Home প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – দ্বিতীয় ভাগ – প্রথম পর্ব
প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – দ্বিতীয় ভাগ – প্রথম পর্ব

শৈবাল কুমার বোস

১) মোগল শাসন ও সপ্তদশ শতাব্দী

ষোড়শ শতাব্দীর শেষপাদে আকবর বাংলাদেশ অধিকার করেছিলেন, তবে তখনকার দিনে বাংলা বলতে যে ভূভাগ বোঝাতো তার সর্বত্র মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল। বাংলাদেশের স্থানে স্থানে বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অল্পবিস্তর স্বাধীন পকেট ছিল, সেখানকার ভূস্বামীরা বা ভুঁইয়ারা সকলেই পরে মোগলের বশ্যতা স্বীকার করেছিল। সেই সময় থেকে ঔরংজেবের মৃত্যুকাল (১৭০৭) পর্যন্ত বাংলাদেশ দিল্লি থেকে প্রেরিত সুবেদারদের দ্বারা শাসিত হতো। তারা বাদশাহের ফরমান নিয়ে আসতেন ও কাজের শেষে বা ডাক পড়লে দিল্লি ফিরে যেতেন। তারা বাংলাভাষী ছিলেন না ও বাংলা সংস্কৃতির প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণ ছিল না। সুতরাং সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্য রাজশক্তির আনুকুল্য থেকে বঞ্চিত ছিল। তবে রাজা মানসিংহ যতদিন বাংলার সুবেদার ছিলেন ততদিন তিনি হিন্দু সংস্কৃতি রক্ষায় কিছু যত্নবান ছিলেন। জাহাঙ্গির মসনদে বসেই মানসিংহকে দিল্লি তলব করেন ও তার জায়গায় অবাঙ্গালী সুবেদার নিযুক্ত করেন। ফলে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে মিটমাটের কিছু বাধা সৃষ্টি হয়েছিল। মানসিংহ ও তার উত্তরাধিকারীদের মতো বৈষ্ণবভাবাপন্ন রাজপুত রাজসভায় বাঙ্গালী পন্ডিতেরা সাদরে স্থান পেতে লাগলেন। ঔরংজেবের আমলে বৃন্দাবন-মথুরার দেববিগ্রহ বিভিন্ন রাজপুত রাজধানীতে স্থানান্তরিত হবার সাথে সাথে বহু বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ-পুজারী ও বৈষ্ণব পন্ডিত ব্রজধাম ও বাংলাদেশ থেকে রাজপুতনায় গেছিলেন।

চৈতন্য ধর্মের প্রভাবে সাধারণ বাঙ্গালীর চিত্তসংস্কার অনেকটাই হয়েছিল। অ-ব্রাহ্মণ লোকেদের মধ্যে শিক্ষা-লেখাপড়ার প্রসার বেড়েছিল। বৈষ্ণবঘরের মেয়েরাও কেউ কেউ পুরুষের সমান শিক্ষা লাভ করতো। কিন্তু ব্রাহ্মণদের স্মৃতিশাসন দিন দিন কঠিনতর হচ্ছিলো। গৃহস্থদের জাতিবিভেদ পূর্বাপেক্ষা গাঢ়তর হলো। বিদ্যার মধ্যে স্মৃতিরচর্চা বেশী করে হতে থাকলো। ম্লেচ্ছসংসর্গ যতই বাড়তে থাকল ততোই তা অধিকতর দূষ্য বলে বিবেচিত হতে থাকে ও স্মৃতিশাসন ততোই অধিকতর রক্তবর্ণ হতে থাকে। এই সব কারণে এই কারণে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ সমাজে এক নূতন স্বয়ংক্রিয় শাসনব্যবস্থা আপনা থেকে গড়ে উঠেছিল। সেটা হলো কৌলিন্য প্রথা। আর্থিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ও অন্যান্য  দোষগুণ বিচার করে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে কয়েকটি থাক বিন্যস্ত হলো – কুলীন ও শোত্রিয় বংশজ। কৌলিন্যের শাস্ত্র সাধারণত সংস্কৃত শ্লোকমালা ও বাংলা ছড়া, সাধারণ নাম কুলজী বা কুলপঞ্জী রচিত হতে থাকে।

ষোড়শ শেষ হবার আগেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে গুরুবাদ অটল ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছিল। বৈষ্ণব গুরু মহন্তদের অনুশীলিত ও অনুমোদিত সাধনব্যবস্থার পদাবলীর কীর্তন ও নামসংকীর্তন রীতি সঙ্গীতের  ও লোকনৃত্যের অভিনব প্রকর্ষ সম্পাদন করলো। অষ্টপ্রহর ও চব্বিশপ্রহর নাম সংকীর্তন ও ভোজন মহোৎসব – জনসাধারণের কাছে অভিনব এই উৎসব সমাজের উদ্দিপনা জাগিয়ে দিল। বিষ্ণুপুরের রাজসভার অনুকূলতায় বৈষ্ণবধর্ম একটি নতুন শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রকাশপথ খুঁজলো। সে হলো মন্দির শিল্প।  ষোড়োশ শতাব্দী শেষ হবার আগেই বৈষ্ণব ধর্ম অবৈষ্ণব গুহ্য সাধকদের অর্থাৎ যোগী, তান্ত্রিক, সুফীদের আকর্ষণ করতে শুরু করেছিল। সপ্তদশ শতকে কোনো কোনো সাধক সম্প্রদায় বাহ্যত বৈষ্ণব বৈরাগীর  আচার ও আচরণ অবলম্বন করলেন।  প্রধানত  এদের মধ্যে দিয়ে চৈতন্যের ধর্ম বিধিভুক্ত পদ্ধতির বহিরঙ্গতা এড়িয়ে দেশের অন্তর্ভূমিতে নেমে গিয়ে সর্বত্র প্রচ্ছন্ন ভাবে বইতে লাগলো। এনারাই উনবিংশ শতক থেকে আউল-বাউল-দরবেশ-সাঁই-সহজিয়া-কর্তাভজা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছেন।

মুসলমান শাসনের ফলে সপ্তদশ শতকে ব্রজভাষা শিক্ষিত বাঙ্গালীর কাছে অনেকটা পরিচিত হয়ে ছিল। ফারসী তখন রাজভাষা, কাজেই ফারসী অনেককে শিখতে হলো। এই ফারসী জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে হিন্দি ভাষার প্রবেশ বাংলা দেশে ঘটেছিল। ব্যবহারিক প্রয়োজনে বাংলা গদ্যের অনুশীলন সপ্তদশ শতকে অপরিহার্য হয়েছিল। সরকারি দলিল পত্র সব ফারসীতে লেখা হতো, তবে যেখানে বাঙ্গালীর সাথে বাঙ্গালীর কারবার সেখানে বাংলা চলতো। কামতা-কামরূপ, কাছাড়-ত্রিপুরার স্বাধীন প্রত্যন্তে সরকারি কাজে বাংলা চলতো। সমসাময়িক সাহিত্য সম্পূর্ণ ভাবে ধর্মকথাশ্রিত হলেও  সপ্তদশ শতকের অধিকাংশ  রচনার বাইরে ধর্মের রঙ টুকু ফুটেছে কিন্তু অন্তরে ধর্মের  রসটুকু ধরেনি অর্থাৎ দেবতার প্রতি ভীতি যতটা আছে ভক্তি ততটা নেই। ধর্ম ও দেবতাকে বাদ দিয়ে সপ্তদশ শতকে কয়েকটা  প্রেমকথাময় সুললিত আখ্যায়িকা রচিত হয়েছিল, লেখকরা মুসলমান।

সপ্তদশ শতকে ধর্মমঙ্গলের কথা বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের কোনো দিকে অভিনব ও মৌলিক বিকাশ হয়নি। পদাবলী রচনার ধারা আগের পথেই প্রবাহিত ছিল। তবে পদাবলী গানের পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য  এসেছিল। কীর্তন গানে বিভিন্ন পদ্ধতিরও উদ্ভব হয়েছিল। এই শতাব্দীতে পুরাণ কাহিনীতে সাধারণ শ্রোতার সমধিক আগ্রহের সমাদরের প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন লেখক কর্তৃক পান্ডব ও রামকথা রচনার প্রচেষ্টায়। দু তিনটি চন্ডীমঙ্গল এই শতাব্দীতে লেখা হয়েছিলো। তবে সবই বৈশিষ্ট্য বর্জিত। উত্তর ও পূর্ববঙ্গে মার্কন্ডেয় চন্ডীর কাহিনী খুব প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের সর্বত্র মনসামঙ্গলের সমাদর ছিল। পশ্চিমবঙ্গে একটি নূতন মঙ্গল পাঞ্চালী সৃষ্টি হলো – ধর্মমঙ্গল। একাধিক সমর্থ কবি ধর্মমঙ্গল লিখেছিলেন। ধর্মমঙ্গল পাঞ্চালী কাব্য মধ্যকালের বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট ও শেষ নবোদ্গত শাখা।

 

২) পদাবলী ও কৃষ্ণলীলা কাব্য

কৃষ্ণলীলা পদাবলী গানের উৎপত্তি সম্ভবত  নারী সঙ্গীতে। এর প্রথম বিকাশ রাজসভায়। লক্ষ্মণসেনের রাজদারবার থেকে মিথিলার রাজদরবার, পাঠান আমলে পুনরায় গৌড়ের রাজদরবার, সেখান থেকে ত্রিপুরার মতো কোনো কোনো প্রত্যন্ত রাজসভায় পদাবলীর বিশেষ করে ব্রজবুলি ভাষায় লেখা গানের জের চৈতন্যর বাল্যকাল পর্যন্ত ছিল। চৈতন্যদেব পদাবলী গান ভালোবাসতেন। তার ভক্ত অনুচররা অনেকেই পদাবলী গান রচনা করেছিলেন। সপ্তদশ শতকে পদাবলী ও কীর্তন গানের পুষ্টি বাংলাদেশ ও বৃন্দাবন উভয় স্থানের বৈষ্ণবদের দ্বারা সংসাধিত হলেও মল্লভূমের মতন প্রান্তীয় অর্ধস্বাধীন রাজসভায় এবং দেশের অন্যত্র শিক্ষিত ভূস্বামীদের বৈঠকে পদাবলির ও কীর্তন গানের  সমাদর যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়েছিল। অচিরে দেশের সর্বত্র হরি-নাম সংকীর্তন জনগণের মনপ্রাণ রঞ্জনের এক প্রধান ও বিশিষ্ট বিধানরূপে গৃহীত হয়ে গেল। বিহারে বাংলায় তুর্কি অভিযান শুরু হবার পর নেপালভূ্ম বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের প্রধান আশ্রয়স্থল হয়েছিল। নেপালের রাজসভায় সংস্কৃত-প্রাকৃত-লৌকিক মিশ্রিত নাট্যরচনার সমাদর ছিল। লৌকিক অংশের ভাষা হতো সাধারণত বাংলা, মৈথিল, মিশ্র বাংলা-মৈথিল, নেওয়ারি অথবা বাংলা-মৈথিল-নেওয়ারি। এই অনুসারে বাংলা প্রভৃতি প্রাদেশিক সাহিত্যের চর্চা নেপাল রাজসভায় চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর উপান্ত অবধি একটানা চলেছিল। নেপালে লেখা সর্বাপেক্ষা পুরানো নাটক যা পাওয়া গেছে তা হলো ধর্মগুপ্তের রামাঙ্ক-নাটিকা, এটি সংস্কৃত নাটকের মতন সংস্কৃত-প্রাকৃতে লেখা। তবে শেষ চার অংকের ভাষায় দেওয়া আছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর উপান্তে নেপাল রাজ্য তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেছিল। এক অঞ্চলের রাজধানী কাষ্ঠমন্ডপ বা কাঠমান্ডু, আর এক অঞ্চলের রাজধানী হল ভাতগাঁও (ভক্তগ্রাম বা ভক্তপুর), তৃতীয় ভাগের রাজধানী ছিল ললিতাপুর বা পাটন। ষোড়োশ শতাব্দীর শেষে ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ভাতগাঁও এর ত্রৈলক্যমল্লের রাজত্বকালে রচিত একটি কৃষ্ণলীলা নাটকের কয়েকটি গানের ভাষা বাংলা ও মৈথিল। ত্রৈলক্যমল্লের পুত্র জগজ্জ্যোতিমল্লের নামে পাওয়া যায় হরগৌরী নাটক। এই নাটকে ভাষা গান আছে পঞ্চান্ন্টি।  জগজ্জ্যোতিমল্লের পৌত্র জিতমিত্রমল্ল মদালসাহরণ ও গোপীচন্দ্র নাটক লিখেছিলেন বলে কথিত। ভাতগাঁওয়ের জগজ্জ্যোতিমল্লের সমসাময়িক ললিতাপুরের সিদ্ধিনরসিংহমল্ল। ইনার রাজত্বকালে রচিত গোপীচন্দ্র নাটকের পদ্যাংশের ভাষা বাংলা।  রাজা কবীন্দ্র প্রতাপমল্লের নামে দুটি রচনা পাওয়া যায়। একটি সঙ্গীতশাস্ত্রের বই সঙ্গীততালোদয়চূড়ামণি দ্বীতিয়টি বৃষ্টির স্ত্রোত্র বৃষ্টিচিন্তামণি। বৃষ্টিচিন্তামণির আরম্ভ সংস্কৃত পদে। এবাদেও নেপালে বিদ্যাপতির গোরক্ষবিজয় নাটকের পুঁথি পাওয়া গেছে। এটি লেখা সংস্কৃত প্রাকৃত ব্রজবুলি মৈথিল ও বাংলায়।

মল্লভুম বিষ্ণুপুরে শ্রীনিবাস আচার্য ও রামচন্দ্র কবিরাজ এই দুই মহন্তের প্রভাবে মল্লভূমের অধিপতি বীরহাম্বির সপরিবারে শ্রীনিবাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার সভায়  বৈষ্ণবশাস্ত্রের ও বৈষ্ণবসাধনার অঙ্গরূপে কীর্তন গানের অত্যধিক সমাদর হয়েছিল। বিষ্ণুপুরে বৈষ্ণব-সংস্কৃতির যে বিকাশ দেখা গেছিল তা সাহিত্যের পথে নয়, শিল্পের পথে এবং সে শিল্প হল সঙ্গীত, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য।  বীরহাম্বিরের ভণিতায় দুটি পদ পাওয়া গেছে। একটি গুরু শ্রীনিবাসের বন্দনা আর একটি নবানুরাগিণী রাধার দৃষ্টিতে কালাচাঁদের স্বরুপ বর্ণনা। বীরহাম্বির চৈতন্যদাস ভণিতায় পদ লিখছিলেন বলে নরহরি চক্রবর্তী উল্লেখ করেছিলেন।

সপ্তদশ শতাব্দীতে পদাবলীতে কৃষ্ণলীলা যেটুকু অভিনবত্ব দেখাল তা রাধাকৃষ্ণের মিলনে নতুন নতুন আছিলার ও সুযোগের কল্পনায়। এ কল্পনা  অনেকটা সংস্কৃত কামশাস্ত্র ও দেশী কুটনীপনার পথে চলেছে তা অস্বীকার করা যায় না।ভবানন্দের হরিবংশের আলোচনায় তার স্পষ্ট উদাহরণ দ্রষ্টব্য। অন্য উদাহরণ হচ্ছে রাধার সুবল বেশ ধরে কৃষ্ণের সাথে গোষ্ঠে মিলন ও কৃষ্ণের নাপিতানী সেজে রাধার সাথে দিনের বেলায় গৃহে মিলন। তবে নতুন সন্নিবষ্ট কাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল কলঙ্ক ভঞ্জন।  

বৈষ্ণবকবির রচনায় আরবী-ফারসী-হিন্দির প্রবেশ একেবারেই উল্লেখযোগ্য নয়। তবে বৃন্দাবন বাঙ্গালী বৈষ্ণবের প্রথম তীর্থস্থান ও প্রধান শাস্ত্রবিদ্যাপীঠ হওয়ায় ব্রজভাষার প্রভাব কিছু কিছু পড়তে থাকে। যারা বৃন্দাবন মথুরা থেকে পদরচনা করেছিলেন তাদের রচনাতেই তা বিশদ ভাবে দেখা যায়। এই লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নরহরি চক্রবর্তী। ভাষামিশ্র কবিতা রচনাও সপ্তদশ শতাব্দীতে শুরু হয়। গোবিন্দদাস কবিরাজের পৌত্র ঘনশ্যাম কবিরাজ কিছু শ্লোক ব্রজবুলি বাংলা মিশ্রিত সংস্কৃতে রচনা করেছিলেন। ঘনশ্যাম ছিলেন শ্রীনিবাস আচার্যর পুত্র গোবিন্দগতি বা গতিগোবিন্দ (এই গতগোবিন্দই মল্লাভূমের রাজধানীর নাম দেন বনবিষ্ণুপুর যা পরে শুধু বিষ্ণুপুর হয়ে দাঁড়ায়)। ঘনশ্যাম ব্রজবুলি পদরচনায় নিষ্ঠাবান ছিলেন ইনার সংস্কৃত কবিতা রচনায়ওপারদর্শীতা কমছিল না। ইনার গুরুপূজাঞ্জলি গোবিন্দরতিমঞ্জরীতে সংস্কৃত শ্লোকের সূত্রে অনেকগুলি ব্রজবুলি পদ গ্রথিত আছে। পদসংখ্যা ছেচল্লিশ তার মধ্যে একটি, নিত্যানন্দবন্দনা, বাংলায়। কবি রাধাবল্লভদাস বা রাধাদাস শ্রীনিবাস আচার্যর শিষ্য ছিলেন। শ্রীনিবাসের আর দুই শিষ্যের নাম রাধাবল্লভ ছিল। এদের মধ্যে রাধাবল্লভ চক্রবর্তী যিনি, তিনি একজন বিশিষ্ট পদকর্তা। রামগোপালদাস রসকল্পবল্লীতে “শ্রী রাধাবল্লভ চক্রবর্তী ঠাকুর” বলে তার পদ উদ্ধৃত করেছেন। রাধাবল্লভ চক্রবর্তী ধারাবাহিক ভাবে কৃষ্ণলীলা পদাবলী রচনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। একটি পুথিতে রাসলীলার কিছু পদ পাওয়া গেছে। পদগুলিতে ভাগবতের কাহিনী অনুসরণ করা হয়েছে। রাধাবল্লভ কয়েকটি শোচক অর্থাৎ তিরোভূত মহাজনের স্মারক পদাবলী লিখেছিলেন। রঘুনাথদাসের বিলাপকুসুমাঞ্জলির ও অনুবাদ করেছিলেন। ভক্ত ও বিদগ্ধ পন্ডিত বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ক্ষণদাগীতচিন্তামণি প্রথম বিশুদ্ধ পদাবলী চয়নিকা। পদগুলি সব ব্রজবুলিতে লেখা।

সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত কৃষ্ণলীলা কাব্য  প্রধানত তিন ধরণের। এক ধরনের রচনাগুলো প্রধানত আখ্যান। পড়বার জন্য লেখা। এগুলিতে গান নেই বা থাকলেও অল্প। এখানে প্রধানত ভাগবত কাহিনীর অনুসরণ করা হয়েছে। গোস্বামীদের চিন্তার প্রভাব ক্ষীণ ও মূলসুর দাস্যভক্তির। দ্বিতীয় রচনাগুলো প্রধানত গীতিনিবন্ধ, গাইবার বা সুরে আবৃত্তি করার জন্য লেখা। এগুলিতে পদ্য অর্থাৎ গান প্রচুর আছে। এখানে গোস্বামীদের চিন্তার অনুসরণ স্পষ্ট ও সুর প্রেমভক্তির। তৃতীয় ধরনের রচনাগুলোতে আদিরসের বাহুলতা। প্রধানত গাইবার জন্য রচিত। এখানে লৌকিক কাহিনীর অনুসরণ ও সুর হাস্যভক্তিরও নয়, প্রেমভক্তির নয়, ভক্তিমিশ্র আদি ও কৌতুকরসের। এ ধরনের কাব্য সংখ্যায় কম।

ষোড়শ শতাব্দীর অন্তিমভাগে একজন প্রভাবশালী বৈষ্ণব ছিলেন জয়গোপালদাস। উনার দুজন শিষ্যের লেখা ভাগবত-অনুসারী দুটি কৃষ্ণলীলা কাব্য পাওয়া গেছে। দুইজনেরই গুরুপ্রদত্ত নাম শ্রীকৃষ্ণকিঙ্কর। দুটি কাব্যরই নাম শ্রীকৃষ্ণবিলাস। প্রথম কাব্যটিতে গুরুর দোহাই আছে ব্রজলীলা পর্যন্ত। তারপর হয় অপরের রচনা প্রবেশ করেছে না হয় গুরু অপ্রকট হয়েছেন।লেখকের নাম ঘনশ্যামদাস। গুরুরচনাবলীর উল্লেখ করেছেন যথা সারসংগ্রহ, ভক্তিভাবপ্রদীপ, মনোবৃদ্ধিসংবাদ, ভক্তিরত্নাকর, অনুমানসম্বন্ধ, ধর্মসম্পর্ক ইত্যাদি।  এরচনাগুলি সব সংস্কৃতে বলে মনে করা হয়। ঘনশ্যামের রচনার আর একটা পুথিতে কাব্যের নাম পাওয়া যায় – হরিবংশ অথবা ভাগবত অথবা ব রহ্মবৈবর্ত। লেখক উক্ত পুরাণগুলো থেকে কৃষ্ণলীলা সংগ্রহ করেছিলেন বলে এই বিভিন্ন নাম দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় কৃষ্ণবিলাসও এক শ্রীকৃষ্ণকিঙ্করের রচনা।  বইটির খন্ডিত ও অসম্পূর্ণ পুথির খোঁজ পাওয়া গেছে। যশশ্চচন্দ্রের গোবিন্দবিলাস আকারে বেশ বড় বই। প্রধানত বর্ণনাময়। আদ্য, রাধা, দান, ,অনুরাগ ইত্যাদি বিভিন্ন খন্ড অনুসারে বিভক্ত।

দুজন ব্রাহ্মণ পরশুরাম কৃষ্ণমঙ্গল কাব্য লিখেছিলেন প্রায় একই সময়ে। একজন পরশুরাম চক্রবর্তী। পরশুরামের কাব্যে কৃষ্ণলীলা অংশে দানখন্ড-নৌকাখন্ড কাহিনী ভাল করেই  আছে। যেমন অজামিল-উপাখ্যান, ধ্রুবচরিত্র, প্রহ্লাদসংবা্‌দ,রামকথা, ইত্যাদি। দ্বিতীয় পরশুরামের পুরো নাম পরশুরাম রায়। রচিত কাব্যের নাম মাধবসঙ্গীত বা সঙ্গীতমাধব। এতে কয়েকটি ব্রজবুলি পদ আছে।

ভবানন্দের হরিবংশ কৃষ্ণলীলা কাব্যগুলির মধ্যে অত্যন্ত অভিনব। তবে প্রধান সুর ভক্তিরসের নয়, আদিরসের। এবিষয়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সাথে হরিবংশের বেশ মিল আছে। কাব্যটির স্থানে স্থানে কামসূত্রের মত লাগলেও বেশ ভাল রচনা। হরিবংশে পদাবলী বা গান অংশ কম নয় – রাধাবিরহ অংশগুলো পুরো গানময়। অপর সব কৃষ্ণলীলা কাব্যের সাথে হরিবংশের পার্থক্য শুধু আদিরসের বাহুল্যে। কোনো পাত্রপাত্রীর নামে নতুনত্ব আছে। রাধার নামান্তর এখানে তিলোত্তমা। রাধার মায়ের নাম বিমলা, ননদের নাম যশোদা। বৈষ্ণবভাবের দিক দিয়ে বড়ু চন্ডিদাসের কৃষ্ণকীর্তনের তুলনায় ভবানন্দের হরিবংশ সুষ্ঠুতর কাব্য।

 
ঋণ স্বীকার :
১) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস দ্বিতীয় খন্ড – ডঃ সুকুমার সেন
২) বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা প্রথম পর্যায় – শ্রী ভূদেব চৌধুরি
৩) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আদি ও মধ্য যুগ – ডঃ দেবেশ কুমার আচার্য
৪) বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাস – ডঃ দীপঙ্কর মল্লিক
লেখক পরিচিতি
শৈবাল বসু

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে স্নাতক। পেশাগত ভাবে গত ৩৪ বছর ধরে ব্যাঙ্কার। নেশাগত ভাবে শরদিন্দু ও ইতিহাস প্রেমী। বর্তমানে কলকাতা ও বাংলার ইতিহাস নিয়ে চর্চারত।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!