Home রোমান্টিক, গল্প একটু অবসরে
রোমান্টিকগল্প

একটু অবসরে

সুদেষ্ণা চক্রবর্তী

তোমার আসতে আজ এত দেরী হলো?”

“রাস্তায় ভীষণ ভীড়। পথের দু-ধারে লোকজনের বড্ড ভীড় রথ দেখার জন্য”।

“খেয়েছো তো?”

“হুম”।

“হুম না, কি খেলে বলো?”

“তুমি আজ হঠাৎ শাড়ী পরলে?”

“হাতে অনেকটা সময় ছিল তাই…….”

“শাড়ী পরলে তোমাকে বেশ দেখায় কিন্তু”।

“তোমাকেও জিনসের ওপর সবুজ পাঞ্জাবিটা পরলে দারুণ দেখায়, তবু পরো না”।

“কিছু না”, বলে মুচকি হাসে শুভঙ্কর।

এই বকবকিয়ে মেয়েটার সাথে কথায় পেরে ওঠেনা কোনোদিন। তাই জামাকাপড়ের প্রসঙ্গটাই তবে বাদ।

এই হল তাদের রোজকারের কথোপকথন। সে সাক্ষাতেই হোক বা ফোনালাপই হোক।

এরা নন্দিনী আর শুভঙ্কর……

একে অপরকে ভালোবাসে।

এরা দুজন কিন্তু পূর্ণেন্দু পত্রীর লেখনীর চরিত্র নয়, তবে সাহিত্যচর্চা ওদের দুজনেরই খুব প্রিয়।

এরা দুজনেই এই শহরে বাস করে। শিলিগুড়ি তাদের প্রাণের শহর।

একে অপরকে চেনে সেই ছেলেবেলা থেকে।

শুভঙ্করের খুব ইচ্ছে ছিলো গান, বাজনা, কবিতা, লেখা-লিখি এসব নিয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার।

নাহ, সেটা হয়নি।আরোও পাঁচজনের মত তার জীবন-যাপনও আটকে গেছে দশটা থেকে পাঁচটার চাকরিতেই। মাঝে মাঝে আছে ওভার ডিউটির লোড।

আর এই লকডাউনে বড্ড কঠিন হয়ে উঠেছে প্রাইভেট চাকুরিজীবিদের জীবন।

আজকাল মাঝেমাঝেই বড্ড আনমনা দেখায় শুভঙ্করকে।

আর নন্দিনীর …

না, ওর কোনো হেলদোল নেই। ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন্দিনী জানে একদিন সবটা ঠিক হয়ে যাবে।

শুধুমাত্র ধৈর্য্যের প্রয়োজন।

গাছতলায় বাইকটা রেখে ওরা দুজনে হাঁটতে থাকে।

নন্দিনীর বিশ্বাসের ওপর বড্ড ভরসা করে শুভঙ্কর আজকাল। এত মনের জোর কোথা থেকে পায় যে মেয়েটা।

সব পরিস্থিতেই খুব সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিতে পারে মেয়েটা।

“নন্দিনী, আমার খুব ভয় করে,বড় ভয় করে”।

“কোনও একদিন বুঝি জ্বর হবে, দরজা দালান ভাঙা জ্বর। তুষারপাতের মত আগুনের ঢল নেমে এসে নিঃশব্দে দখল করে নেবে এই শরীরের শহর বন্দর।”

“বাহ, বেশ লাগছে শুনতে, থামলে কেন”?

এটা কথোপকথনের প্রথম ভাগ…..কত নম্বর কবিতা সেটা মনে নেই। বেশ মুখস্ত করে ফেলেছো তো।”

নন্দিনীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে শুভঙ্কর।

“তোমার কথা কিছু বল, আজ নতুন কি লিখলে বল।”

একমনে আকাশের দিকে চেয়ে বলতে থাকে নন্দিনী……..

“প্রকৃতি আজ তার নিজস্ব রঙে রঙিন

তার তো কোয়ারেন্টাইন নেই-

মানবজাতির অসহায়তা আজ সে দেখে চেয়ে চেয়ে

বিশুদ্ধ বাতাসে খুঁজে পেয়েছে শান্তি।

গেলো বছরে বৃক্ষরোপণের দিনে লাগানো আকন্দের চারাটা

অসময়ের বৃষ্টির জলে বাড়ছে তরতর করে।

আজ সকালেই সূর্যমুখীর কুঁড়িটা সূর্যের সঙ্গে সাহসের সাথে চোখ মেলায়

নয়নতারা বাড়ে অযত্নেই

বেলফুলের গন্ধ কি মিষ্টি

একটাই স্থলপদ্ম-থাক সে, গাছেই থাক

সন্ধ্যে হতেই কামিনী আর মাধবীলতার গন্ধে চারিদিক ম-ম করে,

আমার শৈশবের ফেলে আসা  দিনগুলোকে মনে করায়

দূর থেকে আজানের মিষ্টি সুর আর বাড়ির উঠোনের শঙ্খধ্বনি

আজ মিলে মিশে একাকার

আমরা অপেক্ষায় আছি এক সুন্দর পৃথিবীর-

সবাই অপেক্ষায় আছি এক সুন্দর পৃথিবীর।”

এতখানি বলে থামল নন্দিনী,

তাকালো শুভঙ্করের দিকে।

এই অন্ধকারের আকাশের তলায় আত্মবিশ্বাসে ভরা জ্বলজ্বল করে ওঠা একজোড়া চোখ দেখতে পেলো শুভঙ্কর।

“চল এবার ফেরা যাক, বৃষ্টি আসবে মনে হয়।”

“হুম, রথের দিন বৃষ্টি তো হবেই। জিলিপি খাওয়া হলোনা তো এবার”।

চুপচাপ কোনো কথা না বলে বাইকটা স্টার্ট দেয় শুভঙ্কর।

নন্দিনী জানে বাইকটা একবারে গিয়ে থামবে গোপালকাকুর জিলিপির দোকানের সামনে।

আলতো করে শুভঙ্করকে জড়িয়ে ধরে বসে নন্দিনী।

বাড়ী ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে স্কুলের কাজ নিয়ে বসে নন্দিনী।

সারা সপ্তাহ কেটে যায় হাজারো ব্যস্ততায়।

কোনো কোনো সপ্তাহে একটু ছুটি ম্যানেজ করে শুভঙ্কর। ঐ দেড়/দু ঘন্টা কোথা দিয়ে চলে যায় বুঝতে পারেনা ওরা।

রাতে কোনো কোনো দিন শুভঙ্করের সাথে কথা হয় কোনোদিন হয়না। বড্ড ব্যস্ত মানুষটা। বড্ড কাজ পাগল। নন্দিনীর ব্যাপারে বড্ড উদাসীন শুভঙ্কর। মাঝে মাঝে বড্ড মন খারাপ হয় নন্দিনীর। তবুও ভালোবাসে শুভঙ্করকে। সত্যিকারের ভালোবাসাগুলো বোধহয় এরকমই হয়।

খুব যখন একা একা লাগে নিজেকে তখনই লেখার খাতাটা নিয়ে বসে নন্দিনী।

লেখার অভ্যেস সেই কোন কাল থেকে।

ছোটোবেলায় বাবা বলেছিলো “যতটুকুই পড়ো না কেন, সেই টুকু লিখে নেবে নিজের ভাষায় নিজের মতোন করে, তবেই মনে থেকে যাবে সবটা।”

বাবাকে হারিয়েছে সেই কবে। বাবা বলতে আজ সম্বল শুধুমাত্র বাবার লেখা ডাইরি। ওটা পড়েই মনে জোর বেড়ে যায় মেয়েটার।

শুভঙ্করের হাবভাবটাও অনেকটা বাবার মতোন। গুরু গম্ভীর মানুষটাকে মুখে কিছু না বললেও ওর ওপর বাবার মতোই ভরসা করে নন্দিনী।

আজ আটদিন বাদে দু ঘন্টা ছুটি ম্যানেজ করেছে শুভঙ্কর।

সারা সপ্তাহের এই দুই ঘন্টার অপেক্ষা করে ওরা।

যেদিন ওর অফডে সেদিন।

নন্দিনীর সবচেয়ে বেশি অনলাইন ক্লাস।

তবু ওরা খুশি। নিজেদের ছোট্ট ছোট্ট সুখ দুঃখ মিলিয়ে নিয়ে ওরা খুব খুশি।

পথে আবারও ভীড়। আজ তো উল্টোরথ। জগন্নাথদেবের ঘরে ফেরার দিন।

বাইপাসের রাস্তা ধরে বাইক চলতে থাকে। এই গন্তব্য বিহীন পথ চলতে নন্দিনীর বড় ভালো লাগে।

হঠাৎ করেই বাইকটা মাঝ রাস্তায় থেমে যায়।

বোকা বোকা মুখ করে শুভঙ্কর বলে “তেল শেষ মনে হচ্ছে।”

বছর চারেক আগে হলে হয়তো গাল ফুলিয়ে রাস্তাতেই ঝগড়া শুরু করতো নন্দিনী।

নাহ, আজ এক অন্য নন্দিনী দেখতে পেলো শুভঙ্কর।

“একটা টোটো ধরে জলের বোতলে করে তেল নিয়ে আসি চল”,বাইকটা ঐ চায়ের দোকানে রেখে দাও”।

এতক্ষণে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল শুভঙ্কর, নাহ কোথাও যেতে হবেনা তেলের ব্যবস্থা আমি ফোনেই করে নেবো। চল আমরা বসি।

একটা ছোট্ট মতোন চায়ের দোকানে চা আর বিস্কুট দিতে বলে শুভঙ্কর বললো “তোমার কফি তো এখানে পাবেনা।”

নন্দিনী কিছু না বলে ব্যাগ থেকে  ভাঁজ করা একটা কাগজ  শুভঙ্করের পকেটে গুঁজে দিতে দিতে বলে মনের ভুলে এটা যেন এখানে না রয়ে যায়

সময় পেলে খুলে দেখো কোনো এক অবসরে।

সময়!

এই ছোট্ট শব্দটাই যে শুভঙ্করের হাতে নেই।

আর এই নিয়েই যত অভিমান পুষে রাখে মেয়েটা।

এখনো অনেক কথা যা বলা হয়ে ওঠেনা শুভঙ্করকে সেটা নন্দিনী লিখে রাখে চিঠিতে।

এই ইন্টারনেট এর যুগেও চিঠি লেখার অভ্যেসটা ছাড়েনি মেয়েটা।

এই জন্যই তো ভালোলাগে নন্দিনীকে।

রাগ দুঃখ অভিমান বেশিক্ষণ পুষে রাখতে পারেনা।

আড়চোখে শুভঙ্কর তাকায় নন্দিনীর দিকে।

“তুমি আরো অনেক অনেক লেখো। স্রোতের বিপরীতে হাঁটলেও আমি আছি তোমার পাশে।”

“লিখবো, তার আগে তুমি আমাকে কথা দাও। একটা দিন পুরো ছুটি নিয়ে তুমি শুধু আমার সাথে কাটাবে। সেদিন পুরোটা সময় জুড়ে  থাকবো শুধু আমি।”

“এই প্রথম জিলাপি আর লিপস্টিক বাদ দিয়ে আমার কাছে মুখ ফুটে তুমি কিছু চেয়েছো নন্দিনী, আমি কথা দিলাম”।

“উল্টো রথের দিনে সোজা কথা তোমার মুখে বাপরে তাই আজ না হয় কফি বাদ দিয়ে চায়ের ভাঁড়েই চুমুক দিলাম। জয় জগন্নাথ।”

দুজনেই প্রাণ খুলে হাসতে থাকে।

বিশ্বাসেই বেঁচে থাকুক ভালোবাসারা।

সমাপ্ত

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!