Home সামাজিক, গল্প আলোকবর্তিকা
সামাজিকগল্প

আলোকবর্তিকা

কল্যানী মিত্র ঘোষ

আটই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০২১ সাল, তবু লড়াই চলছে সমানাধিকারের, কবে যে শেষ হবে জানা নেই। নারী সৌন্দর্যের প্রতীক, মায়া মমতায় টইটুম্বুর একটি শরীর ও মন, প্রয়োজনে পথিককে ছায়া দেবে, তৃষ্ণার্তকে পানীয়, গৃহকর্মে নিপুণা আবার যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েও চলবে। এতো কিছু প্রত্যাশার চাপে নিয়ত জর্জরিত নারী প্রতিদিন বদলাচ্ছে একটু একটু করে …

এতোটা লিখে কম্পিউটারের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে কফির কাপটা হাতে তুলে নেন দেবারতি।

একটু পরেই তাঁকে বেরোতে হবে স্থানীয় লাইব্রেরীতে আজ সন্ধ্যায় তিনি প্রধান অতিথি, নারী দিবস উপলক্ষ্যে একটা অনুষ্ঠান হবে, তারই বক্তৃতার খসড়া তৈরী করছেন তিনি। প্রায় ষাট বছর বয়স হলো তাঁর, মাথায় রূপোলী ঝিলিক, চোখের কোণে ক্লান্তি, কিন্তু সাজপোশাক ভারী পরিপাটি। খুব সুন্দর করে সাজেন দেবারতি, বিভিন্ন প্রদেশের হ্যান্ডলুমের শাড়ি, সঙ্গে রূপোর গয়না, পিঠে বোতাম দেওয়া লম্বা ঝুলের ব্লাউজ আর ফুলেল সুগন্ধী, এই সবই দেবারতির ট্রেড মার্ক। হাসলে এখনও ভারী মিষ্টি দেখায় তাঁকে, শরীরটাও ভেঙে পড়েনি।

সুবিনয় গত হয়েছেন প্রায় দশ বছর হলো, ছেলে সুদেব লন্ডনে সংসার পেতেছে। নামটা সুবিনয়ই রেখেছিলেন, তাঁদের দুজনের নামের সঙ্গে মিলিয়ে, এখন ছেলের জীবনে শুধু নামের কয়েকটা অক্ষর হয়েই রয়ে গেছেন তাঁরা। কালে কষ্মিনে ফোন আর ভিডিও চ্যাট। নাঃ, মন-টন খারাপ হয় না তাঁর, ছেলে বুড়ো বয়সে দেখবে এমন কোনো আশা কোনোদিনই তাঁরা দুজনেই করেননি। দেবারতির টাকায় খায় কে! সুবিনয় হাতের তেলোয় করে রেখেছিলেন তাঁকে, আজও সব দিক যাতে বজায় থাকে সে ব্যবস্থাও করে গেছেন।

এই দশ বছরে নিজের ভালোলাগার কাজগুলো আবার শুরু করেছেন দেবারতি। তাঁর সংসারের হাল ধরে আছে ময়নার মা, নাম আসলে বীণা, কিন্তু এটাই চলতি নাম। অনেক বকেছেন দেবারতি,

“এটা কি তোমার মা বাবার দেওয়া নাম? কি করে সাড়া দাও এই নামে?”

“শোউর বাড়ি থেকে অভ্যেস হয়ে গেছে বৌদি, ময়না হওয়ার পর থেকে ওর বাবাও তো এই নামেই সোহাগ করতো!”

এক গাল হাসি।

খুব রেগে যান দেবারতি, এভাবেই মেয়েরা সব আত্মসম্মান বোধ, পরিচয় খুইয়ে বসে থাকে। অমুকের বউ, তমুকের মা, অসহ্য! কিছু ভাগ্য করে এসেছিলেন তিনি। বিয়ের পর রেওয়াজ ছিলো শাশুড়ি মা নববধূকে নতুন নাম দেবেন, অন্যান্য জায়েদের ক্ষেত্রেও সেটা কার্যকরী হয়েছে কিন্তু তাঁর বেলা সুবিনয় তীব্র প্রতিবাদ জানান, “মা এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি ওকে ওর বাবা মায়ের দেওয়া নামেই ডেকো। সব ছেড়েই তো মেয়েরা আসে, পদবীও পাল্টায়, নামটুকু থাক।”

অচেনা লোকটাকে এক নিমেষে দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন দেবারতি, আর সুবিনয় সেটার মর্যাদাও রেখেছিলেন। কখনও বুঝতে দেননি “আমি পুরুষ, শক্তিশালী তাই তুমি নারী অবলা হয়েই থেকো”, অথবা “আমার রোজগারে তুমি বসে বসে অন্ন ধ্বংস করছো!” উল্টে সর্বদা সব জায়গায় বলে এসেছেন—

“এই আমার সংসারের রেলগাড়ির সামনের দুটো চাকা কিন্তু দেবারতি, পেছনের দুটো আমি, ঠ্যাকা দিয়ে চলি!”

লজ্জা পেতেন তিনি, কিন্তু ক্রমশঃ মনে একটা আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে, সত্যিই তো, তিনিও মানুষ, সমাজের তকমা লাগানো কারোর বউ বা কারোর মা নন। সুবিনয় পাশে না থাকলে তিনি এই শক্তি পেতেন না, বিয়ের পর তাই সাইকোলজিতে মাস্টার ডিগ্রীটাও করে ফেলেছিলেন। আর আজ কেমন সুন্দর একা একাই জীবন অতিবাহিত করতে পারছেন ।

এখন যে সমস্ত কার্যকলাপের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছেন তার শুরুটা খুব অদ্ভুত এবং এ ধরণের কিছু কাজ যে আদৌ হতে পারে এ ব্যাপারেও তাঁর কোনো ধারণা ছিলো না। চিরকাল তাঁর একটু মেয়েদের স্বনির্ভর করার ব্যাপারে আগ্রহ ছিলো। সুবিনয়ও বেশ প্রশ্রয় দিতেন তাঁকে। কাজের মেয়ের মেয়েটার হাই স্কুল অবধি পড়াশোনা তিনিই চালিয়েছেন, এখন সে কলেজের শেষ ধাপে। বাজারের দুলু মাছওয়ালা একদিন তার মেয়েকে দিয়ে মাছ কোটাচ্ছিলো বলে ভীষণ বকা দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়েছিলেন। সে মেয়েও মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলা এসে পড়া বুঝে যেত। ক্রমে ক্রমে আত্মীয়স্বজনও জেনে গেলো এই মহিলা একটু অন্যরকম, প্রথমে অনেকে “ঢং”, “আদিখ্যেতা” বলে মুখ বেঁকালেও পরে সম্ভ্রমের চোখেই দেখেছে। আসলে “সময়” কথা বলে।

বছর পাঁচেক আগে একদিন বান্ধবী রীতা তার মেয়ে সমর্পিতা কে নিয়ে আড্ডা দিতে আসে। এ কথা সে কথায় রীতা বলে ,

“মেয়েটার বিয়ের সম্বন্ধ দেখছি রে, কি আছে কপালে কে জানে। ভালো বর জোটা একটা ভাগ্যের ব্যাপার!”

ব্যাস দেবারতি কে পায় কে!

“কেন রে? প্রথমতঃ, এতো তাড়া কিসের? ও নিজের পায়ে দাঁড়াক আগে।  দ্বিতীয়তঃ, ও কি চাইছে এটা?”

“তুই আর আগুনে ঘি দিস্‌ না, উনি তো বিদেশে চাকরি করতে যাবেন বলে পা বাড়িয়ে রয়েছেন, ইন্টারভ্যিউ দেওয়া চলছে!”

“দারুণ। আর তুই সেই স্বপ্নে জল ঢেলে দিচ্ছিস?”

তারপর প্রায় টানা পনেরো মিনিটের একটা বক্তৃতা দিলেন দেবারতি যে, মেয়ে জন্ম মানেই বিয়ের হাঁড়িকাঠে বলি প্রদত্ত নয়। ইচ্ছে হলে, সময় হলে করবে, তার আগে নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করুক, একটাই তো জীবন! বিয়েটা আমাদের দেশে শারীরিক চাহিদা মেটানোর একটা বৈধ উপায়, কিন্তু দিন বদলাচ্ছে, পৃথিবী বদলাচ্ছে।

তাঁরা আড্ডা দিচ্ছিলেন আর সমর্পিতা মোবাইল হাতে বসে ছিলো, কথা শেষ হবার পাঁচ মিনিট পর সে মুখ খুললো, বললো,

“মাসীমণি তুমি না এতক্ষণ লাইভে ছিলে, হি হি!”

“সেটা কি রে?”

“কালকেই বুঝতে পারবে। আজ চলি।”

পরদিন সাত সকালেই সমর্পিতার ফোন,

“মাসীমণি লাইভে পাঁচ হাজারের ওপর লাইক আর কমেন্টস এ সব তোমাকে ধন্যি ধন্যি করছে। দাঁড়াও এসে তোমাকে সব দেখাচ্ছি, বোঝাচ্ছি …. আমার ফেভারিট ঝিঙে পোস্ত আর পোস্তর বড়া রেডি রাখো।”

ব্যাস! সেই শুরু! সমর্পিতার উৎসাহেই তিনি মাসে দু বার করে মেয়েদের কোনো না কোনো সমস্যা এবং তার ঘরোয়া সমাধান নিয়ে লাইভে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। সেগুলো এতটাই জনপ্রিয় হয়, সাধারণ মায়েরা এবং তাঁদের মেয়েরা সেগুলোর সঙ্গে এতটাই রিলেট করতে পারে যে বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁকে “টেড টক” দিতে নিয়ে যায় উপযুক্ত পারিশ্রমিক সহ। বলতে গেলে দেবারতি রায় আজ একটি পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ। তিনি নিজেও খুব ভালোবাসছেন এই কাজটা। এখন নিজেই টেক স্যাভি হয়ে গেছেন, দু টো মোবাইল, একটা ল্যাপটপ, আই প্যাড, এক্সট্রা স্টোরেজ ড্রাইভ, প্রিন্টার, একদম গুছিয়ে নিয়েছেন সব। একটি কোম্পানী থেকে একটি ছেলে এসে মাঝে মধ্যে সফটওয়্যার আপগ্রেড করে ব্যাক-আপ ইত্যাদি করে দিয়ে যায়, ওইটুকুই। বাকি সব তিনি নিজে শিখেছেন।

অনুষ্ঠানের যাওয়ার সময় এগিয়ে এলো, আজ পড়লেন ঘন নীল সুতির ব্যোমকাই, কালো কলমকারি ব্লাউজ, বড় কালো টিপ, এলো খোঁপা আর জুঁইয়ের সুগন্ধী। বেরোতে যাবেন অমনি সেল ফোনে ভিডিও কল; দিদুন সোনামণি, কি ব্যাপার!

“হাই দিদিয়া, হাউ আর ইউ?”

“আরে তুই এখন? কি ব্যাপার সোনা?”

সবেধন নীলমণি নাতনি বুবলি, ভালো নাম পৃথা, এই এগারো ক্লাসে উঠেছে। গড়গড়িয়ে যা বললো তার হলো —

“শোনো তোমার সব অনলাইন সেশনগুলো আমি আর মা দেখি। আমার স্কুলের একটা প্রজেক্ট এ আমি তোমার কাজের কথা লিখে প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলাম, আর বলেছিলাম কোনো স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম অথবা ফরেন কান্ট্রির কালচার স্টাডির ওপর কোনো কাজ করতে পারলে আমি খুশী হবো। অ্যান্ড গেস হোয়াট!”

“কি?”

“আমি এই সামারে তোমার ট্রেনী হিসেবে কাজ করবো, ফিরে এসে ওটার ওপর লেখা জমা দেবো। আই অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ দিদিয়া, আই লাভ ইউ!”

স্ক্রীনে অনেক অনেক চুমু খেতে থাকে মেয়েটা।

শক্তপোক্ত দেবারতি আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়েন। হোক না ছেলে একটু আত্মকেন্দ্রিক, কিন্তু জিনটা যাবে কোথায়? সে তো ঠিক জায়গায় ঠিক মাটিতে শিকড় গেঁথে বসেছে।

“আয় সোনা, আমরা দুজনে অনেক অনেক কাজ করবো আর খুব খুব মজা করবো। কি কি খাবি বল আমাকে, তোর সেই ফেভারিট পাইন্যাপেলের আচারটা করবো, আর রোজ রোজ ক্যারামেল কাস্টার্ডও খাওয়াবো ……”

সমাপ্ত

আলোকচিত্র সৌজন্য : কল্যানী মিত্র ঘোষ

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. গল্পটা খুব ভালো লাগলো। বাস্তবেও এমনই হওয়া উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!