সুদেষ্ণা চক্রবর্তী
রঙীন বাহুডোর
সুদেষ্ণা চক্রবর্তী
শপিং মলে মাস কাবারি বাজার করে বিল মেটাতে এসে জয়ীর চোখে পড়লো রাখীগুলো।
নেড়ে চেড়ে দেখছে…
ওই দূরে দাঁড়িয়ে অফিসের ফোনে কথা বলতে বলতে সেটা লক্ষ্য করে অর্ণব।
এগিয়ে এসে বলে “নেবে তো নিয়ে নাও”।
একমাত্র ভাই থাকে বহুদূরে। শেষ কবে রাখী বেঁধে ছিল মনে নেই জয়ীর।
পরদিন পাড়ার দোকান থেকে পছন্দের শিফন সুতো কিনে আনলো জয়ী। দোকানদার শিফন সুতো দিল ঠিকই, কিন্তু R-শিফন জিনিষটা কি, সেটা বুঝতে পারলো না।
আর সাথে কিনলো সাদা ক্রচেট সুতো।
ছেলের ইস্কুল সেই ভোর বেলা, অর্ণব অফিসে বেরিয়ে যাবার পর তেমন তো কোনো কাজ থাকে না বিশেষ…..পছন্দের রঙ গুলোকে একটা একটা করে বিছানায় সাজালো।
ঠিক যেমন পরপর গায়ে গা ঠেকানো খাটগুলোতে ওরা বন্ধুরা মিলে সাজাতো।
শ্রীসদন হোস্টেলে এসে প্রথম জেনেছিল একমাত্র গোলাপী রঙের রাখীটা বিশেষ কোনো মানুষের হাতে বাঁধা যায়।
এতদিন জয়ী জানত ভাই বা দাদাভাইকেই রাখী পরানোর কথা।
শান্তিনিকেতনে এসে জেনেছিল এটা বন্ধনের উৎসব এখানে প্রেমিকের হাতেও নির্দ্বিধায় রাখী বাঁধা যায়।
এখনও রান্না ঘরের পাশে লাগোয়া স্টোররুমে খয়েরি রঙের ট্রাংকটাতে সাদা রঙ দিয়ে বড় বড় করে লেখা –
জয়ী চ্যাটার্জী
ক্লাস সিক্স
পাঠভবন, বিশ্বভারতী
এটার ভিতরে জয়ীর শৈশব আর কৈশোরের টুকরো টুকরো স্মৃতি অতি যত্নে রাখা আছে।
“কি মনি মুক্তো আছে তোমার ঐ ট্রাংকে???”
একদিন মজা করে জিজ্ঞেস করেছিল অর্ণব…..
মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন জয়ী
“আমার ভালোলাগা গুলো বাক্সবন্দী করে রেখেছি যাতে কখনো পালিয়ে না যায়”।
কি আছে জয়ীর ওই ট্রাংকে?
আছে সুন্দর করে মায়ের পুরোনো শাড়ি দিয়ে মলাট দেওয়া তিন চারটে ডায়েরি।
আছে একটা বাঁধনির ওড়না, আছে একটা শিমুল তুলোর তৈরি শাড়ি পরানো পুতুল, আছে একটা লম্বা শেষ না হওয়া মাফলার….
আছে তিন চারটে ক্যাসেট, গল্পের বই আর গুচ্ছ শাহরুখ খানের পোস্টার। আর আছে কিছু চন্দনবীজ, কুঁচবীজ, পপির পা পড়ি, টিয়ার পালক, পাতাবাদাম, শিরা বের করা অশ্বত্থ গাছের পাতা আর একটা গোলাপী রঙের……..
(১)
আগস্টের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে রাখী বন্ধন…..স্বাধীনতা দিবস আর বর্ষা মঙ্গলের ঠিক আগে পরে আমাদের রাখী উৎসব।
পছন্দ করা রঙের স্লিপ ডিপোজিট কাগজে লিখে হোস্টেলের অফিস – টেবিলে জমা দেওয়ার নিয়ম ছিল।
ঠিক গুনে গুনে পনেরোটা শিফন সুতোর লাচি হাতে পেতাম আমরা।
সাদা কালো আর রামধনুর সাতটা রঙ বাদেও আরও কত্ত রঙ চিনতে শিখলাম।
সী-গ্রীন, স্নাফ, অফ হোয়াইট,মেরুন, রাস্ট চোখে যেন রঙিন স্বপ্ন….. থুরি রঙিন সুতো।
সারা শ্রীসদন জুড়ে R-শিফনের গল্প জুড়ে রয়েছে।
কার রাখী কত সুন্দর হবে আর কত ফুলবে।
প্রথম রাখী বানানো শিখে তিনটে রাখী আর তিনটে দড়ি ব্যান্ড বানিয়েছিলাম। সাহায্য করেছিল কাবেরী।
ও ছয় লাচি দিয়ে দিয়ে একটা কদম রাখী করেছিল আর তার ব্যান্ডটা ছিল চার লাচির।
“এই এত্ত বড় গোলাপী রাখীটা কার জন্য রে?”
“কাল সকালেই দেখতে পাবি।”, বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো কাবেরী।
আর আমি সুন্দর নীল রঙের রাখীটা ভাইয়ের জন্য রেখে দিলাম। আগামী বুধবার চিঠির সাথে পোস্ট করে দেবো।
আর বাকি দুটোকে একটা ছোট টিফিন বক্সে রেখে ঘুমোতে গেলাম।
পরদিন ক্লাসে যার হাত ফাঁকা পাব তাকেই পরাবো।
রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম স্নাফ আর অফ হোয়াইট মেশানো লোর্ডশেডিং রাখী আর একটা কমলা রঙের রাখী দুজনে একে অপরের বন্ধু হয়ে গেলো।
(২)
বছর কেটে গেলো…..
আমাদেরও তখন একটু একটু করে পাখা আর পা দুটোই গজাতে লাগলো।
অমুক বন্ধুকে, তমুক দিদিকে হসপিটালে দেখতে যাবার নাম করে সরু গলি দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে চলে যেতাম রতনপল্লীর রঞ্জনীতে।
নিজের পছন্দে বেছে বেছে কেনা হোতো শিফন সুতো।
এবারে অনামিকা বানালো এক এত্ত বড় গোলাপী রাখী….. কার জন্য সেই নামটা বলা বারণ।
আমিও নীল, তুঁতে আর সবুজের সাথে বানালাম একটা গোলাপী রাখী।
গৌরীদির ইংলিশ ক্লাসে চলছে সেই রাখী পরানোর পালা।
তুঁতে রঙের রাখীটা অয়নের হাতে বেঁধে ফিরে আসার সময় আবার অয়ন একবার ডাক দিল জয়ীকে।
“আবার কি বলবি…….
একটা আমূল ক্যাডবেরি হাতে দিয়ে বলেছিল গোলাপী রাখীটা কার জন্য রাখলি রে?…..ভেবেছিলাম ওটা বুঝি তোর সেই………”
কথা শেষ হয়নি অয়নের, কাবেরী সুমেধা আমি সকলে মিলে হাসতে হাসতে গোপালদার আইসক্রিম গাড়ির দিকে দৌড়ে গেছিলাম।
বিশেষ বিশেষ দিনে চেরিবেরি কাঠি বরফ খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা।
আর সেই জয়ীর বানানো গোলাপী রাখীটা???
ওটা বইয়ের ভাঁজেই থেকে গেলো।
(৩)
মাধবী হোস্টেলের একদম শেষ কোণের ঘরে দুটো সেতার পাশপাশি রাখা।
সেতারের দুটোর কানে ছোটো ছোটো লাল রঙের আংটি রাখী বানিয়ে নন্দিনী পরিয়ে দিয়েছে কখন যেন।
“বিকেলে দেবশ্রীদি আসবেন সেতার শেখাতে ,গত বুধবারের ক্লাসটা বাদ গেছে দান সংগ্রহের জন্য ।তোর কাছে গোলাপী রাখীটা আছে না???”
জানলার দিকে বসে বেণী বাঁধতে বাঁধতে নন্দিনী কথাগুলো বললো জয়ীর উদ্দ্যেশ্যে।
“ওটা নেই….একটা ব্যান্ড আছে চল ওটাই দুজনে মিলে বেঁধে দেবো”….
“ওমা ওটা কাকে পরালি বল…
প্লীজ বল…”
“ধুর! এই দ্যাখ। থাক এটা বাক্সে”।
“হ্যাঁ রে! তুই বাম না অতিবাম না বদ্ধ পাগল??”
পাশ থেকে কাবেরী এসে বললো, “থ্রি ইন ওয়ান।”
(৪)
এরপর আমাদের আনন্দ বাজারের প্রস্তুতি পর্ব।
রাখী ছেড়ে সবাই তখন হাতের কাজে মন।
বাংলা ক্লাসে একদিন কৃষ্ণাদি বললেন, “তোমরা পুজোর ছুটিতে আত্মকথা দিয়ে রচনা লিখে আনবে।”
যেমন – “একটি গাছের আত্মকথা বা একটি পাখির আত্মকথা তোমাদের যা মনে আসে তাই লিখো।”
অনামিকা লিখেছিল, সেগুন গাছের আত্মকথা।
কাবেরী লিখে ফেলল, সাইকেলের আত্মকথা।
সুমেধা খুব মজা করে লিখে ফেলল, একটি উকুনের আত্মকথা ।
পূজোর ছুটির পর ফিরে এসে সকলে রচনার খাতা জমা দিয়েছিল কৃষ্ণাদির কাছে।
উনি প্রতিদিন এক একজনকে ক্লাসে একটি করে আত্মকথা পড়ে শোনাতে বলতেন।
জয়ী লিখেছিল, গোলাপী রাখীর আত্মকথা।
“জয়ী দিদি খুব যত্ন করে আমাকে বানিয়ে একটা স্টিলের টিফিন বক্সে রেখে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে বের করে নেড়ে চেড়ে দেখে, চার্লি সেন্টের শিশি থেকে মাঝে মধ্যে স্প্রে করে আমার ওপর তারপর আলতো করে একটা চুমু খেয়ে আবার রেখে দেয়।
সেদিন বিকেলে যখন রতনপল্লীর দোকানের বাক্স থেকে বের হয়ে চার পাঁচটা দিদির হাসাহাসি করে রং বাছাবাছি দেখছিলাম তখনই আমার ভীষণ ভীষণ আনন্দ হয়েছিল।
হোস্টেলে এসে আমি ওদের গল্প গুলো শুনছি আর হাসছি। এদের সাথে থাকতে থাকতে মেয়েগুলোর মনের কথা জেনে ফেলছি।
ওরা কার জন্য ক্যাসেট কেনে, কার জন্মদিনে গুঁড়ো দুধ আর ভাত মিশিয়ে পায়েস বানায়, কার জন্য পাঞ্জাবী তৈরি করে, ওদের সব গল্প আমার জানা।
এরপর মহালয়ার পরদিন আমি ট্রেনে চাপলাম। কি সেদিন কি আনন্দ আমার।
নাই বা পেলাম আমি কারও হাত, জয়ী দিদির কাছেই থেকে যাব আমি বন্ধু হয়ে।
জয়ী দিদির বাড়িতে এসে আমি বুঝতে শিখলাম পরিবার কাকে বলে…..
বেশ কাটছিল আমার দিন গুলো। একদিন এ’ঘর ও’ঘর করতে করতে জয়ী দিদির ভাইয়ের ঘরে ঢুকে পড়লাম।
ও মা! টেবিলের এককোণে পেন স্ট্যান্ডের পাশে ঠিক আমার মতন দেখতে একজনকে দেখতে পেলাম। রংটা ছিল নীল।
ব্যাস! সেইদিন থেকে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।
ভাইফোঁটার পরদিন দিদির হোস্টেল ফেরা।
গোছগাছ শুরু হলো। আর আমার শুরু হলো মনখারাপ।
আমি ইচ্ছে করেই দাদার টেবিলের একটা ড্রয়ারে লুকিয়ে রইলাম।
বন্ধুকে ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না।
জয়ী দিদি হস্টেলে ফিরে গেলো।
আর আমি পেয়ে গেলাম আমার বন্ধু। মনের প্রাণের কথা বলবার বন্ধু।”
(৫)
“মা, দেখ আমার গাড়িতে দুটো বন্ধু চেপেছে…….
ভুউউউ ভুউউউ ভুউউউ”
মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে করতে অত্রি এ’ঘর থেকে ও’ঘরে খেলছে।
ছেলের ডাকে ঘোর কাটলো জয়ীর।
ও মা! কখন যে দুটো বেজে গেছে টেরও পায়নি।
ছেলের স্কুল বাসের আওয়াজও কানে পৌঁছয়নি। ইশশ অর্ণব থাকলে আজ নির্ঘাৎ বকুনি খেত জয়ী।
এতক্ষণ কোন জগতে চলে গেছিল সে….সেই ভেবে মনে মনে হেসে উঠলো।
ছেলেকে খেতে দিয়ে গাড়িটা শোকেসের মাথায় তুলে রাখে জয়ী। ছেলে ক্লাস থ্রি-তে উঠে গেলো, তবুও তার মধ্যে থেকে ছেলেমানুষী ভাবটা এখনও গেলো না।
অত্রির গাড়ির থেকে দুই বন্ধুকে হাতে তুলে নেয় জয়ী,
ড্রেসিং টেবিল থেকে অর্ণবের ব্রুটের শিশি থেকে দু’বার স্প্রে করে ওদের গায়ে আর তারপর বসবার ঘরের কোণে রাখা অত্রির এস্রাজের কানে দুটোকে বেঁধে দিলো।
গোলাপী আর নীল রাখী দুটোর সুগন্ধ আবারও ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে।
কখন যেন নিজেই গোলাপি রাখী হয়ে গেলাম ….