Home প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – প্রথম ভাগ – প্রথম পর্ব
সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রবন্ধ

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – প্রথম ভাগ – প্রথম পর্ব

শৈবাল কুমার বোস

ভণিতা 

সম্পাদিকা মহোদায়া অনুরোধ করলেন আর আমিও “হ্যাঁ” বলে রাজি হয়ে গেলাম। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে লিখতে হবে। তখন কিন্তু বুঝতে পারিনি কি লিখতে হবে। সকাল বেলায় যদি কেউ ঘুম থেকে উঠে সদর দরজা খুলে দেখে যে চারপাশের অতি পারিচিত রাস্তাঘাট বাড়ী দুয়ারের বদলে চারিদিকে থইথই করছে দিগন্ত জুড়ে সমুদ্রের জলরাশি তাহলে তার যা মনের অবস্থা হয় লিখিত বিষয়বস্তু নিয়ে একটু পড়াশুনা করতে গিয়ে আমারও মনের অবস্থা হল তাই। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তে বর্ণিত অবস্থা হলো “লাও তো বটে কিন্তু আনে কে ?” প্রায় বারো-তেরো শতকের বেশী জুড়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে লেখা আমার মতন অর্বাচীনের পক্ষে সেটা গিয়ে দাঁড়ালো পাড়ার সুইমিং ক্লাবে দুদিন সাঁতার শিখে হঠাৎ করে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অতলান্তিক মহাসাগর সাঁতরে পার হবার চেষ্টা করা। কিন্তু আমি নিরূপায় কারণ আমি প্রতিশ্রুতবদ্ধ। কিছু তো একটা লিখতে হবে তাই এই ভণিতা করা।

আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র নই, পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র। তাও স্নাতক হয়েছি ৩৫ বছরেরও বেশী। কাজেই আমার বাংলা সাহিত্যের পান্ডিত্য যে কত গভীর তা সহজেই অনুমেয়। লিখে মনে হলো কি ছাঁইপাশ লিখলাম জানিনা, হয়তো কিছু একটা হলো হয়তো কিছুই হলো না, অশ্বডিম্ব ছাড়া। মনে হচ্ছে অনেক কিছু লেখা হলো না, বলা হলো না। বিদগ্ধ পাঠক পাঠিকাদের কাছে একান্ত অনুরোধ এই মূঢ়ের অর্বাচীনতাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা। এ বিষয়ে বহু জ্ঞানীগুণীজন বহু পান্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখে গেছেন সেখানে আমার এই চেষ্টা নিতান্তই বাতুলতা। লিখতে গিয়ে দুটি জিনিষ মাথায় রাখতে হচ্ছে এক Du কলম একটা ব্লগ ম্যাগাজিন, সেখানে মেদবহুল লেখা লিখে নিজের পান্ডিত্য জাহির করা একান্তই বাঞ্ছনীয় নয়, দুই এটা কোনো থ্রীলার ধর্মী লেখা নয় যে পাঠক পাঠিকা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবেন যবনিকাপাতের জন্য। এ শুধু নীরস তথ্যের কচকচানি, অনাবশ্যক দীর্ঘ হলে পাঠক পাঠিকার ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটবে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব সংক্ষেপে সারার। সুকুমারীয় (ডঃ সুকুমার সেন) মত মেনে পুরো প্রবন্ধটিকে তিন ভাগে ভাগ করেছি – ১) ? থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ২) সপ্তদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত, ৩) ১৮০১ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত। ১৮৮০ র পর থেকে ধরা হচ্ছে রবীন্দ্রযুগের শুরু। এবিষয়ে আমি কিছু বলব না প্রথমতঃ এটি বহুল চর্চিত বিষয় দ্বিতীয়তঃ পিপীলিকা সম ক্ষুদ্র আমার কি দুঃসাহস যে হিমালায় সম রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা। আশাকরি জ্ঞানীগুণীজন আমার মতের সাথে সহমত হবেন। আরোও একটা কথা। লেখাটিতে যেমন কিছু নামোল্লেখ আছে তেমনি কিছু নামের অনুল্লেখও আছে। সেটা যে কাউকে বড় আর কাউকে ছোটো দেখানোর জন্য তা কিন্তু নয়। আসলে সবায়ের নামোল্লেখ করতে গেলে লেখাটা মাত্রাছাড়া হয়ে যাবে তাই। আসলে উদ্দ্যেশ্য ছিল এ লেখা সকল লেখক কিংবা তাদের সকল বা আংশিক লেখের পরিচয় খুঁজবে না। সাহিত্যের আধার ধরে জীবনের বিবর্তন পথের যে ক্রমিক দিশাটুকু চোখে পড়ে তাকেই কেবল খুঁজবে।

উপক্রমণিকা

সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গেলে অনিবার্য ভাবে ভাষার ইতিহাসের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। ইতিহাস একান্তই তথ্য ভিত্তিক। তবু সকল তথ্য নিঃশেষে জড় করে দিলে ইতিহাস গড়ে ওঠে না। সাহিত্য আর জীবন অভিন্ন নয়। সাহিত্য আসলে জীবন সম্ভব। সাহিত্য এক বিশেষ কালবদ্ধ বিশেষ বিশেষ মানব গোষ্ঠীর বিবর্তমান জীবন অভিজ্ঞতা ও জীবন বাসনা প্রত্যশার অভিব্যক্তি।

ভাষা নিয়ে দেশ। যে দেশের ভাষা বাংলা সে দেশ বাংলা দেশ। বাংলা ভাষার যখন উৎপত্তি হয় তখন সে ভাষা আধুনিক বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বেশ কিছুদূর অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলা ভাষা যা থেকে অব্যবহিত ভাবে উৎপন্ন সেই প্রত্ন ভাষা অর্থাৎ প্রত্ন-বাংলা-অসমিয়া, প্রত্ন মৈথিলী ও প্রত্ন ওড়িয়া, তার ক্ষেত্র আরোও বিস্তীর্ণ ছিল। তারও আগে এ অঞ্চলে যে ভাষা প্রচলিত ছিল সেই পূর্বী অবহট্‌ঠ বাংলা-আসমিয়া-ওড়িয়ার মতন দক্ষিণ ও পশ্চিম বিহারে প্রচলিত মগহী ও ভোজপুরী ভাষারও জননী। সে ভাষা পূর্বে কামরূপ থেকে পশ্চিমে কাশী পর্যন্ত প্রসারিত ছিল।

সাহিত্য ভাষা নির্ভর। আগে ভাষা পরে সাহিত্য। অথবা ভাষার সাথে সাথে সাহিত্য। যে ভাষা আদিম বা অনুন্নত তাতে হঠাৎ সাহিত্যসৃষ্টি হয় না। তবে যে ভাষা উন্নত কোনো ভাষার রূপান্তর তাতে সাহিত্যসৃষ্টি ভাষার বিকাশের সাথে সাথে ঘটবার পক্ষে কোনো বাধা নেই। বাংলা এরকম ই একটি ভাষা। কথ্য সংস্কৃত কথ্য প্রাকৃ্ত এবং তা থেকে ক্রমে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে কথ্য সংস্কৃতের যে রূপ প্রচলিত ছিল তা ক্রমে প্রাচ্য প্রাকৃ্তে রূপান্তরিত হয় খ্রীষ্টিয় তৃতীয় শতকের অনেক আগেই। আর্যাবর্তে অন্যত্র প্রচলিত প্রাকৃ্ত ভাষার তুলনায় প্রাচ্য প্রাকৃ্ত সংস্কৃত থেকে অনেক বেশী বিচ্যুত হয়েছিল।  এই প্রাচ্য প্রাকৃ্ত কালবশে বাংলা-বিহার-ওড়িশায় যে রূপ ধারণ করেছিল তাকে বলা যায় প্রাচ্য অপভ্রংশের অর্বাচীন রূপ প্রাচ্য আবহট্‌ঠ ( অপভ্রষ্ট)। আনুমানিক ১০০০ অব্দের কাছাকাছি অবহট্‌ঠ পরে তিনটি আঞ্চলিক আধুনিক ভারতীয় ভাষায় পরিণত হয়। পশ্চিমে বিহারী, উত্তর পশ্চিমে মৈথিলী ও পূর্বে বাংলা-ওড়িয়া। বিহারী ভাষা থেকে আধুনিক ভোজপুরী (পশ্চিম বিহার) ও মগহী (দক্ষিণ বিহার) উৎপন্ন। বাংলা ও অসমিয়া বহুদিন একই খাতে বয়েছিল ষোড়শ শতাব্দী থেকে এই দুটি ভাষা ভিন্নপথ ধরেছে।

বাংলা ভাষা জন্মলাভ করার আগে এদেশে ভদ্র সাহিত্যের ভাষা সাধু ভাষা ছিল সংস্কৃত। সংস্কৃত প্রথম থেকেই ছিল উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির ব্যবহার্য ভাষা। উপরন্তু সংস্কৃত সাহিত্য ছিল ভারতবর্ষের সব প্রদেশের সাহিত্যের সাধারণ মূলধন যেমন সংস্কৃত ছিল সব ভারতীয় ভাষার অক্ষয়ভান্ডার। সুতরাং সংস্কৃতে ব্যাপক সাহিত্য সৃষ্টি স্বাভাবিক ভাবেই হয়েছিল। বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু হবার সময়ে এবং তার পরেও অনেককাল পর্যন্ত (প্রায় ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত) উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ সংস্কৃত জানা লেখক প্রধানভাবেই সংস্কৃতেই কবিতা নাটক ইত্যাদি লিখতেন। এইসব রচনায় সমসাময়িক ও পরবর্তি বাংলা সাহিত্যের বিষয়ের ও ভাবের বেশকিছু পূর্বাভাষ মেলে। সুতরাং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেসব রচনার আলচনা কিছু অপ্রাসঙ্গিক কিছু নয়। কোনো কোনো সংস্কৃত রচনা যেমন জয়দেবের কাব্য সাক্ষাতভাবে বাংলা ভাষার ( এবং অন্যান্য কোনো আধুনিক আর্যভাষায়) পদাবলী রচনায় উদ্দীপন ও মালমশলা জুগিয়েছিল।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – প্রথম ভাগ – প্রথম পর্ব

 
সংস্কৃতে রচনা :

বাংলাদেশে সংস্কৃত ভাষায় রচিত সাহিত্যের ইতিহাসকে মোটামুটি তিন পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে , ১) প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়, ২) শিলালেখ ও ৩) সাহিত্যিক পর্যায়। ভারতবর্ষে আর্য সমাগমের তারিখ নির্ণয়ে পন্ডিতেরা একমত নন। তবে খ্রীষ্টজন্মের অন্তত দেড় হাজার বছর পূর্বে যে তাদের আগমন হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। তবে বাংলাদেশে আর্য প্রভাব বিস্তারে আরো অনেক বিলম্ব হয়েছিল। আর্যপূর্ব বাংলা সাহিত্যের পরিচয় অপ্রাপ্যই। পন্ডিতেরা মনে করেন মৌর্যযুগে ( খ্রীঃপূঃ চতুর্থ শতকে) বাংলাদেশে উল্লেখ্য আর্য সংযোগ ঘটে। বাংলাদেশে আর্যভাষায় রচিত প্রাচিনতম শিলালেখটি পাওয়া গেছে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে। লিপিটি খন্ডিত, অনুমান করা হয়েছে তা লেখা প্রাকৃ্তে। পরবর্তী প্রামাণ্য লিপিটি গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সমসাময়িক, বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়াতে পাওয়া গেছে। এটির ভাষা সংস্কৃত। অনুমান করা হয় এটির উৎকর্তা রাজা চন্দ্রবর্মা। এছাড়া গুপ্তযুগের অন্তত আটটি তাম্রলিপি পাওয়া গেছে যাদের লিপিকাল ৪৪৩ থেকে ৫৫৩ খ্রীষ্টাব্দ। কিন্তু আর্য ভাষায় রচনার নিদর্শন সত্ত্বেও খ্রীষ্টিয় সপ্তম শতাব্দীর আগে বাংলাদেশে সাহিত্য গুণান্বিত কোনো গদ্য বা পদ্য লেখার নিদর্শন পাওয়া যায় নি। তবে সংস্কৃতে বাঙ্গালীর রচনার পরিচয় দুর্লভ নয়। এরমধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছে পালকাপ্য রচিত “হস্তি-আয়ুর্বেদ” গ্রন্থ। বিখ্যাত চান্দ্র ব্যকরণ রচয়িতা চন্দ্রাচার্য বা চন্দ্রগামী আলোচ্য যুগে বাংলায় আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে অনুমিত হয়। ৪৬৫ থেকে ৫৪৪ খ্রীষ্টিয় সনের মধ্যে তিনি জীবিত ছিলেন বলে অনুমিত হয়। সাহিত্য গুণ সম্পন্ন শাসন রচনার নিদর্শন পাল রাজাদের সময় থেকে শুরু হয়। উদাহরণ হিসাবে ধর্মপালদেবের দ্বাত্রিংশ রাজ্যাঙ্কে লিখিত মালদহ জেলার খালিমপুরে প্রাপ্ত লিপিটিকে ধরা যায়। কয়েকটি প্রত্নলিপি শাসনপট্ট নয় প্রশস্তি কাব্য। আমাদের দেশে সবচেয়ে পুরান এমন কাব্য হলো নারায়ানপালের মন্ত্রি ভট্ট গুরবমিশ্রের প্রশস্তি। বাংলা ভাষার জন্মের বহু আগে থেকেই এদেশে কবি পন্ডিতেরা সাহিত্য চর্চা করে আসছিলেন। রামচরিত কাব্যের রচয়িতা অভিনন্দ যদি গৌড়ীয় তবে এটি বাঙালীর লেখা প্রথম রামচরিত কাব্য। অন্যদিকে রামপালের মহামন্ত্রী প্রজাপতি নন্দীর পুত্র সন্ধ্যাকর নন্দীও একটি রামচরিত কাব্য লিখেছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগে দুটি বড়ো কবিতা সংকলন গ্রন্থও রচিত হয়েছিল। একটি বিদ্যাকর রচিত সুভাষিতরত্নকেশ দ্বীতিয়টি শ্রীধরদাস সংকলিত সদুক্তিকর্ণামৃত। তবে সংস্কৃত ভাষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি হলেন গীতগোবিন্দের রচয়িতা জয়দেব। এই জয়দেবের জান্মস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বাদেও ওড়িশাতেও জয়দেবের খোঁজ পাওয়া যায়। সেকালের লৌকিক সাহিত্যের গীতিকবিতাকে সংস্কৃতে ঢেলে সাজিয়ে ইনি দেবভাষায় অভিনব কবিতার সৃষ্টি করেছিলেন। জয়দেব এক হিসাবে বাংলা প্রভৃতি আর্যভাষার আদিকবিও বটে। এনারই গীতিকবিতার আদলে বাংলাদেশ, মিথিলা ও অন্যত্র রাধাকৃষ্ণ পদাবলী ও আনুরূপ গীতিকবিতার ধারাস্রোত নেমেছিল।

অবহট্‌ঠ কবিতা :

নবম শতাব্দী থেকে প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত পশ্চিমে গুজরাত থেকে পূর্বে বাংলা পর্যন্ত অবহট্‌ঠ প্রচলিত ছিল লোকসাহিত্যের ভাষা রূপে, সংস্কৃতের হীন বিকল্প রূপে। এই সময় থেকেই অবহট্‌ঠ উত্তরাপথে সংস্কৃতের প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের বৌদ্ধ বজ্রযানিক ও শৈবনাথপন্থী যোগী সিদ্ধাচার্যরা এই ভাষায় অনেক শিক্ষাপ্রদ কড়চা বই ও ছড়াগান লিখে গেছেন। এই রচনা শৈলী পরবর্তীকালের মধ্যে ধারাবাহিত। ঊনবিংশ শতকের বাউল গানে এর পরিণতি। এর বাইরেও অবহট্‌ঠ কবিতা পাওয়া যায় কোনো কোনো গ্রন্থে , শিলালেখ ও একটি সংকলন গ্রন্থে। শিলালেখটিতে যে অবহট্‌ঠ রচনা পাওয়া গেছে সেটি মালবের ( অধুনা মধ্যপ্রদেশ) ধার বা ধারা অঞ্চল থেকে। কিন্তু লেখের শিলাটি ভগ্ন বলে সম্পূর্ণ রচনা পাওয়া যায় নি। নীতিবাক্য, বহুদর্শীর উপদেশ, আবহাওয়া কৃষি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়ে ছড়া অবহট্‌ঠেও প্রচলিত ছিল। খ্রীষ্টিয় চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে সংকলিত অবহট্‌ঠ ছন্দোনিবন্ধ “প্রাকৃত-পৈঙ্গল” গ্রন্থে নানাবিধ কবিতা ও গান পাওয়া গিয়েছে। অবহট্‌ঠে লেখা হলেও এগুলিতে বাংলা ও মৈথিলী প্রভৃতি নবীন আর্যভাষার ছাপও কিছু আছে। এই প্রত্ন-নব্য-আর্যভাষায় সাহিত্যিক রচনা সাধারণত গেয় ছিল। গেয় অর্থাৎ গান বা সুর করে আবৃত্তি করা পদ্য যেমন মানসোল্লাস।

চর্যাগীতি :

আমাদের দেশে সর্বস্তরের সাহিত্যের উন্মেষ হয়েছে ধর্মকে আশ্রয় করে।  বাংলা ভাষারও ক্ষেত্রে তার অন্যথা নেই। বাংলা ভাষা যখন সদ্যোজাত, তার রূপ অত্যন্ত অপরিণত, তখন সংস্কৃত অবলম্বনে বাঙালী শিষ্ট কবি পন্ডিতের সাহিত্য চর্চা চলত। আর যারা শিক্ষিত ও অভিজাত সমাজের ধার ধারতেন না তারা সাধারণের বোধোগম্য ভাষাতে গল্প-গান-ছড়া রচনা করতেন। এই সূত্রেই বৌদ্ধ ও শৈব সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা বাংলা ভাষা সাহিত্যে প্রথম অনুশীলিত হয়েছিল। আজ অবধি যা পাওয়া গেছে তার মধ্যে সিদ্ধাচার্যদের জীবন-তত্ত্ব জ্ঞাপক ও অধ্যাত্ম- অনুভূতি পরিচায়ক চর্যাগীতিগুলোতেই বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শন বিদ্যমান। চর্যাপদাবলী এপর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম বাংলা পুঁথি। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয় এটি নেপালের রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করেন। এতে আসলে তিনটি গ্রন্থ অনুলিখিত হয়েছিল। চর্যাপদ ছাড়া আরো দুটি গ্রন্থ হচ্ছে সরহোপাদের দোহাকোষ ও কানহোপাদের দোহাকোষ। এছাড়াও ডাকার্ণব নামে আরো একটি গ্রন্থ ছিলো। এর মধ্যে কেবল চর্যাপদেই বাংলাভাষার নিঃসংশয় নিদর্শন রয়েছে, বাকি ডাকার্ণব ও দুটি দোহাকষ – এর ভাষা পশ্চিমা অপভ্রংশ।

চর্যাসংগ্রহে মোট ৫১টি গানছিল। তার মধ্যে একটি টীকাকার মুনিদত্ত ব্যাখ্যা করেননি বলে পুঁথিতে অনুল্লেখিত। আর পুঁথির মধ্যেকার কয়েকটি পাতা নষ্ট হাওয়ায় তিনটি সম্পূর্ণ ও একটি পদের শেষাংশ অপ্রাপ্ত। অতএব পুঁথিতে মোট সাড়ে ছেচল্লিশ খানা গান পাওয়া গেছে। চর্যায় সর্বমোট ২৪টি পৃথক কবিনামের ভণিতা রয়েছে – আর্যদেব, কঙ্কণপা, কম্বলা ম্বরপা, কানহপা, কুককুরীপা, লুইপা, ভুসকুপা ইত্যাদি। এদের মধ্যে অনেকেই ঐতিহাসিক ব্যাক্তি ছিলেন। অবশ্য অন্য অনেকের পরিচয় আবিষ্কার করা দুরূহ।

রাহুল সংকৃত্যায়ন নেপাল তিব্বতে তালপাতার পুঁথিতে কয়েকটি নতুন করে চর্যাগীতি আবিষ্কার করেছিলেন।  এগুলি প্রাচীন চর্যাগানের মকশ।  এই পুঁথিগুলিতে বিনয়শ্রী, সরুও ও অবধূ এই তিন নতুন কবির চর্যাগান পাওয়া যায়। এনারা যে প্রাচীন চর্যাগীতিকারদের পরবর্তী তা প্রাচীন চর্যাগানের রূপ ও রূপকের অনুকরণ থেকে বেশ বোঝা যায়। মুসলমান অভিযানের পরথেকে বাংলা দেশের চর্যাগীতির ধারা অব্যাহত থাকেনি।  তবে বিলুপ্তও হয়নি।  অধ্যাত্ম সাধকদের সাহিত্য কর্মে এই বিশিষ্ট ভঙ্গিটি সাধারণের লোক গোচরের বাইরে থেকে কোনো কোনো সাধক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলন পায়। নাথ-পন্থি যোগীরা এই ঐতিহ্যের অধিকারী। তবে বৈষ্ণব কবিদের সাথে চর্যাগীতিকারদের এক বিষয়ে বেশ পার্থক্য আছে। চর্যাগীতির বাহ্য অর্থের বিষয় সমসাময়িক জীবন থেকে নেওয়া, সে জীবন অত্যন্ত সাধারণ লোকের। কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলীতে সমসাময়িক বা অতীত কোনো কালেরই সাধারণ মানবজীবনের সমাজ সংসারের কোনো কথা নেই।

ত্রয়োদশ – চতুর্দশ শতাব্দী ও তুর্কি আক্রমণ :

বাংলাদেশে তুর্কি আক্রমণ ঘটে ১২০২ খ্রীষ্টাব্দে। যদিও উত্তরাপথে তারও দুই শতক আগে মুসলিম রাজতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল। বক্তিয়ার খিলজি সতের জন (মতান্তরে আঠের জন) অশ্বারহী সৈন্য নিয়ে নবদ্বীপ আক্রমণ করে সেন বংশের রাজা লক্ষ্মণসেনকে পরাজিত করেন। কথিত যে বৃদ্ধ রাজা খিড়কির দরজা দিয়ে মহিলার ছদ্মবেশে পলায়ন করেন। যদিও পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা অনেকাংশে এ লজ্জার অপনোদন করেছিলেন। আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে বাঙালী যথার্থই বিপর্যস্ত ও অভিভূত হয়ে পড়েছিলো। তারা বিধর্মী তুর্কিদের থেকে শাসন সীমা থেকে দীর্ঘকাল পালিয়ে ফিরেছে, পালিয়েছে প্রাণের ভয়ে, মনের ভয়ে, ধর্ম সংস্কারের অবলুপ্তির ভয়ে। যদিও বক্তিয়ার খিলজি শাসকের ভূমিকায় শান্তি স্থাপনে প্রয়াসী হয়েছিলেন কিন্তু তিন বছর খানেকের মধ্যে তাকে ক্ষমতালোলুপ সহকারীর হাতে প্রাণ দিতে হয়।  আবার তার আততায়ী আলি মর্দানকে প্রাণ দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। তারপর সার্ধ শতাব্দী ধরে বাংলার মাটিতে রাজ্যলিপ্সা, জিঘাংসা, যুদ্ধ, হত্যা, আততায়ীর হাতে মৃত্যু – ভয়াভয়তার কোনো সীমা ছিল না। ফলে বাঙালী অধিবাসীরা ধন-মান-প্রাণ তথা জাতির ভয়েও গেছিলেন বঙ্গের পূর্বে উত্তর প্রত্যন্তর দুর্গমতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, নদীমাতৃক দুর্গমতায় যেখানে নতুন আক্রমণের প্রতিষ্ঠা সহজ ছিলো না। দেশ ছেড়ে পালানোর সময় হিন্দুরা নিজেদের ধনরত্ন সহ পুঁথিপত্রও সাথে নিয়ে গেছিলেন। প্রধানত এই কারণেই বাংলা কাব্য কবিতার বহু দুর্লভ নিদর্শন আবিষ্কৃত হতে পেরেছে পূর্ব ও উত্তর পূর্ব প্রত্যন্ত প্রদেশ দেশ থেকে।  চর্যা পদাবলীও বিনষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে নেপালভূমির সাংস্কৃতিক আতিথ্যে। এই সময় অর্থাৎ ১২০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে অন্তত ১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের বিশেষ কোনো হদিশ পাওয়া যায় না। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ রচিত হয়েছিল এমন দুচারটি গান বা ছড়া বাদে আর কোনো কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে পরবর্তী কালের সাহিত্যের গঠন, প্রকৃতি ও বস্তু বিচার করে বলা যায় যে এইসময়ে মনসার কাহিনী, ধর্মঠাকুরের কাহিনী, চন্ডীর কাহিনী ইত্যাদি দেশীয় বস্তু ও রামায়ণ-কৃষ্ণলীলা কাহিনী ইত্যাদি পৌরাণিক বস্তু ছোটবড় গানে বা পাঁচালীতে নাচগানের সাথে গ্রামোৎসব বা দেবপূজা উপলক্ষে পরবেশিত হত। গোড়ায় লৌকিক সাহিত্যের মোটামুটি তিনটি ধারা ছিল। প্রথম ধারা গান, দ্বিতীয় ধারা ছড়াগান, তৃতীয় ধারা গেয় বা বাচনীয় আখ্যান। গান ছোট বড়ো দুরকমেরই ছিল ও তা মেয়েলি ব্রতে, গ্রাম্য ও গার্হস্থ্য উৎসবে গাওয়া হত। গোড়ার দিকে মেয়েলি ব্রতের গানে সাহিত্যরসের সঞ্চার ছিল না। গ্রাম্য উৎসব হতো নানা উপলক্ষে – ফসল বোনার ও তোলার সময়, ঋতু উৎসব, গ্রামদেবতার বাৎসরিক অনুষ্ঠানে। গার্হস্থ্য উৎসব হতো ছেলেমেয়ের জন্মে ও বিবাহে, শান্তিস্বস্তয়নে, শ্রাদ্ধ, গৃহদেবতার নৈমিত্তিক পূজায়।

ঋণ স্বীকার :
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড) – ডঃ সুকুমার সেন।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম পর্যায়) – ভূদেব চৌধুরী।
বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – ভূদেব চৌধুরী।
লেখক পরিচিতি
শৈবাল বসু

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে স্নাতক। পেশাগত ভাবে গত ৩৪ বছর ধরে ব্যাঙ্কার। নেশাগত ভাবে শরদিন্দু ও ইতিহাস প্রেমী। বর্তমানে কলকাতা ও বাংলার ইতিহাস নিয়ে চর্চারত।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. অসম্ভব তথ্যবহূল লেখা। অনেক কিছু জানতে পারলাম। বাংলা সাহিত্যের এই প্রাচীন অংশটি সম্পর্কে আমার প্রচুর কৌতূহল। লেখকের কাছে একান্ত অনুরোধ, প্রতি শতাব্দীতে বাংলা লিপির সামান্য/ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ সম্বন্ধে যদি প্রমাণসহ আলোকপাত করেন।

  2. সৃজিত্ বাবু আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটি পড়ে আপনার মূল্যবান মতামত দেবার জন্য। আপনার অনুরোধ রাখার চেষ্টা করবো আমার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে। তবে আগে সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে লেখাটা শেষ করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!