Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৭
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৭

গোপা মিত্র

সিকিম

।। প্রথম পর্ব ।।

হাতের কাছেই যেন রয়েছে অস্তসূর্যের আলোয় রাঙা, গর্বোদ্ধত উন্নতশির কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই কবে যেন কতো যুগ আগে প্রথমবার দার্জিলিঙে গিয়ে দেখা হয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে। সেই প্রথম দেখাতেই তো তার রূপে মুগ্ধ আমি। এবারেও এসেছি তার দর্শনেচ্ছায় পেলিং। দাঁড়িয়ে আছি তার সামনে, কতক্ষণ জানি না। হাড়ে কাঁপন ধরানো কন্‌কনে ঠান্ডা হাওয়া জানান দিলো, আর নয়, এবার ফিরতে হবে হোটেলে।

সিকিমের স্মৃতিচারণ করতে বসে মনে যেমন আসে অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত, তেমনই আসে এক বিষাদের স্মৃতি। অবশ্য সেই বেদনা আমায় এখন আর বিদ্ধ করে না। কারণ অরুণাচল (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত, পর্ব – ৯ ও ১০) তার থেকে আমায় মুক্তি দিয়েছে।

চারধাম (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত, পর্ব – ৭ ও ৮ এবং শারদীয়া দু~কলম) ভ্রমণের পর অনেক দিন কোথাও যাইনি। এবার আমি আর কল্যাণ ঠিক করলাম ডিসেম্বরে কোনো এক পাহাড়ে যাবই। সেপ্টেম্বর মাসে মানালি থেকে রোটাং পাস গিয়ে বরফ না পাওয়ার হতাশায় (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত, পর্ব – ২) আমরা তখন ঠিক করে নিয়েছি এবার পাহাড়ে গেলে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেই যাব। সেইমতই আমরা ২০০০ সালের ডিসেম্বরের শেষে সিকিম যাব ঠিক করলাম।

হোটেল বুকিং এর জন্য আমরা এক পর্যটন সংস্থার অফিসে গেলাম। তখন কাগজে প্রায় প্রতিদিনই তাদের বিজ্ঞাপন আসছে সিকিম বিশেষজ্ঞ বলে। সেখানে আমাদের ইচ্ছের কথা জানালাম-কলকাতা থেকে প্রথমে পেলিং (চার রাত), তারপর রাবাংলা (তিন রাত), শেষে গ্যাংটক (ছয় রাত) থাকবো। সেখান থেকে নাথুলা ও তিনদিনের প্যাকেজে ইয়ুমথাং বেড়িয়ে আসবো।

আমরা পেলিং-এর জন্য কতগুলো হোটেলের নাম কাগজ থেকে জেনে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাদের দেখাতে তারা কোনগুলোর বুকিং করতে পারবেন, জানালেন। তাছাড়াও আমাদের বাজেট এর মধ্যে আরো এক নতুন হোটেলের ছবি দেখিয়ে বললেন যে, আমি আপনাদের এখানে থাকার পরামর্শ দেবো। দেখলাম, সত্যিই ভালো হোটেল। তার কথায় আমরা রাজি হয়ে গেলাম। রাবাংলা আর গ্যাংটকের বুকিংও তাদের হোটেল-চেন থেকে করে দিলেন। সব হোটেলের বুকিং রিসিপ্ট নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ী ফিরে এলাম। তারপর একদিন শীতের ভোরে পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি। এই প্রথম আমরা এসি-থ্রি টায়ারে চড়লাম – তখন সবে চালু হয়েছে।

পশ্চিম সিকিমের এক ছোট্ট শৈলশহর পেলিং, শিলিগুড়ি থেকে ১৩৫ কিলোমিটার, গ্যাংটক থেকে ১১৫ কিলোমিটার ও গেজিং থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ৭২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত পেলিং থেকে বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন একেবারে হাতের কাছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার পটভূমিতে পেলিংকে অপরূপ করে তুলেছে অরণ্য, জলপ্রপাত, সবুজ উপত্যকা ও তার বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদী।

শিলিগুড়ি থেকে সেবক রোড ধরে করোনেশান ব্রিজ পার হয়ে, ডানদিকে তিস্তা নদী সঙ্গী করে কিছুদূর যাওয়ার পরতাকেই বাঁদিকে রেখে তিস্তাবাজার, মেল্লিবাজার পার হয়ে এগিয়ে চললাম জোড়থাং-এর দিকে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে যতো ওপরের দিকে উঠছি, ততো ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ছে। রঙ্গিতকে সঙ্গে নিয়ে অনেকটা চলে সিকিমের অন্যতম বড় জনপদ জোড়থাং এসে পৌঁছে গেলাম।

জোড়থাং বেশ বড় শহর এবং সিকিমের প্রাণকেন্দ্র। এখান থেকে দার্জিলিং বা সিকিমের যে কোনো প্রান্তে যাওয়ার গাড়ী পাওয়া যায়। বাংলা ও সিকিমের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা রাম্মাম নদী জোড়থাং-এ এসে রঙ্গিতের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এরপর গাড়ী নয়াবাজার হয়ে পথ ধরলো পেলিং-এর।

পাহাড়ের পাশ দিয়ে পথ – ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠেছে। একদিকে পাহাড়ের পাঁচিল, অন্যদিকে জঙ্গলাবৃত খাদ। মাঝে মাঝে দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে – তখন পাহাড়ের কোলে উঁকি দিচ্ছে কোনো আচেনা গ্রাম বা তার ধাপ চাষ। কখনো মনে হচ্ছে রাস্তা এখানেই শেষ – আর এগোনো যাবে না। তখনই হেয়ারপিন বাঁক নিয়ে গাড়ী আবার পৌঁছে যাচ্ছে অন্য কোনো পাহাড়ে। মাঝেমাঝেই ওপর থেকে নেমে আসা কোনো ঝর্ণা রাস্তা ভিজিয়ে দিচ্ছে। আকাশে কখনো মেঘ তো কখনো রোদ্দুর। ঘন জঙ্গল কোথাও অন্ধকার করে রেখেছে, কোথাও আবার রোদ্দুর পড়ে জঙ্গল উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। স্থানীয়ভাবে মাঝে একবার অল্প বৃষ্টিও হয়ে গেলো। তবে পাহাড়ের সঙ্গে, চারপাশ এত সবুজ যে চোখের আরাম।

এভাবেই পাহাড় জঙ্গলের সৌন্দর্যে মগ্ন আমরা পৌঁছে গেলাম গেজিং। গাড়ী থেমে গেলো। আমাদেরও ধ্যান ভঙ্গ হলো। দেখলাম, একটা পেট্রোল পাম্পের সামনে গাড়ী দাঁড়িয়ে। দরজা খুলে আমাদের নামতে বলছে ড্রাইভার। এখানে কেন নামবো? এটা ত পেলিং নয় – গেজিং। আমাদের বুকিং করা হোটেল পেলিং-এ নয়, গেজিং-এ; ড্রাইভারের কথায় জানলাম। তার কথায় মাথায় বজ্রাঘাত। আমাদের অবস্থা দেখে সে বললো যে, এখান থেকে অন্য গাড়ী নিয়ে কয়েক কিমি ওপরে আমাদের হোটেলে যেতে হবে।

আমরা হতভম্ব। কিন্তু কিছু করার নেই। Full payment হয়ে গেছে। আমাদের সেই হোটেলে যেতেই হবে। এখন নিজেদের ওপরে রাগ হচ্ছে – কেন যে তাদের কথা শুনতে গেলাম! ভুল আমাদের, কাজেই শাস্তিও আমাদেরই পেতে হবে।

ড্রাইভারই গাড়ী ডেকে মালপত্র সব তুলে দিল। আমরা, আমাদের সেই অসম্ভব সুন্দর চমৎকার (?) হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। পাহাড়ের পাশ দিয়ে উঠে গেছে পথ। ডানদিকে পাহাড়ের ঢালে দূরে দূরে দু-একটা গ্রাম। মাঝে মাঝে গাছপালার জঙ্গল। জনমানবশূন্য পথ। বুঝলাম এ পথ শুধু হোটেলের জন্যই তৈরী। আর তখনই বুঝে গেলাম, পেলিং যেতে হলে প্রথমে গাড়ী করে গেজিং এসে, আবার ওপরে উঠতে হবে – তবেই সেখানে বেড়ানো যাবে।  কি করে সম্ভব?

বিরাট হোটেল। ঘরও বিরাট। সঙ্গে ব্যালকনি। ঊল্টোদিকে দেখা যাচ্ছে নাতিউচ্চ পাহাড় আর গাছপালার জঙ্গল। বাথটব দেওয়া বিশাল বাথরুম। কিন্তু এসব কে চায়? বেড়াতে এসে ইচ্ছামত পায়ে হেঁটে কোথাও যেতে পারবো না, ঘরে বন্দি হয়ে থাকবো নাকি? এমনটাই কি আমরা চেয়েছিলাম?

যা হোক, কোনোরকমে তৈরী হয়ে উপস্থিত হলাম ডাইনিং হলে প্রাতঃরাশের জন্য। খাবারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছি – এমন সময় দেখি, হল সংলগ্ন এক মাঠে চেয়ার, টেবিল, স্পীকার, বক্স আসছে। আলো লাগানো হচ্ছে। Receptionএ উপস্থিত ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করাতে বললেন যে, আজ ৩১শে ডিসেম্বর। রাতে বর্ষবিদায় উৎসব হবে। তারই প্রস্তুতি চলছে। পেলিং এর সব হোটেল মালিকরাও আসবেন। আপনারাও নিশ্চয় আসবেন।

একটু পরেই দেখি গাড়ী নিয়ে একজন এলেন, আর ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ শুরু করলেন। তাদের কথাবার্তা Overhear করে বুঝলাম যে, যিনি এসেছেন তিনি পেলিং এর একজন হোটেল মালিক। সেদিন রাতের ব্যবস্থাপনা দেখতে এসেছেন।

শুনে আমি কল্যাণকে বললাম যে, একবার ওনার সঙ্গে কথা বলতে – যদি পেলিংএ থাকার কোন ব্যবস্থা করা যায়। কল্যাণ রাজী নয়। ওর ধারণা এ অসম্ভব। যদি হয়ও, এখানে দেওয়া টাকাটা বরবাদ হয়ে যাবে। আমার বক্তব্য, একবার চেষ্টা করতে দোষ কি? না হলে না হবে।

কল্যাণের কথা না শুনেই, আমি তাদের আলাপচারিতার মাঝেই সেখানে ঊপস্থিত হলাম। ক্ষমা চেয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি পেলিং এর কোনও হোটেল মালিক কি না! তাঁর সম্মতিসূচক উত্তর শুনে, আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম যদি তিনি তাঁর হোটেলে আমাদের থাকার অনুমতি দেন, তাহলে আমরা পায়ে হেঁটে পেলিং বেড়াতে পারি। তিনি রাজী হলেন। ইতিমধ্যে কল্যাণও আমার পাশে এসে গেছে। আমারও সাহস বেড়ে গেছে। আমি তাঁকে আবারও অনুরোধ করলাম যে, আমাদের এই হোটেলের Payment এর সঙ্গে যদি তিনি তাঁর হোটেল ভাড়া Adjust করে নেন, তাহলে আমরা উপকৃত হব। তিনি বললেন যে, সে ব্যাবস্থাও হয়ে যাবে। এই বলে তিনি আমাদের সব মালপত্র তার সঙ্গের গাড়ীতে তুলতে বললেন। আমরা তাঁর গাড়ী করেই পেলিং-এ তাঁর হোটেলে পৌঁছে গেলাম।

রাতের মাইক বা বক্সের চিৎকার থেকেও বেঁচে গেলাম।

জীবনের চলার পথে এমন অনেক সমস্যা বা বিপদে পড়েছি। কিন্তু কখনই হতাশ হইনি বা ভেঙ্গে পড়িনি। চেষ্টা করেছি সমস্যা বা বিপদ মুক্ত হতে। আর তখনই আমার ভাগ্যদেবতা আমার হাত ধরেছেন, আমাকে সমস্যা বা বিপদ মুক্ত করেছেন।

পেলিং-এর হেলিপ্যাডের পাশেই তার হোটেল – হোটেল ফ্যামরঙ্। বেশ ভালো হোটেল। ঘরও বেশ বড়ো। জানলার উল্টোদিকেই সবুজে ঢাকা খাদের পরই দূরে দেখা যায় তুষারধবল পর্বতশৃঙ্গ।

খাওয়াদাওয়া সেরে বেড়িয়ে পড়লাম এক এজেন্সীর খোঁজে। দু’পা হেঁটেই এক এজেন্সীর অফিস। তাদের কাছে সিকিম বেড়ানোর দুদিনের দুটো ট্রিপ বুক্‌ করে ফিরে এলাম।

বিকেলে মহামহিম কাঞ্চনজঙ্ঘার ধ্যানগম্ভীর রূপ দেখে ফিরে এলাম হোটেলে।

রাতে কি ঠান্ডা! জানলা ভেদ করে কন্‌কনে্‌ হাওয়া হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। নিজেরাই চাপাচুপি দিয়ে গরম জামা পরে শুয়ে পডলাম। রুম-হিটার চেয়ে ওদের আর বিরক্ত করলাম না। আর কত সুবিধা নেবো!

পরদিন সকালে প্রাতঃরাশ সেরে পৌঁছে গেলাম তাদের অফিসে। সেখান থেকেই গাড়ী ছাড়বে।

সেদিন ১লা জানুয়ারী, ২০০১। শীতের ভোরে গাড়ী আমাদের প্রথমে নিয়ে চলেছে খেচিপেরী লেক। শৈলশহরের ঘুম মনে হয় তখনও ভাঙ্গে নি। সেই সময়েই আমরা প্রায় পৌঁছে গেলাম হ্রদের কাছে।

পেলিং থেকে ৩৪ কিমি দূরের এই লেকের অবস্থান খেচিপেরী গ্রামের কাছে। চারিদিকে অরণ্যপর্বতবেষ্টিত পবিত্র এই লেক ‘ইচ্ছাপূরণ হ্রদ’ বা ‘Wish Fulfilling Lake’ নামেও খ্যাত। বিশ্বাস এই যে,এখানে কোন ইচ্ছা নিয়ে প্রার্থনা করলে সেই ইচ্ছা পূরণ হবেই। হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মাবলম্বীই এই হ্রদ পবিত্র মনে করে। সামনে থেকে নয়, তবে পর্বতের উপর থেকে দেখলে এই হ্রদের আকৃতি অনেকটা যেন পায়ের পাতার মত মনে হয়। কারো মতে এই চিহ্ন তারা দেবীর। কারো মতে মহাদেবের, আবার কেউ বলে গুরু পদ্মসম্ভবের। বছরে কয়েকবার এখানে উৎসবও হয়। এই হ্রদের এক বিশেষত্ব, এর সবুজ জলে একটাও গাছের পাতা ভাসে না। পাতা পড়লেই একটা পাখী এসে ওই পাতা মুখে করে তুলে নিয়ে হ্রদের জল নির্মল করে দেয়।

গাড়ী আমাদের হ্রদ থেকে এক কিলোমিটার দূরে নামিয়ে দিল। এখান থেকে আমাদের হেঁটেই যেতে হবে। শুনেছি এখানে জোঁকের খুব উপদ্রব। তাই সঙ্গে কিছুটা লবণও নিয়ে এসেছি।

এগিয়ে চলেছি বনপথ ধরে, পায়ে চলা এক পথে, কুয়াশায় মোড়া সকালে, প্রায় লাইন দিয়ে , ছন্দোবদ্ধ ভাবে। আমাদের সঙ্গে চলেছে অসংখ্য সিকিমীজ, নেপালী, ও ভূটানী তরুণ তরুণী। ওরা আবার একই সঙ্গে কি একটা সুরেলা গানও গাইছে। কি যে ভালো লাগছে, এই শীতল ভোরে অরণ্য পথে, চারিদিকের সবুজ গাছপালার মধ্যে দিয়ে এই ভাবে একই সঙ্গে, একই উদ্দেশ্যে হেঁটে যাওয়া, কি বলবো! এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

অবশেষে পৌঁছে গেলাম জঙ্গল পাহাড় ঘেরা সেই হ্রদের কাছে, ছোট এক ব্রীজ পার হয়ে। দেখলাম সকলে সেখানে মোমবাতি জ্বালাচ্ছে। আমরাও জ্বালিয়ে দিলাম। চারিদিকে উড়ছে রঙ, বেরঙের প্রার্থনা পতাকা। তাদের মতই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আর তখনই দেখতে পেলাম – টুপ করে গাছের একটা পাতা এসে জলে পড়লো, আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা পাখী এসে ঠোঁটে করে সেই পাতা তুলে নিয়ে জল পরিষ্কার করে দিলো।

একই ভাবে সেই বনপথ ধরে ফিরে এলাম বাইরে। সেখানে রয়েছে এক গুমফা। দর্শন সেরে গাড়ী করে আবার এগিয়ে চললাম কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাতের দিকে।

পেলিং থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত। কিন্তু আমরা চলেছি খেচিপেরি হ্রদ থেকে। কিছুদূর যাবার পর জলপ্রপাতের গর্জন কানে এলো। দূর থেকেই দেখতে পেলাম দুরন্ত জলধারা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তীব্র বেগে নেমে আসছে নীচে। গাড়ী থেকে নেমে কাছাকাছি যেতেই গুঁড়িগুঁড়ি জলকণা চোখেমুখে ছিটকে আসতে লাগলো। সিকিমের অনেকগুলি দ্রষ্টব্যের মধ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত অন্যতম। শুধু ঝর্ণাই নয়, চারিপাশের সৌন্দর্যও অসাধারণ। ঘন সবুজ পাহাড় আর উপত্যকার পটভূমিতে পাহাড়ের অনেকখানি জায়গা জুড়ে অনেকটা উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ছে এই জলধারা। উপর থেকে নেমে আসছে একটি ধারায়, কিছুদূর নেমেই পরিবর্তিত হচ্ছে দুটি ধারায়।তারপর দুরন্ত দুর্বার বেগে নীচের এক খাদে এসে ঝঁপিয়ে পড়ছে। পাথরের ওপর দিয়ে বেশ কিছুটা নীচে নামলে তবেই দৃষ্টিগোচর হয় এইঅতুলনীয় জলপ্রপাতের সম্পূর্ণ সৌন্দর্য। তবে সেখান থেকে ছবি তোলা একেবারেই অসম্ভব। কারণ ক্যামেরার লেন্স ভিজে যাবে জলকণায়।

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। শীতের তীব্র হাওয়া সঙ্গী করে, একদিকে সবুজ পাহাড়, আর একদিকে পান্না সবুজ উপত্যকার খাদ, তারই মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ী এগিয়ে চললো রিম্বি ফল্‌সের দিকে। মাঝে মাঝেই দু’একটা কাঠের ছোট ছোট বাড়ী মেঘ আর সবুজের গায়ে যেন ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পেলিং থেকে ১২ কিমি আর দারাপ উপত্যকা থেকে ৫ কিমি দূরে রয়েছে রিম্বি ফল্‌স। দারাপ-এর ধাপ চাষ চোখে পড়ার মতো। উঁচু নীচু পাথরের উপর দিয়ে উপলবন্ধুর পথে কুলকুল করে বয়ে চলেছে রিম্বি নদী। কাঞ্চনজঙ্ঘা ফল্‌সের পরে রিম্বি ফল্‌স ততটা আকর্ষণীয় মনে হয় না। জলধারা বেশ গর্জন করেই নীচে পড়ছে। তবে অবশ্য রাস্তার একেবারে পাশে হওয়ার জন্য সহজেই নেমে একেবারে ঝরণার কাছে যাওয়া যায়। আমরাও নিচে নেমে ঝরণার ঠান্ডা জলে মুখ হাত ধুয়ে নিলাম। আমার অবশ্য পাশ দিয়ে কুল্‌কুল্‌ করে বয়ে যাওয়া রিম্বি নদী বেশী ভালো লাগলো। ভিড় কম। শান্ত নির্জন। ছবি তোলার উপযুক্ত।

আজকের মত পেলিং সফর শেষে ফিরে এলাম হোটেলে। খাওয়াদাওয়া সেরে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে, বিকেলে বেরোলাম, পায়ে হেঁটে পেলিং দেখবো বলে। হেলিপ্যাড পার হয়ে এবার চলে গেলাম অন্যদিকে – ওদিকটা একটু বেশী ঘিঞ্জি বলে মনে হলো। ফিরে কিছুক্ষণ হেলিপ্যাডে অপেক্ষা করলাম। কিন্তু আজ আকাশ মেঘে ঢাকা, শৃঙ্গদর্শন হলো না। সন্ধ্যে হলে, শীতের কাঁপুনি বাড়লো। ফিরে এলাম, হেলিপ্যাডের পাশেই আমাদের হোটেলে। আজকের মতো পেলিং ভ্রমণের এখানেই ইতি। কাল নতুন সকালে, আবার নতুন করে পেলিং আবিষ্কার।

~ প্রথম পর্ব সমাপ্ত ~

লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. ২০ বছর আগেকার ভ্রমণ বৃত্তান্ত সবকিছু মনে করে লেখা খুব সহজ কাজ নয়। খুব ভালো লেখা হয়েছে।।
    💐💐💐

  2. খুব সুন্দর আর সাবলীল সচ্ছন্দ লেখা। ভাল লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!