Home বিবিধ, প্রবন্ধ আমার সাহসিকতা
বিবিধপ্রবন্ধ

আমার সাহসিকতা

লেখিকা: শিপ্রা মিত্র


 

ঊনিশশো একষট্টি সালের গোড়ার দিক, আমার তখন সাড়ে ন-বছর বয়স। শোনা গেলো ইংল্যাণ্ডের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কলকাতা আসছেন। সারা কলকাতা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো রাণীর আসার দিনটির জন্যে। অবশেষে এলো সেই প্রতীক্ষিত দিন।

রাণী যে যে রাস্তা দিয়ে যাবেন, তার মধ্যে একটি ছিলো উত্তর কলকাতার যতীন্দ্র মোহন অ্যাভিনিউ। ওই রাস্তার ধারেই আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি ছিলো। আমি বায়না ধরলাম রাণীকে দেখবো বলে। শেষ পর্যন্ত আমার কাকার সঙ্গে আমি, আমার ছোড়দা ও আমার দুই খুড়তুতো বোনের সঙ্গে গেলাম সেই আত্মীয়ের বাড়ি।

আমরা সবাই মিলে বারান্দায় দাঁড়ালাম রাণীকে দেখবো বলে। সে কি আনন্দ! সামনের রাস্তা লোকে লোকারণ্য। সবাই রাণীর জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। অবশেষে রাণী এলেন একটা হুডখোলা বিশাল গাড়ি – ১৯৫৬ মডেলের ডজ কিংস্‌ওয়ে কনভার্টিব্‌লে চড়ে। সঙ্গে স্বামী ফিলিপ। জনতা চিৎকার করে রাণীর গাড়িতে ফুল ছুঁড়তে লাগলো। রাণী সবার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে লাগলেন। মুখে মিষ্টি হাসি। ধীরে ধীরে রাণীর কনভয় চলে গেলো। আমরা বাড়ি ফেরার জন্যে রাস্তায় নামলাম।

রাস্তায় তখন প্রচণ্ড ভিড়। আমরা সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়েই পরস্পরের হাত ধরাধরি করে হাঁটছি। হঠাৎ ভিড়ের ধাক্কায় আমার হাতটা ছেড়ে গেলো। আমি অনেকটা দূরে সরে গেলাম। তারপর চারদিক চেয়ে আমার কাকা, দাদা, বোনেদের – কাউকেই দেখতে পেলাম না। সব অন্য, অচেনা মুখ। বুঝলাম হারিয়ে গেছি।

আমি কিন্তু একটুও ভয় পেলাম না। কাছেই একটা বাস গুমটি ছিলো। সোজা সেখানে গিয়ে একজন কন্ডাক্টরকে বললাম, “আমি হারিয়ে গেছি।” তিনি আমায় বললেন, “বাড়ির ঠিকানা জানো?” আমি ঠিকানা বললাম। তিনি বললেন, “আমি যদি তোমাকে বাসে তুলে দিই, তুমি যেতে পারবে?” আমি বললাম, “না, তাছাড়া আমার কাছে তো পয়সা নেই।”

কন্ডাক্টরটি তখন আমায় শ্যামপুকুর থানায় নিয়ে গেলেন। ও.সি.-র সঙ্গে কথা বলে আমাকে ওখানে রেখে চলে গেলেন। ও.সি. আমাকে নাম, ঠিকানা, ফোন-নম্বর সব জিজ্ঞেস করলেন। আমি যতোটা পারলাম, বললাম। তারপর আমি কিছু খাবো কি না জিজ্ঞেস করাতে আমি মাথা নেড়ে না বললাম। তারপর উনি ফোনে কথা বলতে লাগলেন। আমি এদিক-ওদিক দেখতে লাগলাম।

ফোনে কথা সেরে ও.সি. আমার সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। একটু পরে দেখি আমার বড়দা ও কাকা থানায় এলেন। দুজনেরই মুখ ভয়ে ভাবনায় শুকিয়ে আছে। আমি তখন হেসে হেসে ও.সি.-র সঙ্গে গল্প করছি। কাকা তো আমার কাছে এসেই এক চড় তুললেন। দাদা আর ও.সি. ভদ্রলোক মিলে তাঁকে বাধা দিলেন। ও.সি.-কে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে কাকা ও দাদা আমাকে নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলেন।

বাড়ি এসে দেখি মা জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে আছেন, আমাদের ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে। মা কিছুই জানতেন না। পরে সব জেনে তো হতবাক।

কি ভাগ্যিস, আমার বাবা সেই সময়ে কলকাতায় ছিলেন না। তাই বেঁচে গেছিলাম। না হলে সেদিন কপালে অশেষ দুঃখ ছিলো।

_____

 


শিপ্রা মিত্র

 

এককালে রীতিমতো সঙ্গীতচর্চা করলেও বিয়ের পর সংসারের চাপে গান নিয়ে আর এগোনো হয়নি। অসম্ভব বই পড়ার নেশা থাকলেও লেখালেখির অভ্যেস কোনোওকালেই তেমন ছিলো না। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথম কলম ধরা।

 


 

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. খুব ভালো লাগলো কাকীমা। আপনি আরো লিখুন।

    ছোটবেলায় মামারবাড়ি গেলে আমার দিদা ওনার ছোটবেলার গল্প শোনাতেন। আজ আপনার লেখা পরে আমার ছোটবেলার সেই সব কথা মনে পড়ে গেলো।

  2. খুব ভালো ছোটমণি। আরো লেখো। তুমি আমাকে এই ঘটনাটা জি/3র বারান্দায় বসে বলেছিলে। আজ মনে পড়ে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!