেট্রোয় টালিগঞ্জ পেরোচ্ছি মোবাইল বেজে উঠল। কলার টিউন শুনে বুঝলাম বউ। ফোনটা ধরলাম না। কুঁদঘাট স্টেশনে নেমে কল ব্যাক করলাম। সিম্পল ম্যাটার! হাতরুটির বদলে তিন খানা রুমালি রুটি নিতে হবে এবং তার পরেই অর্ডার একটা ফুলঝাড়ু এবং একটা শলার ঝ্যাঁটা। কাঁধের ঝোলায় রুমালি রুটির মোড়ক ঢুকিয়ে দু হাতে ঝাড়ু আর ঝ্যাঁটা নিয়ে ঘরে ঢুকলাম।

তার পর!

বউ কি যে খুশি কি বলবো তোকে! জোড়া ঝ্যাঁটা ঘরে আনার কারণ শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারি না। ওটা হচ্ছে ধন তেরাসের স্ট্যাটাস সিম্বল। সোনা-রূপো, নতুন বাসন যা খুশি কেনো না কেন ঝাড়ু ইজ আ মাস্ট। চতুর্দশীর সন্ধ্যায় ঝাড়ু মেরে ঘর থেকে ঝেঁটিয়ে অলক্ষী বিদায় করা হবে।

ব্যাপারটা কি জানিস দুর্গেশ, বারো মাসে তের পার্বণের পরেও হুল্লোড়বাজির যা যা কম পড়েছিল, সব আমরা আমাদের রিলিজিয়ন আর কালচারাল বডিতে ট্রান্সপ্লান্ট করে নিয়েছি ।

একদম ঠিক। আমাদের সময় বাড়িতে নতুন পঞ্জিকা আসলে পুজোর নির্ঘন্ট দেখে তারপর ভিতরের পাতায় মা দুর্গার রঙিন ছবি দেখে রোমাঞ্চিত হতাম। পুজোর চেয়ে পুজো আসছে এই ব্যাপারটাই ছিল অনেক বেশি আনন্দের। এখনকার মতো টেলিভিশন আর খবরের কাগজে ‘পুজোর বাকি বাহান্ন দিন’ বিজ্ঞাপন ছিল না।

আরে, মা দুর্গা তো তখন কার্নিভালের প্রতীক ছিলেন না তাই না! কয়েক বছর ধরে তো নতুন এক ফ্যাশন হয়েছে  মহালয়ার আগেই পুজো প্যান্ডেলের ফিতে কাটা। দুর্গেশ আরেকটা জিনিস তুই খেয়াল করেছিস কিনা জানি না।

কি!

বাজার হাটে গনেশ পুজো কি হারে বাড়ছে দেখেছিস? পুজোর আগে পরে টানা তিন দিন ডিজে’র কান ফাটানো আওয়াজ। প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে পাবলিক লাইন দিয়ে শালপাতার টুকরিতে খিচুরি খাচ্ছে তার পর ধ্বনি তুলছে     -আসছে বছর আবার হবে। আয়োজকদের খুশির অন্ত নেই, প্রণামীর বাক্স উপচে পরছে। এসব দেখে তোর কি একবারও মনে হয় দেশ বেকারী আর মন্দায় ভুগছে?

ভাই অলোক আমি তো প্রথমে তোকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম! কিন্তু তুই তো পাবলিক কালচারে ঢুকে গেলি। পাবলিক তো একা! সে কি করবে? পাবলিক কে দিশা দেখাবে যারা তারা কোথায়? সব মিলিঝুলি কলকাত্তাওয়ালি! ভাবতে পারিস দিনের পর দিন যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা রাস্তায় বসে আছে প্রশাসনের কোন হেলদোল নেই। টোটাল সার্ভিস সেকটার একেবারে ভেঙে পড়েছে। খেলা মেলা মোচ্ছব আর ডোল দিয়ে বেশিদিন চলে না। আবার যদি যৌবন ফিরে পেতাম খুব ভালো হতো জানিস! দশ বারোটা টগবগে সাহসী ছেলে মেয়ের আলাদা আলাদা লাখ খানেক গ্রুপ তৈরি করে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলতাম। তারপর প্রকৃত গণতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি সেটা বুঝিয়ে দিতাম।

তুই এখনও সেই দিন বদলের স্বপ্ন দেখিস?

হ্যাঁ, আমি আজও সেই স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন সফল হবে কি হবে না সেটা বড় কথা নয়। স্বপ্ন দেখাটা ভীষণ প্রয়োজন অলোক! অন্তত একজন সুস্থ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে গেলে, স্বপ্ন তো দেখতেই হবে।

যা হবার নয় তা ভেবে কি লাভ দুর্গেশ! আমাদের তো এখন একদিন করে শেষের দিকে এগোনোর পালা। তবে হ্যাঁ খারাপ লাগে এটা দেখে যে বাঙালী আর আগের মতো ভাবে না। সব কিছুই গা সওয়া হয়ে গিয়েছে।

সিস্টেম তো এটাই চায় অলোক। তুমি চোখে যা দেখছ দেখ, মনে রেখ না। চোখ হলো মস্তিস্ক আর হৃদয়ের সী-বিচ। দু চোখের সামনে প্রতিনিয়ত আছড়ে পড়ছে ঢেউ। ক্রমাগত আসতে থাকা ঢেউয়ের ভেতর থেকে ভালো মন্দ যা কিছু সব ধরে রাখতে হবে মগজে। চিন্তার প্রসার ঘটিয়ে সৃষ্টি করতে হবে পজিটিভ মুভমেন্ট যার মধ্য দিয়েই হবে দেশ এবং দশের ভালো।

নাটক নিয়ে নতুন কিছু ভাবছিস, তাই না?

হ্যাঁ! একদম সোজ়া সাপটা কথা এবং শেষে সাংঘাতিক একটা ধাক্কা দেব। জানি না ক’টা শো করতে পারবো। প্রথম শোয়ের দিন পারলে যাস।

শ্যিওর!

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. ভালো লাগলো খুব। এটাই বর্তমান পরিস্থিতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!