সুদেষ্ণা চক্রবর্তী
(১)
পঁয়ত্রিশ বছর পর আজ সেই দিনটা এসে গেলো।
আজকে অবসর নেবার পালা কিংশুকবাবুর।
নীলমণি উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস ঘরে ছোট্ট অনুষ্ঠান রাখা হয়েছে ছুটির পর।
অনুষ্ঠানের শেষে সকলেই কিছু না কিছু উপহার তুলে দিচ্ছেন ওনার হাতে।
মনটা আজ বড্ড ভারাক্রান্ত।
চোখের কোণে জল আসতেই সেটা রুমাল দিয়ে মুছে আড়াল করে নিলেন কিংশুক বাবু।
ঘড়িতে চারটে দশ। আজ সিঁথি এলো না তো। এমনটা হবার তো কথা নয়। বারবার মনে হয়েছে আজ সিঁথির কথা।
বার বার মুঠোফোনটাকে হাতে নিয়েও শেষ পর্যন্ত ফোন করেনি কিংশুক।
কি হলো মেয়েটার?
বাড়িতে কি কোনো ঝামেলা হলো।
সাতপাঁচ ভাবতে থাকে কিংশুক।
(২)
সিঁথি গত আটাশ বছর ধরে এই বিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করেন।
কিংশুকবাবুর থেকে বছর পাঁচেকের ছোট হবে মেয়েটি।
ভারি সুন্দর স্বভাব। মুখে হাসি লেগেই থাকে।
বিদ্যালয়ের সবাই খুব পছন্দ করে সিঁথি ম্যাডামকে।
আজ বিদ্যালয়ের শেষ দিন কিংশুকের তা সত্বেও সিঁথির আজ না আসাটা কিংশুক কিছুতেই মানতে পারছেনা।
অবসর প্রাপ্তির উপহার গুলো সব গুছিয়ে পিয়ন অরুনের হাতে দিয়ে বললেন “এগুলো রেখে দাও। কোনো একদিন সময় করে এসে নিয়ে যাবো।”
সাথে নিলেন শুধু একটি পছন্দের কলম আর ক্লাস ইলেভেনের এক ছাত্রের আঁকা কিংশুকবাবুর পোট্রেটখানা।
ধীর পায়ে এগোতে গিয়ে বিদ্যালয়টিকে শেষবারের মতন দেখলেন কিংশুকবাবু।
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে বাইরের গেটের দিয়ে পা বাড়ালেন কিংশুকবাবু।
(৩)
“বড্ড দেরী হয়ে গেলো তাই না?”
“তোমার কথাই ভাবছিলাম সিঁথি”,এই বলে রঙিন কাগজে মোড়ানো একটি বই সিঁথির হাতে দিল।
“আজ তো আমার আপনাকে কিছু দেবার কথা কিংশুকদা”।
“দিয়েছো তো।
এই এতগুলো বছরে আমি তোমাকে দেখে শিখেছি কি করে ঘর স্বামী মেয়ে চাকরি সবটা সামলেও সুন্দর বন্ধুত্ব রাখা যায়। কি করে হাসিমুখে সবটা জয় করা যায়। এই হাসি মুখটা আমাকে প্রতিদিন নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।”
মুখটা লাল হয়ে যায় সিঁথির।
কিংশুকের চোখে চোখ পড়তেই মুখটা নিচু করে নেয় সিঁথি।
“আজ স্কুল আওয়ারে আসলে না কেনো? আর কেনই বা দেরি করলে?”
মুচকি হেসে ব্যাগ থেকে একটা ছোট মতন বাক্স আর একটা টিফিন কৌটো বের করে সিঁথি বলে, “এইটা বানাতে গিয়েই আজ ইচ্ছে করেই স্কুলটা অফ দিলাম।
“কি আছে এতে?”
“রাতে সপরিবারে খেতে বসেই দেখবেন”।
“ভাল থেকো তুমি। আর গানটা সময় পেলে গেও।”
“আপনিও আপনার এই অখন্ড অবসরে পুরোনো অভ্যাসে ফিরে যাবেন কথা দিন”।
অবাক হয়ে কিংশুক সিঁথির মুখের দিকে তাকায়।
হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরার জন্য অটো স্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়ায় সিঁথি আর কিংশুক উল্টো পথে হাঁটা দেয় পাঁচটা কুড়ির বাসটা ধরবে বলে।
(৪)
বাসে জানলার ধারের সিটে বসে বাইরের আকাশটাকে দেখে কিংশুক।
পঁয়ত্রিশটা বছরের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে এই যাতায়াত।
আগামীকাল থেকে সবটা অন্যরকম।
সেবার প্রথম শিক্ষক দিবস সিঁথির এই বিদ্যালয়ে।
লম্বা একটা বেণী,ছোট একটা কালো টিপ আর সাদা শাড়ি পরা মুখটা মনে পড়ে গেলো মেয়েটার।
কি অপূর্ব গাইলো
“আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে এই আকাশে।”
সাতাশ বছর আগের কথা তবুও কিংশুকের সবটা পরিষ্কার মনে আছে।
সেইদিন সব ছাত্রছাত্রীরা মিলে বলেছিল “স্যার, একবার বাজান মাউথ অর্গানটা।”
“ওটা গতবারের এক্সকার্শনে লাভা থেকে ফেরার পর আর খুঁজে পাইনি রে। আমার সেই ছাত্রজীবনের সখের মাউথ অর্গানটা হারিয়ে ফেলেছি।”
ওই একটাই তো সখ ছিল কিংশুকের। বড্ড প্রিয় ছিল মাউথ অর্গানটা।
ওটা হারিয়ে যাবার আর কেনাই হয়নি কখনো।
পুরোনো কোন অভ্যাসে ফিরে যেতে বললো সিঁথি????
(৫)
রাতে খাবার পর কিংশুক ভাবে কবে যে মেয়েটাকে বলেছিল “ভাপা ইলিশ তার বড্ড প্রিয়। মা মারা যাবার পরে ওই স্বাদ ভুলেই গেছি।”
আজ হঠাৎ মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ মনে পড়ে গেলো এতগুলো বছর পর।
সব মনে রেখেছে সিঁথি।
নিজের ঘরে এসে ছোট্ট বাক্সটা খোলে কিংশুক।
একটা ছোট চিরকুটে লেখা, “এটা আবার বাজাবেন, কিংশুকদা”।
কিংশুক হাতে তুলে নেয় মাউথঅর্গানটা।
বাইরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়।
চাঁদের আলোয় চারিদিক উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
মাউথ অর্গানে সুর বাজছে, “এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়”।
রাতে সব কাজ সেরে রঙিন মোড়ক থেকে
“শেষের কবিতা” খুলে নিয়ে বসে সিঁথি।
“রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।”
কিছু উপহারের মূল্য হয় না। তাতে জড়িয়ে থাকে, একে অপরের অনুভব।
চিত্রাঙ্কন : সৌমেন দাস