Home গল্প, রহস্য ও ভৌতিক আর্থার সাহেবের নেশা
গল্পরহস্য ও ভৌতিক

আর্থার সাহেবের নেশা

রচয়িতা: কোয়েলী সরকার ও সৌগত চক্রবর্তী


।। ১ ।।

“এখনো রাতে ভূতের গল্প পড়লে আমি সহজে পাশের ঘরে যেতে পারি না। একটা অদ্ভুত ভাবনাকে আমি আজও তাড়াতে পারি নি। মাঝে মাঝে মনে হয় একই বাড়ির সব ঘরে কি সময় একইরকম এগোয়? যদি কোনও ঘরে থমকে থাকে সময়? অন্য কোনও সময়ের মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবে বসে থাকে সেখানে আর দেখা হয়ে যায় যদি?”, ভাসা ভাসা চোখে বলে যাচ্ছিল স্বপ্নময়, এই গ্রুপের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য।

“বাজে কথা বোলো না। সবসময় শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। তুমি ভূতে ভয় পাও, এটাই সত্যি।” প্রায় মুখ ঝামটা দিয়ে বলে ওঠেন অতনু। স্বপ্নময়কে এ দলে ভেড়ানোর মূল কারিগর তিনিই, ওঁর নিজের কথাতেই ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সের একটা ছেলে এরকম মুখচোরা হয়ে অফিসের এককোণে বসে মাথা গুঁজে কাজ করে যাবে, এটা সহ্য করাই মুশকিল। অতঃপর স্বপ্নময়কে একরকম পাকড়াও করে নিজের আড্ডার জায়গায় নিয়ে আসা, তাও প্রায় বছর দুয়েক হতে চললো। স্বপ্নময়ও এখন বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করে এখানে কথা বলতে, যদিও অনেক সময়েই ওঁকে এভাবেই চুপ করিয়ে দেওয়া হয়।

“তবে এই একটা সময়ে আটকে পড়ার ব্যাপারটা কিন্তু আমি আগেও শুনেছি, বুঝলে অতনুদা। শুনেছি মানে কোনো বিদেশী গল্পে পড়া। হ্যাঁ, মনে পড়েছে জেফ্রি আর্চারের একটা গল্প। তবে সেটা ছিলো আরও অদ্ভুত। এক বিজনেস টাইকুন টাইম মেশিনে করে অতীতে চলে গিয়ে সেখানে আটকে পড়বেন,” শিশির বলে। পেশায় কোম্পানি সেক্রেটারী শিশিরের নেশা থ্রিলার পড়া।

“হ্যাঁ, তো সেটাও তো গল্পই। তোমাদের এই কল্পনার জগত নিয়ে আমি আর পারি না বাপু। অতই যদি শখ টাইম মেশিনে চড়ার, চলো না আমার সঙ্গে, থাকবে একরাত ঐ তিনশো তেত্রিশে। দেখি কার কত বড় বুকের পাটা।” অতনু বলেন।

“হোক, হোক,” সমস্বরে বলে ওঠে দলের বাকি দুই সদস্য বিকাশ আর সামন্ত। এই শেষজনকে যে সবাই তাঁর পদবী ধরে ডাকেন, অতনু কখনো কখনো সেটাকেও সংক্ষিপ্ত করে নেন, তার কারণ আর কিছুই নয়। সামন্তের ভালো নাম মৃদুলমলয় শর্মা সামন্ত। “জোড়া নাম, আবার জোড়া পদবীও। আপনি তো লোক সুবিধের নন, মশাই,” হাসতে হাসতেই বলেছিল শিশির ওঁর ভিজিটিং কার্ডটা দেখে। সামন্ত একটি বহুজাতিক সংস্থার প্রোডাক্ট হেড। হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও এই আড্ডায় নিয়মিত আসতে না পারলে ওঁর শান্তি হয় না।

“অনেকদিন কলকাতায় আটকে পড়ে রয়েছি, চলুন অতনুদা থেকে আসি আপনার ঐ হোটেলে। অবশ্য দার্জিলিং-এ আমাদের গেস্ট হাউজটাও পাওয়া যেতে পারে। চারটে ঘর আছে। উই ক্যান ম্যানেজ আই থিঙ্ক।” সামন্ত প্রস্তাব দেন।

“না, না, না। তারপর দেখা গেল স্বপ্নময় ঐ হোটেল থেকে বেরিয়ে রাতে আর গেস্ট হাউসে ফিরতে পারলো না। ভূত না মানতে পারি, পাহাড়ি কুকুরগুলো তো ঘোর বাস্তব। আমরাও ঐ হোটেলেই থাকবো।” অতনু জোর করেন।

“কিন্তু ঐ ঘরটা পাওয়া যাবে তার কী গ্যারান্টি, রুম নম্বর দিয়ে তো আর বুকিং হবে না।” বিকাশ বলে। ওঁর নিজস্ব পার্লার রয়েছে দক্ষিণ কলকাতায়। পৈতৃক ব্যবসা।

“আরে ঐ ঘরে তুমি বিনা ভাড়াতেও থাকতে পারো, এমনকি স্বপ্নময় যদি একরাত কাটিয়ে সার্টিফিকেট দিতে পারে যে ঘরে কিস্যু নেই, তাহলে হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের বিলটাও মকুব করে দিতে পারে, বুঝলে? এই এক ঘর নিয়ে ওরা জেরবার হয়ে গেছে‌। না হলে ওরকম লোকেশন, অথচ লোকে মোটে থাকতে চায়না, ভাবো তো।” অতনু আশ্বাস দেন। স্নো লেপার্ড হোটেলের মালিক পিটার অতনুর বহুদিনের পরিচিত, বন্ধুর অনুরোধে অনেক আগেই রুমটা ব্লক করে রেখেছিলেন। স্বপ্নময়কে বুঝতেই দেওয়া হয়নি যে পুরো ব্যাপারটাই তাঁর সঙ্গীদের সাজানো।

“দেখো, ভয়কে জয় করতে গেলে তার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। স্বপ্নময়ের এই ভূতের ভয়টা অস্বাভাবিক। এটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। নাথিং বেটার দ্যান রুম নম্বর থ্রি থার্টি থ্রি অন দি ইভ অফ গুড ফ্রাইডে ফর দ্যাট।” মাস তিনেক আগেই আড্ডায় স্বপ্নময়ের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বলেছিলেন অতনু। সবাই রাজিও হয়ে যায়। সেই পরিকল্পনা মাফিক আজকের আড্ডায় ভূতের অবতারণা।

।। ২ ।।

নকশালবাড়ির কাছেপিঠেই একটা কোথাও লাঞ্চ সেরে ওরা দার্জিলিঙে পৌঁছোয় বিকেল তিনটে নাগাদ। ম্যাল রোডের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে বাগডোগরা থেকে ভাড়া করা ইনোভা ছেড়ে দিতে হবে। স্নো লেপার্ড ম্যালের ঠিক উল্টোদিকে, বেশ কিছুটা ওপরে, সেন্ট পলস্-এর কাছে। এখানে অনেকেই বলে স্যাম্পেল। পিটার বলেই রেখেছিলেন ঘুম আসলেই ওঁকে ফোন করতে, মালপত্র আর সওয়ারীরা স্ট্যান্ডের একটু আগেই গাড়ি বদলায় শুধু।

হোটেলটা তিনতলা। রেস্তোরাঁ পাশে আরেকটা আলাদা বাড়িতে। দুয়ের মাঝে এবং সামনে সুন্দর লন। তিন তলায় পিটার একটা রিডিং রুম বানিয়েছেন,  ঠিক তার লাগোয়া ঘরটাই স্বপ্নময়ের জন্যে বরাদ্দ হয়েছে। ৩৩৩। ঘরে ঢুকে স্বপ্নময় একটু লজ্জাই পায়। পুরনো আমলের মতো করে বানানো কাঠের ঘরে ফায়ার প্লেস আছে, তার সামনে বসার জায়গা। পিরিয়ড ফার্নিচার।

বাথরুমে টাব রাখা, বোঝাই যাচ্ছে এটা হোটেলের সবথেকে ভালো ঘরগুলোর একটা। অতনুকে সেকথা বলেও স্বপ্নময়। “আপনি সিনিয়র, আপনিই থাকুন না।”

“এই বলে পার‌ পেয়ে যাবে ভেবেছ?” অতনু বলে।

পিটার নিজে উঠে এসেছিলেন ওদের সঙ্গে। তিনিও গলা মেলালেন। “আই কান্ট রিস্ক পুটিং অটনু ইন দ্যাট ব্লাস্টেড রুম। হি হ্যাজ হাইপারটেনশন। ইউ সীম টু বি ফিটেস্ট কমপেয়ারড্ টু দ্য আদারস।” দেখা গেল মিথ্যাভাষণ সাহেবেরও সহজাত।

ডিনারের পরে স্বপ্নময়কে সাহস জোগাতে ওঁর ঘরেই আড্ডা বসে। শিশির রাস্তায় বলেছিল তিনশো তেত্রিশের মাহাত্ম্যটা কি সেটা আড্ডাতেই বলবে। এখন সবাই, এমনকি স্বপ্নময়ও শিশিরকে চেপে ধরে।

“AD 33. April 3rd. 3AM. ন’ঘন্টা ক্রুশবিদ্ধ থাকার পর অবশেষে যীশু মারা গেলেন ঐ দিন ও সময়ে। সেইমতো ৩৩৩৩ হওয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু ৩৩৩কেই অশুভ মানার আরেকটা কারণ বোধহয় এটা ৬৬৬র ঠিক অর্ধেক আর ৬৬৬ তো জানোই, শয়তানকে represent করে।”

স্বপ্নময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে হেসে ওঠে।

“কী হলো?” অতনু জানতে চান‌।

“না, আমি ভাবলাম Christ তো আবার সাতদিন পর বেঁচে উঠেছিলেন বলে বিশ্বাস। সেক্ষেত্রে ওঁর মৃত্যুর সময়টাও খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়‌। আমি মানছি আমার ভূতের ভয় আছে, কিন্তু এসব কুসংস্কারকে আমি অন্তত: মানিনা।” স্বপ্নময়কে এতটা বেপরোয়া হতেও ওঁরা কোনোদিন দেখেনি।

“ঠিক আছে, সে কাল সকালেই বোঝা যাবে। তোমার মুখেই শুনবো, তোমার মত পাল্টালো কি না,” শিশির বলে।

আড্ডাটা এরপরে কেন জানি জমে ওঠে না। এগারোটা বাজতে না বাজতেই সবাই উঠে পড়েন। বাকি চারটে ঘরই পূর্ব পরিকল্পনামাফিক নেওয়া হয়েছিল দোতলায়। নেমে যাওয়ার আগে সবাই পরদিন সকালে নীচের লনে সকাল আটটায় দেখা করবে বলে কথা হয়ে থাকে।

।। ৩ ।।

“একবার নক করে দেখবেন নাকি?” বিকাশ অতনুর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে। গভীর রাতে বেশ খানিকটা ঝড় বৃষ্টি হয়েছে হঠাতই। প্রায় সবার ঘুম ভেঙ্গে গেলেও আবার ঘুম আসতে অসুবিধে হয়নি তেমন। বিকাশ নীচে নামতে যাচ্ছিল, অতনুর ঘরের দরজা খোলা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। অতনুও দেখে তৈরী, চার্জার থেকে নিজের মোবাইল খুলছেন।

“না, না, দেখে নিও টুডে হি উইল এমার্জ আ নিউ ম্যান,” বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে অতনু, “ওঁকে নিজে আসতে দাও, চলো নীচে যাই।”

নীচে নামতে নামতেই ওরা দুজন শিশির আর সামন্তের গলা শুনতে পায়। তার মানে স্বপ্নময়েরই আসা বাকি। অবশ্য আটটা বাজতে তখনো তিন মিনিট বাকি।

সামন্ত ওদের দু’জনকে দেখেই বললেন, “আজ কিন্তু আমি কিছুতেই কফি খাচ্ছি না। রেস্তোরাঁয় বলে দিয়েছি। গত মরশুমের সেকেন্ড ফ্লাশ আছে। স্বপ্নময় এলেই সার্ভ করতে বলবো।”

“এসে গেছি।” সামন্তের কথা শেষ হতে না হতেই স্বপ্নময়ের গলা শোনা যায়, তবে হোটেলের ভেতর থেকে নয়। বড় রাস্তা থেকে হোটেলে ঢোকার যে ছোট্ট গলি রেস্তোরাঁর পেছন দিয়ে উঠে এসে হোটেলের গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে, তার মোড় ঘুরতে দেখা গেল স্বপ্নময়কে। পরণে ট্র্যাকস্যুট আর প্যান্টস্‌।

“আর অতনুদা, আপনাকে একটা বিশাল থ্যাংক ইউ, এই প্ল্যানটা না করলে আমার কল্পনাটা কোনোদিন নিরাকার হতো না, হা হা হা।” আরেকটু কাছে আসতে বললো স্বপ্নময়।

“ম-মানে?”

“মানে কাল তো আপনারা চলে গেলেন। শুয়েও পড়লাম তখনই। কিন্তু ঘুম আর আসে না। মনে হয়েছিল অনেকক্ষণ শুয়ে আছি,  বিরক্ত হয়েই উঠে পড়লাম একসময়, নাইট ল্যাম্পের আলোয় দেখলাম ঘড়িতে এগারোটা তিন বাজে। ভাবলাম কম আলোয় ভুল দেখছি হয়তো বা। টিউবটা জ্বালালাম। নাহ্, সত্যিই এগারোটা তিন। তাহলে কী ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেল? মোবাইল তো আমি বন্ধ করে শুই। সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা ছিল সেটা। নিতে গিয়ে দেখি নেই। মনে করার চেষ্টা করছি অন্য কোথাও রেখেছি কী না, হঠাৎ দরজায় কেউ নক করলো। এত রাতে আবার কে এলো রে বাবা, কোনো অশরীরীর আগমন হলো না তো, ভেবে আইহোলে চোখ লাগাতে যাবো, দেখি সেটাও নেই। একিরে বাবা, মোবাইল না হয় অন্য কোথাও রাখতে পারি, তাই বলে আস্ত একটা আইহোল দরজা থেকে গায়েব হয়ে যাবে। সত্যজিৎ রায়ের ‘নীল আতঙ্ক’ গল্পটা মনে আছ,, সেরকম কেস না তো? একটু নিজের দিকে তাকালাম। নাহ্, আমি তো যে স্বপ্নময় বোস ছিলাম, তাই আছি। গলা খাঁকরে জিজ্ঞেস করলাম, “কৌন হ্যায়”, দিব্য আমার নিজের গলা। বাইরে থেকে উত্তর এলো হিন্দিতেই, কিন্তু সাহেবী উচ্চারণ। “ঘুম আসছে না বোস্, দরজাটা খোলো, আর এক হাত হয়ে যাক আজ রাতে।”

তখনই অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলো জানেন। হাতের কথা শুনেই বুঝতে পারলাম ইনি সেই আর্থার সাহেব, যার আমার ঠাকুরদার সঙ্গে রোজ দাবা না খেললে চলতো না। ঠাকুরদার যে দার্জিলিঙে পোস্টিং ছিল সে কথা তো কখনো বলিনি আপনাদের‌। দরজা খুলে দিতেই দেখি ঠিক ধরেছি।”

“বুঝেছি। তুমি তো বেশ ধুরন্ধর হয়ে উঠেছ দেখছি। আমাদের প্ল্যান জানতে পেরে এখন উল্টে আমাদেরই ভয় দেখাচ্ছ?” অতনু অনুযোগের সুরে বললেন।

“ছি, ছি, ভয় দেখাবো কেন। যা ঘটেছে তাই বলছি। অবশ্য আপনাদের প্ল্যানটাও জানতে পারলাম আর্থারের মুখেই। আমার মন্ত্রীটা খেতে খেতে উনি এটাও বলেছিলেন যে আমি যদি ওঁর কথা আপনাদের বলি, তাহলে হয় আপনারা হেসে উড়িয়ে দেবেন, অথবা ভয় পাবেন। এখন দেখছি দ্বিতীয়টাই ঠিক।”

“হয়েছে স্বপ্নময়, গল্পটা ভালোই তবে বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর হ্যাঁ, তুমি ভীতু বলে আমার যে ধারণাটা ছিল, সেটা যে নিতান্তই ভুল তাও তুমি প্রমাণ করেছ। সো, কনগ্র্যাচুলেশনস ব্রাদার। এবার চলো দার্জিলিং চা উপভোগ করা যাক।” অতনু নিজের পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে বলেন।

“সে তো যাবোই। কিন্তু আর্থার যে কাল সত্যিই এসেছিলেন, তার একটা প্রমাণ ঐ রুমেই থেকে গেছে কিনা। আপনারা একবার চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে আসলে পর চা খেলে হয় না?” স্বপ্নময় অনুরোধ করে।

“বেশ তাহলে। সামু, ওদের বললে ওঁরা চা টা স্বপ্নময়ের রুমে দেবে না?”

সামন্ত বলেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেবে না কেন, রুম থেকেই না হয় ফোন করে দেব, চলুন।”

“আপনি লীড করুন।” স্বপ্নময় অতনুকে বলে, “তখন যতটা না ভয় পেয়েছিলাম, এখন তার থেকে বেশি ভয় লাগছে।”

অতনু সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ান।

“আহ্, দরজাটা খুলে রেখে গেছো কেন?” ৩৩৩-এর সামনে পৌঁছে বিরক্তির সুরে বলেন অতনু, “আজকাল কি কাউকে ভরসা করা যায়? না করা উচিত?”

“আজকাল কোথায়, অতনুদা? ভুলে যাচ্ছেন কেন এই দরজার ওপারে সময় থমকে আছে।” বিকাশ হাসতে হাসতে বলে। বাকি সবাই হাসিতে যোগ দেয়। অতনু হাসতে হাসতেই দরজায় ঠেলা মেরেই আঁৎকে উঠে আবার দরজা টেনে দিলেন। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার দিকে দেখিয়ে বললেন “তো-তোমরাই দেখো।” বিকাশ কিন্তু কিন্তু করছে দেখে শিশির দরজা ঠেলে পুরোটা খুলে দিতে সবাই দেখতে পেল সেন্টার টেবিলের ওপর একটা খুলে রাখা সেকেলে দাবার বোর্ড, খেলা শেষ হয়নি সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে, কারণ ওদের দিকে যিনি পিঠ করে বসে আছেন, তাঁর হাতের দু’আঙুলের ফাঁকে ধরা রয়েছে বিপক্ষের মন্ত্রী। আঙুলগুলো সাদা, তাতে রক্তমাংস বা চামড়ার চিহ্নমাত্র নেই।

স্বপ্নময় হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে আর্থার সাহেবের উল্টোদিকে গিয়ে বসে পড়লো। বাকিরা তখন নিজেদের জায়গা থেকে নড়তে পারছে না।

“কী সামন্তদা, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন। সেকেন্ড ফ্লাশটা আজ ওঁর অনারেই খাওয়া যাক,” স্বপ্নময় বলে, “অতনুদা, আপনি কিন্তু ইজিলি ডবল এজেন্ট হতে পারতেন। বলেই দিন এঁদের।”

অতনুর মুখেও তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই বলেন, “স্পন্ডিলাইসিসের জেরে জানোই তো অমন শখের থিয়েটার ছাড়তে হলো গত বছর। খুব মুষড়ে পড়েছিলাম, তখন একদিন এই স্বপ্নময় এলো আমার কাছে। কী বললো জানো, চলো না আড্ডার সবাইকে আমাদের একটা যুগ্ম অভিনয় দেখাই‌। পিটারের কথা ওঁকে আগেই বলেছিলাম। সেও দেখলাম এক কথায় রাজি হয়ে গেল। স্বপ্নময় সবার ছোট, অভিজ্ঞতাও কম, তাই মাঝে মধ্যেই তোমরা ওঁকে হেয় করো এটা আগেও দেখেছি। আমিও যে করিনি তাও না। কিন্তু ওই যখন আমার খারাপ সময়ে পাশে এসে দাঁড়ালো, তখন ভাবলাম তোমাদেরও জ্ঞানচক্ষু খোলা দরকার। প্রয়োজন বলতে ছিল কিছু প্রপ্সের, তার মধ্যে মুখ্য হলেন এই আর্থার সাহেব। নকল। রেজিনের। আর বাকিটা কিন্তু স্বপ্নময়ের কল্পনা আর চিত্রনাট্য। থ্রি চীয়ার্স ফর স্বপ্নময়, হিপ হিপ হুররে।”

এবারে সবাই গলা মেলালেন।

 


রচয়িতা পরিচিতি:


কোয়েলী সরকার

আকাশ দেখে, হাই তুলে অনেকগুলো দিন কাটিয়ে দিতে পারে। ঘরে হাইস্পিড ইন্টারনেট আর চিঁড়েভাজা থাকলে তো কথাই নেই।
পড়াশোনা – পুণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতকোত্তর
ভালোবাসা – রঙ, গান, দেশবিদেশের উপকথা, রহস্য, ভালো দার্জিলিং চা, ক্যারামেল পুডিং ইত্যাদি।
বায়োলজির দিদিমণি। ঘুপুর মা। সুযোগ পেলেই গান গায়। ভীষ্মলোচন। যেসব মফঃস্বলীর কাঁঠালিচাঁপা গাছ, নির্জন লাইব্রেরি, মাঠ আর ধুলোপড়া চিঠির সঙ্গে একটা সম্পর্ক থেকে যায়, তাদের একজন।



সৌগত চক্রবর্তী

 

বাড়ির লোকেদের মতে একমাত্র প্যাশন হলো ঘুম। এতোটাই যে ঘুম নিয়ে একটা আস্ত বই লিখে ফেলেছে। পড়াশোনা নিতান্তই কম, তাই বিতর্ক দেখলেই দূরত্ব বজায় রাখে। মাটন ছাড়া বিরিয়ানি হয়না এই মৌলবাদে বিশ্বাসী। মুদ্রাদোষ: “একটা গল্প বলি শোনো”। অমলকান্তিদের একজন।

 


Author

Du-কলম

Join the Conversation

    1. Dhanyobad Manabendrababu. Jotoi udiyoman lekhokder lekha porchhilam, totoi nijer lekhalekhite moshlar abhab prokot hochchhilo, tai ei swadbodoler cheshta. Pathoker swikriti peye bhalo lagchhe.

  1. বেশ ভালো লাগলো। সত্যজিৎ রায় ঘরানার এই ধরনের গল্পগুলির অভাব এখন। দুই রচয়িতাকে ধন্যবাদ সেটা মেটানোর জন্য। আরও এই ধরনের গল্প চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!