Home বিবিধ, প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ ও পল্লীজীবন
বিবিধপ্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথ ও পল্লীজীবন

মেরী খাতুন

যৌবনে জমিদারি পরিচালনার কাজে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ আসেন। তখনই তাঁর বয়স ত্রিশ বছর।  সে সময়ে পাবনার শাহজাদপুর, রাজশাহীর কালিগ্রাম এবং নদিয়ার বিরাহিমপুর-এই তিনটি পরগনায় ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ছিল।

শিলাইদহ কুঠিবাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ থাকতেন। কালিগ্রাম পরগনার সদর কাছারি ছিল পতিসরে। পতিসরের অনতিদূরে নাগর নদী। এখানে কোন কুঠিবাড়ি ছিল না। মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথ পতিসরে এসে নাগর নদীর উপরে তাঁর “পদ্মা” কোটে থাকতেন।

গ্রাম বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে সেই হলো তাঁর প্রথম পরিচয়।

দৈনন্দিন কাজকর্ম ও প্রজাদের সঙ্গে মেলা-মেশার মধ্য দিয়ে পল্লীজীবনের ভালো- মন্দ  সবকয়টি দিক তাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টিতে ধরা দিয়েছিল। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমারের ভাষায়: “জমিদারি পরিদর্শন ও পরিচালনা করিতে আসিয়া তিনি হাসি-কান্না সুখ-দুঃখ ভরা মানুষকে তাহার যথার্থ স্থানে দেখিতে পাইলেন। উত্তরবঙ্গ বাস করিতে আসিয়া বাংলার অন্তরের সঙ্গে তাঁহার যোগ হইল–মানুষকে তিনি পূর্ণদৃষ্টিতে দেখিলেন।”

গ্রামবাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষী-মজুরদের অবস্থা ছিল হতদরিদ্র।  সারা বছরই অভাব-অনটনের মধ্যে তাঁদের দিন কাটত। লেখা-পড়ার বিশেষ বালাই ছিল না। অধিকাংশই ছিল নিরক্ষর।  শোচনীয় দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও রোগের জালায়  গ্রামবাংলায় তখন প্রাণের সাড়া ছিল না।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি রেলপথ-নির্মাণ শুরু  হওয়ায় দেশের স্বাভাবিক জলনিকাশী ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে জলা জমিতে মশার আস্তানা বাড়ে। গ্রামে-গ্রামে ম্যালেরিয়া তান্ডব শুরু হয়।চিকিৎসা বা রোগ-প্রতিরোধের বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ঘরে-ঘরে লোকজন অসুখ-বিসুখে ভুগত। জড়ি-বুটি, কবজ-মাদুলি ও জলপড়াই ছিল অসহায় দৈব-নির্ভর গরীবদের ভরসা। কলেরা বসন্তের মহামারীতে অনেক সময় গ্রামকে-গ্রাম উজাড় হয়ে যেত।

তাই তখন নাগরিক জীবনের সুখ-সুবিধার লোভে জমিদার ও সম্পন্নঘরের অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসেন। তাঁরাই ছিলেন পল্লীসমাজের শীর্ষস্থানীয়। গ্রামের টোল-পাঠশালা, জলাশয়, রাস্তাঘাট, মন্দির-মসজিদ–প্রায়ই সবকিছুই ছিল এঁদের উপর নির্ভরশীল। এর ফলে পল্লীজীবনে বিপর্যয় দেখা দেয়। সমাজব্যবস্থাও ক্রমেই শিথিল হয়ে আসে। জীবিকার সন্ধানে গ্রামের ভূমিহীন, চাষা-মজুর অনেকে শহরে ভীড় করে, কল-কারখানায় কাজ নেয়, দিন-মজুরি শুরু করে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উক্তি: “কর্তী শহরে যায় কাজ করতে, ধনী শহরে যায় ভোগ করতে, জ্ঞানী শহরে যায় জ্ঞানচর্চা করতে, রোগী শহরে যায় চিকিৎসা করতে; এটা ভাল না মন্দ সে তর্ক করা মিথ্যা–এতে ক্ষতিই হোক আর যাই হোক এ অনিবার্য।”

শিলাইদহ থাকাকালে প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটা সহজ সরল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। জমিদারিকে শুধু খাজনা আদায়ের ব্যবসা হিসাবে তিনি কোনোদিনই মেনে নেন নি। প্রজারা নির্ভয়ে তাঁর কাছে আসত,নিজেদের নালিশ-আবদার জানাতেই, খোলা মনে সুখ-দুঃখের কথা বলত। গ্রামের মানুষ ঘড়ি ধরে চলে না। তাদের সঙ্গে কথায়-কথায় কোনো-কোনো দিন কবির সময়মত স্নান-আহারের অবসর ও মিলত না। প্রজাদের সঙ্গে তাঁর এই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আজীবন বজায় ছিল।

শিলাইদহ থাকাকালে নিরানন্দ পল্লীজীবনের দুঃখ-দুর্দশা, দারিদ্র্য ও হতাশা, গ্রামবাসীদের পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা, বিদ্বেষ, ছলনা সবকিছু কবি নিজের চোখে দেখেছেন। অসহায় গ্রামবাসীদের জন্য কিছু করবেন এই ভাবনায় তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে উঠত। কবির নিজের কথায়:”যতদিন পল্লীগ্রামে ছিলেন তাকে তন্ন-তন্ন করে জানবার চেষ্টা আমার মনে ছিল।… ক্রমে এই পল্লীর দুঃখ-দৈন্য আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, তার জন্য কিছু করব এই আকাঙ্ক্ষায় আমার মন ছটফট করে উঠেছিল। তখন আমি যে জমিদারি ব্যবসা করি, নিজের আয়-ব্যয় নিয়ে ব্যস্ত, কেবল বণিক-বৃত্তি করে দিন কাটাই, এটা নিতান্তই লজ্জার বিষয় মনে হয়েছিল।  তারপর থেকে চেষ্টা করতুম–কী করলে এদের মনের উদ্বোধন হয়।, আপনাদের দায়িত্ব এরা আপনি  নিতে পারে।” দান-খয়রাতির তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না।

শিলাইদহে কবি পল্লী-সংস্কারের কাজে নিজেই হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু নতুন কিছু করতে গেলেই গ্রামবাসীরা সন্দেহ করে। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশ কয়েকটি তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা নিজেই বলেছেন।  শিলাইদহের পাশে এক গ্রামে নিদারুণ জলকষ্ট ছিল। সে গ্রামে কোনো পুকুর বা কুয়ো ছিল না। রবীন্দ্রনাথ একদিন গাঁয়ের লোকদের ডেকে বললেন তারা যদি গায়ে খেটে একটা কুয়ো খুঁড়ে দেয় তবে তা বাঁধিয়ে দেওয়ার খরচ তিনি দেবেন। কিন্তু তারা তাতে মোটেই রাজি হয় নি, তারা বলেন:”আমরা কি এতই বোকা? নিজেরা গায়ে খেটে কুয়ো খুঁড়ে দেব আর জলদানের পুণ্যি পাবেন জমিদারবাবু? এ যে মাছের তেলে মাছ ভাজা।” এ ধরনের আরো কত ঘটনা আছে।

শিলাইদহে প্রজাদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে রবীন্দ্রনাথ পতিসরে পল্লীসমাজ গঠনে উদ্যোগী হন। গঠনমূলক কাজে প্রজাদের উৎসাহ ছিল এবং কিছুকালের মধ্যেই নানা ধরনের পল্লী-উন্নয়নের কাজ গ্রামে-গ্রামে  ছড়িয়ে পড়ে। একাজে রবীন্দ্রনাথের প্রধান সহযোগী ছিলেন আদর্শ কর্মী অতুল সেন। কবি-নির্দিষ্ট গ্রামের কাজের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত পাঁচটি: ১) পল্লীবাসীদের চিকিৎসা-বিধান। ২) প্রাথমিক শিক্ষাবিস্তার। ৩) পূর্তকাজ ও জনস্বাস্থ্যমূলক প্রচেষ্টা অর্থাৎ রাস্তা-নির্মাণ ও মেরামত, কূপখনন, এঁদো ডোবা ও পুকুর সংস্কার, জঙ্গল পরিস্কার প্রভৃতি। ৪) ঋণদায় থেকে দরিদ্র চাষীদের রক্ষা এবং ৫) সালিশী বিচারের মাধ্যমে গ্রাম্য কলহ-বিবাদের নিষ্পত্তি।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাজের অগ্রগতি ছিল সন্তোষজনক। এর আগে কখনও গ্রামবাসীদের সম্মিলিত চেষ্টায় গ্রামবাংলায় এমন ধরনের গঠনমূলক কাজ আর হয়নি। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এ ব্যাপারে খুবই আশাবাদী ছিলেন।

কিন্তু কবির আশা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। কিছুকাল পরেই বিপ্লবী সন্দেহে অতুল সেন ও তাঁর সহকর্মীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং সরকারি আদেশে তাঁরা অন্তরীন হন। রবীন্দ্রনাথ এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় খুবই আঘাত পেয়েছিলেন,  কিন্তু তা চূড়ান্ত বলে কোনোদিন মেনে নেননি। পরবর্তীকালে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা ও গ্রামোন্নয়নের কাজে এরই সুস্পষ্ট প্রতিফলন চোখে পড়ে।

সমকালীন কাব্য ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবির পল্লীচিন্তার সুস্পষ্ট ছাপ পড়েছে। ‘চিত্রা’ কাব্যের, ‘এবার ফিরাও মোরে’ (১৮৯৩) কবিতায় শোষণ ও বঞ্চনার শিকার ভাগ্যহত মানুষের দুঃখ-আর্তির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে তোলার কথা কবি বলেছেন। এসময়ের কবির আরও কয়েকটি গান ও কবিতা এপ্রসঙ্গে স্মরণযাগ্য। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন,’ ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছ আপমান’ কবিতাগুলি সবই ১৩১৬ আষাঢ়ে রচিত। গ্রামবাংলার পটভূমে গাঁয়ের মানুষের সুখ-দুঃখ-ভরা জীবনের কাহিনী নিয়ে কবির “গল্পগুচ্ছ” একালেই রচিত।

কবির অজস্র রচনায় পল্লী-প্রকৃতির সৌন্দর্যের অনুপম চিত্র ছড়িয়ে আছে। তা হলো পল্লীর বাইরের রূপ।  পল্লীর অন্তরের কথা ‘ছিন্ন পত্রাবলীর(১৮৯১-৯৪) অনেক পত্রেই সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত (১৩১৪-১৬) ‘গোরা’ উপন্যাসে কবির পল্লীচিন্তা, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও বেদনাবোধ গোরার চিন্তা, চেষ্টা, অভিজ্ঞতা ও বেদনারূপে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

শিলাইদহে থাকাকালে রবীন্দ্রনাথ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, প্রজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলা-মেশা করতেন,তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতেন।কিন্তু পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে চলে আসার পর স্থানীয় গ্রাম বা গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সুযোগ ছিল না। কারণ খ্যাতির বিড়ম্বনা। রবীন্দ্রনাথের নিজের কথায়:” আমার বিপদ হয়েছে এখন–অখ্যাত ছিলেন যখন, অনায়াসে পল্লীর মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছি। কোনো বেষ্টন ছিল না–” ওই কবি আসছেন,” ওই রবি ঠাকুর আসছেন ‘ধ্বনি উঠত না। তখন কত লোক এসেছে, সরল মনে কথা বলেছে। কত বাউল, কত মুসলমান প্রজা, তাদের একান্ত হৃদ্যতায় আলাপ-পরিচয় হয়েছে-সম্ভব ছিল তখন। ভয় করেনি তারা।…..আমি পল্লীর পরিচয় হারিয়েছি নিজের পরিচিত হয়ে। বাইরে বেরোনো আমার পক্ষে দায়, শরীরেও কুলোয় না। আমার পল্লীর ভালোবাসা বিস্তৃত করতে পারতুম, আরও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারতুম, কিন্তু সম্মানের দ্বারা আমি পরিবেষ্টিত, সে পরিবেষ্টন আর ভেদ করতে পারব না। আমার সেই শিলাইদহের জীবন হারিয়ে গেছে।”

(০৭/০৮/২০২২)

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!