Home প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বঙ্গ জীবনে ‘নমস্কার’ রীতি ও রবীন্দ্রনাথ
প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

বঙ্গ জীবনে ‘নমস্কার’ রীতি ও রবীন্দ্রনাথ

রণজিৎ গুহ


বঙ্গ সমাজে আমাদের পারস্পরিক সাধারণ সম্ভাষণ রীতি বুকের সামনে হাতজোড় করে নমস্কার বলা।শুধু বঙ্গ সমাজে কেন গোটা ভারতেই এমন কি আমাদের এই উপমহাদেশের সীমানার বাইরেও দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে  এই সম্ভাষণ রীতিই প্রচলিত।

নমস্কার (নমস্ + কার) শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষার নমস্কার শব্দ থেকে, নম এবং কৃ ধাতুর সাথে ঘঞ্ প্রত্যয়ের সংযুক্তিতে সৃষ্ট কার (কৃ + ঘঞ্) শব্দের সন্ধিতে।কধ্বনিটির আগে নমঃ শব্দটি বসায় সন্ধির জন্য তা নমস্ হয়েছে। নমঃ কথাটির অর্থ ‘প্রণাম’, ‘অভিবাদন’, ‘সম্মাননা’ বা ‘নত হওয়া’ এবং কার কথার অর্থ ‘কার্য’ বা ‘করা’ (‘কৃ’ ধাতুর কর্ম কারক)। অর্থাৎ, নমস্কার কথাটির আভিধানিক অর্থ হল “প্রণাম করা” বা “সম্মান করা”। ভারতের কিছু অঞ্চলে অভিবাদনের এই রীতিটি নমস্কারের পরিবর্তে  নমস্তে নামে পরিচিত। এই শব্দটিও একই সংস্কৃত শব্দ নমঃ থেকে এসেছে। এর অর্থ “তোমাকে প্রণাম”। নম এবং তে (যুষ্মদ্ বা তুমি শব্দের ষষ্ঠীর একবচন রূপ) শব্দদ্বয়ের সন্ধিতে তৈরি হয়েছে শব্দটি।

ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে স্থানীয় ভাষায় এই নমস্কার বা নমস্তের উচ্চারণ আলাদা আলাদা।

কন্নড়ে একজন ব্যক্তিকে “নমস্কারা”  আর একাধিক ব্যক্তিকে “নমস্কারাগলু”  বলে সম্ভাষণ জানানো হয়। তেলুগুতে একজনের জন্য “দণ্ডমু”  বা “নমস্কারম্”  এবং একের বেশিজনের ক্ষেত্রে “দণ্ডালু” বা “নমস্কারালু” বলা হয়। এছাড়াও আনুষ্ঠানিক “প্রণামমু”  প্রচলিত। তামিলে নমস্কারকে বলা হয় ভানাক্কম বা “বণক্কম” এর উৎপত্তি “বণঙ্গু”  শব্দ থেকে, যার অর্থ সম্ভাষণ। মলয়ালম ভাষায় নমস্কারম্  শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

নমস্কার বা নমস্তে সম্ভাষণ, অভিবাদন এবং আত্মীয়, অতিথি কিংবা আগন্তুককে স্বাগত জানবার একটি সম্মানজনক রীতি। কারোর কোনো দান বা উপহার গ্রহণে বিনয় জানাতে, অথবা কোনো ব্যক্তির কৃপার প্রতি ধন্যবাদ জানাতেও নমস্কার ব্যবহার করা হয়।

কিছু কিছু স্বাভিমানী ব্যাক্তি নমস্কার জানানোর মধ্যে প্রচ্ছন্ন ভাবে  এক ধরনের নতি স্বীকার নিহিত আছে মনে করেন। নমস্কার করা মানে যেন অবনত হওয়া। প্রাচীন ভারতের ঋষিবৃন্দ যদিও নমস্কার মুদ্রাটিকে প্রণাম এরই অন্যতম প্রকাশ বলে নির্দেশ করেছেন কিন্তু প্রণামে যে সমর্পণের ইঙ্গিত নমস্কার মুদ্রায় তা সূচিত  বিবেচিত হয় না। মূলত অহম্ ত্যাগ করে বিনয়ভাব প্রকাশের জন্যই দুইহাত জোড় করা  বা অঞ্জলি মুদ্রা ব্যবহৃত হয়। কি বলছে  বৈদিক শাস্ত্র?

“যো দেবো অগ্নৌ যো অপসু যো বিশ্বং ভূবনাবিবেশ য ওষধীষু যো বনস্পতি তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ॥”(শ্বেতাশ্ব তর উপনিষদ ২-১৭)

বৈদিক মতে  যখন কাউকে নমস্কার জানানো হয় তখন মূলত সর্বজীবে অন্তর্যামীরুপে অবস্থিত পরমাত্মাকেই প্রণতি নিবেদন করা হয় ,কোন মনুষ্যদেহকে নয়। সুতরাং,নমস্কার সকলকেই জানানো যায়।

সংস্কৃতিভেদে করজোড়ে কিছুটা বৈচিত্র্য দেখা যায় যেমন দেবতাদের উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করতে সাধকরা মাথার উপরে দু’হাত জোড় করে থাকেন। আবার কোন ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতে নমস্কার জানাতে বুকের বরাবর হাত জোড় করেন।

 এসব নাহয় সনাতনী বা বৈদিক  আচরণ। কিন্তু বঙ্গজীবনে এই বুকের সামনে  হাতজোড় করে নমস্কার বলার সম্ভাষণ রীতি   কবে থেকে এল? আমাদের দেশের পুর্বাঞ্চলে ছোটরা বড়দের  পায়ে হাত দিয়ে নত মস্তকে প্রনাম জানাত। উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে হাঁটু ছুঁয়ে শ্রদ্ধা সম্ভাষন জানান হত। হিন্দু মন্দিরে সাষ্টাঙ্গ বা পঞ্চাঙ্গ প্রণামের চল আছে। এই আনত হয়ে প্রণামের বদলে নমস্কার করার চলই এখন প্রায় সর্বক্ষেত্রে জনপ্রিয় ও মান্য সম্ভাষণ  রীতি। এখন সনাতন ধর্মের অনুরাগীরা তাদের পূজ্য  দেব দেবীকেও জোড়হাতে নমস্কার করেন। বাংলার প্রাচীন সাহিত্য চর্যাপদ বা মঙ্গলকাব্যে কিংবা  কাশীরাম দাসের মহাভারত বা কৃত্তিবাসী রামায়ণে এই নমস্কার পদ্ধতির উল্লেখ আছে কিনা গবেষকরাই বলতে পারবেন। আদপে সংস্কৃত মহাভারতেই কি নমস্কার রীতির উল্লেখ  আছে? টিভির মহাভারতে আছে। কিন্তু সে তো আর প্রামানিক কিছু নয়।আমাদের আচার আচরণ বা বঙ্গ সংস্কৃতির যে বর্তমান রূপ রঙ্গ, সৌজন্য প্রকাশ থেকে শোক প্রকাশ  তার প্রায় সবটুকুই রবীন্দ্রভাবনার ফলশ্রুতি। হয় রবীন্দ্রনাথ  প্রবর্তিত নাহয়  রবীন্দ্রভাবনায় জাড়িত বা প্রভাবিত।  এবং তৎকালীন সুধিসমাজ অনুমোদিত এবং অনুশীলিত। এই নমস্কার রীতির জন্যও কি আমরা রবীন্দ্র ঋণে আবদ্ধ?  ১৯০৭ সালে লেখা ‘গোরা’ উপন্যাসে সুচরিতা বিনয়কে নমস্কার করছে বিনয় প্রতি নমস্কার করছে। বিনয় পরেশকে নত হয়ে প্রণাম করে সুচরিতাকে নমস্কার করছে।  সংস্কৃত সাহিত্যে কি এই রীতির উল্লেখ আছে? হতে পারে রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত সাহিত্য থেকেই রীতিটি জেনেছিলেন। অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রচিত  পাঠ্যপুস্তক—’সহজ রচনাশিক্ষা’ তে কেমন করে চিঠি লেখা উচিত সেটা বোঝাতে গিয়ে লিখেছিলেন ..পূজ্য ব্যক্তিকে “প্রণাম” করিতে হয়, তুল্য ব্যক্তিকে “নমস্কার” করিতে হয়। এই জন্য তুল্য ব্যক্তিকে যে পত্র লেখা যায়, তাহার পাঠের নাম “নমস্কার” পাঠ। যথা—

“সবিনয় নমস্কারাঃ নিবেদনঞ্চ বিশেষং অথবা বাঙ্গালায়—

“বিনয় পূর্বক নমস্কার নিবেদন।” অনেকে সংক্ষেপ করিয়া শুধু লেখেন—

“নমস্কার নিবেদন।”

 ১৯০১ সালে ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ পাঁচজন ছাত্র নিয়ে মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দায়িত্বে যে স্কুল খোলেন সেখানকার একটি সমস্যার সমাধানে রবীন্দ্রনাথ প্রাত্যহিক জীবনাচরণে এই নমস্কার রীতি চালু করেন। অন্য দুই শিক্ষক ছিলেন জগদানন্দ রায় ও কুঞ্জলাল ঘোষ। সমস্যা দেখা দিল ব্রাম্ভন ছাত্র অব্রাম্ভন শিক্ষক কুঞ্জবাবুকে কিভাবে পদ স্পর্শ করে প্রণাম জানাবে? রবীন্দ্রনাথ মনোরঞ্জনবাবুকে লিখিত নির্দেশ দিয়ে এই নমস্কার রীতিটি চালু করতে বলেন। সম্ভবত শান্তিনিকেতন হয়ে এখন ‘নমস্কার’ বঙ্গজীবনের অঙ্গ।

ইদানীং অনেকে বাঙালিয়ানা জাহির করতে বৃটিশদের গুড মর্নিং গুড নাইটের আদলে সুপ্রভাত শুভরাত্রি জানাচ্ছেন। কিন্তু এই সৌজন্য সম্ভাষণ তো নিছকই অনুবাদ ও অনুকরণ।অথচ  শ্রদ্ধা, আমন্ত্রণ, আপ্যায়ন,স্বীকৃতি,  বিনয়, বিদায়,  অভিবাদন, গ্রহন, এমনকি গ্রহন  করার অক্ষমতায়  বঙ্গ সংস্কৃতির সকল সৌজন্য  আমরা একটি নমস্কারেই প্রকাশ করতে পারি। আমাদের কারখানায় আমরা ফোনে হ্যালোর পরিবর্তে নমস্কার বলা চালু করেছিলাম। অনেকেরই সেটা এখন অভ্যাস।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাধারণ সৌজন্য প্রকাশের নানা ধরনের পদ্ধতি আচরিত হয়।কোথাও করমর্দন কোথাও আলিঙ্গন কোথাও বা চুম্বন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমাদের এই নমস্কার জানানোর রীতি নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম। আন্তরিক ও নিরাপদ। একটি মাত্র মুদ্রায় বহু অভিপ্রায় প্রকাশের অভিনব পদ্ধতি আমাদের নমস্কার জ্ঞাপন।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!