Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৩০
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৩০

গোপা মিত্র

দার্জিলিং
পর্ব ২

(সঙ্গে কালিম্পং)

পথরোধ করে সামনে এসে দাঁড়ানো উদ্‌ভ্রান্ত পথভ্রষ্ট মেঘের দল তখন আমাদের কাছেই জানতে চাইছে তাদের আকাশে ফিরে যাবার রাস্তা। কিন্তু আমরা তাদের পথদিশা দেখাবো কেমন করে? অস্বচ্ছ সাদা মেঘের পর্দায় আমরাই তো তখন দিশাহারা – বুঝতেই পারছি না, কোনদিকে খাদ আর কোনদিকে পথ। কোনক্রমে তাদের আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব্যে। জানিনা কখন আবার কাল্‌চে ধূম্রবর্ণ মেঘের ঝরে পড়া জল, আমাদের ভিজিয়ে দেবে বা রাস্তা পিচ্ছিল করে দিয়ে আমাদের যাত্রাপথে বাধার সৃষ্টি করে, আমাদের এই দার্জিলিং বেড়ানোর একটা দিন নষ্ট করে দেবে। 

আমার দ্বিতীয়বার দার্জিলিং যাওয়া প্রথমবারের কয়েক বছর পরে, শরৎকালে, ১৯৭৮ সালে পুজোর পরে, অক্টোবরের প্রথমে। তখনও শীতে বেড়ানোর মজা সকলের জানা নেই, পূজোর পরেই বেড়ানোর চল। তাই সুযোগ যখন এসেই গেল আমিও তাদের সঙ্গে জুড়ে গেলাম। তবে এবার অবশ্য দুজনে নয়, মোট এগারো জনে – মেয়ে নিয়ে আমরা তিনজনে, আমার ছোট বোন আনু, আর কল্যাণের দুই কলিগ, সপরিবারে। ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে, সেখান থেকে জিপে প্রথমে যাব কালিম্পং, তারপর দার্জিলিং।

প্রায় ৪১০০ ফুট উচ্চতার শৈলশহর কালিম্পং-এর অবস্থান ডেলো আর দুরপিনদাড়া – এই দুই পাহাড়ের মাঝে। একসময় এই শহরের মধ্যে দিয়ে চলত ভারত আর তিব্বতের মধ্যে বানিজ্য। ফুল আর অর্কিডের শহর কালিম্পং। নিম্ন উপত্যকা দিয়ে বয়ে চলা তিস্তা নদী, উপরে তার উচ্চশির কাঞ্চনজঙ্ঘা, আর চারিপাশে অজস্র ফুলের সমারোহ কালিম্পংকে করে তুলেছে অনবদ্য, বিশেষ। মাথার উপরে যখন মেঘমুক্ত নীল আকাশ, নিচের উপত্যকা তখন আবৃত মেঘের চাদরে, কালিম্পং-এর এটাই বিশেষত্ব।

শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং যাবার পথে সেবক পেরিয়ে আমরা দেখে নিলাম কালীঝোরা। চারিপাশ পাহাড়ে ঘেরা, মাঝে উপত্যকা ও অরণ্যময় পরিবেশে পাহাড় থেকে নেমে আসছে তিস্তা। এখানে স্নানও করা যায়। তিস্তার পাশে পাশে পথ গিয়েছে রাম্বি। এবার তিস্তার পাশে পাশে আমরা পথ ধরলাম কালিম্পং-এর।

কালিম্পং-এ আমাদের বাসস্থান রাজ্য পর্যটন নিগমের ট্যুরিস্ট লজ ‘সাংগ্রিলা’, বাজার থেকে দূরে এক নাতিউচ্চ পাহাড়ের উপর। ছোট্ট কাঠের এই লজটিতে আমরাই কয়েকজন মাত্র পর্যটক। নিরিবিলি নির্জনে একলা এই লজটি আমাদের বেশ পছন্দ। উপরে উঠলেই দেখা যায় পাহাড় চূড়া। তবে এখনও এই লজটি আছে নাকি, কলেবর বৃদ্ধি করে নামও বদলেছে, জানি না। 

আমরা প্রতিদিনই নেমে যাই নিচে, ভীড়ে গম্‌গম্‌ বাজারে। সেখানে গাড়ী ষ্ট্যান্ড থেকে জিপ কালিম্পং-এর প্রায় সব দিকেই যায়। 

ব্রিটিশ আমলে তৈরী মিশনারী স্কুল গ্রাহামস্‌ হোম শহর থেকে ৩ কিমি দূরে, শুরু হয়েছিল মাত্র কয়েকজন অনাথ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাচ্চাদের জন্য। সামান্য একটা কটেজ দিয়ে শুরু এই স্কুলের এখন বিশাল এলাকা, একাধিক কটেজ ও অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। চারিপাশে ফুলের বাগান আর সবুজের মাঝখানে এই স্কুলের যে কোনো অংশে যে কেউ গিয়ে দেখে আসতে পারে।

একদিন গেলাম দুরপিনদাড়া পাহাড়ের উপর জাং ধোক পালরি ফোদং বা ফোদং মনাষ্ট্রীতে। তিব্বত থেকে আনা দুস্প্রাপ্য গ্রন্থসমূহ রয়েছে এখানে। এর দেওয়াল সজ্জিত থাঙ্কা আর অপূর্ব সব ফ্রেস্কো চিত্রে, মধ্যে রয়েছে  গুরু পদ্মসম্ভবের মুর্তি। পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যায় দূরের তুষারশুভ্র শৃঙ্গগুলি। এর রাজকীয় স্থাপত্য আর ত্রিমাত্রিক Appearance অবশ্যই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 

কালিম্পং-এর অন্যতম দ্রষ্টব্য সুউচ্চ, প্রাচীনতম, গথিক শৈলীতে নির্মিত ম্যাকফার্লেন চার্চ, যেমন সুন্দর তেমনই পরিচ্ছন্ন। ১৮৯১ সালে স্কটিশ মিশনারী ম্যাকফার্লেন দ্বারা নির্মিত এই চার্চটি কালিম্পং-এর ল্যান্ডমার্ক বলা যায়। পরিস্কার দিনে এখান থেকে দেখা যায় ঝক্‌ঝকে পর্বত শিখরগুলি।

কালিম্পংএর চারিদিকে চোখে পড়ে রংবেরংএর পুষ্পসম্ভার, নয়নভুলানো অর্কিড আর দুষ্প্রাপ্য ক্যাকটাস। এখানে রয়েছে একাধিক নার্সারী। এদের প্রধান ব্যবসাই হল দেশেবিদেশে পুষ্প রপ্তানী। 

কালিম্পং বিখ্যাত তার ডেয়ারী প্রোডাক্টস্‌এর জন্যও। এদের ডেয়ারীর চিজ্‌ ফাজ্‌ চকোলেট ললিপপ সবই অতি সুস্বাদু। মোটরষ্ট্যান্ড থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে মেন রোডে কালিম্পং আর্ট এন্ড ক্রাফ্‌ট। এদের তৈরী ব্যাগ, ওয়াল প্যানেল, হাতে তৈরী তাস, রুমাল ক্রয়ের সুযোগ রয়েছে এখানে।  

এসে পৌঁছলাম দার্জিলিং – জলাপাহাড়ের উপরে রাজ্য সরকারের তখনকার ট্যুরিস্ট লজ ‘শৈলাবাস’-এ। দার্জিলিং-এ যত জায়গায় থেকেছি, অনেক উপরে হলেও এটিই আমার কাছে সেরা মনে হয়। কাঠের তৈরী এই বাংলো টাইপের লজটির সাহেবী আমলে তৈরী বড়বড় ঘর, চতুর্দিকের কাচের জানলা, সংলগ্ন উদ্যান আর চারিপাশের নিঃঝুম প্রকৃতির মাঝে শুধুমাত্র পাখীর কলতান, ফুলের সৌরভ, আর প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি নির্জনতা প্রিয় প্রকৃতি প্রেমিকদের কাছে স্বর্গ বলা যায়। একটু উপরে উঠলেই দেখা যায় সুর্যোদয়।

প্রতিদিন সকালে প্রাতঃরাশ সেরে আমরা নেমে যেতাম নিচে, সেন্ট পল্‌স স্কুল আর ইউথ হোষ্টেলের পাশ দিয়ে। তারপর কিছুদূর হেঁটে পৌঁছে যেতাম ম্যালে বা অন্য কোথাও। সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরেফিরে আবার ফিরে আসতাম জলাপাহাড়ের নিচে। এদের নিজস্ব জিপ আমাদের নিয়ে আসত উপরে। তবে সবদিন অবশ্য জিপে উঠতাম না, কোনো কোনো দিন হেঁটেও উঠতাম উপরে, সবাই মিলে হৈ হৈ আনন্দে। 

ম্যাল রয়েছে সেই আগেরই মত – প্রায় সবদিকেই আগেরই মত বেঞ্চিপাতা, দোকানপাট দিয়ে সাজানো। নীল আকাশের বুক চিরে উঠে আসা বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা সেও তো রয়েছে সেই আগেরই মত। পরিবর্তন হয়েছে শুধু মানুষের ভীড়ের। পুজোর পরের জনসমাগমে ম্যালে পা রাখাই দায়। ম্যালের বেঞ্চিগুলো যেন Musical Chair, একজন উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে একজন বসে পড়ছে। 

এবার অবশ্য আগের সব জায়গাতেই গেলাম না, অবজারভেটারী হিল প্রদক্ষিণ করলাম ঠিকই কিন্তু মহাকাল মন্দিরে উঠলাম না। চিড়িয়াখানা না গেলেও মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট যেতে ভুলে গেলাম না। রোপওয়ে না গেলেও হ্যাপি ভ্যালী টি-এস্টেট ঘুরে দেখে চা কিনে নিলাম।

এবার গেলাম এক নতুন জায়গা – মিরিক, সঙ্গে পশুপতিনগর। দার্জিলিং থেকে ৫০ কিমি দূরত্বে, গাড়ীতে আড়াই ঘন্টার পথ, মিরিক তখন সবেমাত্র তৈরী হয়ে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। মিরিকের মূল আকর্ষণ এর প্রাকৃতিক লেক। সকাল সন্ধ্যায় মেঘেরা নেমে এসে বিশ্রাম নেয় এই হ্রদের বুকে, আর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে যায় উপরে। হ্রদের একদিকে সবুজ অরণ্যে ছাওয়া পর্বতমালা আর অন্যদিকে পাহাড়ি সমতল। লেকের পাশে নরম ঘাসের প্রান্তর জুড়ে বাগিচা। পাশেই রয়েছে পর্যটন দপ্তরের ডে সেন্টার। সেখানে পাওয়া যায় স্ন্যাক্স ও অন্যান্য খাবার-দাবার।

মিরিকের ১৪ কিমি দূরে নেপালের সীমান্তে পশুপতিনগর। গাড়ী থেকে নেমেও দুপুরের রোদে হাঁটতে হল বেশ কিছুটা। দেখলাম এক জায়গায় বিদেশী সামগ্রীর বেশ কিছু দোকানপাট। বলছে বিদেশী, কিন্তু সবই দেখলাম চিনের তৈরী। পর্যটকরা সেইসব দোকান থেকেই কিনছে শাড়ী, কসমেটিকস্‌, নকল গয়না, ব্যাগ, ছাতা ইত্যাদি। আমরাও সেখান থেকে কিনলাম ফোল্ডিং ছাতা আর ব্যাগ। এখন অবশ্য এমন ছাতা আর ব্যাগ সব জায়গাতেই পাওয়া যায় – যা মুড়ে নিলে ছোট হয়ে হাত ব্যাগে রাখা যায়।

আমাদের কাছে এবার ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয়, টয় ট্রেণ বা খেলনা রেলে চড়ে ‘ঘুম’ যাওয়া আবার ফিরে আসা। টয় ট্রেণ তখন নিয়মিত চলে, নিঊ জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং পর্যন্ত ন্যারো গেজ লাইনে। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে এটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের আখ্যা পেয়েছে।

সকলে চলেছি নিচের এক বাজার, আর বাড়ীঘরের মধ্যে দিয়ে দার্জিলিং ষ্টেশনে। এটা দার্জিলিং শহরের নিচু অঞ্চল। এর উপরের ধাপে আপারষ্ট্যান্ড পর্যন্ত চলে যায় শিলিগুড়ি থেকে আসা শেয়ারের গাড়ী। সেখান থেকে পিচ রাস্তার হাঁটাপথ উঠেছে ম্যালের দিকে। ম্যালে গাড়ী চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু অন্য রাস্তায় ঘুরপথে আরও কিছুটা উপরে জলাপাহাড়ের রাস্তায় গাড়ী যেতে পারে। 

দার্জিলিং ষ্টেশন থেকে খেলনা রেলে আজ যাবো ৭৪০৭ ফুট উচ্চতার ঘুম – এশিয়ার সর্বোচ্চ ও পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম রেলষ্টেশনে। আমাদের মত অনেকেই তখন দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে, ট্রেণের অপেক্ষায়। অবশেষে এল চার কামরার এক শিশুরেল – দেখতে দেখতে ভরে উঠল কামরার ফাঁকা অংশগুলো। এবার নড়েচড়ে উঠল ট্রেণ – তারপর কু ঝিক্‌ঝিক্‌ করে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে এগিয়ে চললো সদর্পে, কখনো জঙ্গল, কখনো জনবসতি সঙ্গে নিয়ে, ধীরলয়ে। মাথার উপরে নীলচে আকাশে সাদা মেঘের পান্‌সি, চারিদিক ঝল্‌মল রাস্তায় স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছোট ছোট খুদে পড়ুয়ার দল, ঠোঁটে তাদের চওড়া হাসির ঝিলিক। 

কারিগরি বিদ্যার (Engineering) অন্যতম বিস্ময় এই টয় ট্রেণের লাইনে রয়েছে একাধিক বাঁক, Loop, Zigzags যাতে সে উপরে উঠতে পারে। কি অসামান্য দক্ষতায় না জানি ইঞ্জিনীয়াররা এই লাইন পেতেছে ! 

দার্জিলিং থেকে মাত্র ৭ কিমি আগের ষ্টেশন ঘুম পর্যন্ত পথটুকু অতিক্রম করতে সময় লাগে মাত্র ৫০ মিনিট। এই দুই ষ্টেশনের মাঝেই রয়েছে আশ্চর্য বাতাসিয়া লুপ। অনেক উঁচুতে – প্রায় ১৪০ ফুট, ওঠার জন্য এই লাইন উঠেছে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে (Spiral Loop). এখান থেকে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার হিমশিখর গুলি আর দার্জিলিং শহর একেবারেই অনবদ্য। 

ঘুম ষ্টেশন থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটাপথে আমরা দেখে এলাম ওল্ড ঘুম মনাষ্ট্রি বা ইগা চোলিং মনাষ্ট্রি। ৮০০০ ফুট উচ্চতায়, এই গুম্ফায় রয়েছে ১৫ ফুট উচ্চতার মৈত্রেয় বুদ্ধের মূর্তি। সেখান থেকে আমরা আবার ফিরে এলাম দার্জিলিং – টয় ট্রেণে করেই। ফেরার পথে নিচের বাজার থেকে কিনে নিলাম কয়েকটা সোয়েটার।

একদিন ভোরে এবারেও আমরা চললাম টাইগার হিলে। তবে এবার আর লেপ কম্বল জড়াতে হল না, কারণ সময়টা ছিল শরৎকাল আর গরমজামাও ছিল পর্যাপ্ত। এবারেও কাঞ্চনজঙ্ঘা ও এভারেস্ট আমাদের বঞ্চিত করল না। সাদা কাল ক্যামেরায় ছবি তুলে নেমে এলাম নিচে, অনেক দূরে থাকার জন্য এভারেস্ট এল না, ছবি এল শুধু সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার।

শরতে দার্জিলিং, সেও তো দেখা হয়ে গেল – এবার চললাম বর্ষায় দেখতে দার্জিলিং, জুন মাসের প্রথমে ১৯৮৯ সালে। বর্ষায় দার্জিলিং, বোধহয় শুধু পাগলেই যায় – আমরা হয়ত পড়ি তাদেরই দলে। তাই মেজ ভগিনী পতি সঞ্জয়, কর্মসূত্রে দার্জিলিং যাওয়ার সময় যখন আমাদের কাছে প্রস্তাব দিল আমরা একবাক্যে রাজী হয়ে গেলাম। 

সেবার আমরা পৌঁছবার ঠিক আগে, তিন দিন ধরে দার্জিলিং-এ চলেছিল তুমুল বর্ষণ। মুখ অন্ধকার করে তো আমরা তিনজন আর সঞ্জয়রা চারজন – মোট সাতজন, এসে পৌঁছলাম ম্যালের ঠিক পাশেই হোটেল ‘অ্যালিস ভিলা’য়। সেখানে পৌঁছেই শুনলাম, তিনদিন ধরে আমাদের পাশের ঘরের পর্যটকরা ভিডিও ভাড়া করে এনে ঘরে বসে শুধু সিনেমাই দেখে চলেছে। তবে আমাদের ভাগ্য ভাল, আমরা আসার পরই বৃষ্টি থেমে গেল, কিন্তু রোদ উঠল না। যাক্‌ আমাদের অন্ততঃ ঘরে বসে কাটাতে হবে না ! কিন্তু একটা মুশকিল রয়েই গেল – সঞ্জয়ের বাটার স্যু ভিজে চুপচুপে, ওকে ওই শ্যূ পরেই কাজে বেরতে হবে। কি আর করা? পা প্লাস্টিকের প্যাকেটে সম্পূর্ণ মুড়ে তলায় কাগজ দিয়ে, সঞ্জয় সেই জুতো পরেই কাজে বেরোল। 

এবারে অবশ্য, এমন মেঘলা দার্জিলিং-এ আমরা কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করলাম না। শুধু পর্যটকশুন্য ম্যালের বেঞ্চিতে বসে অলস দৃষ্টিতে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, আর আড্ডা দিয়েই কেটে গেল। তবে অবজারভেটারী হিলের পাশের রাস্তা দিয়ে একবার তো আমায় হাঁটতেই হত। সেইমতই একদিন লম্বা লম্বা পাইন গাছের সারি, দীর্ঘ পাক খাওয়া পথ, মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারা চারিপাশের উজ্জ্বল সবুজ গাছপালা আর আচমকা পাহাড় বেয়ে নেমে আসা বর্ষা জলের ছোট্ট কোনো ঝোরা বা উপর থেকে নেমে আসা হঠাৎই কোন মেঘের দল, আর মেঘ সরে গিয়ে নীল আকাশের একবার দেখা দিয়েই আবার মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া – এই সবকিছু সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলাম আবার সেই মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে।

ক্যাভেণ্টার্স থেকে গ্লেনারিসের রাস্তায় আসতে গেলে ভুটিয়া মেয়েদের যে বাজার বসতো, বর্ষার কারণেই হয়ত সেই বাজার বন্ধ দেখলাম। ব্যাস, এবার দার্জিলিং বেড়ানো এই পর্যন্তই –শুধুমাত্র ম্যালের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো।

বর্ষায় দার্জিলিংকে পেলাম অন্যরূপে। মাথার উপরের আকাশ আবৃত কালচে মেঘে, নিচের প্রকৃতি তখন কোথাও স্বচ্ছ কোথাও অস্বচ্ছ মেঘের ওড়নায়। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা ? সে তো একেবারেই মুখ লুকিয়েছে মেঘের অন্তরালে। ম্যালের আশেপাশেই আমাদের যাতায়াত, প্রতীক্ষা যদি একবারও অন্ততঃ দেখা যায় তাকে – কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান –চকিতের জন্য তিনি উন্মোচন করলেন মেঘের আবরণ তারপরই আবারও মুখ ঢেকে ফেললেন। হঠাৎ করেই ঝরে পড়ে উপর থেকে জলধারা, ছাতা খুলেই আমরা ছুট্টে চলি আমাদের অস্থায়ী বাসস্থানের দিকে।

প্রথম ও দ্বিতীয়বার কাঞ্চনজঙ্ঘা ছিল প্রায় সব সময়ই আমাদের সঙ্গে। কখনো সামনে; কখনো পাশে। কিন্তু তৃতীয়বার মেঘলা দার্জিলিং-এর এক অন্যরূপ দর্শন সত্ত্বেও কাঞ্চনজঙ্ঘাকে না পাওয়ার অতৃপ্তি নিয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল। তখনই মনস্থির করে নিয়েছিলাম আবারও একবার আসব ফিরে এই দার্জিলিং-এ কাঞ্চনজঙ্ঘার পদতলে, তবে শীতকালে।

 

— দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত —

লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. খুব ই ভালো লাগলো ।তুমি তো Darjeelingএর অনেক রূপ দেখেছো।তুমি তো আনন্দ করেছো আর তোমার লেখার মাধ্যমে আমি ও আনন্দ পেলাম।

    1. এই পরিস্থিতিতে স্মৃতি রোমন্থনে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!