সর্বানী ঘোষ বাসু
ঋতুপর্ণ ঘোষকে নিয়ে লিখতে বসলে, শব্দ কিরকম কম পড়ে। আসলে আমার কাছে ঋতুপর্ণ ঘোষ একটা আবেগের নাম। বিশ্ব বিখ্যাত বাঙালী পরিচালক, বিদগ্ধ পন্ডিত, পরম রবীন্দ্র-অনুরাগী, বিচক্ষণ অভিনেতা অথবা স্পষ্ট বক্তা এক বিরল ব্যক্তিত্ব – তাঁর এই সব পরিচয়কে ছাপিয়ে আমার কাছে যিনি সবচেয়ে নিজের হয়ে ধরা দেন, তিনি প্রবল আবেগময় সংবেদনশীল এক মানুষ। তাঁর সেই আবেগ প্রতিমুহূর্তে ধরা দেয় তাঁর লেখায়, তাঁর ছবির বিষয় নির্বাচনে, তাঁর কথায়, তাঁর মতামত প্রকাশে এবং তাঁর অভিনয়ে।
” আঘাতকে যে পুষে রাখতে ভালোবাসে, ব্যথার শাস্তি তার চিরকালের”। ফার্স্ট পার্সনের পাতা থেকে উঠে আসা এ তাঁরই কথা এবং আক্ষরিক অর্থেই তাঁর জীবনের কথা। নারী-পুরুষের দ্বৈত সত্বার মাঝে আটকে পড়া এক চরম আবেগ প্রবল মন তাঁকে বারবার রক্তাক্ত করেছে, বিদ্রোহী করেছে এবং সর্বোপরি ব্যতিক্রমী করেছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের যে সামাজিক বঞ্চনা, অপমান, অবমাননা এবং লজ্জা নিয়ে প্রতিমুহূর্তে বেঁচে থাকার লড়াই করতে হয়, ঋতুপর্ণ হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের সকলের প্রতিবাদের কন্ঠস্বর। তাঁর ছবি, তাঁর লেখা, তাঁর বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে তাদের অপমানিত জীবনের কথা এবং তাদের প্রতি তথাকথিত “মূল স্রোতের মানুষদের নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যের কথা। তিনি বলেছেন – ” এই লজ্জা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার, আমাদের বড় হওয়ার এবং মূল স্রোতকেই ‘একমাত্র ‘ বলে চেনার। ” আরেকটি প্রেমের গল্প ” ছবিতে কিংবদন্তি ” পুরুষ রাণী ” চপল ভাদুড়ীর কম বয়সের চরিত্র চিত্রায়নে অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাদের চোখ ভিজিয়ে দেন।
“বনমালী তুমি পরজনমে হ’য়ো রাধা “….
পুরুষের শরীরে আটকে থেকে নারী-হৃদয় নিয়ে বেঁচে থাকা একটা মানুষের আর্তি, যন্ত্রণা আর অসহায়তা দর্শককে কাঁদায়, ভাবায় আর কোথায় যেন একটা বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় – আমরা, এই মূল স্রোতের মানুষেরা কি সত্যিই এতটাই অসার, এতটাই উদাসীন? একটা মানুষের যোগ্যতা, প্রতিভা, তার মনের সংবেদনশীলতা, এই সব কিছুকে ছাপিয়ে কি শুধু প্রধান হয়ে ওঠে তার বহিরঙ্গের রূপটাই?
কি জানি….
একবুক অভিমান নিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ চলে গেছেন। মা, বাবার মৃত্যুর পর থেকে ক্রমশ একা হয়ে আসা এই কিংবদন্তি পরিচালক আস্তে আস্তে পর্দাগুলো টেনে দিচ্ছিলেন পৃথিবীর জানলার বুকে। “রবিবার ” এর সম্পাদকীয়তে তাঁর লেখা “ফার্স্ট পার্সন” পড়ার জন্য আমরা যারা উদ্বেল হয়ে থাকতাম, তারা জেনেছিলাম যে তিনি ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন জাগতিক সব কিছু থেকে। পুজোর আগের একটি সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন – “কত লোকে জগজ্জননীর কাছে কত কি চায়! আমি চাই শুধু প্রতি রাতের নিশ্ছিদ্র মৃত্যু”।
কিন্তু তিনি জানতেন না, হয়তো জেনে যেতে পারেন নি, যে মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। মধ্যবিত্ত বাঙালির অনেকখানি শিল্পচেতনা জুড়ে, বোধের জায়গা জুড়ে, আবেগের আলোড়নকে ঘিরে আজও তিনি ভীষণভাবে জীবিত। আমার মতো আরো অগণিত মানুষ, যাঁরা কখনো তাঁকে চোখে দেখিনি, আমাদের কাছেও তিনি এক পরমাত্মীয়; বড় বেশি আপনজন, যাঁর চলে যাওয়া একটা ব্যক্তিগত ক্ষতির পর্যায়ে পড়ে। কারণ ওই যে বললাম, ঋতুপর্ণ ঘোষ একটা আবেগের নাম, আর আবেগের কখনো মৃত্যু হয় না ।।
Sarbani Ghosh Basu
She is a teacher and a special children educator. Associated with performing arts. An anchor and a content writer. Co-partner in Romoni’s (Boutique).
Opurbo,mon chuye gelo ,monta bhari hoye gelo.