অঞ্জন বসু চৌধুরী
শমিত ভঞ্জ ডাকনাম বুবু। আমরা বুবুদা বলে ডাকতাম। বুবদার বাবা স্বর্গীয় ‘প্রীতিময় ভঞ্জ’ বা “খোকা কাকা” ছিলেন আমার বাবার পিসতুতো ভাই। তমলুকে থাকতেন। বুবুদার বরাবরই সিনেমায় অভিনয়ের খুব ইচ্ছে ছিল। খুব ভালো ক্রিকেট খেলতো।
কলেজে পড়তে পড়তেই সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ এসে যায়। কেদার রাজায় পুলিশ ইন্সপেক্টর এর অভিনয় করে। শুটিং-এর পুরো টিম উঠেছিল বুবুদার বাড়িতেই।
খুব শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিল শমিত ভঞ্জ ওরফে বুবুদা।
মাকে যেমন ভালবাসত এবং শ্রদ্ধা করতো তেমনই ভয় পেতো।
একটা ব্যাপারে তার মা মানে আমার নতুন কাকিমা রেগে গিয়ে চাবির গোছা ছুড়ে মেরেছিলেন। লেগেছিল বুবুদার কিন্তু তাও মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে মায়ের রাগ ভাঙিয়ে দিয়েছিল। এমনিই ছিল আমাদের বুবুদা মানে আপনাদের শমিত ভঞ্জ।
আমার বাবাকে জেঠু বলে ডাকতো আর কোন সমস্যায় পড়লেই বাবার কাছে আসতো। বিয়ে করেছিল ভালোবেসে কিন্তু খোকা কাকাকে বলার সাহস হয়নি। অগত্যা আমার বাবার শরণাপন্ন হলো, বিয়ে হলো। বৌদি দারুন সুন্দরী এবং খুবই ভালো মানুষ। বুবুদা শান্ত মিষ্টভাষী ছিল তো বটেই সকলকে প্রাণের থেকেও বেশী ভালবাসতো। গানের গলা দারুন ছিল ভালো তবলা বাজাতে পারতো। আর হারমোনিয়াম বাজানোয় ছিল তুখোড়।
যতদূর মনে হয় ‘হারমোনিয়াম’ সিনেমাটাতে যেখানে ছায়াদেবী আর আরতি ভট্টাচার্য, তরুণকুমার ছিলেন সেখানে ছায়াদেবীর গানের সঙ্গে নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে ছিল। অপূর্ব বাজিয়েছিল।
তপন সিনহার আপনজনের ‘ছেনো গুন্ডা’-কে বাঙালী কোনদিন ভুলতে পারবে না। তখনকার নকশাল আমলে ছেনোর ভূমিকায় বুবুদা অনবদ্য। এমনকি তখনকার উঠতি পাড়ার ছেলেদের কাছে এই চরিত্রটি একটা আইডল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-তে ফাটাফাটি অভিনয় করেছিল। চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলা সিমি গারেওয়ালের মত অভিনেত্রী পাশে খুব সহজ কথা ছিল না। বুবুদার নিজস্ব অভিনয় গুণে চরিত্রটি অন্য মাত্রা পেয়েছিল।
‘ফুলেশ্বরী’ ছায়াছবিটির সহজ সরল আপন ভোলা গানপাগল রেলওয়ে গেটম্যানকে কেউ কি ভুলতে পারবে! মনের মত এই চরিত্রের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল সে। অসাধারণ ছবি। সন্ধ্যা রায় আর বুবুদার অভিনয়ে সে ছবি সবার কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
অসম্ভব হাসিখুশি মানুষ ছিল। বন্ধুবৎসল বুবুদা ছিল ভোজনরসিক আর সবাইকে খাওয়াতে খুব ভালোবাসতো। চিন্ময় রায়, কল্যান চ্যার্টাজ্জী এরা সবাই “বুবু” বলতে অজ্ঞান ছিলেন।
পরবর্তীকালে অত্যন্ত শরীর খারাপের মধ্যেও ডিরেক্টরের গৌতম ঘোষের ডাকে সাড়া দিয়েছিল। শুনেছি খুব খুশী হয়েছিল। ‘আবার অরণ্যে’-র ছবির জন্য তখন কোনো কিছু চিন্তা না করেই “হ্যাঁ” বলেছিল। সেটাই সর্বশেষ অভিনয়। অনবদ্য অসাধারণ অভিনয় করলো শেষবারের মতো।
তার কিছু দিনের মধ্যেই ইন্ডাস্ট্রি শূন্য করে বিদায় নিলেন আপনাদের “শমিত ভঞ্জ” ওরফে “ছেনো” ওরফে আমার “বুবুদা”।
২০০৩ সালের ২৪শে জুলাই – উত্তমকুমারের মৃত্যুদিনেই, আমরা হারাই ‘শমিত ভঞ্জ’-কে। প্রিয় বুবুদাকে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা জানালাম এই লেখাটি দিয়ে।
আমার অন্যতম প্রিয় অভিনেতা। 💐💐💐