Home বিবিধ, প্রবন্ধ আজ ও রবীন্দ্রনাথ
বিবিধপ্রবন্ধ

আজ ও রবীন্দ্রনাথ

অনন্ত কৃষ্ণ দে


যুগন্ধর স্রষ্টা কবি রবীন্দ্রনাথের একশত ষাট বছর পূর্ণ হলো গত ২৫শে বৈশাখ। একশত ষাট কালের হিসাবে দীর্ঘ নয়। আশা করা যায় গুরুদেবের প্রতিভার মুল্যায়ন-পুনর্মূল্যায়ন নতুন মাত্রা পাবে। অন্তত প্রত্যাশা সে রকমই। কিন্তু সত্যিই কি নতুন মাত্রা পাবে? না কি একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নতুন ভঙ্গিমায় উচ্চারন করে-দায়-দায়িত্ব সম্পন্ন করা হবে? রবীন্দ্র উত্তরকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বিষ্ণু দে গভীর বেদনা আর হ্রদয় যন্ত্রণায় দীর্ন হয়ে লিখেছিলেন,

  তুমি কি কেবলই স্মৃতি, শুধু এক
  উপলক্ষে, কবি?
  হরেক উৎসবে হৈ হৈ
  মঞ্চে মঞ্চে কেবলই কি ছবি?
  তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ
  আর বাইশে শ্রাবণ?
  কালবৈশাখীর তীব্র অতৃপ্ত প্রতিভা,
  বাদলের প্রবল প্লাবন
  সবই শুধু বৎসরান্তে একদিনেই নির্গত নিঃশেষ?

এই প্রশ্ন কবির শতবার্ষিকী, একশো পঁচিশ, সার্ধ-শতবর্ষ পূর্তি উৎসবেও ছিল, আজও আছে। যারা আগের সেই প্রবল রবীন্দ্র তর্পণের দিনগুলির খবর রাখেন, তারা সকলেই জানেন ঘটা করে আমরা সকলে মিলে অঙ্গীকার করেছিলাম, কবির মহৎ উত্তরাধিকার সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেতে হবে জনগনের মধ্যে। কিন্তু অনেক অতিক্রান্ত বার্ষিকীগুলির পর মুল্যবান বছরগুলিতে প্রায় কিছুই হয় নি। প্রসঙ্গত প্রশ্ন উঠে কেন রবীন্দ্রনাথ এবং কোন রবীন্দ্রনাথ? নতুন প্রশ্ন আর নতুন জিজ্ঞাসায় দীর্ণ হওয়াই রবীন্দ্র উত্তরাধিকার।

আশি বছরের দীর্ঘ জীবনের এই মহৎ উত্তরাধিকার তিনি সৃষ্টি করে গেছেন। বস্তুত সমকালের এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই প্রায় ছিল না যা রবীন্দ্র দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সৃষ্টিশীল প্রতিভার সচেতন বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধিৎসু জিজ্ঞাসার উজ্জ্বল ফসলগুলিই তার স্বাক্ষর বহন করে। উনবিংশ শতাব্দীর নব জাগরনের উজ্জ্বল প্রভাত থেকে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বিংশ শতাব্দীর প্রথম চারটি দশক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল কবি জীবন। প্রায় ৬৫ বছরের সৃষ্টিশীল কলম, নতুন সৃষ্টির চমকে বাংলা ভাষা-ভাষী পাঠক সমাজকে বারে বারে বিস্মিত ও আবেগে আপ্লুত করেছে। রবীন্দ্রনাথের কন্ঠেই শোনা গিয়েছিল আমাদের পরাধীন জাতির ভাষা। মহৎ প্রতিভা মাত্রই যুগ ও কালের প্রতীক হয়ে উঠে। সমকাল অতিক্রমের ইঙ্গিত যত স্পষ্ট ও উজ্জ্বল হয়, প্রতিভার স্থায়িত্বও জনমানসে তত গভীর ও দৃঢ় হয়ে ওঠে। শেকড়-বাকড় ছড়িয়ে যায় বলেই সমগ্র সত্তা নিয়ে, সে আপন অস্তিত্ব কালান্তারে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। রবীন্দ্রনাথের বিবেকী কন্ঠ সমকালের প্রতিটি ঘটনায় সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন থেকে শুরু করে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, বিজ্ঞান, এমন কোন ক্ষেত্র ছিল না, যেখানে রবীন্দ্র প্রতিভার অবাধ গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।

পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ভারতবাসীর উপর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বর্বর অমানবিকতা, রবীন্দ্রমানসে ক্রোধ, ধিক্কার আর ঘৃনার সঞ্চার করেছিল। তাই তার সৃষ্টি সম্ভার স্বাধীনতা সংগ্রামে বৌদ্ধিক প্রেরনা সঞ্চার করেছিল। বন্দি মুক্তি, ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সপক্ষে বারে বারে তাঁকে ধিক্কার জানাতে দেখা গেছে। জাতির পক্ষ থেকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিটি আক্রমনের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। জালিয়ানওয়ালা বাগের নির্মম হত্যার বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় প্রতিবাদ, কে ভুলতে পারবে? কে ভুলতে পারবে হিজলি জেলে বন্দী হত্যার নিন্দায় তাঁর কঠোরতম ভাষা? বঙ্গ –ভঙ্গ রদ করার জন্য তাঁর সক্রিয় উদ্যোগ কেউ কখনও বিস্মিতি হতে পারেন ? পুঁজিবাদের সংকট এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চক্রান্তের মুখে দাঁড়িয়ে কবি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলেছিলেন, ‘ শান্তির ললিতবানী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।‘ বলেছিলেন, ঐক্যতত্ব সম্পর্কে আমার কথা ভুল বোঝবার আশঙ্কা আছে। একাকার হওয়া, এক হওয়া নয়। যারা স্বতন্ত্র তারাই এক হতে পারে। পৃথিবীতে যারা পরজাতির স্বাতন্ত্র্য লোপ করে, তারাই সর্ব জাতির ঐক্য বিনাশ করে। যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল ভুমিকা আন্তর্জাতিক বিবেকী বুদ্ধিজীবীদেরও অনুপ্রাণিত করেছিলো। আজীবন তিনি শাশ্বত বানীর নিষ্ঠাবান প্রচারকের ভূমিকায় ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মহৎ সৃষ্টিশীল প্রতিভা বারে বারে নতুন প্রশ্ন, নতুন জিজ্ঞাসায় উদ্গ্রীব হয়েছে। যতই পরিণত হয়েছেন, ততই চিন্তা, চেতনা, সৃষ্টিকর্ম চুড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ততই তিনি নিজেকে বদলে সাধারণ মানুষের আরও কাছে চলে এসেছেন। বিশেষত জীবন সায়াহ্নে তাঁর শেষ পর্বের কাব্যগ্রন্থে এবং অন্যান্য সৃষ্টিকর্মে, নিজেকে ভেঙ্গে মুচড়ে নতুন আদলে প্রতিভাত করার যে আকাঙ্ক্ষা তা বেশ স্পষ্ট ও ইঙ্গিতবাহী। 

পরাধীন ভারতের কবি স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ গ্রাম-গ্রামান্তরে শিক্ষার আলোক বর্তিকা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন সর্বব্যপ্ত শিক্ষার সুযোগ ছাড়া জাতি কখনও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে আলোয় বিধৌত পৃথিবীতে সমগ্র জাতিকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি চেষ্টা করেন। এই জন্যই তিনি স্থাপন করেছিলেন মুক্ত চিন্তার প্রাঙ্গন শান্তিনিকেতন। গ্রামীন পরিমন্ডলে গড়ে উঠেছিলো সৃজনাত্মক ও আনন্দময় বিদ্যালয়টি। রবীন্দ্রনাথ 

পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমবায়কেই মুল হাতিয়ার করার কথা ভেবেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ কো-অপারেটিভ প্রনালী, আমাদের দেশকে দারিদ্র্য হইতে বাঁচাইবার পথ’। তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন, ‘দরিদ্রকে ভিক্ষা দিয়া, দারিদ্র্য দূরীকরণ করা সম্ভব নয়’। রবীন্দ্র নাটক ‘রক্ত করবী’-তে রাজা ছিলেন অদৃশ্য। তার জালের আড়ালে, শুধু তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেত নন্দিনী। সেই রাজাই নন্দিনীর প্রেমিক রঞ্জনকে হত্যা করে জনতার সঙ্গে মিশে যান। এই রাজা, ঈশ্বর, না আমাদের শাসক, এই প্রশ্নটির কোনও স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না।

আমরা যে মানুষ কে মহামানব বলি, সে মানুষ এতই বৃহৎ যে গোটা মানুষটাকে দেশের মধ্যে ধরে না। কিছু তার দেশ ছাপিয়ে যায়, বাংলা ছাপিয়ে যায় ভারতকে, ভারত ছাপিয়ে যায় পৃথিবীকে। পৃথিবীর দেশে দেশে কত যে তার সমাদর হয়েছে, সে তো আমরা দেখেছি। অপর দিকে যে কালে তাঁর জন্ম সেই কালকেও তিনি অতিক্রম করে যান। অনাগত দিনের কথা ভেবে অনেক কথা তিনি আগাম বলেন। সেই জন্য তার সমকালীন মানুষেরা তাঁর সকল কথা সঠিক ভাবে বুঝতে পারে না। তাই বলে কিছুই শেষ হয়ে যায় না। দেশে, বিদেশে ভবিষ্যতকালে মানুষ আবার নতুন করে তাঁকে আবিষ্কার করে। রবীন্দ্র যুগের এখনও অবসান হয় নি। আমরা রবীন্দ্র যুগেই বাস করছি। একদা রবীন্দ্রনাথ সুরে-তালে-রঙে-রসে ছন্দে বাঙ্গালী জীবনে আনন্দের, সুন্দরের,মধুরের এক মহোৎসব লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মহোৎসবকে আমাদের জীবনে আবাহন করে আনতে হবে। ইংরাজী এলিজাবেথান স্পিরিট বলতে যেমন প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার ভাবকে সুচিত করে, তেমনি রবীন্দ্র-যুগ কথাটি যেন অনিবার্যভাবে আমাদের মনে নবীনতা, সজীবতা, সরলতা এবং সৌন্দর্যের ভাবকে সর্বদা জাগিয়ে রাখে, এটাই প্রার্থনা।


 

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!