মেরী খাতুন
গাছগাছালির আড়ালে হাজার বছরের প্রাচীন মন্দিরের সারি। ভাস্কর্য স্থাপত্যের যুগলবন্দি পর্যটককে চমকে দেবে সৌন্দর্যে। অনন্য আর্টফর্মের পুরা-নিদর্শন দেখার অভিজ্ঞতায় ভরে উঠবে নতুন কালের শিল্পীর ঝাঁপি।
ভারতের মধ্যযুগীয় মন্দির-স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন খাজুরাহো। খাজুরাহো মন্দির যা “টেম্পল অফ লাভ” নামে খ্যাত। খাজুরাহো জায়গাটি মধ্যভারতের বিন্ধ্য পর্বত এলাকার মধ্যেই পড়ে। শহরের নামটিও খাজুরাহো। খুব বেশি হলে হাজার পঁচিশ তিরিশের লোকের বাস এই শহরে। স্থাপত্যে উদ্ভাসিত সেই সময়কার শিল্পের চরম উৎকর্ষতা। মন্দিরগাত্রের দেওয়ালে দেওয়ালে মূর্ত তৎকালীন জীবনযাত্রার বিভঙ্গ। দশম-একাদশ শতকে চান্দেলা রাজবংশের শাসনকালে গড়ে ওঠা এই অনন্য মন্দির-নগরীর অধিকাংশই আজ ধ্বংস। হাজার বছর আগে তৈরি হওয়া ৮৫ টি মন্দিরের মধ্যে টিকে আছে কেবল ২২টি। তবু এতেই বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়–কী বিশালত্বে, কী স্থাপত্যে,কী সূক্ষ্ম শিল্পরচনায় খাজুরাহোর শিল্পকীর্তি আজও অনন্য। তাই দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও পর্যটকের সমাগম আজও অব্যাহত খাজুরাহোকে ঘিরে।
চান্দেলা রাজবংশের পতনের পর অর্থাৎ প্রায় ১৪ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে স্থানটি ক্রমশ গৌরব হারিয়ে ফেলে। বেশিরভাগ মন্দিরই মাটির নীচে বা ঘন জঙ্গলে চাপা পড়ে যায়। এখানকার অতুলনীয় ঐশ্বর্য পুনরাবিষ্কৃত হয় ব্রিটিশ আমলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে। টিকে থাকা ২২ টি মন্দিরের মধ্যে পশ্চিমগোষ্ঠির মন্দিরগুলিরই আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। দক্ষিণগোষ্ঠির জন্য সময় না থাকলেও পুবগোষ্ঠির জৈন মন্দিগুলি অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত।
খাজুরাহোর মন্দিরগুলির দৃশ্যকল্পনার মধ্যে কিছু কিছু সাদৃশ্য থাকলেও, প্রতিটি মন্দির কিন্তু স্বকীয়তায় ভাস্কর। অলঙ্করণে ভাস্কর্যচিন্তায় প্রত্যেক মন্দিরেই ফুটে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি। সব মন্দিরই তৈরি হয়েছে উঁচু ভিত্তিবেদি বা জগতীর ওপর। সেখান থেকে শুরু হয়েছে মন্দিরের দেওয়াল বা জঙ্ঘা। দেওয়ালের ওপর থেকে শিখরে সারি, ধাপে ধাপে উঁচুতে উঠে তুলে ধরেছে সর্বোচ্চ শিখরকে। এমন ছন্দোবদ্ধ শিখরের ঊর্ধ্বে আরোহণ খাজুরাহোর মন্দিরগুলিকে করে তুলেছে অনন্য। মন্দিরের ভিতরে সর্বোচ্চ শিখরের ঠিক নীচে প্রধান দেবতার অবস্থান। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালের মতো ভিতরের দেওয়ালেও অসংখ্য কারুকাজ। ছোট ছোট মূর্তিতে ভরা তোরণ, ঝুলন্ত নকশা। গর্ভগৃহ ঘিরেও অসংখ্য ভাস্কর্য, স্তম্ভ, খিলানের সমাহার। আলো-আঁধারের ছায়াতরঙ্গ কেমন যেন এক অন্যরকম সৌন্দর্যের পরিবেশ সৃষ্টি করে।
পশ্চিমগোষ্ঠীর মন্দিরচত্বরের বাইরেই মাতঙ্গেশ্বর শিবমন্দির। এই মন্দিরেই এখনও পুজো হয়ে থাকে। বেলেপাথরের বিশাল মন্দির কিন্তু আশ্চর্যভাবে এটি ভাস্কর্যশূন্য। এর জগতী থেকেই ধরা পড়ে পুরো পশচিমগোষ্ঠীর মন্দিগুলি। সবুজ মখমলি ঘাস,ছড়ানো-ছিটানো ফুলের গাছ আর কিছু বড় বড় গাছের ফাঁকে ফাঁকে এতগুলি মন্দিরের ছন্দোময় শিখর স্থাপত্যের দৃশ্য মনকে ভরিয়ে দেওয়ার মতো। মাতঙ্গেশ্বর মন্দির থেকেই নজরে আসে পাশেই ঘেরার মধ্যে লক্ষ্মণ মন্দির। প্রথমেই নজরে আসে এর জগতীর মিথুন মূর্তির সারি। আর এর ডান দিকে দেখা যায় আরেক বড় মন্দির বিশ্বনাথ মহাদেব মন্দির। মহারাজা লক্ষ্মণের রাজত্বে ৯৩০ থেকে ৯৫০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে তৈরি হওয়া মন্দিরটি তাঁর নামানুসারেই। আসলে এটি বিষ্ণু ভগবানের মন্দির। বিশ্বনাথ মন্দিরটি পূর্ণতা পায় এর কিছু পরে। অসাধারণ কারুকার্যময় এই মন্দিরটি। অস্পরা ও মিথুনমূর্তি দারুণ প্রাণবন্ত। নমনীয় তাদের অঙ্গসৌষ্ঠব,আভরণ কারুকার্যখচিত। কোথাও বিশালভাবে দেওয়াল জুড়ে, কোথাও বা অন্য মূর্তির ফাঁকে ফাঁকে একের পর এক মিথুনমূর্তি। হয়তো কোনওটা স্থূল ইন্দ্রিয়সর্বস্ব আবার কোনওটা বা চমকপ্রদ যৌগিক ক্রিয়ার বিন্যাস। কোথাও বা স্বর্গীয় সুষমামন্ডিত আলিঙ্গনাবদ্ধ যুগলের অসাধারণ ব্যাঞ্জনা।
আরও পরের যুগে তৈরি কান্ডারিয়া মহাদেব মন্দির স্থাপত্যে ও ভাস্কর্যে সব থেকে দর্শনীয়। বিশালত্বে কিংবা শিল্পবিচারেও একটি অনন্য। অমিত কারুকার্যময়। সাধারণ মানবীয় ভঙ্গিতে সুর-সুন্দরীর দল পাথরে পাথরে উৎকীর্ণ। অসাধারণ লীলায়িত ও জীবন্ত আবেগ পূর্ণ বর্ণনায় মানব-মানবীর শরীর সংহত হয়ে আছে কঠিন পাথরে। কান্ডারিয়া মহাদেব মন্দিরের একই চাতালে জগদম্বী মন্দির। প্রণয়কাল মগ্ন ও আলিঙ্গনবদ্ধ যুগলে এই মন্দির পূর্ণ। পাশেই চিত্রগুপ্ত মন্দির। সাতঘোড়ার রথে চড়া সূর্যদেবের মূর্তিটি ভগ্নপ্রায়। নৃত্যরত সুর-সুন্দরীরা এতটাই জীবন্ত যে,মনে হয় যেন কারও অভিশাপে হঠাৎ পাথরে পরিণত হয়েছে এরা।
শৈব, শক্তি, বৈষ্ণব, জৈন সব ধর্মেরই সমাহার এই খাজুরাহোতে। পুবগোষ্ঠির মন্দিরের মধ্যে পাশ্বর্নাথ, শান্তিনাথ ও আদিনাথ—জৈন ধর্মাবলম্বীদের তিন মন্দির। স্থাপত্যের বিচারে এই তিন মন্দিরের আবেদনও পর্যটকদের কাছে যথেষ্ট। বিশেষ করে পাশ্বর্নাথ মন্দিরের দেওয়ালের প্যানেলে দেখা যায় অসংখ্য মূর্তির সমাবেশ। খাজুরাহোর বহু বিখ্যাত মূর্তি খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। আর আছে ঘন্টাই মন্দির। একেবারে ভাঙাচোরা, শুধু স্তম্ভে রয়ে গেছে ঝুলন্ত ঘন্টার অসাধারণ খোদাই।
পশ্চিমগোষ্ঠীরই আরও দুটি মন্দির লালগুঁয়া সাগর ঝিলের পাড়ে। চৌষট্টি যোগিনী আর লালগুঁয়া মহাদেব মন্দির। হাতে সময় থাকলে দেখে নেওয়া যায় দক্ষিণগোষ্ঠির দুই মন্দির, দুলাদেও মহাদেব আর চতুর্ভূজ মন্দির।
হাজার হাজার টিয়াপাখির সবুজ ডানায় ভর করে নেমে আসা খাজুরাহোর সূর্যাস্ত বেশ অন্যরকম। পশ্চিমে ঢলে যাওয়া সূর্য মুখ লুকায় কান্ডারিয়া মহাদেব মন্দিরের পেছনে। কালো সিল্যুয়েট এই বিশাল মন্দিরের অবয়ব কেমন যেন সম্ভ্রম জাগায়। মন্দিরচত্বর পার হয়ে টিকিট কেটে ঢুকে পড়ুন খোলা মাঠের মঞ্চে। সামনে গাছগাছালি মেশা মাঠের খোলা ময়দানে চিত্রগুপ্ত মন্দিরের অবয়ব। অন্ধকারেই দেখা যায় অন্য মন্দিরগুলিও। আলো ও ধ্বনির মাধ্যমে তুলে ধরা হয় খাজুরাহোর ইতিহাস। বেশ লাগে।
মন্দিরচত্বর বাদে খাজুরাহোর পথঘাট-জঙ্গল-নদী-ঝরনা এখনও নির্জন এবং অতুলনীয় সৌন্দর্যে ভরা। এই মন্দির তাদের অনুপম স্থাপত্য আর ওই অসাধারণ ভাস্কর্যের সমাবেশ—-পর্যটকদের সারাজীবনের সংগ্রহের অন্যতম হয়ে থাকবে। কাছাকাছি রানে ওয়াটার ফলস আর পাগুব ওয়াটার ফলস ২০ থেকে ৩০ কিমির মধ্যে। পান্নাতে আছে হিরের খনি। দেখা নেওয় যায় পান্না ন্যাশনাল পার্কে রকমারি বন্যপ্রাণী।
অসামান্য শিল্পকলা ও স্থাপত্যের নমনা দেখতে এবারই না হয় খাজুরাহো বেড়ানো প্লানটা করে ফেলুন। দেখবেন বেড়ানোর ইতিহাসও হচ্ছে, আর তার সাথে প্রেমও হচ্ছে। অবশ্যই একবার ঘুরে আসুন মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো থেকে। খাজুরাহোতে বছরের যে কোন সময় যাওয়া যেতে পারে, তবে গ্রীষ্মকালে খুব গরম থাকে এখানে।
কিভাবে যাবেন:—কলকাতা থেকে খাজুরাহো যাওয়ার সরাসরি কোন ট্রেন নেই, মুম্বই মেল ভায়া ইলাহাবাদ, হাওড়া থেকে মির্জাপুর গিয়ে সেখান থেকে সাতনা পৌঁচ্ছে গাড়িতে চলে যাওয়া যায় খাজুরাহোতে। কিংবা যে কোন ট্রেন ধরে কানপুর চলে যাওয়া যেতে পারে, সেখান থেকে ট্রেন বদলে চলে যেতে পারেন খাজুরাহোতে।
কোথায় থাকবেন:–মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের গেস্ট হাউসে থাকতে পারেন। এছাড়াও বেসরকারি বিভিন্ন হোটেল যেমন, হোটেল ঝঙ্কার, হোটেল হারমনি, হোটেল খাজুরাহো ইন, গ্রিনভিউ ইত্যাদি।