রচনা : রীতা রয়
।। ১ ।।
সাদা বালিতে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে সুতনু। মাথায় সাদা হেডব্যান্ড ছাড়িয়ে চুঁইয়ে পড়ছে ঘামের ধারা। দরদরিয়ে ঘেমে ভিজে প্যাচপ্যাচে শরীরটাকে বোঝার মত টেনে নিয়ে ছুটে চলেছে দিশাহীন ভাবে। টকটকে লাল চোখ আর শক্ত ক্লান্ত পায়ের পেশী থাকলেও একসময় হার মানলো সুতনুর সুঠাম শরীর। আছড়ে পড়লো মেরিন ড্রাইভের সী বীচে।
স্থানীয় চা, টিফিন বানানোর স্টলগুলো সবেমাত্র এক এক করে সী-বীচে নিজেদের মাচা খুলছে তখন। আশেপাশের সেইসব স্টল থেকে মর্নিং ওয়াকে আসা, ভোরের আছড়ে পড়া ঢেউ গুনতে আসা গুটিকয়েক মানুষের হঠাৎ এভাবে আছড়ে পড়া ছেলেটার দিকে চোখ আটকে যেতেই চারিদিক থেকে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসে অচৈতন্য ছেলেটিকে ধরে নিয়ে মাচায় শুইয়ে জলের ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা চালিয়ে গেল।
দু-তিন মিনিট সময় পার হয়েছে কি হয়নি, অনেকটা ঠিক ব্লাস্ট করার মত চোখটা খুলে গেল সুতনু’র। ক্ষিধের দৃষ্টি, যেন কাউকে গিলে খাবে সে। ছিটকে ভয়ে সরে গেল আশেপাশের মানুষগুলি। কেউ কেউ এ-ওর ঘাড়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ল। সবাই ছিটকে পিছিয়ে আসলে ও’পাশে থাকা এক বৃদ্ধা অস্পষ্ট দৃষ্টি মেলে ছেলেটির কপালে হাত রাখতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। চোখ ফেটে যেন রক্তের ধারার নীরব বিক্ষোভ মিছিল শুরু হল।
।। ২ ।।
“আসবো ম্যাম?”–
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসুন। বসুন। বলুন কি সমস্যা হচ্ছে আপনার। বাই দা ওয়ে… ভেরি সরি, জানাই হয়নি আপনি-ই পেশেন্ট কিনা! হ্যাঁ বলুন, আমি কিভাবে আপনার উপকার করতে পারি!”– স্মিত হেসে মস্ত গ্রীন কালারের পুরু কাঁচের এস আকৃতির বাঁকানো টেবিলের অংশের মধ্যে একটা ডীপ ব্রাউন কালারের লেদারের চেয়ারের দিকে হাত দেখিয়ে বসতে বললেন ড: মিতা বিশ্বাস।
“না না, ভুল কিছু বলেননি… (চেয়ারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে ডক্টরের দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে নিয়ে ডান হাত দিয়ে নাকটা মুছে সামান্য হেসে বসেই বললো) …তবে আমি পেশেন্ট না অন্যকিছু কিংবা পেশেন্ট কিনা আপনিই বলতে পারবেন। একচুয়ালি, আমি নিজের কিছু প্রব্লেম শেয়ার করতেই এসেছি মিতা ম্যাম। প্লিজ হেল্প মি।”
“ও-কে… আমি আগে শুনে নি, প্রব্লেমটা ঠিক কি! আশাবাদী আমি যে, আপনি নিরাশ হবেন না। বলুন একদম নির্দ্বিধায়, নি:সংকোচে এবং কিচ্ছু বাদ না দিয়েই।”– হাতে কলম টা তুলে নিতেই…
“আপনি সবটা সময় নিয়ে শুনবেন তো??” স্থির দুটো অপলক চোখ।
“নিশ্চই শুনবো। আপনার সব কথা শোনার জন্যই তো আমি বসে আছি, নিশ্চিন্তে বলুন।”
টেবিলে দু’হাতের কনুই চেপে সামান্য ঝুঁকে বললো, “আমি সুতনু। সুতনু চন্দ আমার সার্টিফিকেট নাম। বাড়িতে সবাই ভালোবেসে বাবান’ বলেই ডাকে। আমি একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে প্রায় চার বছর কর্মরত। (সামান্য ইতিউতি করতেই)”-
“এনি প্রব্লেম মিস্টার চন্দ?”
“হ্যাঁ, না -ন্না.. মানে, একটু জল, মানে মিনারেল ওয়াটার পেতে পারি? গলাটা তেষ্টায় পায় মাঝে মাঝে বড্ড।” (বলেই মাথাটা ঝাঁকুনি দিল দু’বার মত)।
ড: বিশ্বাস একটা সুইচে আঙুল চেপে ধরতেই চেম্বারের বাইরের থেকে একজন সুবেশী তরুণী চেম্বারে ঢুকতেই পাশের দেওয়ালে সাঁটানো ফিল্টার থেকে গ্লাসে জল দেওয়ার জন্য ইশারা করলেন।
তরুণীটি জলের গ্লাসে জল ভর্তি করে এগিয়ে দিলে। সুতনু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জলটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে এক নি:শ্বাসে ঢকঢক করে শেষ করে ফেললো।
মৃদু হেসে তরুণী সুতনুর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে বেরিয়ে যায় প্রায় নি:শব্দেই।
ড: বিশ্বাস প্রত্যেকটা মুহূর্তকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মত মাপতে থাকলেন সামনে বসে থাকা সুদর্শন যুবকটির। চঞ্চল নয়, অথচ অস্থির দৃশ্য খুঁজে বেড়ানোর এক আপ্রাণ চেষ্টা ছেলেটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
পিছু ফিরে দেখে নিয়ে বললো– “বেশ সুন্দর করে চেম্বারটা সাজিয়েছেন আপনি। দরজা জানালায় ধবধবে সাদা সিফনের গোছা গোছা পর্দা, গোল্ডেন অফ হোয়াইট প্রিন্ট করা ছোট্ট ওয়াল, গ্রীন টেবিল, গ্রীন, রেড, ইয়েলো মানে রামধনুর মত হরেক রকমের লাইট! আচ্ছা আপনি কি লাইট থেরাপি করান? মিউজিক থেরাপি??? করান না? তাহলে Angry Patient-দের শান্ত করেন কিভাবে? আ–আচ্ছা, আপনি খুবই ঠান্ডা, শান্ত মানুষ তাই না? কি–কি হল! বলছেন না যে কিছুই?”
কথা ছাড়িয়ে ধীর গলায় বললেন ড: বিশ্বাস, “উম-ম -ম…. Actually আমি নিজেকে বা নিজের প্রফেশনকে খুব ভালোবাসি। তাই যত্ন করে সাজিয়েছি, আপনার ভালো লেগেছে? অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
“বাই দা ওয়ে –“
“এক মিনিট, এক মিনিট — মারাত্মক ভালো কিন্তু বলিনি আমি! এই যে ঢাউস সাইজের টেবিল সঙ্গে লেদারের চেয়ার আর চারিদিকের দেওয়ালে দেওয়ালে সাঁটানো বোর্ডের মধ্যে ডিপ্রেশনের ছবি ভর্তি করে রেখেছেন; এর চেয়ে ঢের ভালো নয় কি যে দেওয়ালগুলোতে বিভিন্ন মানুষের বডিপার্টসগুলোকে শরীর থেকে টুকরো করে কেটে যত্ন করে ধুয়েমুছে Preservative দিয়ে বোর্ডের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা??”
প্রখর চৈত্রের দুপুরে তীক্ষ্ণ চিলে’র ডাক অনেক দূর থেকে ভেসে এলো।
চোখে যেন কেউ ধোঁয়া ছিটিয়েই সরে গেল মনে হল ড: বিশ্বাসের। শিরদাঁড়া বেয়ে চিল করা এসি রূমের মধ্যেও দরদরিয়ে জল ঝরতে লাগলো। সোজা হয়ে বসে আগের মতই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন — “মিস্টার চন্দ! আমার চেম্বারের কথা ছাড়ুন ,আপনার সমস্যাটা নিয়ে যদি আলোচনায় যাই তো! (একটু হেসে) এক কাজ করুন,বলুন – বাড়িতে কে কে আছে আপনার? বন্ধুবান্ধব নিশ্চই অসংখ্য? “
হেসে নিয়ে ফের উদাস হয়ে বললো সুতনু, “কথা ঘোরাবেন না ম্যাডাম, আমি একদম পছন্দ করি না। আপনার চেম্বার সাজানোর কথা হচ্ছিল কিন্তু। এই দেখুন না,-আমি হলে তো এরকমই সাজাতাম। একটার পর একটা খুন করতাম ধারালো ছুরি বসিয়ে বসিয়ে, আর তাদের রক্ত মেখে নিয়ে তাদের প্রত্যেকটা অঙ্গ শরীর থেকে টুকরো টুকরো করে ধুয়েমুছে আলাদা করে তারপর প্রিজার্ভড করে দেওয়াল বন্দী করতাম। বড্ড সুন্দর হবে সেই সব ছবি।” — ড: বিশ্বাসের দিকে ঘন হয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে সামান্য এগিয়ে এসে বললো – “কি ঠিক বলিনি??”, বলেই চোখের নিমেষে ঝিমিয়ে পড়ে গেলো টেবিলের কোনায় সুতনু।
ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সুইচে হাত দিয়েই ড: বিশ্বাস সুতনুর চোখেমুখে লেপ্টে থাকা তেল চ্যাপচ্যাপে মুখটায় জলের ঝাপটা দিতে দিতেই চেম্বারের বাইরে থেকে তরুণী মেয়েটি আর একজন তরুণ ছুটে এসে সুতনুকে চেয়ারের ফোল্ডারটা খুলে বিছানার আকার করে দেয়। এসির পাওয়ার কমিয়ে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা চালিয়ে যান।
ঠিক তখনই জাম্প দিয়ে উঠে বসে সুতনু। টকটকে লাল চোখ আর শক্ত চোয়াল, যেন এখনই কাউকে হাতের কাছে পেলেই খুন করে বসবে। কিন্তু ডক্টর বিশ্বাসের নির্লিপ্ত ভাবলেশহীন মুখ দেখেই কেমন যেন সুবোধ বালকের মত উঠে দাঁড়িয়ে বললে– “আজ আসি ম্যাডাম। অফিস ডুব দিয়েছি তো! আমার যে কি হয় আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারি না। অন্যান্য বেশ কয়েকজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখিয়েছি, জানেন! প্রায় সবারই একমত যে, আমার Anger Treatment করাতে হবে। আমার জন্য তো বাবা-মা’ও ঘর ছেড়ে ভয়ে বেরিয়ে যায়। যাবে না বলুন? ওরা যখন তখন ঝগড়া শুরু করে দেয়, আর তখন আমি কেমন যেন হয়ে যাই। ছুরিতে টুকরো টুকরো করে ফেলে সবার রক্ত কেমন দেখতে ইচ্ছে করে, কেন ওদের এত রাগ খুব জানতে ইচ্ছে করে, তাই ওদের শরীরের পার্টসগুলোকে কেটে বের করে গুছিয়ে রাখলে হয়তো ঠিকঠাক বিচার করতে পারতাম।
“কিন্তু জানেন! ওরা বলে–আমি-ই নাকি ভীষণ রাগী। ওদের দেখে নাকি আমার চোখ টকটকে লাল হয়ে যায়, ছুরি তুলে নিয়ে নাকি তাড়া করি আমি, আর না পেলে ওদেরকে আমি নিজেই নাকি নিজেকে ছুরি দিয়ে কাটতে থাকি! কি অদ্ভুত না?? বিশ্বাস করুন,ওরা না সত্যি বলছে। এই দেখুন, এই দেখুন না আমার হাত-পা! এগুলো নাকি আমি-ই কেটেছি। অথচ আমার কিন্তু একটুও মনে নেই। একটুও না। এখন যাই বুঝলেন! নাহলে বস বকবেন, আর কোনদিন যদি বসকে—ই।” — বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল সুতনু।
তিন জোড়া চোখ গনগনে আঁচের লাল পিচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো —
“ওঁর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো কুনাল।” ওয়ার্ড বয়ের উদ্দেশ্যে বলেই ডক্টর বিশ্বাস বললেন “তৃষা, তোমার দিকে উনি ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন, তাই না!”
সামান্য চিন্তার ছাপ ডক্টর বিশ্বাসের চোখে।
“হ্যাঁ, ম্যাডাম। আমিও আপনার কাছে থাকতে থাকতে শিখে গেছি যে, ডাক্তার বা পারিপার্শ্বিক মানুষ গুলোর হাসি ভরা মিষ্টিমুখে হাজারো রোগ নিরাময় হয়ে যায়। কিন্তু ম্যাডাম, যদি ভদ্রলোক সত্যিই খুন করে বসেন তো?”
“না, ঠিক সেরকম পেশেন্ট নন উনি। উনি নিজেই নিজের সমস্যাটা বুঝেই ছুটে এসেছেন,তার মানে কোথাও গিয়ে ওনার একটা কন্ট্রোল পাওয়ার কাজ করছে। মানে অন্তর থেকে নিজেকে নিংড়ে বের করে আনেন সুতনুবাবু। এবার যেটা জানবার সেটা ওনার ফ্যামিলি থেকেই। বাড়ির লোকজনই বলতে পারবেন সুতনু বাবু কখনো কোন মেন্টাল বা ফিজিক্যাল হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছেন কিনা! এছাড়াও যেগুলো খেয়াল করতে হবে, যে উনি Schizophrenic Patient কিনা! এই পেশেন্টরা দু’ধরনের হয় বেশির ভাগ।একটা সুইসাইডাল আর একটা হোমিসাইড। এনার মধ্যে হোমিসাইডাল এফেক্ট গ্রাস করেছে। এটাও একটা মেন্টাল ডিসওর্ডার। এরা প্রচুর ড্রাগ এডিকটেড হতে পারেন, আবার বাড়ির মধ্যেই কাউকে না কাউকে দেখেছেন যারা বা যে অল্পস্বল্প হলেও কোনও না কোন ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত। অথবা ওনাকেই হয়তো কেউ Harm বা Abuse করেছেন। Actually, Mental Crimes কখন কিভাবে ঘটবে বা কারুর শরীরে বিষের মত প্রবেশ করবে তা সহজে উপলব্ধি করা যায় না।এমনও দেখা যায় যে, সাধারণত দুর্বল মানসিকতার মানুষগুলো হঠাৎ যখন Aggressive বা Vulgar লোকেদের মাঝে অজান্তেই ঢুকে পড়ে, তখন একটা মেন্টাল ক্রাইসিস তৈরি হয়,হয় মারাত্মক ভয় জন্মায় নাহলে সময়ে সময়ে নিজেই Vulgar হয়ে ওঠে। আবার এই দুর্বল মানুষ গুলো হয়তো এই ধরনের কোন মানুষের সঙ্গেই মেলামেশা করেন নি,তবুও কখন যেন মনের কোনে একটু একটু করে এই খুনে রোগ বাসা বাঁধে। কোনও একটা ডেঞ্জারাস গল্প বা থ্রিলার সিনেমার চরিত্রের মধ্যে নিজেকে খুঁজে নেয় অবলীলায়। আর সেই চরিত্রে ঢুকে সে খুব মজা ও পায়, ভাবতে থাকে ঠিক এরকম টা আমিও করবো,কারন এটাই করা উচিত। যারা যারা ঝগড়াঝাটি করে বা যাদের কথাবার্তা পছন্দ হচ্ছে না বা প্রেমের বিচ্ছেদের কারন যদি কোন মহিলাই হয়ে থাকেন, তো তার শাস্তি পাওয়া উচিত। আর সেটা খুনের রক্ত দিয়েই বা হোক না কেন!”— বলেই থামলেন ডক্টর বিশ্বাস।
মিনিট কয়েকের ডিফারেন্সে প্রায় হুড়মুড়িয়ে এসে চেম্বারে ঢুকে পড়লেন অতিরঞ্জিত এক সুবেশী ভদ্রমহিলা। লেয়ার কাট চুলে হাইলাইট করা শার্ট কলারের হাফ কুর্তি আর ক্যাজুয়াল সাদা প্যান্ট সঙ্গে পেন্সিল হীল জুতো। হাতে বক্স ভ্যানিটি ব্যাগ, নখে স্টোনের ডিজাইন। যতটা বর্ধিঞ্চু ভাবানোর চেষ্টা করুন না তিনি কোথাও যেন বড্ড বেমানান তাঁর চরিত্রের সঙ্গে। সাইকোলজিস্ট ডক্টর বিশ্বাস স্থির দৃষ্টিতে মেপে নিয়ে বললেন, “Appointment করে এসেছেন?”
তৃষা তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো – “না ম্যাডাম, প্রত্যেকের নাম আগে থেকেই লেখা আছে,আর তারা সব্বাই উপস্থিত চেম্বারের বাইরে। উনি তো ছিলেন না কই! – আপনি কে? এভাবে Appointment না করে আসতে পারেন না!”
“ভেরি সরি ম্যাডাম ডিস্টার্ব করলাম বলে! আসলে এখনি যে পেশেন্টটি আপনার চেম্বার থেকে বেরোলো, সে আমারই একমাত্র ছেলে। ও কি বললো আপনাকে? আসলে আমি না ওর পিছু নিয়েছিলাম। বাইরেই গাড়িতে বসেছিলাম, ও দেখেনি আমায়। দেখলে রক্ষে ছিল না আমার। প্লিজ, বলুন না কি বললো আপনাকে? আ-আচ্ছা, আপনি পারবেন ওর সমস্যাটা থেকে বের করে আনতে?? পারবেন?”
“আপনি বাইরে Counter এ গিয়ে কুনালের সঙ্গে আপনাদের ডিটেইলস বলে যান With Phone Number. আমরা যখনই আপনাকে কল করবো কাইন্ডলি চলে আসবেন। বাড়ির কাছের মানুষের সহযোগিতা ছাড়া কোন মানসিক রুগীকে সুস্থ করে তোলাই মুশকিল।”
“কিন্তু, ম্যাডাম–“
” প্লিজ, অনেক পেশেন্ট বহুদূর থেকে এসেছেন তাঁদের সমস্যা নিয়ে, আপনি আসুন এখন। ঠিক সময়েই ডেকে নেব আমি। প্লিজ–“
।। ৩ ।।
হঠাৎ কালবৈশাখীতে করিডরে কাঁচের জানালার গ্রীল ভেদ করে আছড়ে পড়ছে বৃষ্টি। গমকে গমকে ঝাপটা দিয়ে চারিদিক ভিজিয়েই চলে যাচ্ছে সঙ্গে তীক্ষ্ণ বিদ্যুতের ঝলকানি। মেঘ ভাঙা বৃষ্টির সঙ্গে যেন অযাচিত ঢাকের কাঠি। করিডরে ঘষা কাঁচের জানালা দেওয়া হলেও এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে বাড়ির কাজের মেয়ে রেনু পর্দা ফেলতে ফেলতে দেখলো যে, গেটের বাইরে যেন কেউ একজন গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওই বৃষ্টিতে। জানালার কাঁচ খুলতে যেতেই কিছু দূরেই মেঘের হুংকারে ভয়ে জানালা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে দৌড় লাগালো।
“কি-রে! ভয় পেয়েছিস? বারান্দাতেই বা যাস কেন এত ভয় যদি তো ? “– ডক্টর বিশ্বাস ড্রয়িংরুমে টুকরো টুকরো কিছু কাজ নিয়ে নিজের মনেই ব্যস্ত তখন।
“দিদি… ও দিদি… বারান্দায়…. “–
“টুং-টুং টুংটাং “– দুবার পরপর বেল বাজতেই একটু অদ্ভুত ভাবে রেনু’র দিকে তাকাতেই দেখেন, রেনু ভয়ে বারান্দার দিকে আঙুল দিয়ে কিছু দেখাচ্ছে সে। চকিতে চোখ বারান্দায় রাখতেই আঁৎকে থতমত খেয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বললেন, “একি! আপনি? আপনি সুতনু বাবু না? সেদিন চেম্বারে এসেছিলেন? তাই না?”
কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না বললো বাইরে দাঁড়ানো ছেলেটি। কিন্তু হাতজোড় করে রিকোয়েস্ট করছে বাড়িতে ঢোকানোর জন্যে সে।
সামান্য ইতস্তত করে করিডর ছাড়িয়ে গ্রীল দেওয়া পেল্লাই কাঁচের গেটটা খুলে দিলেন ডক্টর বিশ্বাস। চোখের পলকে খোলা জানালা থেকে সরে প্রায় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লেন সুতনু।
কাক ভিজে সপসপে হয়ে ঢুকেই বললেন,–“একটা টাওয়েল হবে? কেমন ভিজে গেলাম দেখুন। উফ, কি বৃষ্টি, কি বৃষ্টি!”
রেনুও ডক্টর বিশ্বাসের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসায়, কথাটা শুনেই দৌড়ে ঘরে ঢুকে গিয়ে একটা লাল চেকের গামছা এগিয়ে দিতেই প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে সারা শরীরে একপ্রকার জড়িয়ে নিলেন সুতনু। যেন কিছু একটা ঘ্রান খুঁজে চলেছেন মনে হল ডক্টর বিশ্বাসের।
হঠাৎ চোখ ঝলসে ওঠায় সম্বিৎ ফিরে আসলে তড়িঘড়ি করে একপর্যায়ে ঝড়ের বিরুদ্ধে গিয়ে গেটটা লাগিয়ে দেন ডক্টর। পিছন ফিরে অবাক হয়ে দেখেন যে মাথা চুঁইয়ে জলের ধারা, সপসপে ভেজা শরীর,পায়ের পাতায় জলে কাদায় মাখামাখি, অথচ কেমন যেন গামছাটা নিয়েই ব্যস্ত সুতনু।
“মি.চন্দ! মি.চন্দ! আপনি মাথাটা মুছে নিয়ে পরিস্কার হয়ে ভেতরে আসুন। আপনি তো পুরোই ভিজে গেছেন,এই বাদলায় বেরিয়েছেন কেন? তাছাড়া আমায় জানিয়ে আসা উচিত ছিল আপনার!…হ্যালো, মি.চন্দ! শুনতে পাচ্ছেন?” — প্রায় সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরেই জানতে চাইলেন ডক্টর।
“কি দারুন ওয়েদার বলুন ম্যাম! তার সঙ্গে এই লাল রক্তের গামছাটা, আহা রে!”
রেনু ভয়ে গুটিয়ে যায়, ভয়ে তীব্র গতিতে মিলিয়ে যায় বারান্দা থেকে।
দৃঢ়ভাবে ডক্টর বিশ্বাস ড্রয়িংরুম দেখিয়ে বললেন — “ভিতরে আসুন, গামছাটা বাইরে রেখেই আসবেন। আমি ভিতরে যাচ্ছি।”– বলেই হনহনিয়ে বাড়ির অন্দরে চলে গেলেন।
সুতনু ঢোকার আগেই নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছিলেন ডক্টর বিশ্বাস। একটা ফোন কল করেই ফোনটা রেখে সামনে তাকিয়ে দেখেন সুতনু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। সামান্য অপ্রস্তুত হলেও সামলে নিয়ে বললেন — “বসুন। যে-ভাবে ভিজে গেছেন আমার তো কিছু করার নেই আপনাকে ফিরে যেতে বলা ছাড়া। আপনি কি এক কাপ চা খাবেন? কিন্তু, একটা কথা বলে রাখি, এই অবস্থায় চা খেলে ঠান্ডা গরম লেগে যেতে পারে। ভেবেই বলুন,তাহলে চা দিতে বলবো। তবে, একটা কথা জানার আছে, আপনি আমার বাড়ির ঠিকানা জানলেন কি করে?”– চোখে চোখ রেখে জানতে চাইতেই…
“ও আমি জেনে নিয়েই এসেছি, আপনার ভয়ের কোন কারন নেই, আমি আপনার কোন ক্ষতি করবো না। আমি কাজেই বেরিয়েছিলাম,তারপর ফাঁকি দিয়ে চলে এলাম আপনার কাছে। আসলে সব্বার কাছেই না আমার সব কথা শেয়ার করেছি, কিন্তু কেউই আমার বন্ধু হতে পারেননি। খালি প্রেসক্রিপশন লিখবার তাড়া। এই ওষুধ খাও, সেই ওষুধ খাও। আরেহ, বোঝে না কেন আমার সমস্যাটা কি? আপনাকে আমার একটু হলেও ভালো লেগেছে, কোন মেডিসিন দেননি এখনো।
আর হ্যাঁ, চা খাবো না,খাই না। ভালো লাগে না আমার। আসলে আমার না কিছুই ভালো লাগে না,কি করি বলুন তো ? আজকাল তো সুইসাইড করতে ইচ্ছে করে আমার। কারন দেখুন আপনি,কাউকেই তো আজও অব্ধি খুন করতে পারলাম না,তো আমার বেঁচে থেকে কি লাভ? যে জীবনে আমার সমস্ত সাধ-আহ্লাদ পুরণের বালাই নেই,কি হবে এমন জীবন রেখে ?”– ভাবলেশহীন মুখ তাঁর।
শান্ত ধীরস্থির ভাবে সুতনুর দিকে তাকিয়ে বললেন ডক্টর বিশ্বাস –” এই অবস্থায় আপনার সঙ্গে কি আলোচনায় যাই বলুন তো? আপনার এভাবে আসাই উচিত হয় নি,এত ঝড়,জলে কেউ বেরোয়? কি দরকার ছিল এই পরিস্থিতিতে অফিস থেকে বেরোনোর? “–
ঘড়ির দিকে বার বার দেখতে দেখতে বললেন –” কল এলো ব’লে বসের। আমি এক্ষুনি চলে যাই,নাহলে সমস্যা হবে, এই দেখুন কেমন কল করছে বার বার! “– ভীষন অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর চেহারায়।
“হ্যাঁ, আপনার কাজ ছেড়ে আসাই উচিত হয়নি এভাবে। যাক গে, সময় নিয়ে আসুন কিছু জানার আছে আমার। আপনার বাড়ির প্রত্যেক সদস্যদের কাছেও কিছু কথা বলার আছে।”
জাম্প দিয়ে যেন উঠে দাঁড়ালেন সুতনু। রক্তচক্ষু করে বললেন, “কাদের সঙ্গে কথা বলবেন, বাড়ির লোক? তারা আবার কারা? (হেসে ফেলে, অনেক টা-ই তাচ্ছিল্যের সুরে) আমার বাড়িতে যারা থাকে তারা আবার মানুষ নাকি?… দূর, বার বার ফোন আসছে আমায় যেতে হবে এখনিই।” — অনেকটাই স্বাভাবিক কিন্তু বিরক্ত গলায় বলে উঠলো।
“এত ঝামেলা৷ নিয়ে আসবেন না আপনি, দেখুন আপনি যদি সত্যিই মনে করে থাকেন যে আপনি সুস্থির হতে চান, সেখানে আমি কিন্তু কোন Compromise-এ যাব না। আমায় টাইম দিতে হবে, আপনার ছোট থেকে এখন অবধি, মানে বড় হওয়া পর্যন্ত আমার সমস্তটাই জানা চাই। সেই ছোট থেকে এখন অবধি। কিচ্ছু বাদ দেওয়া যাবে না। তাই –“
কথা ছিনিয়ে নিয়ে সুতনু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমাকে যেতে হবে এখন। নাহলে চাকরি চলে যাবে। (বাইরে কড়কড় করে বাজ পড়লো কাছে পিঠে কোথাও, চমকে দুজনেই বাইরের দিকে তাকালেন) আপনি একা থাকেন নাকি বাড়িতে? আর লোকজন কেউ নেই? আপনি বিয়ে করেন নি??”– তীক্ষ্ণ চোখ আর ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি রেখে তাকিয়ে দেখেই বেরোতে উদ্যোগ নিলেন।
” এক মিনিট, আমার বাড়িতে কে আছে কি নেই, আপনার জানার দরকার নেই, তবে আপনার বাড়ির সবার সঙ্গেই আমি কথা বলতে চাই, আপনি সময় নিয়ে Appointment নিয়েই আসবেন। সুস্থ হতে চান তো!”– গভীর দৃষ্টিতে চোখ রাখলেন সামনে দাঁড়ানো অস্থির ছেলেটার দিকে। তাছাড়া এখন এসেছিলেন কেন? সেটা অন্তত ক্লিয়ার করে যান, তাছাড়া বাইরে যেভাবে ঝড়বৃষ্টির তান্ডব চলছে তাতে আপনার বেরোনোই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। বসুন আপনি।”
অনেকটা বাধ্য ছেলের মত বসে সুতনু বললো, “ভাবছি আমি নিজেই নিজেকে খুন করে ফেলি। কাউকেই তো মারতে পারলাম না!” — দৃষ্টি স্থির তার।
“Qualification কি আপনার? কি কাজ করেন? আচ্ছা ছোটবেলার কথা কিছু মনে পড়ে আপনার? কেমন কাটিয়েছেন আপনি, মনে পড়ে কিছু ?? “–
“আমি সাইকোলজির স্টুডেন্ট। মাস্টার্স করেছি। কিন্তু লোকে আমাকেই পাগল বলে, জানেন? ভালো কাজ কেউ পায় না আজকাল, যেখানেই টাকা খাওয়াবেন, সেখানেই আপনার কাজ পাক্কা। একটা ভালো কোম্পানি তে চাকরি পেয়েছিলাম , কিন্তু বসে’র দাবি — তার সঙ্গে ডেলি একবার শারীরিক সম্পর্কে থাকতেই হবে। খুব একটা খারাপ লাগতো না আমার… তবে বড্ড টর্চার করতেন, রেপ করেও বলতে পারেন। একদিন দিলুম ঘুঁষি মেরে সহ্য করতে না পেরে, ব্যস চাকরি খতম, কিন্তু পুলিশেও বলতে পারেনি, আর কোনদিন কারুর সর্বনাশও করতে পারবে না। ব্যাটাকে এমন জায়গায় দিয়েছি না, ব্যাটা না পারে বলতে না পারে কিছু করতে।”– একটানা বলে যেন কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো সে।
“আপনি আপনার প্রত্যেকটা মূহুর্ত শেয়ার করুন,মানে ছোট থেকে যা যা মনে পড়ে আপনার।”
সুতনু কিছুটা থতমত খেয়ে বললো, ” মনে তো অনেক কিছুই পড়ে, কিন্তু কতজনকে খুন করবো। এই ধরুন, আমার যখন পাঁচ কি ছ’ বছর বয়স, তখন একজন লেডি টিচার পড়াতে আসতেন। আমি পড়ায় কোন ভুল করলেই আমার গোপনাঙ্গ ধরে টেনে রাখতেন,খিমচি কাটতেন, আর দিনে দিনে সেটা বাড়তেই থাকলো। ম্যাডাম এসেই আমায় কোলে বসিয়ে পড়াবার নাম করে আমার গোপনাঙ্গ নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন। ভালোও লাগতো আবার খারাপও লাগতো। আমার খুব ছোট থেকেই কিন্তু ওই–ওই ইচ্ছেটা হয় বা আছে বলতে পারেন। তবে, কষ্ট হলে প্রতিবাদ করলে বলতেন যে, কাউকে বললে ওটা কেটে ফেলে দেবো। বরং Enjoy কর। একটা সময় সেটা ডেলি রুটিন হয়ে দাঁড়ালো। আমি সেবার ক্লাসে ফেল করলাম। স্কুল থেকে বাবা-মা’কে কল করলেন প্রিন্সিপাল। বাবা তো গেলেনই না, মা যদিও গেলো, প্রিন্সিপাল বললেন, ছেলের প্রতি নজর দিন,ও কি অসুস্থ? এরকম কালসিটে রোগাক্রান্ত হয়ে গেছে মনে হয়। কোন সমস্যা নেই তো, রেজাল্ট তো চূড়ান্ত খারাপ। এটা কেন হল? কিছু সমস্যা হয়েছে কি ওর?”
“বাড়ি ফিরতেই আমাকে দুমদাম উত্তম মধ্যম পিটিয়ে বাবার আর মায়ের রাগ গিয়ে পড়লো টিউশন টিচারের উপর। ছাঁটাই করা হলে নিস্তার পাই সে যাত্রায়। আসলে, অনেকবারই বলতে চেয়েছি বাড়ির সবাইকে, কিন্তু ওরা তো নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। বাবার এক সুন্দরী প্রেমিকা আছে, বাবা তার কাছেই বেশিরভাগ রাত কাটাতেন, মা’ও সেই রাগে চ্যালেঞ্জ ঠুকে একই যুদ্ধে নেমে পড়ে। তিনিও একজন প্রেমিক জুটিয়েছেন। আর, এই দু’জন স্বামী স্ত্রী যখন একই ছাদের তলায় মুখোমুখি হন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও হার মানাবে সব কিছুকে। অশ্লীলতার সংজ্ঞা নিরূপণে কর্তৃপক্ষ এগিয়ে বলতে পারেন”
কিছুক্ষন মাথানত করে ফের মুখ তুলে সুতনু বললেন, ” জানেন ম্যাডাম, এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আমার মাসিমনি আমায় খুব হেল্প করেছে। যদিও ওই ধরুন আমার বয়স বারো কি তেরো! শুধু মাসিমনি নয় জ্যেঠুও। আর এদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমি সেক্সুয়ালি একটিভ ছিলাম!”
“হোয়াট ??…কি যা তা বলছেন? আপনার নিজের মাসি, নিজের জ্যেঠু? আপনার সঙ্গে???”
“ইয়েস। আমার একটুও খারাপ লাগতো না,উলটে ভালই লাগতো। দারুন মজা পেতাম, তাই তো ওদেরকে আমি এত পছন্দ করি!”– মুখে নির্বোধ হাসি ছড়িয়ে পড়লো।
রাগান্বিত ডক্টর বিশ্বাস বললেন, “বাড়াবাড়ি রকমের মিথ্যে বলছেন আপনি! পাঁচ-ছয় বছর বয়সে কোন বাচ্চার এই ধরনের ফিলিংস থাকতে পারে না। আপনি এসব বানিয়ে বানিয়ে বলছেন। সঠিক সত্যিটাই শুনতে চাই আমি। বাজে মিথ্যে গল্প শোনার টাইম নেই আমার।”
“হয় হয়, পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু হয়,যা সায়েন্স দিয়ে বোঝানো যায় না। Exceptional বলে একটা কথা আছে। তাছাড়া চোখের সামনে ঘটতে থাকা যা কিছু খুব সহজেই বাচ্চারা শিখে নেয়। আর বড়দের কাজগুলো করতে আরও বেশি করে আনন্দ পায়, আপনি সবই জানেন, আমি আর কি বলবো। যাক গে, আজ যাই, ঝড় থামলো মনে হয়,এবার বেরোই। না জানি বসের কি ঝড় শুরু হবে। ছেড়ে দেব কাজ। বড্ড জ্বালায় বস। আর ননস্টপ ফোনে তাড়া, এটা করো, সেটা করো। ধুর ব্যাঙ।” — উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত বারান্দায় গিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে বিকৃত হাসি হেসে বললো, “যাকে ডাকলেন, সে তো এলো না! আসবে কি করে ??”– বলেই চকিতে বেরিয়ে গেলো।
।। ৪ ।।
অবাক হয়ে পেছনে ধাওয়া করলেন ডক্টর বিশ্বাস। বাইরের গেটে বড় একটা তালা ঝোলানো। অথচ সুতনু কোথাও নেই। গেটের কাছে গিয়েই বুঝলেন শুধু তালা নয়, সঙ্গে চাবিও ঝুলছে,কিন্তু ভিতর থেকে আটকানো। বৃষ্টির ঝাপটা সামলে নিয়ে কোনরকম তালা খুলতেই দেখে ডক্টর বিশ্বাসের হাসবেন্ড মি: বিশ্বাস সঙ্গে পুলিশের গাড়ি নিয়ে গেটের কাছে এগিয়ে আসছেন।
উৎকন্ঠিত হয়ে জানতে চাইলেন, “তুমি ঠিক আছো?? ফোন ধরছিলে না কেন?? এতবার ফোন করলাম! কে ওই ছেলেটি? ও দেওয়াল টপকে পালালো কেন? কে ও??”
“দেওয়াল টপকে?? তার মানে ওই গেটে তালা লাগিয়েছে, যাতে কেউ না আসে! অদ্ভুত তো!”
“মেডাম, সোব ঠিক আছে? সোনাদানা, টাকা কি কি নিয়েছে ও? বন্দুক ছিল সঙ্গে? আর কেউ ছিল কিনা বলতে পারবেন? ও এক্ষুনি ধোরা পড়ে যাবে, আমাদের লোক ধাওয়া করেছে উর পেছনে। যাবে কোথায় ব্যাটা!” — একজন অফিসার গোছের কেউ এগিয়ে আসতেই ডক্টর বিশ্বাস বললেন–” আরে না না, ভুল করছেন আপনারা। ওই ছেলেটি আমার পেশেন্ট। ও আমার ক্ষতি করতে আসেনি। সে হলে অনেক আগেই করে বসতো, সে সুযোগ ওর কাছে অনেক ছিলো। — কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েই বললেন — ওকে ধরবেন না, ও ভুল করেছে, কিন্তু কোন ক্রাইম করেনি। উলটে ওর হেল্পের প্রয়োজন খুব। বৃষ্টি ফের বাড়ছে, চলুন ড্রইংরুমে বসে কথা বলি,ভিতরে আসুন।” — বলতে বলতে ডক্টর বিশ্বাস কাঁচের গেট ঠেলে ঢুকে গেলেন।
বৃষ্টির ঝাপটায় কম বেশি সকলেই প্রায় ভিজে গেছেন। স্থানীয় অফিসার নবাতুল কালামের মধ্যপ্রাচ্যে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে বৃষ্টির জন্য। অনেক করেও সামলাবার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন একজন ডক্টর ভদ্রমহিলার সামনে নিজেকে প্রেজেন্ট করবার জন্য।
মি: বিশ্বাস সোফায় বসতে বললেন অফিসার কালামকে।
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন –“ভারী যত্নশীল সাজায়েছেন, বলে কি সুন্দর আছে ঘরখানা। নিশ্চই মেডামের চোখ দিয়ে সাজায়েছেন মি: বিশশওয়াস!”–একটা দাঁত না থাকায় এই অবাঙালী অফিসারের মুখে বেশ লাগছিলো কথাগুলো। পিছন ফিরিয়ে মৃদু হেসে ডক্টর বিশ্বাস বললেন, “বাড়িটা আমাদের একটি মাত্র কন্যাসন্তান তার নিজের মত করে রূপ দিয়েছে।
“আপনারা বসুন, আমি বরং কফির ব্যবস্থা করি।”
“না মেডাম, অন ডিউটি আছি। কফি অন্যদিন হবেক্ষন। আজ জেনে নিই, ঠিক কি হয়েছিল, ওই ল্যাড়কাটা কেনো এসেছিলো, মোতলব কি ছিলো?”
ডক্টর বিশ্বাস ড্রয়িংরুমের কোনে একটি ইজিচেয়ার এ বসে গায়ে হাতে পায়ের জল মুছতে মুছতে বললেন, “ছেলেটি একটি মেন্টাল পেশেন্ট। সাধারণত মেন্টাল পেশেন্ট রা বুঝতে চায় না বা পারে না যে তার চিকিৎসার প্রয়োজন আছে, অনেকে তো নিজেকে অসুস্থ বলে মানতেও চায় না,কিন্তু ব্যতিক্রমীও তো আছে,এই ছেলেটি তাদের মধ্যে একজন। যদিও স্টিল নাউ বেশ কিছু মিথ্যে বলে যাচ্ছে, সেটার কারন অবশ্যই জানতে হবে,আর জানতে হবে Actually ও কি চাইছে!”
“এ তো মারাত্মক জটিল কেস–“
“সে হোক, কিন্তু তুমি জানতে না, যে ও বাইরে থেকে লক করে ঢুকেছে??” — বিস্মিত প্রকাশ করে মি: বিশ্বাস জানতে চাইলেন।
“না তো! আমিও তো তাই ভাবছিলাম যে, তোমাকে ও রুমে ঢোকার আগেই কল করেছি! অথচ আসছোই না। উলটে, আমাকে বললো… কোন ভয় নেই ম্যাডাম, আপনার কোন ক্ষতি করবো না!”
“ও কিসের প্রোব্লেম নিয়ে আসলো?”
“Fragmentation বলতে পারেন। কাছের মানুষরা যখন গ্রহনযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে,তখন শিশু মন নিজেকে প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আর তার থেকেই জন্ম হয় রাগ,হিংস্রতা। ইনিও ঠিক তারই নিদর্শন। ছেলেটি, শৈশবেই মানসিক এবং শারীরিকভাবে ভয়ংকর নিপীড়নের সামনে পড়েছে।ছোট অবস্থায় একজন লেডি টিচার তো রীতিমতো সেক্সুয়ালি হ্যারাস করতেন, ভীষণ নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি, আর যখন ওর বাবা-মায়ের সান্নিধ্যতার ভীষণ ভাবে প্রয়োজন ছিল।কিন্তু আফসোস — আত্মকেন্দ্রিক পেরেন্টস শুধু নিজেদেরকে নিয়েই মজে ছিলেন, আর কখন যেন শিশুটি পায়ে পায়ে রাগ, দুঃখ, কষ্ট গুলোকেগোপন করতে করতে আত্মবিদ্বেষী হয়ে উঠেছে।ওর মধ্যে তৈরি হয়েছে এক আদিম রিপু। কোন এক অজান্তে শিখে গেছে যৌনতার আগ্রাসন। এই যৌন আগ্রাসন কেউ কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, কেউ বা পারেই না। সহজাত ইম্পালসের বশবর্তী হয়ে প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ও হয়। আবার কিছু ব্যক্তি Basic Instinct বেশি করে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েই ফেলে। আর এরপর তো আমাদের অগ্রগতির কিছু প্রতিফলন আছেই। টেলিভিশন, টিভি সিরিয়াল, ক্রাইমগুলো দেখানো, পারিবারিক হিংস্রতা সঙ্গে পালটা হিংসা দেখানোর নানান কৌশল সবই দেখানো হচ্ছে। আর যাদের মনে অলরেডি এই রোগ জমে বসে আছে, সে সবার আগেই আগ্রহ নিয়ে শিখে প্রয়োগের চেষ্টা করবেই। মুলকথা যেটা হল যে, ছোট থেকেই ছেলেটি শারীরিক নিগ্রহের শিকার। আর সেই ব্যাপারে পেরেন্টসদের কোন সহযোগিতা পায়নি ও। এছাড়াও যেটা ঘটেছে ওর সাথে,সেটা হল ওর বাবা-মায়ের দু’জনেরই অবৈধ Affair। সমস্ত রাগ,অনুভূতি গুলো জট পাকিয়ে গেছে ওর , মনে হচ্ছে সব্বাই এরকমই হয়। অথচ ও একজন সাইকোলজির স্টুডেন্ট। চাকরিও করে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। কিন্তু মাঝে মাঝেই নিজের রূপ পরিবর্তন হয়ে যায়, যেটা ও তখনই বোঝে না,ঘটে যাওয়ার পর বুঝতে পারে। তাই ও আমার কাছে ছুটে আসে বার বার। অনেক সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছে,প্রায় সব ডক্টরই Anger Treatment করাতে বলেছেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল ও’ নিজে বুঝতে পারে ওর প্রব্লেমটা। এখন সেখান থেকে বের করে আনাটাই হবে আমাদের কাজ। তাই বলছি, ওকে অ্যারেস্ট করবেন না—না হলে উন্মাদ তো হবেই সঙ্গে ভয়ংকরও হয়ে উঠতে পারে। এখনো ওর সুস্থ হওয়ার আশা আছে। ওকে অ্যারেস্ট করলে ওর চাকরির ক্ষতিও হবে। প্লিজ অফিসার, সমস্যাটা নিশ্চই বোঝাতে পেরেছি!” — বলেই চোখ থেকে ধোঁয়াশা ভরা চশমাটা খুলে মুছে নিয়ে পরে অফিসারের দিকে তাকাতেই বুঝলেন যে, ঠিক যেন মাথার উপর দিয়ে হুশ করে একটা প্লেন উড়ে গেছে, ধরতেই পারেনি।
ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি, স্থির দুটো অপলক চোখ ডক্টর বিশ্বাস এর উপর। আধখানা ঠোঁট প্রায় মধ্যপ্রদেশ ছুঁই ছুঁই।
অতিকষ্টে হাসি চাপলেন মি: আর মিসেস বিশ্বাস।
ঠিক সেই সময়েই ভোজপুরী সুরে ছন্দে ঝনঝনিয়ে তারস্বরে একটা গান বেজে উঠলো। চমকে উঠলেন সবাই। কিন্তু সব্বাইকে চমকে দিয়ে একপ্রকার জাম্প দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অফিসার, পকেট থেকে ফোনটা বের করে বুকে হাত দিয়ে ফের ধপ করে বসে পড়লেন।
মি: & মিসেস বিশ্বাস চোখ চাওয়া চাওয়ি করার আগেই ফোনটা কানে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “যোখোন তোখন কোল দিস কেনো? বলে কিনা, আমার হার্টটা তো খুলে পড়ে যাচ্ছিলো। ওদ্ভুদ তো তোরা! কি! কি হয়েছে কি? লোকটাকে ধরলে ছেড়ে দে, কামড়ে দিতে পারে কিন্তু! (কিছুটা গ্যাপ দিয়ে)…সেকি রে… চা খাবে বলছে? ওকে ছেড়ে দে বাবা, ও তোদের লাঠি ছাড়িয়ে তোদেরই পিটাবে। ছেড়ে দে ছেড়ে দে, এক্ষুনি ছাড়!” — বলেই ফোনকল না কেটেই পকেটস্থ করলেন।
“দেখিয়ে স্যার জি, ম্যাডাম জি–আপনাদের কোথায় ছেড়ে দিতে বললাম। কোন ক্রাইম করলে কিন্তু আর ছাড়া পাবে না। আচ্ছা ওর কি ট্রিটমেন্ট করবেন আপনি?”
“পৃথিবীতে যত ক্রাইম দেখছেন না, হয় কেউ পেটের তাগিদে করছে, নয় তো সংসারের চিকিৎসার খরচ চালাতে করছে, না হলে যারা Desperate Attempt করছে, তারা কিন্তু একধরনের Mental Patient-ই। যারা খুনের হুমকি দেন, তারা যে খুন করবেই এমন নয় কিন্তু। আর আপনারা হয়তো তাদেরকেই অ্যারেস্ট করে বসলেন। খুন কেউ বলে কয়ে করে না। তবে হ্যাঁ, বিশেষজ্ঞদের মতে এরা মারাত্মক হয়ে ওঠে। এদের Suicide & Homicide-এর কেসই বেশী। এরা Schizophrenia-তে ভোগে। লাস্ট ১০ বছরের মধ্যে দেখা গেছে শতকরা ৪৪ জন, যারা খুনের হুমকি দিয়েছেন, তারা পরে বেশ কিছু হিংস্র কাজের সঙ্গেও জড়িয়েছেন। এই ধরুন না, এই পেশেন্টটির কথা বলি। যখন এই পেশেন্টটি অন্য কাউকে আঘাত করতে চান, কিন্তু পারেন না, ভয়ে ঘর ছাড়া হয় বাড়ির লোকজনেরা ওর রক্তচক্ষু দেখে বা হাতে ছুরি দেখে, তখন কোনো এক অজান্তে নিজের হাতই ফালাফালা করে কেটে ফেলছেন তিনি ছুরি দিয়ে। এদের কার্যকলাপ হোমিসাইড এই ইনভলভড। এবং শতকরা ১৯ জনের মধ্যে দেখা গেছে যে এরা নিজেকেই মেরে ফেলেছে অভিমানের বশে। এই ছেলেটিও ঠিক একইরকম। বাড়িতে ঝামেলা শুরু হলেই ওর স্বাভাবিক সুস্থতা হারিয়ে ফেলে, হয়ে যায় একজন খুনী। ছুরি হাতে তুলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে এগিয়ে যায় বাড়ির লোকেদের দিকে। এর থেকে যদিও দুটো উপকার হয়েছে ওর বাড়িতে। ওর বাবার বহুবছরের বিবাহবহির্ভূত প্রেমিকা যাকে তিনি ওদেরই বাড়িতে রাখতে চেয়েছিলেন, সেটা ছেড়েছেন ছেলের ভয়ে। মা-ও তাই করেছেন।অবশ্য ওর মায়ের বক্তব্য যে, ওনারা নাকি ছেলেটির ছোটবেলার নির্যাতনের কথা জানতেনই না।এবার বুঝুন তাহলে, এত কিছুর পরও ছেলেটির প্রথম বসও শারীরিক টর্চার করতো। খুব স্বাভাবিক ভাবেও যদি ভাবেন, এরকম অবস্থায় কোন সাধারণ মানুষ ও ক্ষিপ্ত হয়ে মারমুখী হবেই। এভাবে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে অনেক ক্রাইম ঘটে যায়,যা আদৌ হওয়ার নয়। ছেলেটি বিয়েও করতে চায় না, যদি খুন করে ফেলে সন্দেহের বশে! তার মানে দাঁড়াচ্ছে… ছেলেটির সুস্থ হওয়ার আশা অনেকখানি। আমি আশাবাদী যে, ও কাউকেই হার্ম করবে না। ও তো এখন নিজেকেই খুন করতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। আমাকে কিছুদিন সময় দিন ওকে নজরবন্দী করার। চেষ্টা করবো সুস্থ করে তোলার।” — থামলেন অন্যমনস্ক ভাবেই।”
হাঁটু চাপড়ে উঠে দাঁড়ালেন অফিসার। যেতে যেতে বলে গেলেন, “প্রব্লেম হলে জানাইবেন। হামি আছি। কিন্তু, ঘোর আপনার ভারি সুন্দর আছে বটে।” — বলেই বেরিয়ে গেলেন বুটের খটখট শব্দ তুলে।
।। ৫ ।।
বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ খানিক আগেই। ঝড় তার রেশ রেখে গেছে।
এরই মাঝে কাজের মেয়ে রেনু এসে মেঝে পরিষ্কার করে দিয়ে দু’কাপ কফি দিয়ে যায়। গজগজ করে মৃদুস্বরে, “দুনিয়ার নোংরা কাদা নিয়ে সব হাজির হোলো, আর বারান্দা থেকে ড্রয়িং সব চুপচুপে কাদায় মাখামাখি। দূর… যত্ত পচা লোকজন।”
রেনুর কথা শুনে মিস্টার আর মিসেস বিশ্বাস দুজনেই হেসে ওঠে।
মিস্টার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলে উঠলেন, “যদি মারাত্মক হার্ম করে বসে কাউকে,কি করবে? অথবা নিজের ওপর যদি টর্চার করে তো?”–
“অসুখ টা তো একদিনের নয়, ও কোন প্রফেশনাল ক্রিমিনালও নয়, ওর নিজের একটা বাঁচবার ইচ্ছে তো আছেই সেটা তো স্পষ্ট। নাহলে এতদুর পড়াশোনা করে চাকরি করতো না, নতুন করে ওকে কেউ আঘাত তো দেয় নি, যদিও ওর কথা অনুযায়ীই এগুলো বলছি। সুতরাং, একটা কথা ভাবা যেতেই পারে যে, ও নিজেও নিজের অসুস্থতা থেকে বেরোতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। একটা Hallucination-এর মধ্যে হঠাৎ করেই ঢুকে পড়ে যে, কেউ যেন ঝগড়া করছে, বা কেউ কথা বলছে, হয়তো ওর ক্ষতি করবে বা ওর সম্বন্ধে কিছু আজেবাজে বলছে, আর ঠিক তখনই ছেলেটির মাথায় খুন চেপে যায়, কারণ ওদের দ্বারা ওর ক্ষতি হতে পারে সেটা ভেবেই। কিন্তু সেটাও সাময়িক কাজ করে বেশিরভাগ পেশেন্ট দের ক্ষেত্রে। অবশ্য Exceptional তো আছেই। সুতনু কিছুটা হলেও Exceptional — কারন, ও মানুষ খুন করে শরীরের এক একটা পার্টস বের করে দেওয়ালে ফ্রেম বন্দী করে দেখতে চায় কেন তারা এরকম বা তারা এত ঝগড়া করে কেন, কি এমন পার্থক্য আর অন্যদের থেকে। বাড়ির লোকেদেরই বিশেষ করে বাবা-মা’কেই খুন করে জানতে চায় কি এমন আছে ওদের মধ্যে! কাউকে বিশ্বাস ও করে না, ওর বদ্ধ ধারনা যে, সমস্ত নারী-পুরুষে-ই অন্য নারী বা পুরুষে আসক্তি, তাই পৃথিবীর আলো-বাতাস এত অপ্রিয়কর। তাই সে কাউকেই বিশ্বাস করে না। আর আমার ট্রিটমেন্টটা ঠিক এই জায়গাটা তেই থাকবে। ওর মধ্যে বিশ্বাস জাগাতে হবে যে প্রত্যেকটা মানুষ যেমন আলাদা হয়, আবার একজনেরই বিভিন্ন সময়ে বয়স অনুযায়ী শরীরের যেমন পরিবর্তন ঘটে তেমনি মনেরও পরিবর্তন ঘটেই। তাই সবাই যে যার নিজের মতনই হবে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। আর তা যদি সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে ওই ধরনের রুগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, প্রায় তিনমাসের একটা ট্রিটমেন্ট চলে, বেশিরভাগই কিছুটা হলেও সুস্থ হতে থাকে, খুব কম সংখ্যক পেশেন্ট থাকে যারা স্ট্রেস কাটিয়ে উঠতে পারে না, মারাও যায়। কিন্তু সেগুলো রেয়ার কেস।”
নতুন করে বৃষ্টি নামলো আকাশ জুড়ে। কফির কাপটা হাতে নিয়ে নি:শব্দে ধোঁয়াশা ভরা করিডরে গিয়ে কাঁচ ভর্তি জানালায় হাত রাখলেন।
ঝড়ের দাপট ফের গমকে গমকে আছড়ে পড়ছে বৃষ্টি ভেদ করে। কেমন যেন বৃষ্টিতে কান্না মেশানো মনে হল ডক্টর বিশ্বাসের। অজান্তেই চোখে জল এসে গেল তাঁর। কত শত মানুষ আজ নিজেই নিজের কাছে নিরাপদ নয়। নিজের বাড়িতেও নয়। কোন বিশ্বাসে সন্তানকে অন্যের কাছে রেখে স্বস্তি পাবে, কত পেরেন্টস শুধুমাত্র নিজেদের দোষেই নিজের সন্তান কে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে, এ কোন সমাজে আজ আমরা আছি। আঁৎকে ওঠেন অজান্তেই, যদি এমনটা আমার একান্ত আপনজনের সঙ্গে ঘটতো তো? শিউরে উঠলেন ডক্টর বিশ্বাস। অশালীন ঝড় তাঁর সমস্ত ছাপ ফেলে যাচ্ছে ডক্টর বিশ্বাসের শরীর জুড়ে। হঠাৎ কপালে হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠলেন। কপাল থেকে স্বযত্নে এলো চুলগুলো সরিয়ে বললেন মি: বিশ্বাস, “একটু রেস্ট নাও। বড্ড ক্লান্ত তুমি! এরকম করলে তুমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। তোমার সন্তানস্নেহে ও হয়তো সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। তুমি নিশ্চই পারবে। চলো, একটু রেস্ট নাও চোখ বন্ধ করে।”
।। ৬ ।।
সমুদ্র পিছিয়ে গিয়েই ফের এগিয়ে আসছে হাওয়ায় তাল মেলাতে মেলাতে।
এখন যে জোয়ার।
ঢেউ আছড়ে পড়ছে প্রবল বেগে। শনশনে বাতাসে আর ঢেউয়ের দোলায় আবীরমাখা ভোর যেন স্বর্গের খোলা দ্বার। ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে বালি মেখে মেঠো পথের মত ঢালু পথটা ধরে ছুটতে থাকে সুতনু।
বড় বড় রেলিং পার করে কংক্রিটের বাঁধানো সমুদ্রের পাড়ে শান বাঁধানো রাস্তা ছাড়িয়ে নেমে পরে দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশির পায়ে।
ফেনা ওঠা বালি নুড়ি নীল জলরাশি তার পা ছুঁয়ে যাচ্ছে বার-বার। সী-বীচ ধরে যেন তার ছুটে চলা অনন্ত মহানভে। ক্লান্ত হলেই সে জলরাশির দিকে দু-হাত বাড়িয়ে সুঘ্রাণ নিতে চেষ্টা করে
পকেটে থাকা মিষ্টি সুরে ‘জগতে এই আনন্দ যজ্ঞে’ বেজে উঠতেই খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো, “তুমি ভোরের সূর্য দেখেছো?? আবীর মেখেছো ভোরের সূর্যের কাছে ধার নিয়ে??? সমুদ্র নিজে এসে ছুঁয়ে দেখেছে তোমায় কোনদিন???? পায়ে মেখেছো কখনো সমুদ্র লাল আলতা??? আমি মেখেছি, ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে আমার চোখের লালীমা…আমি পেরেছি,আমি পেরেছি সব দেওয়ালের রক্ত বন্দী ফ্রেম গুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে,তোমার অবদান যে ভীষন -ই অমুল্য! পারলে তুমি একটিবার এসে আমায় দেখে যেও মা’! আমি নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি আজ, কারুর রক্ত মাখতে ইচ্ছে করে না আর। নিজেকে খুন করতেও চাই না আমি- পারলে তুমি এসে দেখে যেও!”
ফোনটা কেটে গেল হঠাৎ করেই… ডক্টর বিশ্বাস এর গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।
রেশ কাটতে না কাটতেই হাতের ফোনটা কেঁপে উঠলো। এক অজানা আশংকায় ভেতরটা কেমন যেন লাগলো তাঁর। কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপার থেকে ভেসে এলো গলা ফাটানো অট্টহাসি। গমকে গমকে ফেটে পড়ছে সুতনু।
চিৎকার করে বলে উঠলো, “মাআআআ—— চারিদিকে শুধু রক্তের ঢেউ… উফফ, কি আনন্দ, কি আনন্দ……”
~ সমাপ্ত ~