Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ২৩
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ২৩

গোপা মিত্র

চাঁদিপুর – গোপালপুর

এখানে সে ধীর, স্থির, শান্ত, নম্র, গুটিগুটি পায়ে আসে, আবার সে ভাবেই ফিরে যায়। মানুষ পেলেই বিনম্র চিত্তে তার পাদস্পর্শ করে। অন্যখানে সে অস্থির, উত্তাল, দুদ্দাড় বেগে আসে, আবার সে ভাবেই ফিরে যায়। মানুষ পেলেই টেনে নিয়ে যেতে চায়, সঙ্গে চলে নিরবচ্ছিন্ন গর্জন। দুজনেরই অবস্থান ওড়িশায়-প্রথমজন চাঁদিপুর রয়েছে বালাসোর জেলায়, দ্বিতীয়জন গোপালপুর রয়েছে গঞ্জাম জেলার বেরহামপুর সাবডিভিসনে। উৎস একই –বঙ্গোপসাগর হলেও, দুই সমুদ্রসৈকতে তাদের বিপরীত রূপ।

সব বাঙালীরই সমুদ্র ভ্রমণের হাতেখড়ি হয় পুরী বা দীঘা দিয়ে। তাই আমি আর এখন সেদিকে না গিয়ে আমার পছন্দের কাছেপিঠের দুই সমুদ্রসৈকত চাঁদিপুর আর গোপালপুর নিয়ে লিখতে বসেছি।

চাঁদিপুর :

 

১৯৯০ সালের এক সকালে হাওড়া থেকে ধৌলি এক্সপ্রেসে বালেশ্বর বা বালাশোর ষ্টেশনে এসে নামলাম আমরা ছজন – আমি, কল্যাণ, সোনাই, ভগিনীসম নন্দিনী, দীপকদা ও তাদের ছোট্ট মেয়ে দর্শনা। সেখান থেকে অটোয় এসে পৌঁছলাম ষ্টেশন থেকেমাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরের এই সমুদ্রসৈকত চাঁদিপুরে।

১৫ই আগস্টের ছুটির সঙ্গে কয়েকটা দিন জুড়ে নিয়ে হঠাৎ করেই চলে আসা। এসেই চললো হোটেলের খোঁজ। OTDC-র হোটেল পূর্ণ। সমুদ্রতীরবর্তী আরো কয়েকটা হোটেলেও ঠাঁই নেই। সামান্য দূরে জায়গা পেলাম হোটেল শুভম এ। তাও মাত্র একটা ঘর। অন্ততঃ আজ রাতের মত মাথা গোঁজার একটা জায়গা পাওয়া গেলো। আসার পথেই অবশ্য আনন্দময়ী হোটেলে বুকিং করে এসেছি। ঘর খালি হলে কাল আমরা সেখানেই চলে যাবো।

সময় অল্প। তাই বিকেলেই পায়ে হেঁটে আমরা এগিয়ে চললাম ৩ কিলোমিটার দূরের বলরামগড়িতে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এখানেই বুড়ীবালামের সাগরসঙ্গমে বাঘা যতীনের (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিলো ইংরেজদের। সুন্দর মোহনা। চলছে জেলেদের মাছ ধরা।

পরদিন সকালেই আমরা চলে এলাম আনন্দময়ী হোটেলে – সম্ভবতঃ অনেক পুরনো। বেশ বড়ো বড়ো ঘর। হোটেল থেকে সোজা সামনের দিকে গাছপালার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলেই দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র। এ এক আশ্চর্য সমুদ্রসৈকত – প্রতিদিন ভাটার টানে সমুদ্রের জল সরে যায় প্রায় ৫ কিলোমিটার মতন দূরে। তখন জলের নাগাল পেতে অনায়াসেই হেঁটে যাওয়া যায় সমুদ্রের বুকের ওপর দিয়ে। আবার জোয়ারে জল ধীরে ধীরে ভরিয়ে ফেলে শক্ত বালুর বেলাভূমি। ঝাউ, কাজু প্রভৃতি গাছে ছাওয়া চাঁদিপুরের শান্ত নিরিবিলি সমুদ্রসৈকতের এটাই হল বৈশিষ্ট্য বা নিজস্বতা।

সকালে প্রাতঃরাশের পর আমরা পৌঁছে গেলাম সমুদ্রতীরে – সমুদ্র তখন ভাটার টানে অনেক দূরে। সোনালী বালুবেলায় বসে আমরা শুরু করলাম গল্পগুজব। আস্তে আস্তে মজার এই সমুদ্রের জল বাড়তে বাড়তে এসে পৌঁছলো আমাদের কাছে – পা থেকে জল উঠে প্রায় ডুবিয়ে দিল আমাদের মাথা। তখন প্রায় বারোটা, জোয়ার এসেছে। আমরা না্মলাম সমুদ্রস্নানে। নিজেদের ছেড়ে দিলাম সমুদ্রে। ঢেউয়ের ওঠাপড়ায় আমরাও উঠলাম, নামলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক সমুদ্রযুদ্ধ করে বিজয়ী আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।

বিকেলে টুক্‌টুক্‌ করে হেঁটে গেলাম বালি মাড়িয়ে। ছোট ছোট লাল কাঁকড়াগুলো বালির গর্ত থেকে উঁকি মেরে আমাদের দেখেই আবার গর্তে ঢুকে গেলো। ছুটে ছুটে কুড়িয়ে বেড়ালাম বেলাভূমি থেকে চিত্রবিচিত্র ঝিনুকগুলো। জেলে নৌকোগুলো তখন মাছ ধরে ফিরে এসেছে। তাদের নিয়ে আসা মাছের মধ্যে থেকে একরকম মাছ তারা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে সমুদ্রে বা বালিতে। শুনলাম এগুলো ‘পাফার ফিশ’বা ব্যাঙ মাছ – অনেকটা চাঁদা মাছের মত দেখতে। এই প্রথম দেখলাম এমন মাছ –এরা প্রয়োজনে নিজেদের বেলুনের মত ফুলিয়ে ফেলতে পারে। অন্য মাছের সঙ্গে ওঠা এই মাছ খাওয়া যায় না, তাই ছূঁড়ে ফেলা।

বর্ষায় এসেছি, অথচ বৃষ্টি পাবো না, এমন আবার হয় নাকি! অনেকদিন আগে নৈনিতাল ভ্রমণে গিয়ে রাতের অন্ধকারে পাহাড়ে দেখেছিলাম বর্ষার এক অনবদ্য রূপ (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৪) । আজ এখানে, সকালে, সমুদ্রে দেখলাম বর্ষার অন্য এক রূপ। মাথার ওপরে ব্যপ্ত বিশাল এক কালো মেঘের চাদর। সামনে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র, তার জলও তখন মেঘের ছায়ায় কালো। মেঘ আর সমুদ্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কোন্‌ সে এক সুদূর দিগন্তে। প্রথমে ঝিরিঝিরি, যেন সে জানান দিল যে সে আসছে – তারপর ঝোড়ো বাতাসে গাছপালা প্রায় শুইয়ে দিয়ে নেমে এলো ঝম্‌ঝম্‌ করে। বৃষ্টির স্বচ্ছ জলের পর্দায় সমুদ্র যেন কোথায় হারিয়ে গেল নাকি লুকিয়ে গেল। ঝরে পড়া জলধারা ছাড়া চোখের সামনে তখন আর কিছুই দেখছি না, কানে শুধু বাজছে এক বেতালা বেসুরো মিশ্র শব্দ – ঝম্‌ঝম্‌, শোঁশোঁ, আর তীরে এসে পড়া ঢেউএর আছাড়িপিছাড়ি ধাক্কা। ভিজে ভিজেই আমরা সবাই ছুটলাম হোটেলের দিকে – আমাদের নিরাপদ আশ্রয়ে।

বিকেলে বৃষ্টি নেই। প্রকৃতি শান্ত। আমরা আবার বার হলাম হাঁটতে, যতদূর যাওয়া যায়। চারিপাশের সবুজ প্রকৃতি ধুয়ে গিয়ে আরো উজ্জ্বল মনে হচ্ছে, বালুবেলা ভিজে ভিজে হলেও কোথাও জল দাঁড়িয়ে নেই। সন্ধ্যা হলেই ফিরে এলাম হোটেলে।

পরদিন চলেছি পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। বালেশ্বর ষ্টেশন থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ওড়িষার শৈবতীর্থ পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। নীলাগিরি পাহাড়তরঙ্গের মাঝে (এই নীলাগিরি পশ্চিমঘাট পর্বতমালার নীলগিরি নয়) রয়েছে ছোট্ট এক জনপদ –যেদিকে তাকানো যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। শাল, মহুয়া, জারুল, শিরীষ, আকাশমণি, অশোক, ছাতিম, আরো কত নাম না জানা গাছের সহাবস্থান, মাঝেমাঝেই ফুটে থাকা রংবেরঙের ফুল, প্রজাপতির ওড়াউড়ি আর পাখীর ডাক – প্রকৃতিপ্রেমিকদের স্বর্গ বলা যায়। এখানেরই এক পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উঠে যাওয়া পাহাড়ের ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে পৌঁছতে হয় দেবতা পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের কাছে। আসলে বিরাট এক পাথরের চাতাল, পাশ দিয়ে তার বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী এক ঝরণা, তার নিচে এক পাথুরে খাঁজের জলভর্তি গর্তে রয়েছে ছোটো ছোটো পাঁচটি শিবলিঙ্গ – পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। পাথরের ওপর প্রায় শুয়ে পড়ে সেই জলভর্তি গর্তে হাত ঢুকিয়ে স্পর্শ করতে হয় সেই শিবলিঙ্গগুলি। কথিত আছে, সীতা বনবাসের সময় এই শিবলিঙ্গের পূজো করেছিলেন। আবার অন্যমতে বাণাসুর এই স্বয়ম্ভূশিবের পূজো করেছিলেন। প্রতিবছর শিবরাত্রিতে ৩ দিন ও মাঘ মাসের সপ্তমী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাহাড়ের পাদদেশে মেলা বসে এখানে।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার পথের পাশেই চারিদিকের সবুজ প্রকৃতির মাঝে রয়েছে, OTDC-র এক পান্থশালা।পাহাড়ে মেঘ রোদ্দুরের খেলা আর চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবুজ প্রকৃতির বন্য সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সময়টা যেন কোথা দিয়ে কেটে গেল। ফেরার পথে দেখে নিলাম রেমুনায় শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতিবিজড়িত বৈষ্ণবতীর্থ ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির।

সন্ধ্যেবেলা এক বিপত্তি। কাঁচের গ্লাসের ভাঙা কাঁচে কল্যাণের বাঁহাতের এক আঙুল কেটে রক্তারক্তি কান্ড। রক্ত কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। তখন দীপকদা, ভাগ্যে সঙ্গে ছিলেন, কল্যাণকে নিয়ে চললেন কোথায় কোন ডাক্তার আছে; তার খোঁজে। অন্ধকারে, অচেনা জায়গায় রিক্সাওয়ালাই ভরসা। সেই, দুজনকে নিয়ে চললো কোনো এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানের ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়ে রক্ত বন্ধ করে ব্যান্ডেজ বেঁধে, ইঞ্জেকশন দিয়ে ছেড়ে দিলেন।

পরদিন কলকাতায় ফিরে আবার ডাক্তার দেখানো হলে, তিনি বললেন যে, সেলাই করলেই ভালো হতো। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। পরে ঐ আঙুলের অনেকদিন ফিজিওথেরাপি করতে হয়েছিলো।

শুনেছিলাম চাঁদিপুরে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত চমৎকার ভাবে দৃশ্যমান, তবে মেঘের কারণে সে আর দেখা হল না।

চাঁদিপুর ভ্রমণ এভাবেই শেষ হল। তবে শেষের আনুষঙ্গিকটা না হলেই ভালো হত।

 

 

গোপালপুর :

 

এর একবছর পরে ১৯৯১ সালে গিয়েছিলাম গোপালপুর অন সি আমরা চারজনে – আমি, কল্যাণ, সোনাই আর কল্যাণের প্রিয় বন্ধু শঙ্কর, তবে বর্ষায় নয়, শরতে। গিয়েছিলাম পূজোর পরে – ইচ্ছে এবার কোজাগরী পূর্ণিমায় দেখবো সমুদ্রের রূপ।

হাওড়া চেন্নাই (তখন মাদ্রাজ) রেলপথের বেরহামপুর রেলষ্টেশন থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে গোপালপুর সমুদ্রসৈকত একসময় ছিল সাহেবদের খুবই প্রিয়। এই সি-বিচ্‌টি পুরীর মত অত জনপ্রিয় না হলেও এর সৌন্দর্য কিন্তু অসাধারণ। অন্ধ্রপ্রদেশের সীমানায় অবস্থানের কারণে এখানে ওড়িয়ার চেয়ে তামিল ভাষার চল বেশী।

ষ্টেশন থেকে গাড়ী করে হোটেলে যাবার পথে কিছুদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে সবুজ ধান ক্ষেত। তারপরই বদলে যায় দৃশ্য। ঝাউ, পাম আর নারকেল গাছের সারির ফাঁক দিয়ে দেখা যায় গোপালপুর সমুদ্রের নীল জলরাশি। আর একটু এগিয়ে বেলাভূমির সামনেই আমাদের হোটেল ‘মোটেল মারমেড’। একজন বিদেশিনী তখন সেই মোটেলের কর্ণধার। সামনের বালুভূমি পেরোলেই দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র তার রূপের ডালি সাজিয়ে যেন অপেক্ষা করছে আমাদেরই জন্যে।

চমৎকার হোটেল। দোতলায় পাশাপাশি দুটি ঘর আমাদের। ঘর থেকেই দেখা যায় সমুদ্র, কানে আসে তার গর্জন।

বিকেলে বার হলাম প্রায় জনহীন, শান্ত, নিরিবিলি, সমুদ্রতীর ধরে হাঁটতে। দুএকটি হোটেল চোখে পড়ছে, তার কয়েকটি আবার লোনা হাওয়ার কারণে নষ্ট হতে বসেছে। নীল আকাশের নিচে নীল সমুদ্রের কোল ঘেঁষে সোনালী বালির বিস্তীর্ণ বেলাভূমি। দূর থেকেই দেখা যায় বঙ্গোপসাগরের বুকে মোচার খোলার মত ভেসে থাকা পালতোলা নৌকোগুলো। সারাদিন ধরে মাছ ধরে চলেছে জেলেরা, আর মাছের আশায় তাদের মাথার ওপরে উড়ে চলেছে গাংচিলরা।

পরদিন সকালে চললাম সমুদ্রস্নানে। গো্পালপুরের সমুদ্রের গভীরতা ওড়িশার অন্যান্য সমুদ্রসৈকতের তুলনায় বেশী। চোরাস্রোতও আছে। সমুদ্রে উপলখন্ডেরও ছড়াছড়ি। তাই সমুদ্রস্নানের স্থান নির্দিষ্ট করা আছে। বড়ো বড়ো ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে, সঙ্গে চলছে গর্জনও। তাই খুব সাবধানেই স্নান করতে হল। ব্যস ঐ একদিনই – ঐ বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সামনে দ্বিতীয়বার আর নামতে সাহস হয়নি।

গোপালপুরের সমুদ্রসৈকত ভারতের অন্যতম সেরা সমুদ্রসৈকতই শুধু নয়, সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন সৈকতও বটে।

বিকেলে চলেছি শহর বেড়াতে – একটু ভিতরে। সাজানো পরিচ্ছন্ন শহর, মাঝেমাঝেই চোখে পড়ে সাহেবী আমলে্র বাড়ীগুলি, যার অনেকগুলিই এখন পরিবর্তিত হয়েছে গেস্টহাউস বা হোটেলে। এর মধ্যে চোখে পড়বেই অনেকখানি জায়গা নিয়ে বাগান দিয়ে সাজানো, সাহেবদের আমলে তৈরী এখানের সবচেয়ে বড় হোটেল, ‘পাম বিচ হোটেল’। শুনেছি এখন তার হাত বদল হয়ে, চলে গেছে ওবেরয় গ্রুপের হাতে।

পরদিন ভোরে সূর্যোদয় দেখে প্রাতঃরাশ সেরে চললাম পায়ে হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত বিচের কাছেই গোপালস্বামী মন্দিরে। দেবতা শ্রীবেনুগোপাল স্বামীভারণা। নিরিবিলি নির্জনে এই মন্দিরে পান্ডার কোন উপদ্রব নেই। অনুমান গোপালজীর নামেই এখানের নামকরণ।

বিকেলে চললাম লাইটহাউসে। অনেকগুলো সিঁড়ি উঠে উপরে পৌঁছতে হয়। অতীতে এখানে ছিল এক বন্দর। তখন এখান থেকেই আলো দেখানো হত নাবিকদের। এত উপর থেকে গোপালপুর শহর চমৎকার ভাবে দৃশ্যমান।

পূর্বমুখী হওয়ার জন্য এখান থেকে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্যও দেখা হল। নীল সমদ্রেরজল তখন রাঙা আবীরগোলা, হলুদ বালুবেলাও অদ্ভূত এক লালচে হলুদবর্ণ ধারণ করেছে। অস্তগামী সূর্যের নরম কিরণে প্রকৃতি তখন প্রায় সবদিকেই লাল রঙ ছড়াচ্ছে। সূর্যোদয় আর সুর্যাস্ত দুইই দেখা হল এখান থেকে। তফাৎ শুধু একটাই – সূর্যোদয়ের লাল রং, অন্ধকার দূর করে আর সূর্যাস্তের লা‌ল রং, অন্ধকারকে আবাহন করে।

গোপালপুরে আছে এক সবুজে ঘেরা ব্যাকওয়াটার ক্রীক ও লেগুন। এর আকর্ষণও কম নয়।

গোপা্লপুরে আর বিশেষ কিছুই করার নেই। শুধু নীল সমুদ্র আর কাজুগাছের সারির পাশ দিয়ে, ঢেউএর গর্জন কানে নিয়ে, লোনা বাতাসের স্পর্শ মেখে, সোনালী বালুতট ধরে হেঁটে চলা আপন মনে বা নিরিবিলি বালুতটে বসে আনমনে সমুদ্রের ঢেউ গোনা দূরের পালতোলা জেলে নৌকোগুলো দেখতে দেখতে আর হারিয়ে যাওয়া চেনা জগৎ থেকে অচেনায়।

আজ কোজাগরী লক্ষী পূর্ণিমা। আজকের জন্যই তো প্রতীক্ষা আমাদের। পুর্ণিমার চাঁদের আলোয় আজ দেখবো সমুদ্র। এখানে এদের বিশ্বাস এই যে, আজ স্বয়ং লক্ষ্মী দেবী উঠবেন সমুদ্র থেকে। এদের বিশ্বাস নিয়ে আমি কোন বিতর্কে যেতে চাই না। আমি শুধু চাই আজ যেন কোন কারণেই চাঁদ চলে না যায় মেঘের আড়ালে।

সন্ধ্যায় সমুদ্র তীরে বসে আছি আমরা – অপেক্ষা চন্দ্রোদয়ের। এমন সময় দিকবিদিক উদ্ভাসিত করে এক নরম আলো আমাদের জানিয়ে দিল সেই বহু প্রতীক্ষিত, আকাশের বুকে চাঁদের তরণীর আগমন বার্তা। মাথার ওপরে তখন পূর্ণচন্দ্র, চোখের সামনে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত সমুদ্র আর সোনালী বালুবেলা। জোয়ারের টানে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউগুলো ফস্‌ফরাসের প্রভায় উজ্জ্বল হীরকদ্যুতি ছড়িয়ে তীব্র বেগে তীরে এসে আছড়ে পড়ে শুভ্র বর্ণের উজ্জ্বল ফেনায় ভেঙে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে তীরে বা সমুদ্রে। বালুবেলাও তখন স্বর্ণদ্যুতিময়। নীল সমুদ্রে তখন যেন এক অদ্ভূত নীলচে আলোর বান ডেকেছে। লক্ষ্মীদেবী সত্যি আসেন কিনা আমি জানি না, তবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়্‌, এমন অপার্থিব, অলৌকিক রাতে আলো নাকি রূপের ছটা বিচ্ছুরিত করে হয়ত সত্যিই তিনি আসছেন – সমুদ্রের গর্জন হয়ত তারই আগমনের শঙ্খনিনাদ।

কতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে বসেছিলাম জানি না, কিন্তু উঠে পড়তেই হল। আজ রাতেই সব গুছিয়ে রাখতে হবে – কারণ কাল যাবো তপ্তপানি।

বেরহামপুর থেকে সড়ক পথে ৫০ কিলোমিটার আর গোপালপুর থেকে ৬৬ কিলোমিটার দূরে উষ্ণপ্রস্রবণ কেন্দ্র তপ্তপানি। পূর্বঘাট পর্বতমালার ঢালে প্রায় ১৭০০ ফুট উচ্চতায় তপ্তপানির উষ্ণকুন্ড। এখানের গন্ধকমিশ্রিত উষ্ণজল চর্মরোগ প্রশমনের সহায়ক।

মসৃণ কালো পিচ রাস্তা বাঁক খেয়ে চলে গেছে কোন্‌ দূরে, পাশে রেখে গেছে পান্থনিবাস। পশ্চাৎপটে তার পাহাড়ি ঢেউ, চারপাশে তার শ্যামল বন। চারিদিকের অরণ্য পাহাড় বেষ্টিত প্রকৃতির মাঝে OTDC-র এই পান্থনিবাসটি আমাদের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিল। এখানে ভি. আই. পি. বাংলোটি সত্যি অনবদ্য। তবে আমরা অবশ্য সেখানে জায়গা পেলাম না। প্রথমেই ডাইনিং হল, তারইসংলগ্ন ভি আই পি বাঙলোটি পার হয়ে সরু রাস্তা ধরে বনপথে কিছুটা এগোলেই পড়ে রাতযাপনের ছোট ছোট কটেজগুলি। এরই একটিতে ঠাঁই হল আমাদের – একতলায় শঙ্কর দোতলায় আমরা। দোতলায় ঘর সংলগ্ন ব্যলকনির নিচ থেকেই গভীর জঙ্গল নেমে গেছে অতলান্ত খাদে, তার পিছনেই প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে নাতিউচ্চ গিরিশ্রেণী – নামগুলি ভারি অদ্ভূত – খেমন্তিতাল, ঘোড়াঅম্বা,  ঝান্ডামোড়া।  হট স্প্রিং এর গরম জল পাইপের মাধ্যমে এখানের সব ঘরেই আসে।

পান্থনিবাস চত্বরের সবুজের সমারোহ মন ভরিয়ে দেয়, মনে হয় পাহাড়ী বন যেন ঢুকে এসেছে এই চত্বরে। কতরকম গাছ – পাতাবাহার, দেবদারু, আম, লেবু। এছাড়াও রয়েছে ফুলে ভরা নানারকম ফুলগাছ।

পান্থনিবাস থেকে বাঁদিকের উৎরাই পথে নামলেই পড়ে ডিয়ার পার্ক আর ডানদিকের চড়াই পথে কিছুটা উঠলেই পড়ে তপ্তপানির উষ্ণ প্রস্রবণ ও ছোট্ট একটি বাজার। উষ্ণ প্রস্রবণের চারিধার বাঁধানো। জলের মধ্যেই রয়েছে কতকগুলি শিলা। স্থানীয়রা এগুলিকেই দেবদেবী হিসাবে পূজা করে। পাশেই রয়েছে মহিলা ও পুরুষদের জন্য পৃথক স্নানের ব্যবস্থা।

সকালে এখানে ঘুম ভাঙে পাখীর কূজনে আর বিকেলে এখানে সন্ধ্যা নামে এদের কুলায় ফেরার কলতানে।

আজ পুর্ণিমার পরদিন। আকাশে আজও প্রায় পূর্ণচন্দ্র। তারই উছ্‌লে পড়া স্নিগ্ধ কিরণে নিচের কমণীয় বনভূমি আর দূরের গিরিশ্রেণীর আবছা সিল্যুয়েট – রাতের প্রকৃতির আরো এক মোহময়ী অনবদ্য রূপ দেখলাম আজ এই ব্যালকনি থেকে। রাতের এমন অপ্রাকৃত রূপ তো আমি আগেও দেখেছি লোলেগাঁও, রিশপে (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ২০ ও ২১), জয়সলমীরে (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১২) বা কেদারনাথে (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৭)। এবারে দেখলাম এখানে এসে, এই তপ্তপানিতে। ভাগ্যে পাইনি, ভি আই পি বাংলোতে জায়গা – তাই তো হলাম এমন দুর্লভ দৃশ্যের সাক্ষী।

পরদিনও কেটে গেল একই ভাবে। দূষণমুক্ত প্রকৃতির মাঝে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়ে।

কালই বেরহামপুর থেকে ট্রেন ধরে ফিরে যাব, প্রকৃতি বিবর্জিত ইট-কাঠ-পাথরে আবদ্ধ কলকাতার ‘সভ্য’ পরিবেশে। ফিরতে অবশ্য আমাদের হতই, কারণ সেটাই আমাদের Destiny।

চাঁদিপুরের নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের বর্ষার রূপ আর গোপালপুরের তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে জ্যোৎস্নার রূপ – দুইই তো আমাকে মুগ্ধ করেছে। নিরিবিলি, নির্জন, কাছেপিঠের, এই দুই সমুদ্রসৈকত তাই আমার বড়ই পছন্দের।

লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. যতদিন স্মৃতি betray না করবে, ততদিন আমার ভালো লাগাগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই।

  2. পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ জুড়ে যে জিনিষটা আছে, তার বর্ণনা বেশ দক্ষতার সঙ্গেই করেছেন লেখিকা।

    1. বর্ণনা দক্ষতা এসব জানি না , আমার দেখাটা সকলের সঙ্গে share করতে চেয়েছি মাত্র ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!