শৈবাল কুমার বোস
ষোড়শ শতাব্দীর সাহিত্য
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষপাদে মিথিলা, বাংলা ও ওড়িশায় সাহিত্য সংস্কৃতির নবজাগরণ ঘটেছিল। মিথিলায় তা সর্বাধিক ও সর্বাগ্রে প্রকাশ পায়। ওড়িশায় একটু বিলম্বে ও কিছু ক্ষীণ ভাবে দেখা দিয়েছিল। বাংলাতেও স্বাধীন সুলতানদের আমলে ব্রাহ্মণ শাসিত উচ্চবর্ণের সমাজ ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলো। বৃহস্পতি মহিন্তা “স্মৃতিসংহার” রচনা করলেন। আর কেউ কেউ স্মৃতি লিখলেন। প্রথম থেকেই দেশীয় সাহিত্য দুই খাতে প্রবাহিত ছিল। এক খাত ছিল আবহমান লোকসাহিত্যের ধারা। এ ধারার সাথে সংস্কৃত ও প্রাকৃত সাহিত্যের অনুর্বাহী সংযোগ ছিল। অপভ্রংশ-অবহট্ঠে এ প্রবাহের বেগ প্রবল ভাবে অনুভূত হয়েছিল। লোকসাহিত্যের দুটি প্রধান ধারা – নীতিছড়া ও রূপকথা। এই দুই ধারারই উদাহরণ বৈদিক সাহিত্য অবিচ্ছেদ্য ভাবে মিলেছে। বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলগানে প্রাচীন রূপকথার কালবিবর্তিত রূপ প্রকট। দ্বিতীয় খাতে প্রবাহ প্রথমে ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। এ প্রবাহের উৎপত্তি সংস্কৃতে এবং পুষ্টি সংস্কৃত শিক্ষিতের দ্বারা অথবা রাজসভার আশ্রয়ে। তুর্কি আক্রমণে রাজসভা ভেঙে যাওয়ায় এই প্রবাহ বিচ্ছিন্ন হয়।
রামায়ণ ও মহাভারত এই দুই প্রাচীন মহাকাব্য কাহিনী ভারতীয় সাহিত্যের দুই পাদস্তম্ভ। এ দুটি কাহিনীই বাংলায় রচিত হয়েছিল একাধিক কবির দ্বারা। বাংলায় রামায়ণ গেয় পাঞ্চালী কাব্য, মহাভারত পাঞ্চালী ছাপ পেলেও একান্তভাবে পাঠ্য কাব্য। বাংলায় যিনি প্রথম মহাভারত কাহিনী লিখেছিলেন তার নাম পরমেশ্বের দাস। তিনি নিজেকে কবীন্দ্র বলেছেন। তিনি চাটিগ্রামের (অধুনা চট্টগ্রাম) শাসনকর্তা হোসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খানের নির্দেশে এই কাহিনী লিখেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে লেখা প্রথম মহাভারত কাহিনী রামচন্দ্র খানের অশ্বমেধপর্ব ও জৈমিনী-সংহিতার মর্মানুবাদ। দ্বিজ রঘুনাথের অশ্বমেধ পাঁচালীর একটি মাত্র পুঁথি পাওয়া গেছে। পুঁথি প্রাচীন বলে ভাষায় প্রাচীনত্বের ছাপ আছে। পুর্ববর্তী ও সমসাময়িক অন্যান্য মহাভারত রচনার মতো রঘুনাথের অশ্বমেধ পাঁচালী কাশীরাম দাসের মহাভারত সাগরে মিশে গেছে বলে মনে করা হয়।
কামতা কামরূপে বাংলা-সংস্কৃত আহৃত হয়েছিল রাজা বিশ্বসিংহের (১৫২২-৫৪) রাজসভায়। তার আমলে পীতাম্বর নামক জনৈক অ-ব্রাহ্মণ্যের অন্তত দুটি পৌরাণিক রচনা পাওয়া গেছে। একটি ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণ অবলম্বনে ঊষা-অনিরুদ্ধের কাহিনী, অন্যটি মহাভারত অবলম্বনে নল-দময়ন্তী উপাখ্যান। বিশ্বসিংহের পুত্র নরনারায়াণ দেব ও শুক্লধ্বজ সংস্কৃত বিদ্যার যথেষ্ট পোষকতা করতেন। রাজার আদেশে রাজপুত্রদের শিক্ষার জন্য পুরূষোত্তম বিদ্যাবাগীশ প্রয়োগরত্নমালা ব্যাকরণ লিখেছিলেন। শুক্লধ্বজ পুরাণপ্রিয় ছিলেন। তার সভায় পুরাণ পাঠক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অনিরুদ্ধ। তার উপাধি ছিল রামসরস্বতী। শুক্লধ্বজের অনুরোধে অনিরুদ্ধ ভারত-পয়ার রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। অনিরুদ্ধ প্রথমে বনপর্ব-উদ্যোগপর্ব-ভীষ্মপর্ব আখ্যান ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন পরে শুক্লধ্বজ কৃত গীতগোবিন্দের ব্যাখ্যা অনুযায়ী জয়দেব কাব্য রচনা করেছিলেন। এতে ভাগবতোক্তো কৃষ্ণলীলার পটভূমিকায় গীতগোবিন্দ-পদাবলীকে বর্ণনাময় রূপ দেওয়া হয়েছে। সমসাময়িক ও পরবর্তীকালে কামতা দরবার থেকে অনেকে ভারত-পয়ার রচনা করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অবধি বাংলা ও অসমিয়া ভাষার মধ্যে গুরূতর পার্থক্য দেখা দেয় নি। ষোড়শ শতাব্দীতে আসাম-কামরূপে নব্য ভারতীয় আর্যভাষা বাংলার উত্তরপূর্বী উপভাষার সাথে প্রায় অভিন্ন ছিল। কামরূপ-আসাম অঞ্চলের সবচেয়ে পুরানো পৌরাণিক রচনার নিদর্শন মাধবকন্দলীর শ্রীরাম পাঁচালী। তবে কামরূপে রচিত বৈষ্ণব পদাবলীর শ্রেণীবিভাগ কিছু স্বতন্ত্র। যেমন কীর্তনঘেষা লীলাপদ, নামঘেষা ভজনপদ, ষড়গীত-ব্রজবুলী বা বাংলা-অসমিয়ায় লেখা কৃষ্ণলীলা পদাবলী, ভাটিমা বা ভট্টিমা প্রশস্তিপদ, গুণমালা কৃষ্ণলীলা অনুসারে দীর্ঘপদ। অন্যত্র এ ধরণের রচনা পাওয়া যায় নি।
চৈতন্যাবদান
দীর্ঘস্থায়ী তুর্কি আক্রমণের ফলে বাঙালী জাতির আত্মবিশ্বাস চূর্ণ হয়ে গেছিল। দেবতার কৃপাকেই তারা একমাত্র সম্বল হিসাবে জেনেছিল। অন্যদিকে নিজেদের যুগ ও যুগশক্তির ওপরেও কোনো আস্থা ছিলো না। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য তার সারা জীবনের সাধনা দিয়ে এই অন্ধকারকে দূর করলেন, জাগিয়ে তুললেন মানবশক্তির প্রতি শ্রদ্ধা, নিজের কাল সম্বন্ধে অসীম বিশ্বাস। বাংলা সাহিত্য চৈতন্যত্তর কালের মোহনায় নতুন মুক্তির প্রেরণা খুঁজে পেল।
চৈতন্যর জীবদ্দশায় প্রধান লেখকদের মধ্যে দুই ভাই সনাতন ও বিশেষ করে রূপগোস্বামী উল্লেখযোগ্য। রূপগোস্বামী সমগ্র কৃষ্ণলীলা নিয়ে ব্রজলীলা ও দ্বারকালীলা নামে দুটি নাটক রচনা করেন। এছাড়া দানকেলিকৌমুদী নামে কৃষ্ণের ঘাটলীলা নিয়ে একটি একোক্তি নাটক (ভণিতা) রচনা করেন। এ বিষয় কোনো পুরাণে নেই। তবে বাংলাদেশে কথায় ও গানে প্রচলিত ছিল। অপর রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈষ্ণবরসেশাস্ত্রের উপর রচিত ভক্তরসামৃত ও উজ্জ্বলনিলমণি। রূপ এতে কৃষ্ণলীলা ভাবনাকে সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রের রসাভিব্যক্তির পথে প্রবাহিত করে দিলেন। চৈতন্যের জীবনকাহিনী শ্লোকসূত্রে প্রথম লিখেছিলেন মূরারীগুপ্ত। তারপর স্বরূপ দামোদর। এই দুজনের রচনা কড়চা নামে অভিহিত। কড়চা শব্দটা এসেছে প্রাকৃত কটকচ্চ, সংস্কৃত কৃতকৃত্য থেকে। মূরারীগুপ্তের কড়চা বলে যা পরিচিত তা নামেই কড়চা। এটির নাম শ্রীশ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃতম। বইটিতে মোট আটাত্তর সর্গ, চার প্রক্রমে ভাগ করা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মূরারীগুপ্ত আদিলীলা গ্রন্থিত করেছিলেন, স্বরূপ দামোদর মধ্য ও অন্তলীলা। মূরারীগুপ্তের রচনা ছাড়া সংস্কৃতে লেখা চৈতন্যকথাশ্রিত রচনারূপে আরো তিনখানি গ্রন্থ সমুল্লেখ্য। তিনটিরই লেখক পরমানন্দ সেন – এনার উপাধি ছিলো কবিকর্ণপূর। পরমানন্দের প্রথম গ্রন্থ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত মহাকাব্য। এই গ্রন্থের প্রথম এগারোটি সর্গে মূরারীগুপ্তের প্রভাব বহুব্যাপক। এই মহাকাব্যের রচনা সমাপ্তিকাল ১৫৪২ সাল অব্দ। পরমানন্দের দ্বিতীয় রচনা চৈতন্যচন্দ্রোদয় নামে একটি নাটক। এটি দশ অংকে বিভক্ত। মহাপ্রভুর দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের কাহিনী থেকে গম্ভীরালীলা পর্যন্ত এই নাটকের উপজীব্য বিষয়। পরমানন্দের তৃতীয় রচনা গৌরগণোদ্দেশদীপিকা। এটি একটি ছোট রচনা। এতা গৌর প্রবর্তিত ধর্মের দার্শনিক পটভূমি বিশদে ব্যাখ্যা রয়েছে।
বাংলায় লেখা প্রথম চৈতন্যাবদান কাব্য বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যমঙ্গল। পরে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বৃন্দাবনদাসকে চৈতন্যলীলার ব্যাস বলে বন্দনা করায় ও বৃন্দাবন দাসের কাব্যকে ব্যাসের ভাগবত পুরাণের মর্যদা দেওয়ায় কাব্যটি চৈতন্যভাগবত নামে পরিচিত। চৈতন্যভাগবত বড় বই, তিন খন্ডে বিভক্ত। ছত্রসংখ্যা প্রায় পঁচিশহাজার। আদিখন্ডে পনেরো অধ্যায়, চৈতন্যের গয়া প্রত্যাগমনে শেষ, মধ্যখন্ডে সাতাশ অধ্যায়, চৈতন্যের সন্নাস গ্রহণে শেষ, অন্ত্য খন্ডে দশ অধ্যায়, গৌড়ীয় ভক্তদের সাথে মিলন ও গুন্ডিযাত্রা মহোৎসব পর্যন্ত বর্ণিত। সুরতালে আবৃত্তি ও গান করার উদ্দেশ্যে কাব্যটি লেখা হয়েছিল। বৃন্দাবনদাস অলৌকিক চরিত্রে সুদৃঢ় বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার লৌকিক দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়ে যায়নি। সমসাময়িক পরিবেশ বৃন্দাবনের যে পরিমাণে ও যে ভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা সমসাময়িক বাংলা কাব্যের আর কোনো রচনায় নেই। চৈতন্যবদান রচনাবলীর মধ্যে চৈতন্যভাগবত ছাড়াও কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত চৈতন্যচরিতামৃত প্রামাণ্য। চৈতন্যভাগবতে নবদ্বীপ্লীলা বিশদে ও যথাযথ বিবরণ থাকায় এই অংশ সুত্রাকারে সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। সন্ন্যাসগ্রহণের পর থেকে চৈতন্যর জীবন ও আচরণ চৈতন্যচরিতামৃতে ভাল করে আলোচনা করা আছে। সেই সঙ্গে আছে বৈষ্ণব সিদ্ধান্তের নিগূঢ় মর্মকথা। এতে চৈতন্যজীবন কথার সাথে চৈতন্যাবতারতত্ত্ব কথা যুগপৎ এবং অঙ্গাঙ্গীভাবে বর্ণিত ও ব্যাখ্যাত।
লোচনদাস বা লোচনানন্দ দাস চৈতন্যমঙ্গল লিখেছিলেন মূরারীগুপ্তের অনুসরণে। চৈতন্যমঙ্গল বিশেষভাবে আসরে গাওয়ার জন্য লিখিত হয়ে ছিল। মূরারীগুপ্তের ঐতিহাসিক বর্ণনাকে বর্ণাঢ্য কল্পনার স্পর্শে লোচন এক নবরূপ দান করেছেন। গ্রন্থটিকে লোচন চারটি খন্ডে প্রস্তুত করেছেন – সূত্রখন্ডে মূরারীর হরি-নারদ সংবাদ কাহিনীকে কৃষ্ণ – রুক্মিণী, হরপার্বতি, নারদ ব্রহ্মা সংবাদ বিভিন্ন কাহিনীর সাথে যুক্ত করেছেন, আদিখন্ডে মহাপ্রভুর জন্ম থেকে গয়াগমন ও প্রত্যাবর্তন, মধ্যখন্ডে মহাপ্রভুর ভাববিকার, সন্ন্যাস, পুরীযাত্রা, সার্বভৌম উদ্ধার ইত্যাদি, এবং অন্তখন্ড যেটি তির্থযাত্রার বর্ণনা। চৈতন্যমঙ্গলে ছত্রসংখ্যা ১১০০০, তারমধ্যে সূত্রখন্ডে প্রায় ১৮০০, আদিখন্ডে প্রায় ৩৩০০, মধ্যখন্ডে প্রায় ৪৩০০ সেষ বা অন্তখন্ডে প্রায় ১৬০০ ছত্র। লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গলের আরো কয়েক খানি চৈতন্যচরিত কাব্য গেয় পাঁচালি প্রবন্ধ রীতিতে বিরচিত হয়েছিল। তারমধ্যে একটি অংশত পাওয়া গেছে চূড়ামণিদাসের গৌরাঙ্গবিজয়। এটিও চৈতন্যভাগবতের মতোই আদি, মধ্য ও অন্ত এই তিন খন্ডে বিভক্ত। চূড়ামণির কাব্যে কাব্যে ব্রজবুলীপদের ব্যবহার বেশী আছে বিশেষ করে গানগুলিতে। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল লোচনদাস ও চূড়ামণিদাসের কাব্যের মত গেয় ও আবৃত্তিযোগ্য। জয়ানন্দের কাব্যের ছত্রসংখ্যা মোটামুটি সাড়ে তের হাজার। এটি ন’টি খন্ডে বিভক্ত। এগুলো হলো আদি, নদীয়া, বৈরাগ্য, সন্ন্যাস, উৎকল, প্রকাশ, তীর্থ, বিজয় ও উত্তর। বৃন্দাবনদাসের মতো জয়ানন্দও নিত্যানন্দের ও তার ভক্তদের কথায় বই শেষ করেছেন। চৈতন্যর তিরোভাব কাহিনীর অভিনবতাই এই কাব্যের লোকপ্রসিদ্ধির প্রধান কারণ। গোবিন্দদাসের কড়চা নামে চৈতন্যচরিতের একখানি খন্ডিত কাব্য ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই গ্রন্থ তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে কাব্যের গঠনভঙ্গীর জন্য। তাছাড়া যেখানে প্রাচীনত্বের ছাপ তাও অনেকক্ষেত্রে চেষ্টাকৃত ও কৃত্রিম বলে সন্দেহ করার কারণ আছে।
চৈতন্যচরিত সাহিত্যকে উপলক্ষ করেই বাংলা সাহিত্যে মানব জীবন নির্ভর কাব্যরচনার সূত্রপাত হয়েছিল। যে বিভিন্ন জীবনী সাহিত্য রচনা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঈশাননাগরের অদ্বৈতপ্রকাশ, হরিচরণদাসের অদ্বৈতমঙ্গল, লোকনাথদাস বিরচিত সীতাচরিত্র, বিষ্ণুদাস আচার্য রচিত সীতাগুণকদম্ব ইত্যাদি।
নাট্যগীতি পাঞ্চালী ও চন্ডীদাস :
পদাবলীর কবি চন্ডীদাস প্রাচীন বলে সর্বত্র স্বীকৃত। তার উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যায় কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতে ও তারপর জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে। চন্ডীদাসের পদাবলী বিচ্ছিন্ন ও খন্ডিত ভাবে কীর্তন গানের মধ্যে দিয়ে চলে এসেছে এবং বৈষ্ণব-পদাবলীসংগ্রহে গ্রথিত হয়েছে। চন্ডীদাসের বলে প্রচলিত অনেক ভাল ভাল পুরানো গান প্রাচীনতর পুঁথিতে অপর কবির ভণিতা বহন করে। বিভিন্ন জনপ্রবাদের সূত্রে কবির ব্যক্তি পরিচয়টি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন রয়ে গেছে। একমতে চন্ডীদাস বীরভূম জেলের নানুরে জাত অন্য মতে চন্ডীদাসকে বাঁকুড়ার ছাতনার লোক বলে ধরা হয়। ১৩১৬ বঙ্গাব্দে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামে এক ব্রাহ্মণের বাড়ীতে অযত্নে রক্ষিত একটি কাব্যগ্রন্থ আবিষ্কৃত হয়। এটিই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য নামে পরিচিত। কবির ভণিতা চন্ডীদাস, বেশীর ভাগ বড়ু চন্ডীদাস। এই গ্রন্থে রাধাকৃষ্ণের লীলা পরম্পরিত পালার আকারে বর্ণনা করা আছে। কিন্তু ভাব, ভাষা, উপস্থাপন পদ্ধতি এমনকি শালীনতা ও রুচীবোধের বিচারে কাব্যটি পুরাপরিচিত চন্ডীদাসের পদাবলী থেকে পৃথক। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি নানা পালা খন্ডে বিভক্ত। জন্মখন্ড, তাম্বুলখন্ড, দানখন্ড, নৌকাখন্ড, ভারখন্ড, ছত্রখন্ড, বৃন্দাবনখন্ড, যমুনাখন্ড, বাণখন্ড, বংশীখন্ড ও বিরহখন্ড। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পুঁথি আধুনিক হোক বা না হোক, তাতে প্রক্ষেপ যেমন এবং যতটাই থাক বা না থাক, তাতে বিশেষ কিছু এসে যায় না। আখ্যান পরিকল্পনায়, চরিত্র-চিত্রণে, ভাবে ও ভাষায় এতে একটি সুগঠিত নাট্য-গীতিকাব্যের সৌষম্য ও সংহতি ঘটেছে। চন্ডীদাস বা বড়ুচন্ডীদাস উপাধির অন্তরালে আত্মগোপন করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে প্রকাশিত এই পাঞ্চালিকা গীতিনাট্যটি যিনি রচনা করেছিলেন তিনি বড় কবি এবং অলঙ্কারশাস্ত্রোক্ত মহাকাব্য-লক্ষ্মণের কোনোটিই এতে না থাকলেও সমসাময়িক বাংলাসাহিত্যের মানদন্ডে এটি একটি উল্লেখ্যযোগ্য মহাকাব্য। এতে মাত্র তিনটি চরিত্র – কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি। তার মধ্যে রাধা চরিত্রের বিকাশে ও পরিণতিতে কবি যে দক্ষতার ও চাতুর্যের পরিচয় দিয়েছেন তা পুরানো বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় রহিত। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বেশীরভাগ ছন্দ পয়ার আয় – এই পয়ারের ধ্বনিপ্রবাহ ছাড়া ছাড়া। ত্রিপদী সূষম নয়। ছন্দে নতুনত্ব নেই। তবে নতুনত্ব আছে পয়ারের চার ছত্র নিয়ে ‘চউপঈ” জাতীয় স্তবক গঠনে। এ রীতি সম্ভবত সংস্কৃতের অনুকরণে। বড়ু চন্ডীদাস ছাড়াও চৈতন্যপূর্ব যুগে আর অনেকগুলি চন্ডীদাসের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয় জন পদকর্তা চন্ডীদাস যিনি চৈতন্যচরতামৃত – ধৃত মহাপ্রভূর আস্বাদিত পদটি রচনা করেছিলেন। চৈতন্যোত্তর দুজন চন্ডীদাসের মধ্যে দীন চন্ডীদাস অপেক্ষাকৃত নীরস ও সাহিত্যগুণে দুর্বল পদাবলীর রচয়িতা হলেও পুঁথিগত প্রমাণসিদ্ধ কবি। অন্যপক্ষে দ্বিজ চন্ডীদাসের অস্তিত্ব কিংবদন্তি, পরোক্ষ প্রমাণ এবং অনুমানের উপর নির্ভরশীল। এই চারজন ছাড়াও সহজিয়া ভাবের সাধক একাধিক চন্ডীদাস কবি ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এঁদের মধ্যে তরুণীরমনের চন্ডীদাস, কলঙ্ক-ভঞ্জের চন্ডীদাস তো আছেনই তাছাড়াও একই নামের আরো অনেম কবি হয়ত সহজিয়া গানগুলোর মধ্যে আত্মগোপন করে আছেন।
বৈষ্ণবপদাবলী
বৈষ্ণব কবিতাকে এখন পদ বলা হয়। এই অর্থ অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে প্রচলিত ছিল না। আগে পদ বলতে দুই ছত্রের গান বা গানের দুই ছত্র বোঝাতো। জয়দেব পদাবলী শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন তবে দ্ব্যর্থে। এক অর্থ পদালঙ্কার, পাসুলি (আধুনিক পাঁয়জার) অপর অর্থ পদময় গীত। প্রথম থেকেই বৈষ্ণব গীতিকবিতার দুটি ভাষাছাঁদ, বাংলা ও ব্রজবুলী। কোনো কোনো পদে বাংলা ও ব্রজবুলীর মিশ্রণ দেখা যায়। ব্রজবুলী রচনায় মাঝে মাঝে দু’চারটি ব্রজভাষা (হিন্দি) শব্দও পাওয়া যায়। গীতগোবিন্দের অনুসরণে মিথিলায় যেসব গীতিনাট্য লেখা হয়েছিল তাতে গানগুলি সংস্কৃত নয় ব্রজবুলীতে লেখা। অন্যদিকে এই ধরণের রচনা ওড়িশায় দুটি পাওয়া গেছে সংস্কৃতে। একটি পঞ্চদশ শতাব্দীর রচনা কপিলেন্দ্রদেবের পরশুরামবিজয়, দ্বিতীয় ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা রামানন্দরায়ের জগৎবল্লভ নাটক।বৈষ্ণব পদাবলী যা বোঝায় তা চৈতন্যর আগে উঁচুধারার বৈঠকি গানের মতো ছিল। এ গানের আসর ছিলো রাজসভা ও ধর্মীয় মজলিশ। চৈতন্যর সময় থেকেই যথার্থ বৈষ্ণব পদাবলির আরম্ভ।
বাঙালী বৈষ্ণব-গীতিকবিদের রচনার আদর্শ ছিল বিদ্যাপতির গান। বিদ্যাপতিকে নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি, কাজেই অনাবশ্যক পুনরাবৃত্তি করবো না। বৈষ্ণবপদাবলীর বিষয় সর্বদা কৃষ্ণলীলাময় নয়। চৈতন্যও কৃষ্ণের অবতার রূপে গীত হয়েছেন। চৈতন্যের মহিমাসূচক পদ প্রথম রচনা করেছিলেন অদ্বৈত আচার্য। শ্রীচৈতন্যের আদ্য অনুচরদের মধ্যে মুরারীগুপ্ত ছিলেন প্রথম পদাবলী রচয়িতা। এছাড়া আরো দুই চৈতন্যানুগামী মুরারীদত্ত ও বাসুদেবদত্ত নামে দুই ভাই কিছু পদ রচনা করেছিলেন। দুইজনেরই শুধু একটি করে পদাবলী মিলেছে, ভাষা ব্রজবুলী। সেই সময়ে নরহরি সরকার নামে এক পদকর্তার উল্লেখ পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ায় এক বড় গ্রন্থকর্তা নরহরি চক্রবর্তী “নরহরি” ভণিতায় অনেক পদ লিখেছিলেন। নরহরি চক্রবর্তীর আগেও কোন কোন বৈষ্ণব গ্রন্থে নরহরির নামে কিছু পদ সঙ্কলিত আছে। এছাড়াও উল্লেখ পাওয়া যায় গোবিন্দ, মাধব ও বাসুদেব ঘোষ নামে তিন ভাইয়ের। তিনজনেই গান রচনায় কুশল ও সঙ্গীতে দক্ষ ছিলেন। গোবিন্দঘোষের রচনা বলে নিরূপিত করা যায় এমন পদ পাঁচ-ছটির বেশী পাওয়া যায় না। তবে ইনার আরো কয়েকটা পদ বিভিন্ন গোবিন্দদাস কবির রচনার সাথে মিশে থাকা অসম্ভব নয়। মাধবঘোষের রচিত পদাবলীও বেশী নয়। তার মধ্যে রাধাকৃষ্ণ পদাবলী ও গৌর পদাবলী দুই-ই আছে। বাসুদেবঘোষ বহু পদ লিখেছিলেন। ইনার রচিত গৌর পদাবলীর সংখ্যা আশি। এগুলিই আদি গৌরচন্দ্রিকা। ইনি কিছু কিছু কৃষ্ণলীলা পদাবলীও লিখেছিলেন। বাসুদেব কৃষ্ণলীলার সাথে মিলিয়ে গৌর পদাবলী রচনা করেছিলেন সেগুলি কবিতা হিসাবে উচ্চমানের বলে বিবেচিত হয় না। কিন্তু নবদ্বীপ লীলা বা নীলাচল লীলায় যেখানে বাসুদেব নিজের অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি কাজে লাগিয়েছেন সেখানে তার রচনা সার্থক হয়েছে। বংশীবদন চট্ট নামে আরোও এক চৈতন্য পদকর্তার খোঁজ পাওয়া যায়। বংশীবদন অনেকগুলি পদ লিখেছেন, সেগুল সব বাংলায় লেখা সহজ সরল ভাষায়। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের কবি মালাধর বসুর পুত্র রামানন্দ বসু কিছু পদাবলী রচনা করেছিলেন, যা লিখেছিলেন তার মধ্যে কৃষ্ণের বাৎসল্য পদাবলী আছে, গৌর পদাবলী আছে। বৈষ্ণব পদাবলী রচয়িতাদের মধ্যে রামানন্দর স্থান উঁচুতে, মুরারীগুপ্তের সাথে। পরবর্তী কালে কীর্তন পালাগানে উপযুক্ত বিবাচিত না হওয়ার জন্য, নাম সাম্যের জন্য বা অন্য বিবিধ কারণে চৈতন্যের সমসাময়িক কোন কোন পদকর্তার আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে হারিয়ে গেছে। এইরকম পদকর্তাদের মধ্যে প্রথমেই নাম করা যায় গোবিন্দ আচার্যের। রামগোপালদাসের রসকল্পবল্লীতে গোবিন্দ আচার্যের দুটি ধুয়া পদের উল্লেখ আছে। পরমানন্দগুপ্ত নামে এক পদকর্তা কিছু গৌর পদাবলী রচনা করেছিলেন। এগুলকেই জয়ানন্দ গৌরাঙ্গ বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন। বাৎসল্যভাবের পদাবলী সর্বপ্রথম লিখেছিলেন বাসুদেব ঘোষ, তারপরে যারা বাৎসল্য ভাবের পদাবলী তাদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন বলরাম দাস। বলরাম বাংলা ও ব্রজবুলী দুই ছাঁদেই পদ লিখেছিলেন, তবে বাংলা পদগুলো তুলনামুলক ভাবে ভাল। রাধাকৃষ্ণলীলা বর্ণনায় বলরামদাস নিজের হৃ্দয়াবেগ সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন, সেই জন্য পদকর্তাদের মধ্যে তার স্থান সুনির্দিষ্ট। জ্ঞানদাস বা জ্ঞান ভণিতায় অনেক পদ পাওয়া গেছে, ব্রজবুলী ও বাংলা দুই ভাষা রীতিতেই পদ পাওয়া গেছে। চৈতন্য নিত্যানন্দ বন্দনা ও বাৎসল্য পদাবলী দুই-ই আছে।এনারা ছাড়াও পরমানন্দ কবিরাজ ও তার পুত্র কানুরাম বা কানুদাস, দেবকীনন্দন উল্লেখযোগ্য পদকর্তা। দেবকীনন্দন বিখ্যাত বৈষ্ণব বন্দনার জন্য। এটি আজও ভক্ত বৈষ্ণবের নিত্যপাঠ্য।
চন্ডীমঙ্গল পাঞ্চালী
বাংলাসাহিত্যে চন্ডীমঙ্গলের স্থান সমুচ্চ। এ পর্যন্ত চন্ডীমঙ্গলের যে যে কবির উল্লেখ পাওয়া গেছে তারা হলেন কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, দ্বিজমাধব, মানিকদত্ত, দ্বিজরামদেব প্রমুখ। বিদ্বজনেরা মোটের উপর চন্ডীকে অনার্য দেবী বলে ধারণা করেছেন। আবার অন্যমতে চন্ডীমঙ্গল পাঞ্চালীতে যে দেবীর মহিমা গীত তিনি আসলে রদ্রাণী চন্ডী ছিলেননা। চন্ডীমঙ্গলের অধিদেবতা দুর্গা অরণ্যানী বা বিন্ধ্যবাসিনী তবে তিনি চন্ডমুন্ড মহিষাসুরবিনাশিনী নন, তিনি অভয়া। তাই প্রাচীন চন্ডীমঙ্গল কাব্যের রচয়িতারা তাদের কাব্যকে অভয়ামঙ্গল বলেছেন। চন্ডীমঙ্গলে দুটি কাহিনী খন্ড, আখটিক (অক্ষটি) খন্ড ও বণিকখন্ড। কাহিনীদুটোর মধ্যে কোনো প্রাসঙ্গিক যোগসূত্র নেই। কাহিনীর নায়ক-নায়িকারা শাপভ্রষ্ট দেব দম্পতি। দেবীপূজার জন্যই তাদের নরলোকে জন্ম। প্রথম কাহিনীতে দেবী অরণ্যে পশুমাতা, দ্বিতীয় কাহিনীতে দেবী অরণ্যপালিকা।
কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্য তাবৎ প্রাচীন পাঞ্চালী রচনার মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং আধুনিক পূর্ব বাংলা সাহিত্যে কিছু বৈষ্ণব কবিতা এবং চৈতন্যভাগবত ও চৈতন্যচরিতামৃত বাদ দিলে সবচেয়ে মূল্যবান গ্রন্থ। বইটির মধ্যে মহাকাব্যের গুণ কিছু আছে। কাব্যের আকার বড়, ছত্রসংখ্যা প্রায় বিশ হাজার। মুকুন্দর প্রতিভার মধ্যে রয়েছে কথাশিল্পের কতোগুলি গুণ – যথা ১) বাস্তবচিত্রের উপস্থাপনের বিরল কৃতিত্ব, ২) দক্ষ চরিত্র নির্মাণ ক্ষমতা, ৩) কুশল ঘটনা সন্নিবেশ করার প্রতিভা ৪) চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ উদ্ভাসনের কৃতিত্ব ৫)জীবনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার নৈপুণ্য। মুকুন্দ যে জীবনকে দেখেছেন তা অত্যন্ত বাস্তব। তাই তার রচিত চরিত্রগুলো জীবন্ত এবং তারা আমাদের দেখা জগতের বাইরে কোনো ভিন্নগ্রহের মানুষ নয়। সেযুগের সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, ধর্মজীবন ইত্যাদির পুঙ্খানপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দ। মধ্যযুগের সামজব্যবস্থায় প্রচলিত প্রথা, লোকাচার, লোকবিশ্বাস, সংস্কারের নানা বিধি নিষেধ এ কাব্যে উঠে এসেছে। মিশ্রবৃত্ত রীতির পয়ার ছন্দপ্রয়োগ এবং একপদী, ত্রিপদী কাঠামো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি রচনায় বৈচিত্র্য এনেছেন। উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, সমর্সোক্তি অলংকারের যথার্থ প্রয়োগে্ প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচনকে ও বিশিষ্ট কাব্যভাষার সঠিক ও সাবলীল শিল্পীত ব্যবহারে তিনি তার কাব্য প্রতিভার চরম উৎকর্ষের দাবী রাখেন।
মুকুন্দের চন্ডীমঙ্গলের পাশপাশি উল্লেখ্য হল দ্বিজমাধবের চন্ডীমঙ্গল কাব্যটি। দ্বিজমাধব কাব্যের গঠনকৌশল সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। আখ্যানের মধ্যে আদি-মধ্য-অন্তের একটি বিন্যাস চোখে পড়ার মতো। কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট হল কাহিনীর মধ্যে গীতিকবিতার অসামান্য প্রয়োগ বৈচিত্র্য। তিনি বৈষ্ণবপদাবলীর গীতিধর্মী অসামান্য সব সংগীত সংযোজন করে কাব্যের আখ্যানকে ভিন্ন এক মাধুর্যে নিয়ে গেছেন। তিনি নানা ঘটনাকে এক রৈখিক সূত্রে সাজিয়েছেন। ফলে কাব্যের আখ্যান বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। তিনি নানা তথ্য দিয়েছেন কিন্তু কোথাও বিশদ ব্যাখ্যার অবসর রাখেননি। তার কাব্যে এসেছে ব্রতকথা, স্ত্রী আচার, বিবাহ পদ্ধতি, জাতকর্ম-প্রেতকর্ম, চৌতিশ, বারোমাস্য ইত্যাদি নানাপ্রসঙ্গ। তার কাব্যে সমাজবাস্তবতা প্রত্যক্ষ করার মতো। সমাজজীবনের নানা আচরণ তিনি বাস্তববোধের সাহায্যে তুলে ধরেছেন। ফলে তার কাব্যে অতিলৌকিকতার বাড়াবাড়ি নেই, তার কাব্যে ব্যঙ্গ আছে, রঙ্গ আছে, কোথাও শ্লেষ নেই, তির্যকতা নেই, কারোও প্রতি কোনো আক্রোশ নেই। ফলে তিনি কবি হিসাবে শান্তরসের।
দ্বিজরামদেব ছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কবি। তার রচিত কাব্যটির নাম অভয়ামঙ্গল। কাব্যে কবি চারটি উপাখ্যান সংযোজন করেছেন – মঙ্গলদৈত্য,চন্ডীর পূজা প্রচারাভিলাষ ও কালকেতু উপাখ্যান, ধনপতি উপাখ্যান, শ্রীপতি উপাখ্যান। দ্বিজরামদেব অভয়ামঙ্গল কাব্যে বৈষ্ণব পদাবলীর অনুরূপ বিষ্ণুপদ ও ধুয়াগান ব্যবহার করেছেন। এই কাব্যে কবির ছন্দনির্মাণের বৈচিত্র চোখে পড়ার মতন। ফুল্লরা-খুল্লনার বারোমাস্যা, খুল্লনা ও লহনার বিবাদ, দাম্পত্য কলহ, খুল্লনার সতীত্ব পরীক্ষা, ইত্যাদি বর্ণনায় যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তিনি রচনাকৌশল, চরিত্রে নতুন নতুন আলছায়ার সৃষ্টি, মনস্তত্ব, সাংসারিক অভিজ্ঞতা, পারিবারিক পরিবেশ প্রভৃতি ব্যাপারে যে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তাতে মুকুন্দরামের পর তার কাব্য গণনার যোগ্য হয়ে পড়ে। দেবদেবী, নরনারী চরিত্র সৃষ্টিতে রামদেব বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়াছেন। কোনোভাবে কোনো চরিত্রকে পার্থিব মলিনতার দিকে ঠেলে দেননি। বণিকখন্ড কাহিনী গ্রন্থনে চমৎকার। কারুণরাসের যথার্থ প্রকাশে তিনি সমর্থ হয়েছেন।
চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারার আদিকবি মাণিকদত্ত। তার চন্ডীমঙ্গল কাব্য আখ্যানে বিন্যাসে, চরিত্র নির্মাণের অসাধারণ বুননে ভাষার যথার্থ প্রয়োগ নৈপুণ্যে একটি পাঠযোগ্য ও আস্বাদন যোগ্য কাব্যের মর্যদা পেয়েছে। এছাড়া যাদের আর চন্ডীমঙ্গল কাব্য পাওয়া যায় তারা হলেন রামানন্দ যতি, অকিঞ্চন চক্রবর্তী, ভবানীশংকর, মুক্তারাম সেন প্রভৃতি।
ঋণ স্বীকার :
১) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খন্ড – ডঃ সুকুমার সেন
২) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রথম পর্যায় – ভূদেব চৌধুরী
৩) বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – ভূদেব চৌধুরী
৪) বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাস – ডঃ দীপংকর মল্লিক ও দেবারতি মল্লিক
শৈবাল বসু
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে স্নাতক। পেশাগত ভাবে গত ৩৪ বছর ধরে ব্যাঙ্কার। নেশাগত ভাবে শরদিন্দু ও ইতিহাস প্রেমী। বর্তমানে কলকাতা ও বাংলার ইতিহাস নিয়ে চর্চারত।
অপভ্রংশ-অবহটঠ রীতিতে লেখা প্রাচীন বাংলা ভাষা অদ্ভুত সুন্দর। এ ভাষার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসও সত্যিই কৌতূহলোদ্দীপক। যুগে যুগে কতো জ্ঞানী-গুনী মানুষ এই বাংলা ভাষাকে অলঙ্কৃত করেছেন, তা জানলে সত্যিই রোমাঞ্চিত হতে হয়।