Home প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বুদ্ধদেব গুহ প্রসঙ্গে
প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

বুদ্ধদেব গুহ প্রসঙ্গে

গৌতম বসু

(দে’জ থেকে প্রকাশিত জানুয়ারি ২০২০ তে ‘এবং বুদ্ধদেব’ এ)

কই হে! এসো, দুরে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’

ব্যারিটন ভয়েসটা কানে আসতেই আমরা স্থবির।

শ্বেতচন্দন শুভ্র রাজর্ষি বললেন এ কথা মেঘ বালিকাদের মাঝখান থেকে।

বইমেলার মমর্থে ১৯৮৮ সালের শীতের এক সন্ধ্যাবেলায় প্রথমবার স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখেছিলাম এভাবেই আমরা।

আমরা বলতে আমি আর অদ্রীশ।

স্বপ্ন ছোঁয়া মুহূর্তে পাদুটো যেন থমকে গেছিল বেশ কিছুক্ষণের জন্য। সে এক আশ্চর্য অনুভূতি। ঠিক যেন কুয়াসামাখা প্রথম শীতের ভোরে প্রকৃতির কোলে শ্যমলসবুজ কচি দূর্বাঘাসের  ওপর টলটলে মুক্তো দানার ন্যয় শিশিরবিন্দুর ওপর নগ্ন পায়ের পাতা ছোঁয়ানোর মতন অদ্ভুত এক শিরশিরানি স্নিগ্ধ এক অনুরণন।

১৯৮০ খুব সম্ভবত। বাড়িতে আমার জন্য পূজাবার্ষিকী তখন বাড়িতে আসত তখন দুটো। আনন্দমেলা আর কিশোরভারতী। কিশোরভারতীর ময়ুখ চৌধুরীর লেখাটা পড়ে নিয়েই বসে গেলাম আনন্দমেলাটা নিয়ে। প্রথম উপন্যাস পড়তাম সবসময় শৈলেন ঘোষালের।তারপর পাতা উল্টিয়ে দেখতে দেখতে চলে এলাম একটা লেখায়, ‘গুগুনোগুম্বারের দেশে’ লেখক বুদ্ধদেব গুহ। দেখি পড়ে কেমন। সদ্য সদ্য পড়ে উঠেছি কালজয়ী লেখা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড়। নীল জ্যোৎস্নার অলৌকিক আলোকে তখনও মনে পরিপূর্ণ।

শুরু করলাম পড়া। পড়লাম না এক নিঃশ্বাসে গিললাম খুব সম্ভবত। উফফ কি অসাধারন এক লেখা। স্বপ্নের আফ্রিকাকে তুলে ধরলেন তিনি আমার মানস চক্ষে। ব্যাস পড়ে গেলাম হয়ত তখনই প্রেমে। পরের বছর কিন্তু সেই কিশোর মনে একটু হতাশা এসেছিল ‘ডিমেংকারি’ পড়ে।

১৯৮৫, হাতে পেলাম ‘কোয়েলের কাছে’। কি গভীর প্রেমে পরে গেলাম আবার। ব্যাস এই প্রেম আর ভাঙেনি আজও। এটা যে  আমরনের বন্ধন সেই উপলব্ধি এসে গেছে পুরোপুরি মননে। মাধ্যমিকের পর দিদির কার্ড নিয়ে বড়িশা টাউন লাইব্রেরীতে পড়া শুরু করলাম। এক এক দিনে বা এক এক রাতে শেষ করতাম এক এক উপন্যাস। তারপর উচ্চমাধ্যমিক্যের মধ্যে আমার আরাধ্য দেবতা তখন চলে এসেছে তাঁর লেখার মাধ্যমে।সব রকম লেখক/লেখিকার উপন্যাস পড়েই দেখলাম গুরুদেব একজনই। বুদ্ধদেব গুহ। কি ভীষণ ভাবে জঙ্গল শেখালেন উনি আমাদের। কি ভীষণ ভাবে সাহিত্যের হাতেখড়ি হল ওনার হাত ধরে।

স্মৃতি রয়েছে মনে প্রতি বইমেলায় গুরুদেবের সাথে স্মৃতি রোমন্থনের কথা। চাকরি পেলাম, বিয়ে করলাম, গুরুদেবের আশীর্বাদ নিলাম। কণ্যা সন্তানের পূণ্যতায় পূর্ণলাভ হল আমার। গুরুদেব নামকরন করলেন আমার কণ্যার। আশীর্বাদধন্যা হল আত্মজা। গর্বিত হলাম আমি। গুরুদেবের সঙ্গে পত্রে যোগাযোগ তখন রীতিমতোন।

মনে আছে প্রথম পত্র পাওয়ার ঘটনা। ঠিকানা জোগাড় করে দুরু দুরু বক্ষে লিখে ফেললাম একদিন চিঠি। জানি উত্তর আসবে না তাও প্রতীক্ষার দিন শেষ হতো না যেন। রোজ অফিস ফেরৎ একবার করে লেটার বক্সে অন্য চিঠির মধ্যে খুঁজে বেড়াতাম ঈপ্সিত পত্রটা। আস্তে আস্তে চিঠির ভিড়ে হারাতে চলেছে জীবনের পরম প্রাপ্তি। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলায় লেটারবক্স খুলে দেখলাম ঝর্ণা কলমে লেখা এক সাদা খামের চিঠি। স্নান সেরে খাটে বসে চিঠি দেখে আমি বাক্যহারা। এ যে দেবতার ফুল আমার হাতে। উফফ সে যে কি রোমাঞ্চ সে যে না পেয়েছে তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। জীবনের গুটি কয়েক রেড লেটার ডে এর মধ্যে এখনও এটি আমার কাছে অন্যতম হিসাবে রয়েছে।

মনে পড়ে লাইব্রেরীতে বই আনতে যাওয়ার সেই দিনগুলো। ‘ভাবার সময়’ আর ‘মহুয়ার চিঠি’ কোথায় পাওয়া  যাচ্ছে না সারা কলেজ স্ট্রীট ঘেঁটে। মাথায় হাত তখন।কি করি কি করি। শেষে বুদ্ধি বের হলো। কেলোদা লাইব্ররিয়ান মারফৎ বই দুটো একদিনের জন্য নিয়ে ভুলোদাকে দিয়ে খুলিয়ে জেরক্স করে আবার ওই বই দুটোকে বাঁধাই করে লাইব্রেরীতে ফেরৎ দেওয়া। সে যে কি রোমাঞ্চকর তার লিখে বোঝানো যায় না।

চিঠি লেখার গ্যাপ বাড়তে লাগল। গুরুদেবের শরীরটা ভাল নেয়। গুরুপত্নী ঋতু গুহ তখন সবচেয়ে শান্তির জায়গায় বিরাজ করছেন। চিঠির উত্তর আসা বন্ধ হল আস্তে আস্তে। আমিও কাজে ডুবে যেতে লাগলাম। শিলিগুড়ি পোস্টিং এর সময় নানা জায়গার বর্ণনা দিয়ে অনেক চিঠি লিখতাম। উত্তর পেয়ে মনটা ভরে থাকত।চিঠি আস্তে আস্তে বন্ধ হল। বই পড়াটা কোনদিনই ছাড়ি নি এখনও অব্দি। এখনও শোয়ার সময় মাথার পাশে বালিশের কাছে গুরুদেবের কোন না কোন বই থাকেই সবসময়।

দিন চলছিল মনে খারাপের সাথে মেঘ পিয়নের সঙ্গী হয়ে। দাদার লেখা আর পাই না।কথা তো অনেকদিনই হয় না। একদিন হঠাৎ সুমন, সুমন গোস্বামী আমাকে আবার ফিরিয়ে আনল বুদ্ধ স্রোতে। শান্তিনিকেতনের কোন এক শনিবারের বিকালে সুমন এনে তুলল আমাদের রবিবারে। সেই শ্বেতচন্দন শুভ্র দেবতার সামনে আবার আমরা। সেই স্থবির পা। সেই দূর্বাঘাসের ওপর শিশির বিন্দুর স্পর্শ। প্রথম ১৫ মিনিট কোন কথা বলার অবস্থায় ছিলাম না। আস্তে আস্তে হুঁশে ফিরলাম। স্বপ্ন ছোঁয়া আবার। কখন কি ভাবে দুই তিন ঘন্টা কেটে গেল জানিই না। আমি আর অদ্রীশ সেদিন চুপ করে শুয়ে সারারাত কাটিয়ে দিয়েছিলাম বেশ মনে আছে। সে এক পরম আবেশ ঈশ্বরকে দাদা রূপে পাওয়া। কৌশিকদার কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। কৌশিকদার মাধ্যমে বুদ্ধদেব গুহ গ্রুপে ঢুকে তখন দাদার বই নিয়ে তুমুল আলোচনায় রত থাকতাম।

এরপর এলো সেই মহার্ঘ দিন। দাদার সাথে দাদার তপোবনে দুদিন যাপন। কি নিয়ম শৃঙ্খলা দিয়ে একজন নিজেকে বেঁধে রাখলে তবেই এমন জায়গায় পৌঁছনো যায় সেটা দাদাকে দেখে বুঝলাম আস্তে আস্তে। কতটা গভীর যে মানুষ হতে পারেন সেটা এই দুদিনের কথায় আরও মনে গেঁথে গেল পুরোপুরি।

মনের অন্তঃস্থল থেকে খোলা চিঠি লিখলাম তাই দাদাকে।

দাদা,

মনের ভেতর থেকে একঝাঁক সবুজ টিয়া যেন উড়ে এসে বিকালের পড়ন্ত কমলা  সূর্যটাকে কচি কলাপাতা রঙে রাঙিয়ে তুলেছিল শুক্রবারের সকালে, যখন শুনলাম আপনার মুখ থেকে যে “হ্যাঁ; চল,আমি তো একাই যাই সবসময়”। মন ভাসল হলুদ সর্ষের ক্ষেতে আবার সবুজ এক ঝাঁক টিয়া হয়ে রবিবারের সকালে সানি টাওয়ার্সের নীচে যখন রাশভারী কন্ঠে ঝরে পড়ল “ওপরে চলে এসো”। স্বপ্নে তো ভাসি সবসময় আপনাকে নিয়ে কিন্তু স্বপ্নকে এভাবে সারাক্ষণ ছুঁয়ে থাকব এটা কল্পনার স্বপ্নেও আনতে পারিনি কোনদিন। আপনি বরাবরই আমার কাছে প্রচন্ড দাবদাহের পর প্রথম বৃষ্টির ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের অনুভূতি। প্রথম শীতের কুয়াসা মাখা ভোরে কচি দূর্বাঘাসের ওপর মুক্তোর দানার মতন টলটলে শিশিরকে ছোঁয়ার অনুরণন। ঘোর বর্ষার জমাট বাঁধা কান্না মেঘের আড়াল মাঝে লুকিয়ে থাকা সূর্যের ঝলকানির হাসি। শরতের ঝকঝকে নীল আকাশে শ্বেত চন্দন মাখা কপোতের মতন পেঁজা তুলো মেঘের ডানার ছটফটানি। রুক্ষ শীতের শুকনো কষ্ট পাওয়া ঝরা পাতা পার হয়ে কোকিল বসন্তের চকচকে নগ্ন পিঠের নতুন মসৃন সবুজ পাতার চুম্বন। প্রচন্ড দাবদাহের পরে রুক্ষ জমিতে প্রথম পড়া বৃষ্টির ছোঁয়ায় মাটি সোঁদা সুঘ্রাণের অনুভূতি। প্রচন্ড দাবদাহে পর সেই বৃষ্টিটাই যেন চলে এল পেঁজা তুলোর মেঘকে সরিয়ে জমাট কালো মেঘ বালিকার কান্না হয়ে সবুজ ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে আপনার কথার সাথে সাথেই যে ‘এখন বৃষ্টি হলে বড় সুন্দর দেখাবে এই আকাশটাকে’। সদ্যস্নাতা নব  যুবতী বধুর খোলা চুলের সুগন্ধের পরশ পেলাম আপনার শান্তির নীড়ে এসে। অদ্ভুত এক শান্তি বলয়ে ভরে গেল মনটা পুরোপুরি।স্নিগ্ধতা যে কি তার পরশ লেগে রয়েছে আপনার তপোবন প্রবেশ দ্বার থেকে সর্বত্র। পিতৃসম স্নেহ আর মাতৃসমা ভালবাসার ছোঁয়া পেলাম একইসাথে আপনার কাছে বসে। ধন্য আমি। ঋদ্ধ আমি। জীবনে খুব বড় এক প্রাপ্তি ঘটে গেল আজ আমার জীবনে।যখন বললেন ‘মেয়ের পরীক্ষা চলছে যাও পূজো দিয়ে এসো’ চোখের কোনটা সত্যি সত্যিই চিকচিক করে উঠেছিল আমার। এরকম ভালবাসা,ভালভাবা একজন বড়মাপের মানুষ ছাড়া সত্যি ই সম্ভব নয়।প্রণাম আপনাকে আবার আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে। এত মহৎ অথচ এত গভীর মনের বাঘকে এতে সামনে থেকে এই প্রথম দেখলাম যেন। ভাল থাকুন প্রাণ দেবতা আমাদের, তেমন ই ভাল রাখুন আমাদের রাজর্ষি। তার সাথে বলব একইভাবে বন্য বাঘ হয়েই থাকুন সারাক্ষণ,সারাজীবন। বন্যতা মিশে থাক আপনার মননে বরাবরের মতনই কারন বন্যতার কদর করা মানায় শুধু আপনাকেই। আপনার পক্ষেই সম্ভব দূর্বাঘাস গন্ধী স্তন সন্ধির ঘ্রাণের পরিমাপ করা। কদম্ব গন্ধী বগলতলির মিস্টি সুবাস নাকে ভরিয়ে রাখা। কস্তুরীগন্ধী কম্পমান নাভির তিরতিরানির সুখস্পর্শকে অনুভব করা। উরুসন্ধির মৃত্তিকাগন্ধী অপরাজিতা ফুলের পাতলা দুই ওষ্ঠোকে অ্যাঙ্গুস্টুরা বীটার্সের ফোঁটা ফোঁটা লাল ঠোঁটের পরশে সিক্ত করা। সত্যিকারের নারী রূপ সেই পাবে যে আপনার পূর্ণ জোৎস্নার নীলচে ঔরসে সিক্ত জরায়ুতে পূর্ণগর্ভা নারীকে পরিণত হয়ে থাকতে পারবে।

ভাল থাকুন রাজর্ষি। সুখে থাকুন।

আনন্দে থাকুন।

আনন্দম আনন্দম আনন্দম।

প্রণাম

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!