ধ্রুবতারা…
মানুষ শখ পূরণের জন্য কী না করে ! সব প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির মধ্যে প্রতিজনের মনের ভেতরেই পুষে রাখা থাকে কিছু গোপন শখ I আমিও পুষে রেখেছি শখ I শখ পূরণের জন্য আপনারা কী কী করেন সেটা আমি কী করে বলবো বলুন ! আমি তো আমার শখের কথা বলতে এসেছি I যদিও নিজের কথা শোনানোর প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে প্রবল তবুও আমি শুনতে পছন্দ করি অন্যের শখ I
অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি মানুষের আর্থিক অবস্থা কিন্তু শখকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা I মানুষের সত্তা আর তাদের মানসিকতা অনুযায়ী তারা শখ পালন করে থাকেন I চীনের মেজর লি বলেছিলেন ওনার জীবনে শখ হলো পৃথিবীর উত্তর অথবা দক্ষিণ গোলার্ধের মেরুজ্যোতি বা অরোরা বোরিয়ালিস দেখার I এর জন্য ওনাকে নরওয়ে , গ্রীনল্যান্ড কিম্বা কানাডার ইয়েলোনাইফ সিটি যেতে হবে , জানিয়েছিলাম !
বুঝিয়েছিলাম , সূর্যের চার্জড পার্টিকেল পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সংস্পর্শে আসলেই এই অরোরা বা মেরুজ্যোতি সৃষ্টি হয় I মজা করে বলেছিলাম , ‘মেজর লি , আপনি বরং অরোরা বোরিয়ালিস সৃষ্টির উৎস সূর্যের ভেতরের সেই ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড স্পর্শ করে দেখতে পারেন ! মাত্র পনেরো মিলিয়ন ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রা ছুঁয়ে দেখতে পারেন !’ ওনার মুখের হাসিতে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল I মেজর লি’এর এই শখ পূরণ হয়েছে কি না , আমি জানিনা !
বাংলাদেশের মিলিটারী অফিসার মইনুল জানিয়েছিলেন , ওনার দীর্ঘদিনের শখ পৃথিবী কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে যাক , তিনি দেখতে চান পৃথিবী থেমে গেলে কী হতে পারে ! আঁতকে উঠেছিলাম I বলে উঠেছিলাম , ‘মইনুল সাহেব আপনি জানেন আপনি কী শখ পুষে রেখেছেন ! যে গ্রহ নিজের অক্ষপথে সেকেন্ডে চারশো মিটার আর কক্ষপথে সেকেন্ডে তিরিশ কিলোমিটার বেগে ঘোরাঘুরি করছে তাকে থামিয়ে দেওয়ার পরবর্তী প্রভাব দেখার শখ পুষেছেন ! সাংঘাতিক , মহা প্রলয় হয়ে যাবে ! পৃথিবীর সবকিছু এক মুহূর্তে গতিশীলতা হারাবে আর সব খড়কুটোর মত উড়ে যাবে এদিক ওদিক ! দেখার মত অবস্থায় আপনিও আর জীবিত থাকবেন না !’ উনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন , ‘ভায়া , অপকেন্দ্রিক বলের উপরে একটা সূত্রের আবিষ্কার করতে চাই !’ সেদিন মুখ ব্যাজার করে তাকিয়ে ছিলাম মইনুল স্যারের দিকে I
সাড়ে ছয়ফুট দীর্ঘ বৃহদাকার নাইজেরিয়ার সার্জেন্ট অফিসার মিস্টার চেগ এর আবার দুটো শখ I প্রথমতঃ গোলাপী আরমাডিলোর মাংশ খাওয়া আর দ্বিতীয়তঃ কিং কোবরার বিষ ধারণ করা I শুনেই মনে মনে বলেছিলাম , ‘বর্বর’ কিন্তু উনি ওনার সাদা দন্ত বিকশিত করে বলেছিলেন যে উনি কোনো শর্তেই এই শখ দুটো পাল্টাবেন না I তাহলে ওনাকে স্পেনে গিয়ে কোনো না কোনো সময়ে গোলাপী আরমাডিলোর মাংস খেতে হবে আর দ্বিতীয় শখ পূরণের জন্য ওনাকে একটা দিন চোখ বন্ধ করে আমাজনের জঙ্গলে গিয়ে শুয়ে থাকতে হবে , জানিয়েছিলাম I
মেজর লি মহিলা হওয়ার কারণে ওনার শখ ছিল বেশ সোবার I কিন্তু বাকি দুইজনের শখ তাদের সত্তা এবং মানসিক অবস্থার পরিচয় দিয়েছিল সেদিন হারপারের বন্দরে I কিছুক্ষণের মধ্যেই আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিম দিক থেকে একটা ভেঁপুর আওয়াজ শুনতে পেয়ে চোখ ফেরাতেই দেখি আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসছে ক্যাটেরিনা জাহাজ I আন্দাজ মত মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যেই বন্দরে পৌঁছে যাবে I এমন সময়ে মেজর লি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওয়াত ইজ ইওর অবি !’
বুঝতে পারলাম এবার আমার পালা I কিন্তু ছা পোষা বাঙালির তো শখের অন্ত নেই I বাঙালির তো বিচিত্র সব শখ I কেউ রবীন্দ্রনাথের মত কলম সংগ্রহ করে রাখতে চায় I সদ্য কবিতা লিখতে শেখা কোনো প্রেমিক কবি ফরাসী সাহিত্যিক আলেকজান্ডার ডুমা’র মত নীল রঙের কাগজে উপন্যাস , গোলাপী কাগজে কবিতা লেখার শখ পুষে রাখেন I কেউ মুক্তর রথে চেপে আসা চাঁদের জ্যোত্স্নায় স্নাত রাত্রিতে ওক গাছের নীচে বসে সারা রাত্রি নাইটিঙ্গেল পাখির প্রেমের গান শোনবার শখ পুষে রাখে I কেউ হয়তো আইনস্টাইন এর প্রথম প্রেমিকা মেরি উইন্টলারের প্রতি আইনস্টাইন এর অবিচারের বিচার করতে চেয়ে মেরির দিকে ভালোবাসার রুমালে এক টুকরো মেঘ উড়িয়ে মেরিকে আপন করে নেবার শখ পুষে রাখেন I
কিন্তু সেই সময়ে আমার তেমন কোনো শখের কথাই মনে আসলো না I অনেক দূরে গোবরে নিকোনো উঠোনে ফুটতে থাকা লাল চালের ভাতের গন্ধের কথা মনে পড়ে গেল I আমি জানি ক্ষুধার্ত মানুষদের চোখে ভাতের ছবি স্বপ্নে ফুটে ওঠে I একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে দেখতে পেলাম আইভরি কোস্ট, ঘানা, লাইবেরিয়া, সুদান, সিরিয়ার লক্ষ লক্ষ লোকেরা একই রকমের দেখতে I ওদের সবার নাম আফ্রাম I আফ্রাম, যে ছেলেটাকে দেখেছিলাম আফ্রিকার হারপার দ্বীপের এক নির্জন গ্রামে উলঙ্গ অবস্থায় বসে থাকতে I সেদিন বুঝেছিলাম কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন অনুযায়ী কোনো মানুষ সেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ায় না I আমি একা একা এত এত ক্ষুধার্ত আফ্রামের চোখের বিদ্রুপের দৃষ্টিতে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলাম I
হঠাৎ অনুভব করলাম একটা আট ফুট লম্বা কপার হেডেড রেডিয়েটেড ক্যাট স্নেক আমাকে জড়িয়ে ধরেছে I হাঁসফাঁস করতে করতে বলে উঠলাম , ‘আলো …আলো …আলো !’
খোংসাং …মনিপুর …১৮/০২/২০২২
আমার পরিচয়:
আসল নাম ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় ….পেশায় সৈনিক ..বর্তমানে খোংসাং মনিপুরে ….এই সময়ে আমি মনিপুর থেকেই আপনার সাথে আমি কথা বলছি ….এই হলো সংক্ষিপ্ত পরিচয় ….