জয়শ্রী বোস
আমার ছোটবেলাটা কেটেছে ভবানীপুরে মহেন্দ্র রোডে। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল লেডিস পার্ক। পার্কের ওপাশে ছিল গিরিশ মুখার্জী রোড, সেখানেই মহানায়ক উত্তমকুমারের বাড়ি। আমি যখনের কথা বলছি তখন ও তিনি উত্তমকুমার হননি। তখন আমরা থাকতাম মহেন্দ্র রোডের ভেতর দিকে ওই পার্কের পাশের একটা বাড়িতে। আমি আমার বাবা মা ঠাকুমা এবং দুই ভাই বোনের সঙ্গে থাকতাম সেখানে, আমার ছোট বোন তখনও হয়নি। সেই সময় আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন তখনকার দিনে নামকরা গাইয়ে নিদান ব্যানার্জি। আমি তখন খুবই ছোট নিদান কাকু এবং তার মা, যাঁকে আমি ‘ঠাকুমা’ বলতাম আমাকে খুবই ভালবাসতেন। আমি ওনাদের বাড়ি যেতাম এবং দেখতে পেতাম যে নিদান কাকু তার ছাত্র-ছাত্রীদের গান শেখাচ্ছেন। আমার বাবা ব্যবসায়ী মানুষ, খুবই ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু রবিবার করে নিদান কাকুর বাড়িতে গল্পগুজব করতে যেতেন। সেই সুবাদে আমার বাবার সাথে এবং আমাদের সাথে ওই পরিবারের খুবই সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। সেই বাড়িতেই উত্তমকুমার আসতেন গান শিখতে। আমিও বাবা মায়ের সঙ্গে সেখানে যেতাম। বাবার সঙ্গে উওমকুমারের ভালোই আলাপ হয়ে যায়। খুবই আলাপী মানুষ ছিলেন তিনি। আমি ছোটো এবং ওনার ছেলে গৌতমের সমসাময়িক, তাই খুব স্নেহের সঙ্গে আমার সাথে কথা বলতেন।
পরবর্তী কালে অরুনকুমারের উত্তমকুমার হয়ে ওঠার কাহিনী কারো অজানা নয়।
আমার বাবা কিন্তু যতই ব্যস্ত থাকুন সিনেমা দেখতে কোনদিনই পিছপা হননি। বাড়ির পাশেই ভবানীপুর অঞ্চল। সেখানে পরপর সমস্ত সিনেমা হল। সেখানে আমার বাবা-মা প্রায়ই সিনেমা দেখতে যেত।
বাবা-মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমিও মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে যেতে শুরু করলাম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে উল্টোরথ, প্রসাদ এসব সিনেমার ম্যাগাজিনের পাতা লুকিয়ে চুরিয়ে ওল্টানো আর উত্তমকুমারের ভক্ত হয়ে ওঠা। ভালোলাগা বাড়তে থাকে, রোমান্টিক বা সাদামাটা উত্তম, বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে উত্তম, সব চরিত্র আমার খুব পছন্দের।
সেই সময় আমাদের লেডিস পার্কে বিরাট বড় দুর্গাপুজো হতো এবং সেখানের লুনার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন উত্তমকুমার। তিনি এবং স্ত্রী গৌরিদেবী দুজনে মিলে প্রায় প্রতিদিন রাত্রিবেলা সেখানে উপস্থিত থাকতেন ফাংশনের জন্য। গান ও গাইতেন। অষ্টমীর দিন সকালে বিরাট বড় পুজোর থালা নিয়ে পুজো দিতে আসতেন এবং প্রত্যেকের সাথে কথা বলতেন। ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে তাঁদের কী প্রয়োজন না প্রয়োজন তাই নিয়ে এবং পুজোর আয়োজন এর ক্ষেত্রে কি প্রয়োজন সব নিয়ে আলোচনা করতেন। কোনদিনও স্টারসুলভ হাবভাব পাড়ার লোকজন তার থেকে পাননি। সেখানে তিনি সাধারণ মানুষ। রাতের বেলা তিনি একদম প্রথম সারিতে বসতেন প্রোগাম দেখার জন্য। সেইখানে কিন্তু যারা তখন পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা বা আমাদের মত কলেজ পড়ুয়ারা আমরা সবাই তখন ওই প্রথম সারিতেই বসে থাকতাম। উনি আমাদের সবার সাথে কথা বলতেন এবং পুরো প্রোগ্রাম শেষ হলে তবে বাড়ি ফিরতেন। ওনার ছেলে গৌতম আমাদের সমবয়সী তাই জন্য আমাদের সাথে খুব স্বচ্ছন্দেই তিনি কথা বলতেন। সুদীর্ঘ সুপুরুষ ভুবনভোলানো হাসি আমাদের মহানায়ক উত্তমকুমার আমি এবং আমার পরিবারের কাছে অন্য রকমের ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত।
অষ্টমীর দিন সকাল বেলা ধুতি পাঞ্জাবি পরে গৌরী দেবী কে সঙ্গে নিয়ে পার্কের গেট দিয়ে ঢোকা হাসি হাসি মুখ নিয়ে আমার চোখের সামনে এখনো ভাসে।
১৯৮০ সালের ২৪ শে জুলাই আমাদের মত অগণিত উত্তম মুগ্ধ মানুষকে শোকস্তব্ধ করে দিয়েছিল। মনে আছে আমার ছোটো বোন উত্তমকুমারের শেষ যাত্রা দেখার জন্য দৌড়ে গেছিলো। শুনলাম তার কাছে কাতারে কাতারে মানুষ তাদের প্রিয় নায়ককে দেখবার জন্যে ছুটে এসেছে।
আমি তখন শ্বশুরবাড়িতে উত্তর কলকাতায়। যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু মন পড়ে ছিল যদি একবার দেখতে পেতাম। তখনকার দিনে এখনকার মতো টিভি টেলিভিশনের সম্প্রচার শুরু হয়নি। কিন্তু আটটার বাংলা সংবাদের পর উত্তমকুমারের শেষ যাত্রা টিভিতে দেখানো হয়েছিল। আমার বাড়িতে তখন টিভিও ছিল না। তাই পাশের বাড়িতে ছুটেছিলাম – যা আগে কখনো করিনি। আমি এবং আমার শাশুড়ি মা দুজনে মিলে গিয়ে টেলিভিশনে আরো কয়েকজন উত্তম ভক্তের সঙ্গে বসে তার শেষ যাত্রা দেখি।
আজকে হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে উত্তমকুমারের নানা গল্প নানা কথা নানা আলোচনা শুনতে পাই তার সব পুরোনো সিনেমা কতবার করে দেখতে পাই। কিন্তু তখন ওনার চলে যাবার পর এটাই মনে হয়েছিল আর কোনোদিন আমার প্রিয় নায়ককে দেখতে পাবো না।
আজকের বাংলা সিনেমা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌঁছে গেছে চলচ্চিত্রের জগতে। খুবই ভালো কাজ হচ্ছে। কিন্ত মহানায়ক উত্তমকুমারের সিনেমা, আজও আমার মতো উত্তম ভক্তদের কাছে মন ভালো রাখার চাবিকাঠি।
Khub sundor gharoya lekha, sattyi i gharoya Uttamkumar er jonye jake ekdom kachh theke upolabdho korechho tumi Maima.
Darun laglo porey mone holey shei samay pucheygechi.khub bhalo likheycheyn.