Home বিবিধ, গল্প আত্মপরিচয়
বিবিধগল্প

আত্মপরিচয়

জয়তী ধর (পাল)

বন্ধু বলল, ”Let’s play a game. আমি একটা বিষয় বলবো, তুই তা নিয়ে লিখবি। আমাকে তুই যে বিষয় বলবি তা নিয়ে আমি লিখব।”

বন্ধুর কথা তো রাখতেই হয়। বন্ধু আমার জীবনে এমন একটি শব্দ, যে বেঁচে থাকার জন্য সূর্যের মতোই অপরিহার্য। খাতা কলম নিয়ে বসে তো গেলাম, কিন্তু প্রথমেই হোঁচট খেলাম। বন্ধু বিষয় দিয়েছে ‘আত্মপরিচয়’। লিখতে হলে, আগে তো জানা দরকার,আমার আত্মপরিচয় কি? আমি কে? আমি মানুষ। আমি মেয়ে। আমি দয়িতা। আমি মাতা। আমি বন্ধু। আবার কোথাও পেশা লিখতে হলে, লিখি শিক্ষিকা। নেশার কথা বলতে হলে বলি, আমার পাঠক-সত্তার কথা, রঙ-তুলি হাতে এক অন্য ‘আমি’র কথা। এই এতো পরিচয়ের থেকে কোনটা আসল ‘আমি’ বলে বেছে নেব! 

‘মানুষ’ আমি সমগ্র মানবজাতির প্রতিনিধিত্ব করছি, তাই সেই ‘আমি’র পরিচয় লিখতে হলে সমগ্র মানবজাতির ইতিহাস লিখতে হয়। সেই সৃষ্টির আদিতে গুহামানবের যুগ থেকে আমার যাত্রা শুরু … ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে …’ চলতে চলতে কত বিবর্তন আমার … কখনো অস্ত্র হাতে ধ্বংসলীলায় মাতি,কখনো আবার শান্তির বারিধারায় সিঞ্চিত করি ধরনী … কখনো আমি নাস্তিক, কখনো প্রেমিক… কখনো লালসায় চকচক করছে আমার চোখ, কখনো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে রাতের অন্ধকারে সব মায়ার বাঁধন কেটে নেমেছি পথের ধুলোয়।যুগে যুগে আমার এত্তো পরিচয় লিপিবদ্ধ করা আমার মতো দুর্বল মানুষের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। যে আমার ‘মানব’ পরিচয় জানতে চাও, সে চলে যাও কোনো পাঠাগারে, এই পরিচয় জানতে এতো বই পাবে যে তা পড়ার জন্য গোটা একটা জীবন ছোট পড়ে যাবে।

মেয়ে হয়ে জন্মেছি, বাবা-মার আদরে কেটেছে মেয়েবেলা। বাবার কোলে চড়ে পৃথিবী চেনা, দুচোখে ঘুম নিয়ে মা’র হাতে রাতের খাওয়া, দু-বিনুনি ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বন্ধুদের সাথে হৈ হৈ করে অংশগ্রহণ, বিকেল হলেই এক ছুটে মাঠে পৌঁছে কুমীরডাঙা – রুমালচোর – এলাটিং বেলাটিং সই লো – এ মেতে ওঠা … এইরকম অনেক টুকরো টুকরো ছবিতে আমার মেয়েবেলার পরিচয় আঁকা। রথের মেলার ভিড়ে ছোট্ট মেয়েটি যখন হারিয়ে গিয়ে কাঁদে…তখন সবাই তার পরিচয় জানতে চায় … সে শুধুই কেঁদে যায় … ভয়ে যে সে দিশেহারা … তারপর হঠাৎ চোখের জলের ওপারে দেখতে পায় বাবার উদ্বিগ্ন মুখ … এক ছুটে বাবার কোলে উঠে কাঁধে মাথা রেখে দুটি হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে তার একমাত্র পরিচয়।

কৈশোরের মেয়েবেলা পিছনে ফেলে ধীরে ধীরে জীবনে এগিয়ে আসে মাদকতাময় যৌবন … যে যৌবনে, ‘আমার চোখে তো সকলি শোভন, / সকলই নবীন, সকলই বিমল / সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন / বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল — / সকলই আমার মতো …’। কত রঙিন স্বপ্ন তখন দুচোখে। কাউকে একান্ত নিজের করে পাওয়ার কামনা গোপনে বাসা বাঁধে বুকের গভীরে। অনিবার্যভাবে জীবনে আসে প্রেম … আর সেই প্রেমের দুর্দমনীয় স্রোতে ভাসতে ভাসতে প্রতি মুহূর্তে চলে নতুন করে আত্ম-আবিষ্কার, একান্ত সঙ্গোপনে চলে আত্মকথন, যে কথনের একটাই ছন্দ একটাই সুর একটাই কথা … ‘ ভালোবাসি … ভালোবাসি …’। ক্রমে ‘দয়িতা’ পরিচয়েই সে খুঁজে পায় নিজের জীবনের সার্থকতা। বৃষ্টিভেজা দুপুরে অন্য সব পরিচয় পিছনে ফেলে দয়িতের হাত ধরে নিরুদ্দেশ যাত্রাতেও সে রাজি।

আর এই পরিচয়ের হাত ধরেই তার জীবনে আসে এক নতুন পরিচয়ের স্বাদ — ‘মা’। কথায় আছে, ‘মা হওয়া কি মুখের কথা’! একদমই নয়। ‘মা’ ডাক শোনা যেমন জীবনের এক অতুলনীয় অনুভূতি, তেমনি প্রকৃত ‘মা’ হয়ে ওঠা এক অসামান্য তপস্যা। কত রাত-জাগা ধৈর্য, সহনশীলতা, কষ্ট-লুকানো-হাসি, কত ত্যাগ স্বীকারের ইতিহাস যে থাকে ‘মা’ হয়ে ওঠার পিছনে তা একজন ‘মা’ই জানে। দুই সন্তানকে নিয়ে সেই লড়াই চলছে। কখনো শাসনে কখনো আদরে হাত ধরে শরীরে ও মনে সুস্থ বিকাশের পথে তাদের নিয়ে যেতে হয়। কখনো মা হয়ে ওঠে বন্ধু। সন্তানের মনের জানালায় উঁকি মেরে তাদের সমস্যা বুঝে করতে হয় সমাধান। আমার দুটি আবার দু-রকম। ছোটটি এই ঝমঝম বৃষ্টি, তো এই রোদ ঝলমল আকাশ। আর বড়টি জেদি অন্তর্মুখী আত্মসমাহিত এক নীল সমুদ্র। আকাশ আর সমুদ্রের মাঝখানে আমি সর্বংসহা ধরিত্রী মাতা। এদের কখন কি প্রয়োজন, কিসে মন ভালো হবে, কোন শিক্ষায় এরা মান আর হুঁশ সম্পন্ন প্রকৃত মানুষ হবে — সবদিকে সজাগ দৃষ্টি থাকে মাতৃ পরিচয়-ধারী সত্তাটির।

বাবা ছোটবেলার থেকে শিখিয়েছিলেন নিজের কাজকে ভালোবাসতে। তাই পেশা যখন শিক্ষকতা, তখন ভালোবেসে কাজটা করার চেষ্টা করি। কচিকাঁচা মুখগুলো লতানো গাছের মতোই জড়িয়ে থাকে আমার হৃদয় … ‘বর্ষে বর্ষে দলে দলে আসে বিদ্যামঠ তলে, / চলে যায় তারা কলরব, / কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয়/ যৌবনের শ্যামল গৌরবে।’ তারপর হঠাৎ একদিন ফেসবুকে দেখি, গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে এক ছাত্রী স্ট্যাটাসে লিখেছে, আমার হাত ধরে সে ভালোবেসেছে বাংলা সাহিত্যকে … তার এই সাফল্যের পেছনে কোথাও আমার একটু ভূমিকা আছে … তখন ছাত্রী-গর্বে গর্বিত মন ভাবে, এ পেশা শুধু টাকা দেয় না … আরও অনেক কিছু দেয়। তাই অনেকবারই চাকরি ছাড়বো ভেবেও ছাড়া হয় না। ছাত্রীদের ভালোবাসা এক মন-ভালো-করা অনুভূতির ছোঁয়া এনে দেয় আমার জীবনের এই ‘শিক্ষিকা’ পরিচয়ে।

কখনো কখনো কাজের চাপে দম বন্ধ হয়ে আসে, মন খোঁজে একটু অবকাশ … একটু নিজস্ব আকাশ। তখন বই হয়ে ওঠে বন্ধু … প্রতিটি পাতায় কালো কালো অক্ষরমালায় সে সাজিয়ে রাখে তার ঐশ্বর্য … যে ঐশ্বর্য মনের সব মলিনতার অন্ধকার মুছে দেয় আলোকের ঝর্ণাধারায়। আবার কখনো রঙ-তুলি হাতে আপন মনের খেয়ালে আঁচড় কাটি সাদা পাতায়, আমার মনের ভাবনাগুলো রঙে-রেখায় সেখানে রূপ পায়। এ এমন এক নেশা, যার হাত ধরে পৌঁছে যাই এক অনির্বচনীয় অনুভূতির জগতে। মাঝে মাঝে মনে হয়, চিরটাকাল যদি বই পড়ে আর ছবি এঁকে কাটিয়ে দিতে পারতাম, আর কোনো কাজ যদি না করতে হতো,এটাই যদি হতো আমার একমাত্র পরিচয় …। 

আর এই সবগুলো পরিচয়ের পাশে কখনো সশব্দে কখনো নিঃশব্দে যে হাতগুলি সবসময়ই বাড়ানো রয়েছে আমার সুখে-দুঃখে সেগুলি আমার বন্ধুদের হাত। আমিও চাই একজন সত্যিকারের বন্ধু হয়ে বন্ধুর পাশে থাকতে।একমাত্র প্রকৃত বন্ধুই পারে ঝড়ের রাতে প্রকৃত আশ্রয় হতে … ‘যদি বন্ধু হও / যদি বাড়াও হাত / জেনো থামবে ঝড়/ মুছে যাবে রাত।’ বন্ধুত্বের স্বীকৃতি যেন আমার অস্তিত্বের আলো-ঝলমল নিশান।

আর যখন আমি একা থাকি, সম্পূর্ণ একা, হাজার ভিড়ও যে একাকীত্বকে ছুঁতে পারে না … তখন একে একে আবরণ খসে পড়ার মতো খসে পড়ে আমার সব বাহ্যিক পরিচয়। প্রতিটি পরিচয় যেন নাটকের এক একটা পোশাক … যা পরে আমি অভিনয় করে চলেছি এই বিশ্বমঞ্চে। সময়ের সাথে সাথে পোশাক বদলে যায় … ‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় / নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি/ তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যান্যানি/ সংযাতি নবানি দেহী। ‘তাহলে প্রকৃত আমি কে?’ তা অনন্ত ব্রহ্মের এক কনা মাত্র … যে এই মনুষ্যরূপ ধারন করেছে কিছু নির্দিষ্ট কাজের জন্য। সেই কাজ সম্পন্ন হলে, সময়সীমা শেষ হলে, ধ্বনিত হবে শেষ ঘন্টা-ধ্বনি … যা শুধু শুনতে পাব আমি … নাটক চলতে থাকবে … শুধু আমি লীন হয়ে যাব … ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম – এই পঞ্চভূতে … তারপর অনন্ত ব্রহ্মের সাথে ঘটবে অনন্ত পুনর্মিলন …।

লেখিকা পরিচিতি

 

 

জয়তী ধর (পাল)

স্কুল শিক্ষিকা 

ভালোলাগা — বই পড়া, ছবি আঁকা, গান শোনা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. Khub valo laglo anekdin pare ei rakam lekha pore. Satyi i darun monograhi. Abar lekha pathaben. Valo thakben.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!