সুদেষ্ণা মিত্র
বাংলার সমাজ জীবন তেরোশো শতক থেকে আঠেরোশো শতক অবধি যে বিচিত্র পরিকাঠামোর মধ্যে দিয়ে গেছে তার ফলেই আবির্ভাব মঙ্গলকাব্যের। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার বিশেষ ভূমিকা থাকলেও মূলত লৌকিক জীবনের এবং সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতেই এই মঙ্গল কাব্যের যে সূচনা সেটা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সেইজন্যেই অন্যান্য পৌরাণিক কাব্য বা ধর্মমূলক কোনো আলোচনার থেকে মঙ্গলকাব্যের দেব দেবীর অবস্থান একদম অন্যরকম।
এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে চৈতন্য দেবের আবির্ভাবে তৎকালীন বাংলাদেশে যে প্রেমের ও মানবিকতার ভাব বয়ে গেছিলো মঙ্গলকাব্যের প্রতিটি রচনায় তার প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। সেই কারণেই মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীর সঙ্গে মানুষের ওঠাবসা যেন খুব সাধারণ ঘটনা ছিল।
অন্য আরও কারণ যা মঙ্গলকাব্য কে অন্যান্য পৌরাণিক রচনার থেকে আলাদা করে তা হলো বাংলার মধ্যযুগের অরাজক পরিবেশের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের। রাজায় রাজায় যুদ্ধ, হানাহানি, প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা রীতিনীতি ও ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস, কুসংস্কার এই সবকিছুর সমাধান খুঁজতে মানুষ দেবদেবীর আশ্রয় চায়। কিন্তু দেবদেবী যেন তাদের মতোই মানুষ এই জ্ঞানেই তাঁরা দেবদেবীর পূজা অর্চনা শুরু করে। মঙ্গলকাব্য রচনা শুরুর এটিও অন্যতম কারণ।
এই রচনাগুলির নাম মঙ্গলকাব্য হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল অশান্ত অমঙ্গলজনক পরিবেশের মধ্যে দেবদেবীর বন্দনার মঙ্গলময় পরিবেশ প্রতিষ্ঠা। অন্য কারণ হিসেবে নানা কারণের মধ্যে একটি হলো প্রতি মঙ্গলবার মঙ্গলবার এটি গাওয়া হতো।
সমস্ত মঙ্গলকাব্যে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ওপর লিখিত। তাই এর সুর একইরকম। এমনকি গল্পের গতি বা প্রকৃতিও কম বেশি একইপ্রকার। সমাজের ধনী সম্প্রদায় বা বিত্তশালী মানুষ প্রথমে কোনো বিশেষ দেবদেবীর প্রতি অবিশ্বাসী হোন। দেব বা দেবী তখন বিরূপ হয়ে ওঠেন এবং সেই ব্যক্তিকে নানারকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। গল্পের বিন্যাসে দেখা যায় নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে একসময় সেই মানুষটি দেবদেবীর পূজারী হয়ে ওঠেন। আরো একটি বৈশিষ্ট্য হলো মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীরা যেন সাধারণ মানুষ; শুধুমাত্র তাঁরা অলৌকিক বা দৈবিক শক্তিসম্পন্ন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক মানবিক এবং অনেক কাছের।
প্রতিটি মঙ্গল কাব্যের শুরু গণেশ বন্দনা দিয়ে এবং শেষ কোনো না কোনো দেব দেবীর পুজো প্রচলনের মধ্যে দিয়ে বা দেব দেবী অথবা মানুষের বন্দনা দিয়ে । প্রায় সব কাব্যেই নদী, এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নানারকম মানবিক আবেগ অনুভূতির বিবরণ পাওয়া যায়। প্রেম ভালোবাসা ভক্তির পাশাপাশি হিংসা, প্রতিশোধ অর্থাৎ মানব মনের প্রতিটি স্তরের খোঁজ পাওয়া যায়। মোটকথা সব মঙ্গল কাব্যই ভীষণভাবে বাংলার লোক সংস্কৃতির কাছাকাছি। তাই অনেক জায়গায় এর নাম লোক সাহিত্য।
সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয় মনসামঙ্গলকে। কবিকঙ্কন মুকুন্দ রামের চন্ডীমঙ্গল এবং রূপরাম চক্রবর্তী ও ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল ও রায়গুনাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে উল্লেখ্যযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে।
মঙ্গলকাব্য আমাদের মনের কাছাকাছি এক সুখপাঠ্য হিসেবে সবসময়ই চিরস্থায়ী আসন নিয়ে নিয়েছে। কবিদের মানবিকতাবোধ এবং দেব দেবীদের দেবত্ব বিসর্জন দিয়ে আমাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়াই বোধহয় যুগ যুগ ধরে চলে আসা মঙ্গলকাব্যের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।
চিত্র পরিচিতি:
১ম ছবি: বেহুলা-লক্ষীন্দর বাসর, বগুড়া।
https://upload.wikimedia.org/…/Behula_Lakhsindar_Basor…
২য় ছবি: কবি ভারতচন্দ্র।
https://en.m.wikipedia.org/…/File:Memorial_of_Bharat…
৩য় ছবি: কবি মুকুন্দরাম।