Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ২৪
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ২৪

গোপা মিত্র

শিমলা

— ১ম পর্ব —

এগিয়ে চলেছে ট্রেন – ঝম্‌ঝম্‌, ঝক্‌ঝক্‌, ঝম্‌ঝম্‌, ঝক্‌ঝক্‌, যেন পায়ের মল বাজছে। ট্রেণের এই কামরায় আমরাই মাত্র কজন। সকালের ঝক্‌ঝকে্‌ রোদে আমরা পেরিয়ে চলেছি কোথাও পাহাড়ের কোলের সবুজ উপত্যকা, কোথাও কোন সেতু, কোথাও গাছপালার জঙ্গল বা কোথাও সবুজ কিংবা রুক্ষ পাহাড় আর তারই ভাঁজে ভাঁজে কোনো ছোট্ট গ্রাম বা বাড়ী। যেদিকের দৃশ্য পছন্দ হচ্ছে আমরা সেদিকের জানলার পাশে এসে বসছি, উঁকি দিচ্ছি, আবার উঠে যাচ্ছি। হঠাৎই সব অন্ধকার – আমরা প্রবেশ করেছি এক সুড়ঙ্গে। আবার সকালের রোদ ঝল্‌মল্‌ – এবার সুড়ঙ্গের বাইরে। মাঝে মাঝেই বাজে ট্রেণের হুইসিল – কু-উ-উ ! তখনই আমরা বুঝে যাই, সামনেই রয়েছে কোন বাঁক বা সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গ বুঝলেই জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিই সুড়ঙ্গের নাম আর ক্রমিক সংখ্যা। লাইনের পাশেই ছোট ছোট ষ্টেশনগুলিতে হাত নাড়ে ষ্টেশনমাস্টার বা অন্য কেউ – মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে তাদের। দুয়েকটা ষ্টেশনে রয়েছে ছোট ছোট দোকান। আশেপাশের কামরা থেকে কয়েকজন নেমে দৌড়ে গিয়ে সেখান থেকে কেক পেষ্ট্রী বা রুটি কিনে আবার উঠে পড়ে ট্রেণে। এবার এসে গেল ৩৩ নং বারোগ টানেল – আমরা আগে থেকেই জানতাম, এটি দীর্ঘতম টানেল। আমরা সবাই প্রস্তুত – এখানে অন্ধকার হলেই আমরা যত জোরে পারি চেঁচাবো, গান গাইবো বা যা খুশী তাই করবো। কেউ কাউকে দেখতে পাবো না – এ এক মজার খেলা। যতই এগিয়ে চলেছি, লাইনের ওপরে বা পাশে জমে থাকা বরফ চোখে পড়ছে। ট্রেণ চলেছে তারই মধ্যে দিয়ে, দুদিকের ব্রফও বেড়েই চলেছে। এবার পেরিয়ে গেল ১০৩ নং টানেল। আমি আবার তৃতীয় বারের জন্য এসে পৌঁছলাম শিমলায়। কালকা থেকে শিমলা আসার রোমাঞ্চকর টয় ট্রে্ন ভ্রমণ শেষ হল। ২০০৮ সালে ইউনেস্কো ৯৬ কিলোমিটারের এই ‘কালকা শিমলা রেলওয়েজ’ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে।

একদা ইংরেজ সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শিমলা বর্তমানে হিমাচলপ্রদেশের রাজধানী। প্রায় ৭২০০ফুট উচ্চতায় অর্ধচন্দ্রাকার এক শৈলশিখরে অবস্থিত অন্যতম প্রসিদ্ধ এই হিল ষ্টেশন শিমলা, পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য – সারা বছরই আকর্ষণীয়। শীতের বরফে এখানে বসে আইসস্কেটিং-এর আসর। আজও ইংরেজ আমলের অনেক চিহ্ন রয়ে গেছে এখানে।

আমার প্রথমবার শিমলায় আসা অনেক বছর আগে ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে পূজোর বেশ কয়েক দিন পরে মা বাবা ও বোনেদের সঙ্গে – ছিলেন অবশ্য এক দাদা ও বৌদিও (দিল্লীর বাসিন্দা, মেজোমাসীর ছেলে ও বৌ)। দিল্লী থেকে প্রথমে কালকা মেলে, পরে টয় ট্রেনে শিমলায় পৌঁছনো; থাকার ব্যবস্থা শিমলায় বাঙালীদের আশ্রয় কালীবাড়ীর বেশ বড় এক ঘরে। পর্যাপ্ত লেপকম্বল সবই ছিল, তবুও রাতের ঠান্ডা আমাদের কাঁপিয়ে দিল। সেই প্রথম আমরা বুঝলাম শীত কাকে বলে! আমরা কলকাতার বাসিন্দা – শিমলার এই কন্‌কনে ঠান্ডা আটকানোর মত অত গরমজামা সঙ্গে ছিল না। তাই শিমলা থেকেই আমাদের তিন বোনের জন্যে কেনা হল মোটা মোটা গরম জামা। শিমলায় আসার আগেই সন্ধ্যাদির (মাসীর মেয়ে) আগ্রহে, রীতিমত অর্ডার দিয়ে তৈরী করা হয়েছে আমাদের জন্য চুড়িদার কুর্তা। সেই প্রথমবার শিমলায় এসে আমরা শাড়ী বা স্কার্ট ফ্রক ছেড়ে পরলাম চুড়িদার কুর্তা। সেই প্রথমবার কোন বরফে ছাওয়া পাহাড়, কখনো সামনে নিয়ে কখনোপাশে নিয়ে হেঁটে বেড়ালাম রাস্তা দিয়ে। কি যে ভালো লাগলো!

যে ভালো লাগার রেশ নিয়ে আমি ফিরে গিয়েছিলাম, সেই ভালো লাগা নিয়েই আবারও একবার ফিরে এলাম শিমলায় দ্বিতীয়বারের জন্য ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মানালি যাবার পথে কল্যাণ আর তার দুই বন্ধুর সঙ্গে। আবারও সেই কালীবাড়িতেই থাকা। তবে মানালির টানে, আবারও ফিরে যেতে হল মাত্র দুদিন পরেই।

তৃতীয়বার শিমলায় এলাম সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই, ১৯৮৩-র বর্ষশেষে। ইচ্ছা এই যে শুধুমাত্র বর্ষশেষ নয় বর্ষবরণের আনন্দ উৎসবেও বেশ কিছুদিন সামিল হয়ে ফিরে যাবো দিল্লী হয়ে কলকাতায়। ইতিমধ্যে যদি এতদিনের অধরা তুষারপাতও দেখা হয়ে যায় তবে তো সোনায় সোহাগা।

এর অনেক আগেই অবশ্য প্রথমবার মানালি থেকে রোটাং পাশ গিয়ে (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত — ১) চারিপাশের বরফে সাদা পাহাড় শুধু দেখাই নয়, তাদের মাঝের বরফে সাদা সমভূমিতে হাঁটাও আমার হয়ে গেছে। তখনই আমি উপলব্ধি করেছি এই সাদা পাহাড় আমি শুধু ভালোবাসিই নয়, এখানেই আমার মুক্তি, এখানেই আমার আনন্দ। তাই তো বারেবারেই আমি ছুটে গেছি পাহাড় থেকে পাহাড়ে, তাদের অমলিন শুভ্র রূপ দর্শনে।

এবার শিমলা এলাম আমরা তিন বোনে সপরিবারে- মোট নজনে। থাকার ব্যবস্থা করেছে দিল্লীর বাসিন্দা সুনীত, আমার ছোট ভগিনীপতি, কালীবাড়ীর নিচের রাস্তায়, এক হোটেলে “হোটেল ব্রাইটল্যান্ড”এ। বেশ বড় সুসজ্জিত এক ঘর, সঙ্গে এক বসার ঘর আর কিচেনেট। সন্ধ্যাবেলায় আমাদের আড্ডা জমে উঠতো। আমাদের ছোট ছোট মেয়েরা নিজেদের মধ্যেই খেলা করতো আর আমরা বসার ঘরে কখনো তাস কখনো কোন বোর্ড গেম খেলতাম বা গল্পগুজবে কাটিয়ে দিতাম। রাতের দিকে সুনীত আর সঞ্জয় (মেজো ভগিনীপতি) বাইরে কোন হোটেল বা কালীবাড়ী থেকে আমাদের রাতের খাবার রুটি তরকারী নিয়ে আসতো। একদিন রাতে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি – সেই তুমুল বৃষ্টিঝরা রাতে পাহাড়ী শীতের কন্‌কনে প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে দুটো ছাতা জোগাড় করে ওরা দুজনে খাবার নিয়ে এলো কালীবাড়ী থেকে। ওদের কাছে সব সময়েই ‘Duty First’.

ম্যালের ওপরের রিজ রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই দেখলাম দূরের বরফাচ্ছাদিত পর্বতশ্রেণী। কিন্তু সেই বরফ তো আমাদের অধরা। তাই জাকু হিলসের পাশে জমে থাকা বরফ নিয়েই আমরা বরফ ছোঁয়ার আনন্দে শিউরে উঠলাম।

রিজের অনেক নিচে আইস স্কেটিং রিংকে গিয়ে স্কেটারদের স্কেটিং দেখতে দেখতে পাশে পড়ে থাকা বরফ নিয়ে ছুঁড়তে লাগলাম। জাকু হিলসের ওপরের হনুমান মন্দির দেখতে গিয়ে সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে বরফে মোড়া পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্যও দেখে নিলাম। পাশের লক্কড় বাজার থেকে কয়েকটা পছন্দসই কাঠের উপহার দ্রব্যও কিনে ফেললাম। রোজ শীতের রোদ গায়ে মাখতে রিজের বেঞ্চিতে বসে রইলাম আর দূরের সাদা পাহাড় দেখতে দেখতে ফেরার কথা ভুলেই গেলাম। প্রায় পর্যটকশূন্য রিজের প্রশস্ত চত্বরে একদিন আবার ক্রিকেট খেলাটাও অভ্যাস করে নিলাম। কুফরিতেও একদিন বেড়াতে গেলাম। সেখানের বরফের কার্পেটের ওপর দিয়ে আমরা হেঁটে বেড়ালাম, বসে পড়লাম, আবার দৌড়বার চেষ্টা করে আছাড়ও খেলাম।

বর্ষবরণের আনন্দে মাতোয়ারা সমগ্র শিমলা। ম্যালের দুপাশের সজ্জিত দোকানগুলোর মাঝ দিয়ে যাবার সময় আনন্দে উচ্ছল স্থানীয় বাসিন্দাদের দেখতাম আর ভাবতাম আমাদের মনে আনন্দ নেই কেন? আমরা যে জানুয়ারী মাসে এসেছিলাম শুধুমাত্র বরফ পড়া দেখবার জন্যেই। ঝক্‌ঝকে রৌদ্রজ্জ্বল দিনে বোধহয় সে আশা পূরণ হবার নয়! একদিন সন্ধ্যায় বৃষ্টি পেয়ে আশা জেগেছিল বটে, কিন্তু পরদিনই তা উধাও। ম্যাল দিয়ে হাঁটার সময় মাঝেমাঝেই থেমে গিয়ে দোকানদারদের জিজ্ঞেস করতাম আজ কি বরফ পড়তে পারে! তারা আকাশের দিকে চেয়ে হাত নাড়লে হতাশ আমরা ফিরে আসতাম হোটেলে।

এভাবেই হৈ হৈ আনন্দে শিমলায় থাকার দিনগুলো ফুরিয়ে এল – যদিও মনে এক চিন্‌চিনে বেদনা রয়েই গেল। এর অনেক পরে অরুণাচল ভ্রমণে গিয়ে (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত — ৯ ও ১০) সেই বেদনা দূর হয়ে অবশ্য আনন্দ উছলে পড়েছিল।

কাল ফিরে যাওয়া – এবার অবশ্য টয়ট্রেনে নয়, কালকা পর্যন্ত যাওয়া বাসে।বাস ছাড়বে ভোর সাড়ে ছটায়। তার আগে আমাদের সবাইকে তৈরী হতে হবে। আগের রাতেই সব গুছিয়ে রেখে লেপের তলায় ঢুকেছি। সেই কন্‌কনে ঠান্ডায় একাধিক লেপের ওজনে আমরা প্রায় চাপা পড়ে থাকি, নড়াচড়াই মুস্কিল। যাহোক্‌ সেসব সরিয়ে ভোরবেলায় উঠে সকলে তৈরী হয়ে, আগের রাতেই কিনে রাখা ডিম রুটি কলা পেস্ট্রী এসব দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে গেলাম নিচের বাসষ্ট্যান্ডে। এসে দেখলাম কোথায় কি? অন্য যাত্রীরাই বা কোথায়, ড্রাইভার কন্ডাক্টরই বা কোথায়? বাস অবশ্য দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা, কিন্তু দরজা জানলা সব বন্ধ। এবারেই আসল চমক – সঞ্জয় আমাদের সকলকে বলল যে, এবার যে যার হাত ঘড়ি (তখন মোবাইল ছিল না) আধঘন্টা পিছিয়ে নাও। কারণ গতকাল রাতে সে সবার অলক্ষ্যে আমাদের সকলের ঘড়ি আধঘন্টা এগিয়ে দিয়েছিল – যাতে বাস না মিস্‌হয়ে যায় সেইজন্য।

ফিরে চলেছি দিল্লী, ভারাক্রান্ত মনে। জানিনা আবার কোন দিন শিমলায় আসা হবে কিনা! আবার কোনদিন পাহাড় সঙ্গে নিয়ে রিজের রাস্তা ধরে হাঁটা হবে কিনা! ম্যালরোডের দোকানগুলোয় Window Shopping করতে পারবো কিনা বা লক্কড় বাজার থেকে দরকষাকষি করে পছন্দসই কোন Gift Item কেনা হবে কিনা! এসবই হয়ত একদিন ভবিষ্যত বলে দেবে, তবে এখন আমার সবচেয়ে বেশী করে মনে পড়ছে শিমলা কালী বাড়ীর কথা। সেই কতবছর আগে ১৮৪৫ সালে এত দূরে এসে এক বাঙালী ব্রাহ্মণ প্রতিষ্ঠিত শিমলা কালীবাড়ী এখনও ঠিক আগের মতই নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে। আজ এতদূরে শিমলায় এসে, বাঙালীদের দ্বারা পরিচালিত, বাঙালীদের আশ্রয় এই কালীবাড়ী আমার কাছে শুধুমাত্র বিস্ময়ের নয় – গর্বের কারণও বটে!

— প্রথম পর্ব সমাপ্ত —

লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. সুড়ঙ্গর descriptionটা দারুণ লেগেছে।শিমলা মনে হচ্ছে ,সুন্দর একটি শহর।তোমার লেখার মধ্যে দিয়ে তাই মনে হচ্ছে ।খুব ভালো লেখা।

    1. সময় করে লেখাটা পড়েছ, এটা ই আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া ।

  2. খুবই গুছিয়ে লেখা। পড়ে ভালো লাগল।
    👌👌👌💐💐💐

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!