শর্মিলা মজুমদার
উত্তম কথার অর্থ শ্রেষ্ঠ। অরুণকুমারকে যখন ‘উত্তম’ নামকরণ করা হয় তখন সে নিজেও ভাবেনি নামটা তার সার্থক হয়ে যাবে। আমার স্কুল জীবনে সিনেমা কি, তা জানতাম না, ওই সময় আমাদের বাড়ি থেকে সিনেমা দেখার অনুমতি ছিল না। বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। কিন্তু কলেজে পড়ার সময় বেশি না হলেও কিছুটা বজ্র আঁটুনি আলগা হয়েছিল আর তখনই এল উত্তমকুমার। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ। শুধু উত্তম না, সঙ্গে সুচিত্রা সেনও। এই জুটি সত্যিই অনবদ্য। তবে উত্তম –উত্তমই। তার চোখের অভিব্যক্তি আমার এই বয়সেও আমাকে মুগ্ধ করে। তার চোখই যেন সব কথা বলে দেয়।
আমার এই উত্তম প্রীতি শুধু আমার নয়, আমার মায়েরও ভীষণ প্রিয় অভিনেতা ছিল এই উত্তমকুমার। আমার মা যেহেতু ভবানীপুরের মেয়ে ও বউ তাই তার সৌভাগ্য হয়েছিল উত্তমকুমারের নিজের গলার গান শোনার, তার বাড়ি গিয়ে সামনে বসে। মা বলেছিল এত সুন্দর দরদী গলা; হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাথে মিল আছে। হয়তো এই কারণেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে তার ‘লিপ’ দেওয়া গান শুনলে মনে হতো উত্তমকুমার নিজেই গাইছেন। মার কথা শুনে আমারও খুব চাক্ষুষ দেখার ইচ্ছে হত। কলেজ বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করতাম, কিভাবে সামনে থেকে দেখা যায়। আমার বাবা শুনে খুব হাসতো আর বলতো “আরে ওর ভাই তরুণকুমার রোজ সকালে আমাদের বাড়ির নিচে জগধাত্রী মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে জিলিপি কেনার সময় দাঁড়িয়ে আমার সাথে কথা বলতো, আর আমি ও উত্তম কুমার এক স্কুলে পড়েছি,যদিও উত্তম এক ক্লাস উঁচুতে পড়ত।” এসব শুনে আমার খুব রাগ হতো। মা-বাবা সবাই দেখেছে আমিই বাদ! কি আর করা যাবে।তবে একটা সিনেমাও বাদ দিইনি। আমার বন্ধুরা আমার পাগলামী দেখে উত্তম কুমারের সাজপোষাক নিয়ে বলতো, “তোর বর যদি এরকম ঢোলা প্যান্ট পরে (অগ্নিপরীক্ষা)?” আমি বলতাম “সে যদি উত্তমকুমারের মত হয় তাহলে মানবো।”এটা বাবা শুনতে পেয়ে আমায় একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল “ওরে উত্তম কুমার আমার থেকেও বড়।” আমি রেগে বলেছিলাম “হলেই বা। উত্তম উত্তমই।”
কিন্তু হঠাৎ একদিন যেন মাথায় বাজ পড়ল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি যে, সে নেই! এটা হতে পারে না! আমাদের ছেড়ে এভাবে হঠাৎ…! রেডিও টেলিভিশন সব মিথ্যে কথা বলছে, অভিনয় করছিলেন যে সুস্থ-সবল মানুষটা সে এক ঝটকায়…। ভাবা যায় না। তারপর যখন তার মৃতদেহের শোভাযাত্রা টেলিভিশনে দেখানো হলো, হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম। মাকেও দেখেছি চোখের জলে ভাসতে আর বাবাও স্তব্ধ হয়ে গেছিল। অনেক দিন ধরে এই আবেগ সামলাতে পারিনি।
আজ আমারও বিয়ে হয়েছে ভবানীপুরে। যে পুজো মণ্ডপে অঞ্জলি দিতে যাই, সেই মণ্ডপে উত্তমকুমারও অঞ্জলি দিতেন। আমার স্বামীর সঙ্গে তার ছেলে গৌতমের বন্ধুত্ব ছিল। উত্তম ও পার্থ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দিয়েছে অনেকবার। শুনে ভাবি যদি কয়েক বছর আগে আমার বিয়েটা হতো। কিন্তু তখন তো আমি পড়ছি, বি. এ. পাসও করিনি। এটাই আমার সারা জীবনের আফসোস।