Home প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি আমার ভালো লাগা রহস্য রোমাঞ্চকাহিনী
প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

আমার ভালো লাগা রহস্য রোমাঞ্চকাহিনী

“সুব্রত, রাজু আর কিরীটি ডাক্তারের মৃতদেহ ধীরে ধীরে ইরাবতীর বুকে ভাসিয়ে দিল। ঢেউয়ের তালে তালে দেহটা ভেসে চলল। সকলের চোখই অশ্রুভারে ঝলমল করে উঠল। ইরাবতীর শান্তশীতল জলের তলে কালো ভ্রমর ঘুমিয়ে রইলো”।

কিন্তু দস্যু শয়তান কালোভ্রমর কি সত্যিই মারা গেল? না মোটেই না। সে আবার বেঁচে উঠল অন্য কোন নামে অন্য কোনওখানে। আর তার মত শয়তানদের বধ করতে বা শাস্তি দিতে আবির্ভাব হল কখনো কিরীটি, কখনো ব্যোমকেশ, কখনো ফেলুদা, আবার কখনো বা জয়ন্তর। এভাবেই চলল তাদের হাতে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন।  আর তাদের যুক্তি বুদ্ধি রহস্য বিশ্লেষণের জালে আমরাও জড়িয়ে পড়লাম তাদের সঙ্গে।

আমি তখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্স, সেই সময়ই রহস্য রোমাঞ্চর দুনিয়ায় আমার প্রথম প্রবেশ চারটি খন্ডে বিবৃত নীহাররঞ্জন গুপ্তর ‘কালোভ্রমর’ কাহিনীর মাধ্যমে। আমার অনেক পড়া রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীর মধ্যে, আজও সেই কাহিনী আমার মনের মধ্যে রয়েই গেছে। এরপর আমি নীহাররঞ্জন গুপ্তর এমনই অনেক রহস্য কাহিনী পড়েছি, ’বিষের তীর’, ‘অদৃশ্য সংকেত’ ইত্যাদি। ছোটদের এমন সব কাহিনীর জোগানদার ছিল আমার মামার বাড়ীর এক আলমারী ভর্তি রহস্য রোমাঞ্চকাহিনীর বই – লেখক ছিলেন নীহাররঞ্জন গুপ্ত আর হেমেন্দ্রকুমার রায়। অনেক পরে অবশ্য নীহাররঞ্জন গুপ্তর প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা ‘মৃত্যুবাণ’, ‘চক্রী’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘রহস্যভেদী’ – এসব পড়ারও সু্যোগ হয়েছে।

এই সময় আমার হাতে হঠাৎই এসে পড়লো হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী ‘সূর্যনগরীর গুপ্তধন’। বিমল, কুমারের সঙ্গে আমিও চললাম ইনকা সাম্রাজ্য সূর্যনগরীতে গুপ্তধনের সন্ধানে। অনেকের মতে, এ তো রহস্য কাহিনী নয়, অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী। তবে আমার মনে হয় রহস্য দিয়ে যার শুরু, প্রতিপদে যেখানে রোমাঞ্চ, সেটা রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনী হবে নাই বা কেন? এবার পড়ে ফেললাম হেমেন্দ্রকুমার রায়ের যত অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী, ‘হিমালয়ের ভয়ঙ্কর’ থেকে ‘যকের ধন’ সিরিজ পর্যন্ত। তাঁর লিখিত ‘বিশালগড়ের দুঃশাসন’ ভয়ঙ্কর এক জমিদার রুদ্রপ্রতাপের কাহিনী। লোকালয় থেকে দূরে, নিরিবিলি নির্জনতায় চারিদিক পাহাড়ঘেরা নেকড়েদের রাজ্যে এক দুর্গপ্রাসাদে তার বাস। রাত্রি হলেই সে বেরিয়ে পড়ে তার খাবারের সন্ধানে, মানুষের রক্তের খোঁজে। পরে অবশ্য জেনেছিলাম এটি ইংরাজী সাহিত্যের বিখ্যাত কাউন্ট ড্রাকুলার কাহিনী অবলম্বনে লেখা। কিন্তু অপূর্ব দক্ষতায় তিনি (হেমেন্দ্রকুমার রায়) একে বাংলা ভাষার পাঠকদের উপযোগী করে তুলেছিলেন। বাংলায় লেখা হলেও এ কাহিনীর মাধ্যমেই প্রথম আমার ইংরাজী রহস্য সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়। স্যর আর্থার কোনান ডয়েলের ‘The Hound of the Baskervilles’ অনুসারী ‘নিশাচরী বিভীষিকা’-কে তিনি কিশোরদের উপযোগী করে বাংলায় লিখেছিলেন। তার ‘মানুষ পিশাচ’ সম্ভবতঃ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম জোম্বি কাহিনী।  এসবের সঙ্গেই অবশ্য চলেছে জয়ন্ত ও মানিককে নিয়ে তার গোয়েন্দা কাহিনী রচনা। এসে গেছে কমিক রিলিফ পেটুক পুলিশ চরিত্র সুন্দরবাবু।

সেই সময়ে দেব সাহিত্য কুটীর প্রকাশিত পূজাবার্ষিকীর জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কারণ সেখানে থাকত কিরীটির কোনো রহস্য সমাধান এবং জয়ন্ত-মানিকের কোনো গোয়েন্দা কাহিনী।

শরদিন্দু বন্দ্যোধ্যায়ের সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীকে আমি প্রথম দেখেছিলাম’ ‘চিড়িয়াখানা’ সিনেমায়। ব্যোমকেশও তার সহযোগী অজিত যেন স্যর আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস থেকে উঠে এসেছে। ওয়াটসনের মত এখানেও ব্যোমকেশের সহযোগী অজিত তার কাহিনীগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখে। ব্যোমকেশের কাহিনীর বিশেষত্ব হলো, অধিকাংশ কাহিনীতেই হত্যা বা যে কোনোও অপরাধের পদ্ধতিগুলি রীতিমতো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়, অর্থাৎ সাধারণের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। আমার খুব ভালো লাগে – ব্যোমকেশ রহস্য সমাধানের যেসব সূত্রগুলি খুঁজে পান, সেগুলি সবই তিনি, পাঠকদের সামনে উপস্থাপিত করেন, যাতে তার সঙ্গে পাঠকরাও তাদের বুদ্ধি দিয়ে সেগুলোর বিশ্লেষণ করতে পারেন। যুক্তি বুদ্ধির সঙ্গে তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও ফরেনসিক বিজ্ঞানের দক্ষতার কারণে জটিল খুনের মামলাগুলিও তিনি সমাধান করে ফেলেন। তার বেশ কিছু কাহিনী শার্লক হোমসের ভাবানুসারী, যেমন, ‘চোরাবালি’, ‘পথের কাঁটা’ ইত্যাদি। ‘সীমন্তহীরা’, ‘অগ্নিবাণ’, ‘মাকড়সার রস’ এমন কয়েকটি ছোট গল্পের সঙ্গে তিনি বেশ কিছু রহস্যোপন্যাসও লিখে গেছেন যেমন, ‘শজারুর কাঁটা’ ‘দুর্গরহস্য’, ‘মগ্নমৈনাক’ ইত্যাদি। প্রায় সমসাময়িক হলেও শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় তার রচনায় সাধু ভাষা ব্যবহার করেছিলেন, যেখানে হেমেন্দ্রকুমার রায় ব্যবহার করেছিলেন চলিত ভাষা।

আমি তখন সম্ভবতঃ ক্লাস এইট, হাতে এসে গেল স্বপনকুমার লিখিত গোয়েন্দা কাহিনী। মাত্র ৬৩/৬৪ পাতার এই চটি বইগুলির স্বল্প পরিসরের মধ্যে রহস্য কাহিনীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণিত থাকত। দীপক রতনের এই কাহিনীগুলি তাৎক্ষনিক উত্তেজিত করলেও সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়াও যায়।

এরপর বেশ কয়েক বছর পড়াশোনার চাপে আমার রহস্য কাহিনী পড়ায় ভাটা পড়েছিল। আমি অবশ্য থেমে থাকিনি। বাবার আলমারী থেকে নিয়ে ইংরাজীতে লেখা স্যর আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসের কাহিনীগুলো চেষ্টা করে পড়ে ফেলেছিলাম। শার্লক হোমসের বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। আগন্তুকের ভাবভঙ্গী পোষাক পরিচ্ছদ কথাবার্তার ধরণ দেখে তিনি তার সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলে দিতে পারতেন। পরে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা চরিত্রে আমি এমন গুণ দেখেছিলাম।

সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদার, ভারতের যেকোন স্থান – সমুদ্র, পাহাড়, জল জঙ্গল, মরুভূমি শহর এমনকি গুহাতেও অবাধ গতিবিধি। তবে ‘যত কান্ড কাঠমান্ডুতে, ‘টিনটরেটোর যীশু’ বা ‘লন্ডনে ফেলুদা’-তে তিনি বিদেশেও গিয়েছেন। সবসময়েই তার সঙ্গে থেকেছে তোপসে। ফেলুদার গল্পেই এসেছে সত্যজিৎ রায়ের অনবদ্য সৃষ্টি আশ্চর্য এক মজার চরিত্র লালমোহন গাঙ্গুলী বা জটায়ু। তিনি যতটা না নিজের বুদ্ধিমত একজন জনপ্রিয় রহস্যকাহিনীর লেখক তার চেয়েও অনেক বেশী নির্ভরশীল ফেলুদার বিশ্লেষণী ক্ষমতার ওপর।

‘প্রফেসর শঙ্কু’ সত্যজিৎ রায়ের আর এক অসাধারণ সৃষ্টি। ইনি শুধুমাত্র একজন বিজ্ঞানী নন, একজন আবিস্কারকও বটে। মাত্র একজন সহকারী কাজের লোক ও একটি বিড়াল নিয়ে গিরিডি শহরে উশ্রী নদীর তীরে তার বসবাস, সেখানেই তার গবেষণাগার। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, পৃথিবী বিখ্যাত ব্যাক্তিত্বরা, বিজ্ঞানী, অভিযাত্রীরা, বিপদে পড়লেই তার ডাক পড়ে তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করবার জন্য। আর তিনি তাদের জন্য রওনা হয়ে যান কখনো কায়রো ‘মরু রহস্য’, কখনো তিব্বত ‘একশৃঙ্গ অভিযান’ কখনো মানরো দ্বীপ ‘মানরো দ্বীপের কাহিনী’ বা কখনো স্পেন ‘শঙ্কুর সুবর্ণ সু্যোগ’, সঙ্গে থাকে তারই আবিষ্কৃত অ্যানাইহিলিন, মিরাকিউরল, স্নাফগান, বা এমনই সব যন্ত্রপাতি।এদের কোনটি অস্ত্র কোনটি ওষুধ আবার কোনটি বা সত্যিই যন্ত্র। এই সব অভিযানে তখন তার সঙ্গী হয় দেশ বিদেশের বড় বড় ব্যাক্তিত্বরা কখনো সামারভিল, কখনো সন্ডার্স, আবার কখনো বা ক্রোল ।

শুধুমাত্র এইসব রহস্য উপন্যাসগুলির মধ্যেই সত্যজিৎ রায় সীমাবদ্ধ নন। তার অনেক ছোট গল্পের মধ্যেও ছড়িয়ে রয়েছে অনেক রহস্য। ‘তারিণী খুড়োর গল্প’ তার এমনই এক রচনা। ‘খগম’ তার অবিশ্বাস্য ভয়ঙ্কর এক রোমহর্ষক কাহিনী।

সমরেশ বসু সৃষ্ট চরিত্র অশোক ঠাকুর নৈহাটীর এক বনেদী বাড়ীর ছেলে হয়েও রহস্য সমাধানকেই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে। সে তার বন্ধু অয়স্কান্তকে নিয়ে ঘটনাস্থলে  পৌঁছে সবকিছু দেখে বুঝে এসে তার বৌদি কাঞ্চনকে ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করে। সেই বৌদি তখন সমাধান সূত্রগুলো তকে ধরিয়ে দেয়।

সত্তরের দশক থেকে আনন্দবাজার প্রকাশনের ‘আনন্দমেলা’ প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়। তৎকালীন প্রখ্যাত সব সাহিত্যিকদের রহস্য কাহিনী লেখারও সূচনা হয় তখন থেকে, এই পত্রিকার মাধ্যমে। আমরা পরিচিত হই বিখ্যাত সব গোয়েন্দা চরিত্রদের সঙ্গে। বিমল করের কিকিরা, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের কর্ণেল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু, সমরেশ মজুমদারের অর্জুন, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি, আর সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের দীপকাকুর সঙ্গে। এই পত্রিকা শুধু ছোটদেরই নয়, আমাদের মত বড়দেরও অত্যন্ত প্রিয় ছিল।

বিমল করের কিকিরা (কিঙ্কর কিশোর রায়) একজন প্রাক্তন জাদুকর। টিয়াপাখীর মত নাক, আলখাল্লার মত সরু লম্বা রংচংএ জামা, জাদুকরী হাত আর ক্ষুরধার মাথা, তাকে এক ব্যতিক্রমী গোয়েন্দা চরিত্রে পরিণত করেছে। তার গল্পে খুনোখুনি, বন্দুক পিস্তল রক্তপাত এইসব ভয়ঙ্কর ব্যাপার বেশী নেই। আছে তন্ত্র মন্ত্র জাদু। ঘটনাচক্রে তার পরিচয় হয় তারাপদ আর চন্দনের সঙ্গে। পরে এরাই তার সহকারী হয়ে যায়। তার আবির্ভাব ‘কাপালিকরা এখনও আছে’ গল্পে কাপালিকের ভন্ডামি ধরতে তিনি কাপালিকের ডেরায় থাকতেও পিছপা হন না। তার গল্পগুলির মধ্যে কয়েকটি ‘রাজবাড়ীর ছোরা’, ‘শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ ও কিকিরা’, ‘ময়ূরগঞ্জের নৃসিংহ সদন’ ইত্যাদি। বিমল করের ‘হারানো জিপের রহস্য’ সম্ভবতঃ বাংলা ভাষায় প্রথম Time Travel-এর গল্প।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সৃষ্টি টাক মাথা, সাদা দাড়িওলা ক্রিসমাস বুড়োর মত চেহারা, প্রকৃতি প্রেমিক, প্রাক্তন কর্ণেল নিলাদ্রি সরকার, কর্ণেল নামেই বেশী পরিচিত। পাখী দেখা, প্রজাপতি ধরা, গাছপালা খোঁজা, আর প্রকৃতির ছবি তোলা – এটাই প্রকৃতিপ্রেমিক কর্ণেলের শখ। তবে এসব করতে গিয়ে তিনি যদি কোন খুনজখম, বা রহস্যে জড়িয়ে পড়েন, তখন তিনি তার সমাধান না করেই ছাড়েন না। যেহেতু তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন, তাই দুর্গম এলাকায় যাওয়ার মত সাহস, প্রশিক্ষণ, এবং শরীর তার আছে। জয়ন্ত, তার সফর সঙ্গী, একজন ক্রাইম সাংবাদিক। তার কয়েকটি কাহিনী ‘বিষাক্ত প্রজাপতি’, ‘ত্রিশূলে রক্তের দাগ’, ‘দানিয়েল কুঠির হত্যারহস্য’।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবু’ রাজা রায় চৌধুরী ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারেন না, তবুও তিনি দেশবিদেশ ছুটে বেড়ান রহস্য সমাধানে, ভাইপো সন্তুকে সঙ্গে নিয়ে। কাকাবাবু বিপদে পড়লে সন্তু বাঁচায়, সন্তু বিপদে পড়লে কাকাবাবু বাঁচায়। ভারত সরকারের রহস্য সমাধানেও তার ডাক পড়ে। আমার পড়া কাকাবাবুর অন্যতম সেরা ‘রাজবাড়ীর রহস্য’ গল্পে তিনি রাজবাড়ীর আধিভৌতিক রহস্যের সমাধান করেন। উত্তরবঙ্গের পটভূমিতে লিখিত ‘কাকাবাবু ও বজ্রলামা’ গল্পে বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান গোষ্ঠীর লামাদের, ভয়ঙ্কর তন্ত্রমন্ত্র ও  ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় এবং আমি তাদের সম্বন্ধে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠি। পরে অবশ্য এদের নিয়ে লেখা অনেক থ্রিলারই আমি পড়ে ফেলেছি। ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’ গল্পে কাকাবাবু কিন্তু সত্যি হারেননি, জিতেই ছিলেন।

সমরেশ মজুমদারের অর্জুন তার গুরু প্রাক্তন গোয়েন্দা অমল সোমের শহর জলপাইগুড়িতেই থাকে। অমল সোমের বয়স হয়েছে, সব জায়গায় তিনি যেতে পারেন না। তাই অর্জুন রহস্যের অকুস্থলে যায় ও ফিরে এসে গুরুকে সেখানের সবকিছু জানায়। অমল সোম তাকে সমাধানের পথগুলো দেখিয়ে দেন ও রহস্যের সমাধান করেন। মাঝে মাঝে অমল সোমের সাহায্য নিলেও পরে অবশ্য অর্জুন নিজেই স্বাধীন গোয়েন্দারূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। সে নিজেকে সত্যসন্ধানী রূপেই পরিচয় দিতে ভালোবাসত। উত্তরবঙ্গে তার যাত্রার সূচনা হলেও পরে সে দেশেবিদেশে গিয়েও রহস্য সমাধান করে এসেছে। তার কয়েকটি কাহিনী ‘জয়ন্তীর জঙ্গলে’, ‘সীতাহরণ রহস্য’, ‘ম্যাকসাহেবের নাতনী’, ‘অর্জুন এবার নিউইয়র্কে’।

সুচিত্রা ভট্টাচার্য তার লেখা রহস্য কাহিনীতে এনেছিলেন নারী গোয়েন্দা মিতিন মাসিকে। এর অনেক অনেক আগেই অবশ্য আরো একজন তৎকালীন জনপ্রিয় সাহিত্যিক – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী গোয়েন্দা সাহিত্যের দুনিয়াকে চমকে দিয়ে এনেছিলেন, দুই মহিলা গোয়েন্দা-কৃষ্ণা ও শিখাকে। সুগঠিত চেহারা, মাতৃভাষা ছাড়াও চার পাঁচটি ভাষায় কথা বলার দক্ষতা, ঘোড়ায় চড়া, গাড়ী চালান, এমন সব গুণের সমাহারে কৃষ্ণাকে নির্মাণ করেছিলেন তিনি। মা বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে অকুতোভয় কৃষ্ণাপা বাড়িয়েছিল রহস্য উদ্‌ঘাটনের পথে। তারপর আর থেমে থাকেনি, হয়ে উঠেছিল এক প্রকৃত রহস্যসন্ধানী। ‘কারাগারে কৃষ্ণা’, ‘বনে জঙ্গলে কৃষ্ণা’ এই সিরিজের কয়েকটি বই।

কৃষ্ণার পরে তার সৃষ্ট দ্বিতীয় মেয়ে গোয়েন্দা অগ্নিশিখা রায়, বেশী পরিচিত ‘শিখা’ নামে। বাঙালি হলেও তৎকালীন বাঙালী ঘরের কোণে বসে থাকা দুর্বল মেয়ে সে নয়। শারীরিকভাবে যথেষ্টসক্ষম, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে পারদর্শী তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারিনী স্বাধীনচেতা শিখা, বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে নিজেই ঝাঁপিয়েছিল তার বন্ধুকে উদ্ধার করতে। তার সিরিজের কয়েকটি কাহিনী ‘বিজয়িনী শিখা’, ‘রহস্যময়ী শিখা’, ইত্যাদি।

মিতিন মাসির আসল নাম প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জী, আদতে একজন সুগৃহিনী হলেও ক্যারাটে জানে, আগ্নেয়াস্ত্র সম্বন্ধেও তার যথেষ্ট জ্ঞান। রহস্য সমাধানকেই তিনি পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তার বুদ্ধি দিয়েই তিনি ‘জোনাথনের বাড়ীর ভুত’ কাহিনীতে তিনি আসল ভুতের পরিচয় বার করে ফেলেন। ‘মার্কুইস ষ্ট্রিটে মৃত্যুফাঁদ’ ঠিক কোথায় সেটাও খুঁজে বার করেন। শুধুমাত্র কলকাতায় নয়, তার কাহিনীর বিস্তার বিদেশেও। তিনি তার স্বামী পার্থ, পুত্র বু্মবুম, বোনঝি টুপুরকে নিয়ে বেড়াতে গিয়ে, যদি কোন রহস্যে জড়িয়ে পড়েন, তবে তার সমাধান করেই ছাড়েন। হিমাচল প্রদেশে বেড়াতে গিয়ে একটা ছোট্ট পেনড্রাইভ ‘কুড়িয়ে পাওয়া পেনড্রাইভ’ পেয়ে নকল ছবি রেখে মূল্যবান আসল ছবি পাচারের প্রচেষ্টা ব্যর্থই শুধু করেন না, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুষ্কৃতিদের ধরেও দেন। ‘টিকরপাড়ার ঘড়িয়াল’, কাহিনীতে একদল পোচার, যারা জীবজন্তুকে মেরে তাদের চামড়া, দাঁত নখ, হাড় বিক্রী করে, তাদের বনদপ্তরের হাতে তুলে দেন। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লিখিত তার কাহিনীগুলি ‘বিষ’, ‘মারণ বাতাস’ও যথেষ্ট আকর্ষনীয়।

এই সব প্রখ্যাত সাহিত্যিকরা আজ সকলেই প্রয়াত। কিন্তু তাদের কালজয়ী রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীগুলি আজও আমাদের মনে তাদের অমর করে রেখেছে।

প্রথম পর্ব সমাপ্ত

গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। এক সময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. এক কথায় অপূর্ব। বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ নিয়ে এমন বিশ্লেষণমূলক লেখা কম ই পাওয়া যায়। লেখিকা গোপা মিত্র কে আন্তরিক ধন্যবাদ এমন বিষয় নিয়ে লেখার জন্যে। প্রথম পর্বের শুরুতেই জমে গেছে তাই পরের পর্ব গুলির জন্যে রইলো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা…

  2. খুব ভালো লাগল পড়ে এবং অপেক্ষা রইল আরও পড়ার।

    1. লেখা টা সম্পূর্ণ পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ।

  3. অসাধারণ লেখা। এতো স্বল্প পরিসরেও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীতে সমগ্র বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের সম্পুর্ণ পরিচয় দেওয়া খুব সহজ কথা নয়। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

  4. পড়ে খুব ভালো লাগল। এই ভাবেই লিখতে থাক।
    চরৈবেতি।💐💐

  5. খুব ভালো লাগলো তোমার লেখা।তোমার এই topic নিয়ে বেশ আড্ডা দেওয়া যায় ,একটি বৃষ্টির সন্ধ্যায়। তুমি Sherlock Holmes এর কথা লিখেছ তাই Agatha Christie র Poirot আর Miss Marple এর কথা ও লিখলাম।

    1. তোমার ভালো লাগা আমাকে উৎসাহিত করল। তোমার কথা মনে থাকবে । পরের পর্বগুলো পড়বে, আশা রইল ।

  6. নমস্কার!!! খুব ভালো লাগল লেখাটি। এবার থেকে আপনার লেখা নিশ্চয়ই ফলো করব!!! ভালো থাকবেন

    1. নমস্কার । আমার লেখা আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভালো লাগলো । অনেক ধন্যবাদ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!