সুদেষ্ণা মিত্র
‘স্বামী’ — এক মনস্ত্বাত্ত্বিক পর্যালোচনা
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্বামী উপন্যাসের সৌদামিনী। শরৎ সাহিত্যের অন্যতম নারী চরিত্র যার মধ্যে আজকের নারীর নানা “Shades” বা ছায়া দেখতে পাই। যার ভেতর দিয়ে একজন সাধারণ অথচ দৃঢ় চরিত্রের নারীর রূপ, গুণ, আধুনিক চিন্তা ধারা এবং সবচেয়ে বড় কথা আবেগের স্বাধীন বহিঃপ্রকাশ তৎকালীন সামাজিক পরিবেশের মধ্যে আলাদা মাত্রা রাখে।
স্বামী উপন্যাসের সবচেয়ে বড় আধুনিকতা হল উপন্যাসটির বিষয়বস্তু নির্বাচন। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে সৌদামিনী তার মায়ের হাত ধরে এসে ওঠে মামার বাড়িতে। মামা অত্যন্ত বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী। Agnostic মানুষটি লজিক এবং ফিলসফির যুক্তি ও তর্কে বিশ্বাসী ছিলেন। ছোট থেকেই সৌদামিনী কে তার নিজের মনের মতো করে বড় করে তোলেন।
তাই গ্রামে মানুষ হয়েও সদু বা সৌদামিনি শহুরে মেয়েদের মতই ভিন্ন রুচির ও বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারিনী ছিল।
সেই কারণেই তখনকার সমাজে যেখানে সারদা আইনের অজুহাতে বারো বছর বয়স হয়ে যাওয়া মানে মেয়েদের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়া সেখানে সৌদামিনীর বিয়ের ব্যাপারে কোনো রকম উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যায় না।
গ্রামের একটাই বড় পুকুর আর তার এপারে ওপারে যে দুটো বাড়ির অস্তিত্ব উপন্যাসে দেখতে পাই তার মধ্যে একটি সৌদামিনীদের বাড়ি অন্যটি গ্রামের জমিদার বিনয় মজুমদারের বসতবাড়ি। এক বৃষ্টির দিনে বকুলফুল কুড়াতে যাওয়ার একমাত্র জায়গা ছিল এই জমিদার বাড়ির বাগানে তার সাথে আলাপ হয় জমিদারের একমাত্র ছেলে নরেনের।
কলকাতায় পড়াশোনা করে আর ছুটিতে বাড়ি আসে। অনেক আগে থেকেই নরেনের অবশ্য সৌদামিনির মামার সঙ্গে সাহিত্যের আলোচনা এবং দর্শন নিয়ে তর্ক বিতর্ক করবার উদ্দেশ্যে, মাঝেমাঝেই সদুর বাড়ি যাওয়া আসা ছিল।
সৌদামিনী ও নরেনের একে অপরকে মন দেওয়া নেওয়ার পালা শুরু হতে বেশি সময় লাগেনি। উপন্যাসটি যেহেতু সৌদামিনীর আত্মকথার মত, তাই লেখক সৌদামিনীর মনের কথা তার নিজের ভাষাতেই পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন।
কয়েকটি উক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগ সর্বস্ব।
“আজ এতবড়ো মিথ্যেটা মুখে আনতে আমার যে কি হচ্ছে, তা আমার অন্তর্যামী ছাড়া আর কে জানবে বোলো। কিন্তু তখন ভেবেছিলুম এ বোধহয় সত্যি একটা জিনিস-সত্যি বুঝি নরেনকে ভালোবাসি।”
অতি সুন্দরভাবে লেখক একটি কিশোরী মেয়ের ভালোলাগা প্রথম প্রেমে পড়ার প্রতিটি মুহূর্ত সৌদামিনীর উক্তির মধ্যে দিয়ে পাঠকদের সামনে প্রস্তুত করেছেন আজকের দিনে বসে এই উপন্যাসটি পড়লে পাঠক বা পাঠিকা নিজের কিশোরীবেলার প্রথম অনুরাগকে বোধহয় অস্বীকার করতে পারবেন না। আর এখানেই সৌদামিনী র প্রাসঙ্গিকতা শুরু।
স্বামী উপন্যাসটির নায়িকার জীবনের সব থেকে বড়ো “Irony” হলো “Agnotisim” এ বিশ্বাসী সদুর বিয়ে হয়ে যায় পাকেচক্রে পরম বৈষ্ণব ঘনশ্যামের সঙ্গে। আবার দোজবর। সৎমা, সৎদেওর, সৎ বিধবা ননদ হলো একজন উনিশ বছর বয়েসী মেয়ের শ্বশুড়বাড়ির সঙ্গীসাথী।
কলেজ পাস্ সদু ভুলতে পারেনা নরেনকে। যদিও নরেন কিন্তু বিয়ের সময় আসতে পারে না, শুধু দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে তোমার চিঠি পেলেই চলে, এই প্রতিশ্রুতিটুকু দেওয়া ছাড়া।
“সব মেয়ের মতো সব মেয়ের মতো আমিও তো আমার স্বামীকে বিয়ের মন্বন্তরের ভেতর দিয়ে পেয়েছিলুম তবু কেন তাতে আমার মন উঠলো না তাই যে দামটা আমাকে দিতে হলো। আমার অতি বড় শত্রুর জন্য একদিনের জন্য কামনা করিনে, কিন্তু দাম আমাকে দিতে হলো”। উপন্যাসের একদম শুরুর এই লাইন কয়েকটি উপন্যাসের প্রথম দিকের সদুর সঙ্গে পরের দিক অর্থাৎ বিয়ের পরের সৌদামিনীর মানসিক গঠনকে চিনতে সাহায্য করে।
বিয়ের প্রথম রাত থেকেই সদু আলাদা বিছানা তৈরী করে মাটিতে শোওয়া অভ্যেস করে। লেখক এতো সুন্দর মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন যা সদুর প্রতি আলাদা করে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না যে সদুর মতো লেখাপড়া জানা এবং রীতিমতো প্রগতিশীল চিন্তাধারায় মানুষ হওয়া একটি মেয়ের ভাগ্যদোষে বিয়ে হওয়া ম্যাট্রিক পাস্ একজনের সংসারের ঊনকোটি সমস্যা সামলাতে হচ্ছে তখন তার মন প্রেমিকের প্রতিই আকৃষ্ট থাকবে।
লক্ষণীয় হলো সৌদামিনী যতই আপত্তি থাকুক এই বিয়েতে সে কিন্তু যেদিন থেকে বুঝতে পারলো তার স্বামী ঘনশ্যাম সংসারে সব আর্থিক চাহিদা মিটিয়ে দিলেও সব চেয়ে বেশি অবহেলার মানুষ সে অথচ তাই নিয়ে ঘনশ্যামের কোনো আপত্তি বা ক্ষোভ নেই , সেদিন থেকে তার মনে স্বামীর প্রতি একটা বিশেষ জায়গা তৈরী হল।
নিজের কাছে নিজেই সেদিন অবাক হয়ে গেলো যেদিন সে তার স্বামীর না খেয়ে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে প্রতিবাদে লিপ্ত হল। সৌদামিনী চরিত্র চিত্রণে এখানেই লেখকের মুন্সিয়ানা। শিক্ষিত একজন যে কখনোই অন্যায় দেখে কোনো অবস্থাতেই মুখ বন্ধ করে থাকতে পারবে না , অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেই সে তার সেই মানুষটির ওপর যতো অভিমানই থাক না কেন। ঘনশ্যামের প্রতি অনুরাগ না থাকলেও দিনের পর দিন তার ভালমানুষীর সুযোগে তারই রোজগারে সবাই ভাল খেয়ে পরে তাকে অবহেলা করবে, এ সদু সহ্য করতে পারে না।
নরেনের প্রতি প্রথম প্রেমের তীব্রতা আবার স্বামীর তার সাথে সব কিছুর অমিল সত্ত্বেও ঘনশ্যামের সহ্যশক্তি ও ধৈর্যশক্তি এবং সব ছাড়িয়ে তার ব্যক্তিত্বকে তার স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় বেঁধে ফেলতে লাগলো ধীরে ধীর। এখানে সৌদামিনীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ভারী সুন্দর করে প্রকাশ পেয়েছে আত্মকথনের মধ্যে দিয়ে—”ওরে ও হতভাগী এতো শিখেছিলি, তা শুধু শিখিসনি মেয়েমানুষের কার মানে মান ! কার হতাদরে তোদের মানের অট্টালিকা তাসের অট্টালিকা র মতই এক নিমেষে এক ফুঁয়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায়।”
স্বামীর প্রতি তার এই মনোভাবের পরিবর্তন সে যে খুব সহজে মেনে নিতে পারে তা নয়। এমনকি মুখের ওপর তাঁকে “ভগবান মানিনে” একথা বলতেও পিছপা হয়নি সে আর সেই কথা শুনে ঘনশ্যামের অভিব্যক্তির কাছে মাথা নিচু করে সে। পরম বৈষ্ণব ঘনশ্যাম খুব দৃঢ় গলায় যখন সদু কে বলে এমন কথা তার সামনে যেন সদু আর কখনো না বলে। সদু তাতে লাঞ্ছিত বোধ করলেও কোথাও তাঁর দৃঢ়তার কাছে নতিস্বীকার করে। আর এখান থেকেই সৌদামিনীর মনের অন্য এক রূপ পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চান লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
সদুর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য হলো তার মনের স্থিরতার অভাব যা গল্পের শুরুতে বোঝা না গেলেও, পরবর্তীকালে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে প্রকট হয়ে ওঠে।
নরেন কিন্তু সদুকে ভুলতে পারে না তাই তার দেওরের বন্ধু হিসেবে সৌদামিনীর বাড়িতে এসে ওঠে। ঘনশ্যামের অনুপস্থিতে নরেন আর তাকে কথা বলতে দেখে তার শাশুড়ির তুলকালাম করা এবং প্রতিবাদে তার স্বামীর কোনো কথা না বলা সৌদামিনীকে আরো বেশি অপমানের জ্বালায় দগ্ধ করে।
একদিন সে সেই সর্বনাশটি করে। যা তার মতো শিক্ষিত বা বুদ্ধিমতী মেয়ের করা হয়তো সাজে না।
নরেনের সঙ্গে সে কোলকাতায় বৌবাজারে এসে ওঠে। তবে, ওই ঝোঁকের বসে বেরিয়ে আসাই সার। সকাল হতেই তার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে বাড়ি ফেরবার জন্য। সারারাত স্বামীর স্বপ্ন দেখে মন খারাপ করে পরের দিন নরেনকে তার “দাদা” বলে সম্বোধন করে বাড়ী ফিরে যেতে চাওয়া, নিতান্তই ছেলেমানুষির পরিচয় বলে মনে হয়। তুলনায় নরেন পরিণত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে এবং তাকে বারবার বলেছে যে ঘনশ্যাম কিন্তু তাকে ফেরত নেবে না।
নরেন নিজের স্বাৰ্থের কথা ভেবে বার বার অনুনয় করে যে, এখন তার পক্ষে সদুকে বাড়িতে রেখে আসা উচিত কাজ হবে না এবং এক সময় সে সদুকে তালা বন্ধ করে চলে যায়।
অনুতাপ করা ছাড়া সৌদামিনীর আর কিছুই করার থাকে না। জানলায় বসে আপিস ফেরত বাবুদের দেখে তার শুধুই ঘনশ্যামের কথা মনে হয়ে নিজের মনে বারবার বলে “সে নিরীহ ভালোমানুষ কাউকে করা কথা বলতে পারে না কারো ওপর রাগ দেখতে পারে না।”
আসলে সৌদামিনীর দ্বিধাগ্রস্ত মন ঠিক-ভুলের বিচার করতে পারে না। যদিও লেখক এই নায়িকা প্রধান উপন্যাসটিতে নায়িকার চঞ্চল মন আর পরে সম্পুর্ন নিজের চেষ্টায় নায়িকার স্বামীর প্রতি ভালবাসা ও কর্তব্যকে উঁচুতে স্থান দিয়েছেন। তবু আজকের প্রে্ক্ষাপটে বিচার করলে কোথাও যেন মেন শরৎচন্দ্র নিজেও আপোষ করেছেন তখনকার রক্ষণশীলতার কাছে। তাই মেয়েদের লেখাপড়াকে অগ্রাধিকার দিলেও শেষ অবধি সেই সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে মতবাদকেই মেনে নিয়েছেন। আর তাই বোধোহয় মা ও মামার পছন্দ করা পাত্রের দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সৌদামিনীর মতো প্রগতিশীল নারীর তাকে ভালোবেসে নিজেকে সমর্পিত করতে অসুবিধে হয়ে না।
আজকের দিনের মাপকাঠিতে মনস্ত্বাত্বিক বিশ্লেষণ করলে সৌদামিনী চরিত্রটি নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক।
Apurbo likheychis .