ঊর্মি বসুন্ধরা দুহিতা
বৃষ্টি হচ্ছে আজ সকাল থেকেই ফিসফিস করে। আমার বহুতল বস্তির বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে উল্টোদিকের আলোয় সাজানো দূরের বাড়িটাকে। সকাল থেকেই বাজছে সানাই, বোধহয় কারুর বিয়ে। দিনের বেলাতে যে বড় কদম গাছ আর অমলতাস দুটিকে চোখে পড়ে, বাইরের নিওনের আলো আঁধারির মাঝে তাদের বৃষ্টি স্নাত রূপটা ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা এখন—-কিরকম যেন ঝুপড়ি ঝুপড়ি—-আমার এখনকার ভাবনাগুলোর মতো।
আলো নিভতে থাকে ধীরে ধীরে। সদ্যস্নাত রাজপথ হ্যালোজেনের উজ্জ্বল আলোতেও কেমন যেন নিঃসঙ্গ,ক্লান্ত ,অবসন্ন। সমস্ত শব্দ সমুদ্রের তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ক্রমবিলীন হিজিবিজি, বিড়বিড়ানির মতো থেমে আসে। সানাইয়ের সুর তখন মিশে যায় পাতার কিনারা থেকে ঝরে পড়া জলের টুপটাপ শব্দে, দূরের মালগাড়ির আওয়াজে, মিশে যায় গহীন মনের গোপন কোনে সযত্নে তুলে রাখা হারিয়ে যাওয়া প্রেমের বিষাদের সুরে ……এতগুলো বছর পরেও যা আরো সবুজ, আরো নবীন। আসলে কোন প্রেমেরই বয়স হয় না, যদি সে প্রেম আসল প্রেম হয়।
জানিস, তোকে আজ বড় মনে পড়ছে। তুই মানেই তো ছিল অবিরল গানের ঝরণা। দূর থেকেই ভেসে আসতো তোর খোলা গলার গান, তোর হাসি…… আসলে তুই ছিলিস জগতের সমস্ত মান্য নিয়মের বিরূদ্ধে জাজ্জ্বল্যমান বিদ্রোহ। হাসির তোড়ে পারিবারিক, আর্থিক, সামাজিক সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকেই বর্ষায় ব্রহ্মপুত্রের মতো ভাসিয়ে নেওয়া এক উজ্জ্বল যৌবন। তোর সেই ছবিটাই কিন্তু মনের ফ্রেমে এঁটে আছে। তারপর অনেক ছবি জমেছে তার ওপর পরতে পরতে, কিন্তু সেই প্রথম ছবিটা মুছতে পারেনি অন্য কোন ছবিই। অবিশ্বাস, অস্থিরতা, অকৃতজ্ঞতার কোন ধূলোর আঁচড় সেই ছবিটাকে নষ্ট করতে পারেনি।
আজ বৃষ্টির এই ফিসফিসে কথা, এই সানাই এর মন কেমন করা সুর, গাড়ির ক্ষীণ আওয়াজ মূহুর্তের মধ্যে মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল কলেজ জীবনের ফাইনাল ইয়ারের সময়ের ডুয়ার্স, মূর্তি নদীর পাড়, দুধার থেকে কুড়িয়ে আনা সাদাটে নুড়িচলা কাঁচাপথ। মনে ফিরে আসছিল শিশিরের গন্ধ, ক্লোরোফিল উজ্জ্বল গাছগাছালি, মন উদাস করা ডাক ডেকে যাওয়া পাখির দল, একঝাঁক প্রজাপতি আর হারিয়ে যাওয়া কয়েকটা মুহূর্ত। সেদিন শ্রাবণের সেই মেঘলা দিনে সবার হুল্লোড়ের মাঝে এক ফাঁকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে অস্ফুট বলেছিলি তুই , ” আসবি তুই আমার জীবনে ঝড় হয়ে? উড়ে যাবো দুজনে দুধারে শুকনো পাতার ঝর্ণা বইয়ে দিয়ে এই হলুদ সবুজ কালো বনে? আসবি? আমি কিছু বলতে পারিনি তখন। দুহাতে প্রাণপনে জড়িয়ে ধরেছিলাম তোকে, হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে তোর বুকের মাঝে। মনে মনে বলেছিলাম, “আসবো …. আমায় ছেড়ে যাবি না তো কখনো?”
কাউকে কিছু না জানিয়ে, কোন হদিস না রেখে হঠাৎই কোথায় চলে গেলি বলতো? অভিমানে নাকি ঘরছাড়া কোন বাউলের গানের টানে?…. আজও বুঝে উঠতে পারিনি। জানিস, আমি তোকে চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু সব চিঠি বোধহয় লাল বাক্সের জন্য নয়। কিছু কিছু চিঠি থাকে, যা চিরজীবন ধরে লিখেই যেতে হয় শুধু। তারপর কাটাকুটি করতে হয়, ছিঁড়তে হয় বারে বারে, আবারো লিখতে হয় কিন্তু ডাকে পড়ে না কখনো। সেদিনের সেই জীবনের সবচেয়ে জরুরি, দামী চিঠিটা পোস্ট অফিসের লাল বাক্সটায় না ফেলে কখন যে নিজেকেই হারিয়ে ফেললাম তা এই মধ্য যৌবনে এসে বুঝলাম।
হঠাৎ করে জীবনের এক বাঁকে দুজনের আলাদা হয়ে গেলাম। তুই চলে গেছিস, কিন্তু তোর গান রয়ে গেছে। রয়ে গেছে তোর সেই চুম্বনের উষ্ণতার ‘ওম’ এখনও আমার বুকের মাঝে….. একটুও নিভে যায়নি প্রাত্যহিকতার মালিন্য থেকে। আজ এই নিদ্রা হীন রাতে তোর সেই গান বারবার ফিরে আসছে। আকাশের তারাগুলো যে আজও চেনা হলো না রে …. তোর মতোই তারাও অচেনাই রয়ে গেলো। এখনো কত কথা না বলাই রয়ে গেছে…. তারাও তোর অপেক্ষায়। আমাদের সেই উদ্দাম ভালোবাসা আজও একাকী বয়ে বেড়াই। ভালোবাসার ফসিল দেখেছিস কখনও?
এখনো আমার দুচোখ খুঁজে বেড়ায় তোকে, আমি জানি তুই আসবি একদিন…… মৃত ভালোবাসার গর্ভেই যে নতুন ভালোবাসার জন্ম নেয়। না হলে যে মিছিমিছি ভালোবাসা, মিছিমিছি সেই চুমু খাওয়া, মিছিমিছি কাছে যাওয়া …… সব মিছিমিছি …… তুই আসবি বলেই তো সোনালী স্বপ্ন ভিড় করে আসে চোখে…. আসবি?
Opurbo,khub bhalo laglo ,kintu boro monkamon kora.
valo laglo
ভালো লেগেছে জেনে আমার ভালো লাগলো। ধন্যবাদ আপনাকে
ধন্যবাদ
ভালো লেগেছে জেনে আমার ভালো লাগলো। ধন্যবাদ আপনাকে
মনোগ্রাহী ।
ধন্যবাদ🙏💕
বহু জনের জীবনের ফেলে আসা সবুজ দিন আর ছিড়ে যাওয়া পবিত্র বাঁধনের স্মৃতি জাগবে এই লেখা পড়ে… আর হবে খানিক প্রাণের আরাম।
দারুন…
ভালো লাগা.