গোপা মিত্র
শন্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব
ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে, লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্।।
শুরু হয়ে গেল শান্তিনিকেতনের দোল উৎসব, প্রভাতফেরীর এই গান আর নাচ দিয়ে। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকরা এভাবেই সূচনা করল বসন্ত উৎসবের। প্রথমে ছোট ছোট মেয়েরা, পরে বড় মেয়েরা, সবশেষে বিদেশী ছেলেমেয়েরা। তারা আমাদের সামনে দিয়ে নাচ গানের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে জোড়ায় জোড়ায়, লাইন দিয়ে। পরনে তাদের হলুদ বসন, উড়নী বাঁধা, কোমরবন্ধনী রূপে ছোটদের ক্ষেত্রে, বড়দের ঝুলছে কাঁধ থেকে, পলাশ ফুল শোভা পাচ্ছে তাদের মাথায়, কানে, বা গলায়। ছোটরা নাচছে খালি হাতে, বড়রা কাঠি নিয়ে ডান্ডিয়া। বেড়া দিয়ে ঘেরা সমগ্র গৌর প্রাঙ্গন প্রদক্ষিণ করে তারা বসছে গিয়ে মূল মঞ্চের সামনে বেড়া দিয়ে আলাদা করা তাদের নির্দিষ্ট জায়গায়, পিছনে তখন উপস্থিত অগণিত দর্শকবৃন্দ। আমাদের আসতে সামান্য দেরী হয়ে গেছে, তাই আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি বেড়ার ধারে। তাদের নাচ শেষ হলে, আমরাও গিয়ে বসলাম দর্শকদের পিছনে।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতন বিখ্যাত তার দোল উৎসবের জন্য। শুধু ভারতীয়রাই নয়, দেশ বিদেশের পর্যটকরাও আসে এই উৎসব দর্শনে। ১৯৯৬ সালে, দোলের সময় আমারও একবার সুযোগ এল এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবার – যদিও ভীড়ের জন্য এই উৎসব আমি সব সময় এড়িয়েই গিয়েছি। কিন্তু সুযোগ যখন এসেই গেল তখন আর যেতে দ্বিধা করলাম না।
দোলের আগের দিন আমরা তিন জন – আমি, কল্যাণ, সোনাই আর কল্যাণের ক’জন বন্ধু সপরিবারে, মোট তের জন এসে নামলাম বোলপুর ষ্টেশনে। তারপর রিক্সার প্রসেশন করে প্রায় দুপুরে এসে পৌঁছলাম কলকাতা থেকেই বুকিং করা শান্তিনিকেতনের পৌষালি লজে। এটা একটা দোতলা বাড়ী – ভাড়া দেওয়া হচ্ছে লজ বলে।
দোতলায় আমাদের জন্য বরাদ্দ হল তিনটে ঘর – একটা বড়, বাথরুম সহ, দুটো ছোট, তাদের জন্য কমন বাথরুম। আমরা মেয়েরা আর আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় ঘর, আর বাকীরা ছোট ঘর দুটো ভাগ করে নিল। লজটির সবচেয়ে বড় সুবিধা এটি একেবারেই মূল অনুষ্ঠান স্থল গৌর প্রাঙ্গনের পাশেই।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে বের হলাম শান্তিনিকেতন দেখতে। এখানের সব বিভাগই তখন বন্ধ, খোলা শুধু সঙ্গীতভবন। সেখানেই শুধু প্রবেশ করা গেল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাকী সব বন্ধ বিভাগগুলির সামনে দিয়ে ঘুরে ফিরে বেরিয়ে এলাম বাইরে। এবার পুষ্পবিহীন পলাশ গাছ, ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা গাছপালার নিচ দিয়ে বা ফাঁক গলে, লালমাটির পথ মাড়িয়ে এসে পৌঁছলাম তুলনামুলকভাবে সবুজ এক মাঠে। পরে বুঝেছিলাম, পলাশ ফুল সব তুলে নেওয়া হয়েছিল পরের দিনের অনুষ্ঠানের জন্য।
সূর্য তখন নেমে গেছে অস্তাচলে। মাঠের ধারের টিমটিমে ল্যাম্প পোষ্টের আলো আর চাঁদের আলোয় ফিকে অন্ধকারে দেখলাম মাঠেরমাঝে এক জায়গায় জনতার ভীড়। আমরাও জমে গেলাম সেখানে। দেখলাম, জড় করা কাঠকুটোয় জ্বলছে আগুন – সেই আগুন ঘিরে বসেছে নাচ গানের আসর। সবই অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। সেই জমায়েতে রয়েছে বিখ্যাত একজন বাচিক শিল্পী ও দুজন নৃত্যশিল্পী যাঁরাবর্তমানে প্রয়াতা।
দোলের আগের দিন, আমাদের বাংলার প্রচলিত রীতি আগুন জ্বালিয়ে নেড়া পোড়ানো, যা কিনা সূচিত করে অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির জয়। উত্তর ভারতে প্রচলিত, এরই আর এক রূপ হোলিকা দহন। ওখানে ওদের ব্যাখ্যা অশুভ শক্তি হোলিকা অসুর বধ ও শুভ শক্তি বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের জীবন রক্ষা।
ওদের নাচ গান শেষ হলে, শুরু হল সকলে মিলে হাত ধরে গোল হয়ে সাঁওতালদের মত অগ্নি প্রদক্ষিণ করে তাল মিলিয়ে নাচ। ভীড়ে সামিল আমরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে একসঙ্গে নাচতে লাগলাম। আগুন নিভে গেলে, নাচও শেষ হল। সকলের সঙ্গে আমরাও ফিরে চললাম আমাদের লজে।
নিচের একটা ছোট ঘরে টেবিল চেয়ার পেতে আমাদের কয়েকজনের খাওয়ার ব্যাবস্থা। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাল ভোরে প্রভাত ফেরী শুরু হবার আগেই তৈরী হয়ে বেরোতে হবে।
পৌঁছতে একটু দেরী হয়ে গেল। তাই গৌর প্রাঙ্গন ঘেরা, বেড়ার ধারে দাঁড়িয়েই আমাদের প্রভাত ফেরী দেখতে হল। এ একরকম ভালোই হল – নাচের দল আমাদের সামনে দিয়েই যাচ্ছে। পিছনে বসলে এত ভালো করে হয়তো দেখা যেত না।
প্রভাত ফেরী শেষ হলে সামনের বাঁধা মঞ্চে শুরু হল আজ সকালের মূল অনুষ্ঠান। সুসজ্জিত মঞ্চের পিছনে তখন এসে বসেছে গায়ক ও বাজনদারদের দল। গান বাজনার সঙ্গে এবার শুরু হল নাচের অনুষ্ঠান। সবই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসন্তের গান – “নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল, বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল।” বা “ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান / তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান”। মাঝে মাঝেই চলছে গ্রন্থনা। আমরা বসেছি অনেক পিছনে – স্পষ্ট ভাবে সব কিছু দেখতে না পেলেও গানের সুর কানে আসছে।
প্রভাত ফেরী দিয়ে শুরু বসন্তের আবাহন অনুষ্ঠান শেষ হলপ্রায় ১১ টায়। এবার শুরু হলবসন্ত উৎসবের প্রধান অঙ্গ রঙ খেলা। আশ্রমিকদের সঙ্গে বহিরাগতরাও তখন যোগ দিয়েছে। প্রাঙ্গনের বাইরে তখন মিলে গেছে সকলে। বাতাসে উড়ছে ফাগ আবীরের লাল গোলাপী রঙ। আশ্রমিকদের কপালে আর গালে রঙের চিহ্ন। আমাদেরও কপাল গাল রঙীন। একে অপরকে রং মাখাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কোথাও কোন জোর জবরদস্তি নেই, অসভ্যতা নেই। কেউ আপত্তি করলেই তাকে রঙ লাগানো হচ্ছে না। উড়ে আসা রঙে আমাদের সবার মাথাও তখন রঙীন। কোথাও কোন জল রঙের ব্যবহার নেই – সবই শুকনো রঙ। সেই রঙের ঝর্ণার মধ্যে দিয়ে, রাঙানো পথের ওপর দিয়ে আমরা চললাম এগিয়ে।
মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে গুচ্ছ গুচ্ছাকারে ইতিউতি আশ্রমিকরা নিজেদের মধ্যেই করছে কোন রবীন্দ্রনাথের গান, নাচ, বা আবৃত্তি। আমরাও সেখানে দাঁড়িয়ে সেসব দেখতে বা শুনতে লাগলাম। ভালো লাগলে দাঁড়িয়েই রইলাম, নচেৎ এগিয়ে চললাম পরের গুচ্ছের দিকে। অনেক দর্শককেও দেখলাম তাদেরই মত নিজেদের মধ্যে অনুষ্ঠান করতে।
এভাবেই সকাল গড়িয়ে গেল দুপুরে, আমরা ফিরে এলাম লজে। এসে দেখলাম লজ তখন পরিপূর্ণ ভীড়ে। লজের পিছনের মাঠে ম্যারাপ বেঁধে, চেয়ার টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। সেইসব বহিরাগতদের সঙ্গে আমরাও বসে গেলাম। খাওয়া শেষে উঠে এলাম ওপরে, একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যেতে হবে গৌর প্রাঙ্গনে, সান্ধ্য অনুষ্ঠান দেখতে।
আজ সান্ধ্য অনুষ্ঠানে আশ্রমিকেরা পরিবেশন করবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য। এর আগে শ্যামা আমার অনেকবারই দেখা – তবে সবই অডিটোরিয়ামে,পরিশীলিত কিছু দর্শকদের সঙ্গে, টিকিট কেটে। সেখানে সব কিছুই ছিল পেশাদার – Stage Management থেকে পরিচা্লক শিল্পী সকলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিশ্চয় এমনটা চাননি, তাই হয়ত তিনি তাঁর সাধের শান্তিনিকেতনে, এমন মুক্ত প্রাঙ্গনে হাজার সাধারণ দর্শকের সামনে এমন অনুষ্টানের পরিকল্পনা করে গিয়েছিলেন, যেখানে সব কিছুই অপেশাদার। তিনি হয়ত চেয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টির রস সাধারণের কাছেও পৌঁছে দিতে।
প্রাঙ্গনের মঞ্চ তখন আলোয় উজ্জ্বল, দর্শকাসনও তখন প্রায় পূর্ণ। আমরা এবারও প্রায় পিছন দিকে জায়গা পেলাম। শুরু হল অনুষ্টান। এখানে পুরুষ ভূমিকাতেও অভিনয় করছে মেয়েরা। আগে অনেকবার দেখা হলেও এসব তো কখনও পুরনো হয় না, তাছাড়া সাধারণের মাঝে, রবীন্দ্রতীর্থে বসে এই অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করা ভাগ্যের ব্যাপারও বটে।
এই অনুষ্ঠান শেষের সঙ্গেই এবারের মত বসন্ত উৎসবের পরিসমাপ্তি হল। সকলের সঙ্গে আমরাও বেরিয়ে এলাম প্রাঙ্গনের বাইরে। একটু ফাঁকা হতেই নজর পড়ল চারিদিকে। আকাশে তখন, বাঁধভাঙা চাঁদের হাসির উছলে পড়া আলো, ফাগুনের মাতাল সমীরণে উন্মুক্ত প্রকৃতি তখন পাগলপারা, এই মোহময়ী প্রকৃতি ছেড়ে আমাদের কারুরই তখন ফিরে যাবার তাড়া নেই। কলকাতার ইঁট কাঠ পাথরের জঙ্গলে এমন আর আমরা পাই কোথায়? আমরা সকলে বসলাম এক মাঠের মাঝে – শুরু হল আমাদের আজকের দোলের বিদায় অনুষ্টান। প্রথমে একজন গেয়ে উঠল “নিবিড় অমা তিমির হতে বাহির হল জোয়ার-স্রোতে, শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।” তার গান শেষ হলে আর একজন ধরল “পূর্ণ চাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে …” এবার আমরা সম্মিলিতভাবে গাইলাম “ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে …”, তারপর সেই জ্যোৎস্না মাখানো পথ ধরে ফিরে চললাম, সকলে মিলে গাইতে গাইতে,
“আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।।”
পরিশেষে একটা কথা, শুনেছি শান্তিনিকেতনের দোল উৎসব আজ কলঙ্কিত হচ্ছে কয়েকজন নিম্নরুচি সম্পন্ন মানুষের অভব্য আচরণের জন্য। আশ্রমিক আর বহিরাগতদের সহজ মেলামেশা আজ সেই কারণেই হচ্ছে ব্যহত। মুক্তমনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিকল্পিত বসন্ত উৎসবের মিলনমেলা আজ তার সার্ব্বজনীনতা হারাতে বসেছে। আমরা কি পারি না শান্তিনিকেতন তথা বাংলার সেই পুরনো কৃষ্টি ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে আনতে?
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
খুব ভালো লেখা।
ধন্যবাদ।
খুব ভালো লাগলো। ঠিক দোলের আগে, তাই আরো ভালো লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ ।খুব খুশী হলাম ।
পড়ে মনে হলো আমিও তোমার পাশে বসে অনুষ্ঠান দেখছি।খুব সুন্দর ভাবে লেখা।এখন এই পরিবেশ আর আছে বলে মনে হয় না।
আমি সম্মানিত । তুমি একদম ঠিক বলেছ ।