গোপা মিত্র
অরুণাচল প্রদেশ
।। প্রথম পর্ব ।।
স্বপ্ন – প্রত্যেক মানুষই দেখে আর আমিও তার ব্যতিক্রম নই। স্বপ্নেরই বাস্তব রূপ বলা যায় লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যের পিছনেই মানুষ ছুটে চলে টাকা, বাড়ি, গাড়ির সন্ধানে। আমিও আমার স্বপ্নের টানে বারবার ছুটে গেছি ডিসেম্বর, জানুয়ারী মাসের কন্কনে ঠাণ্ডায় হিমালয়ের আনাচে কানাচে। কিন্তু স্বপ্ন কি খুব সহজেই বাস্তব রূপ পেতে পারে? তবুও আশা ছাড়িনি। আবার ছুটেছি, পুরনো বা নতুন কোনোও পার্বত্য প্রদেশে। অবশেষে স্বপ্নপূরণ – একবার অন্ততঃ তুষার বারিধারায় সিক্ত হওয়ার স্বপ্ন।
২০১০ সালের নভেম্বরে আমার দিল্লীর বোন আনু কলকাতায় এসেছে – স্বামী সুনীত ও মেয়ে জিঙ্কুকে নিয়ে। বোনটির (মেজবোন) বাড়ির এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। বোনটির বাড়ি আর আমাদের বাড়ি রাস্তার এদিক আর ওদিক। আনু, বোনটির বাড়ি এসেছে শুনে আমি গেছি আনুদের সঙ্গে দেখা করতে – আনু আমায় বললো, “দিদি, অরুণাচল যাবে? আমরা যাচ্ছি, বোনটিও যাবে বলেছে, তুমি যদি যাও, খুব ভালো হবে।”
আমি তো সঙ্গে সঙ্গেই রাজি – কতোদিন থেকে অরুণাচল যাওয়ার ইচ্ছে, উপযুক্ত সঙ্গীর অভাবে হচ্ছেই না।
অরুণাচল যাওয়ার জন্যে কিছু প্রস্তুতি দরকার – প্রথমতঃ Inner Line Permit, যা একমাত্র সল্টলেকের অরুণাচল অফিস থেকেই পাওয়া যাবে। তারপর তেজপুর পর্যন্ত Plane-এর টিকিট – যা এক্ষুনি কাটতে হবে। আনু দিল্লী থেকেই এসব ব্যবস্থা করে এসেছে। বোনটিরাও যাবে শুধুমাত্র ক’দিনের জন্য – তার বেশী আর থাকতে পারবে না। কিন্তু বাকি আমরা; এরই সঙ্গে কাজিরাঙ্গা আর কামাখ্যা মন্দিরও ঘুরে আসবো – এরকমই আমাদের Plan ছিলো।
অরুণাচল ভবনে – Inner Line permit –এর দরখাস্ত দিয়ে আসা হলো, আবার অনুমতিপত্র নিয়েও আসা হলো। বোনটিরাও একইসঙ্গে ব্যবস্থা করে ফেললো। কলকাতা থেকে তেজপুর আনুদের সঙ্গে একই Plane-এ টিকিট কাটাও হয়ে গেলো।
এবার প্রতীক্ষা যাত্রার। মনে সংশয় আমার স্বপ্ন কি এবার বাস্তবায়িত হবে? আনুরা কি আর কয়েকদিন পরে ডিসেম্বর মাসে যেতে পারতো না – তাহলে হয়তঃ আমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো। অবশ্য আনুকে কিছু বললাম না। সত্যিই তো, ওদের কিছু অসুবিধা থাকতেই পারে।
যাত্রার আগের দিন আনুর এক অত্যন্ত স্নেহভাজন (পরে অবশ্য আমাদেরও স্নেহভাজন) সুমা তার ৩ বছরের মেয়েকে নিয়ে এসে গেলো। সে আজ রাতে থাকবে বোনটির বাড়ি। কাল আমাদের সঙ্গে অরুণাচল যাবে। সুমাকে শিক্ষিতা, বিদূষী বললেও কম বলা হয়। কারণ, সে দেশী, বিদেশী বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারিনী। বর্তমানে সে একটি Multinational Company-র উচ্চপদে কর্মরতা।
টাটা সুমো গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেছে – রাত ৩টেয় আমরা রওনা হবো। ভোরের Flight। কারুর চোখেই ঘুম নেই – ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারবো তো?
নভেম্বরের ১২ তারিখে ভোরবেলা শুরু হলো আমাদের যাত্রা। আমরা অর্থাৎ আমি, কল্যাণ, বোনটি, সঞ্জয় (বোনটির স্বামী), আনু, সুনীত, জিঙ্কু (আনুদের মেয়ে), সুমা আর ওর মেয়ে – মোট ৯ জন। ছোট প্লেন ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমাদের পৌঁছে দিলো – তেজপুর। সেখানে আমাদের জন্য দুটো গাড়ি অপেক্ষা করছিলো – এসবই আনুর ব্যবস্থা।
আমাদের যাত্রা শুরু হলো অরুণাচলের পথে। আমি যখন যেখানেই বেড়াতে গেছি – সবসময়েই Homework অর্থাৎ সেই জায়গাটা সম্বন্ধে বেশ ভালোভাবে জেনে গেছি। কিন্তু এবার এমন হঠাৎ যাওয়া ঠিক হয়েছে যে, এসব জানবার আর সময়ই পাইনি। শুধু এটুকু জানতাম যে, অরুণাচল প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য সমৃদ্ধ খুব সুন্দর একটা পার্বত্য অঞ্চল। সেখানে যে রয়েছে অপূর্ব এক ‘সেলা পাস’ – বমডিলা থেকে তাওয়াং যেতে আসতে যে সেটা পেরোতে হয় – এসব কিছুই আমার জানা ছিলো না।
অরুণাচলের প্রবেশদ্বার ভালুকপং, তেজপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আমাদের প্রথম যাত্রাবিরতি এখানেই। আমাদের Inner Line Permit পরীক্ষার পর আমাদের যাত্রার অনুমতি মিললো। মনে রাখতে হবে যে, এখান থেকেই আমাদের সমস্ত Prepaid মোবাইল পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেলো। একমাত্র বোনটির Post Paid BSNL পরিষেবা চালু ছিলো।
সূর্যের প্রথম আলোর স্পর্শে জেগে ওঠে এই দেশ – তাই এই নাম অরুণাচল। North East Frontier Agency (NEFA) – আগে ছিলো এই নাম। রাজ্যের দক্ষিণে রয়েছে অসম, নাগাল্যাণ্ড। কিন্তু বাকি ৩টি সীমান্তই যুক্ত ৩টি বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে – পূর্বে মায়ানমার, পশ্চিমে ভূটান আর উত্তরে চীন। তাই প্রতিরক্ষার দিক থেকে এই রাজ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। মাঝে মাঝে আবার চীন অরুণাচলের কিছু অংশ দাবী করে বসে। এই কারণেই এখানে মাঝে মাঝেই দেখা যায় মিলিটারী ছাউনি আর রাস্তায় মিলিটারী কনভয়।
কিছুদূর অগ্রসর হতেই আমাদের নজরে এলো কয়েক কিলোমিটার অন্তর আর্মি জওয়ানরা বন্দুক তাগ করে পথের ধারে ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে অচঞ্চল, আমাদের দেশের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে।
ভালুকপং-এর পরেই শুরু হয়ে গেলো পাহাড়ী রাস্তা। পাশেই চলেছে কামেং নদী – ভালুকপং-এ এর নামই ‘জিয়া ভরলি’। ৫ কিলোমিটার পরে টিপি অর্কিড রিসার্চ সেন্টারে আমাদের গাড়ি থামলো। এখানে রয়েছে কয়েকশো প্রজাতির অর্কিড, দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদ, গুল্ম ও লতা। কাচের ঘরে অর্কিডের সমারোহ – অবশ্য বিশেষ দেখা গেলো না। কারণ এখন অর্কিডের সময় নয়। শুধুমাত্র সাদা ও বেগুনী ফুলের দুরকম অর্কিড দেখলাম।
এখানে আসা অবশ্য ব্যর্থ হলো না। অনেকদিন আগে স্কুলজীবনে পড়া কলস উদ্ভিদ আর বেশ কিছু ঝুলন্ত বায়বীয় মূল দেখলাম। পাশাপাশি গোটা তিনেক কলসপত্রী উদ্ভিদ (Pitcher Plant) গাছে রয়েছে কলসীর মতো একটা অংশ। তার উপরে কোনোও পতঙ্গ বসলেই, সেটি পিছলে কলসীর ভিতরে পড়ে যায় ও সেখানের পাচক রস (Enzyme) পতঙ্গকে হজম করে সেই উদ্ভিদের খাদ্যচাহিদা মেটায়।
গাড়ি এবার সর্পিল পাহাড়ী পাকদণ্ডী পথে উপরে উঠতে শুরু করেছে। জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়, গভীর খাদ, মাঝে মাঝে কুলকুল ধ্বনিতে নেমে আসা কোনোও পাহাড়ী ঝর্ণা, আর নিচ দিয়ে বয়ে চলা দুরন্ত কামেং নদী সঙ্গে নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম বমডিলার পথে। সরু ধ্বসপ্রবণ রাস্তায় মাঝে মাঝেই ধ্বস নামছে আর সঙ্গে সঙ্গেই সদা সচেতন Border Road Organisation (BRO)-এর জওয়ানরা সেই ধ্বস সরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের দেরী হচ্ছে – কিন্তু উপায় নেই। রূপা, টেঙ্গা পার হয়ে অবশেষে প্রায় সন্ধ্যায় এসে পৌঁছলাম বমডিলায়। হোটেল আগে থেকেই Book করা ছিলো। আজ এখানেই রাত্রিবাস।
পশ্চিম অরুণাচলের গুরুত্বপূর্ণ শৈলশহর ৮২০০ ফুট উঁচু বমডিলা, ভালুকপং থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পর্বতবেষ্টিত এই শহরটি দোকানপাট, মনাস্ট্রি নিয়ে জমজমাট। ১৯৬২ সালে কিছুদিনের জন্য চীন এই শহরটি অধিকার করে নিয়েছিলো।
পরদিন আমাদের তাওয়াং যাত্রা। আগেই বলেছি, পথে পড়ে ১৩৭২১ ফুট উঁচু ‘সেলা পাস’। সেলা পাশের আবহাওয়া সদা পরিবর্তনশীল। সকালে আকাশ পরিষ্কার থাকলেও, দুপুরে যে কোনোও মুহূর্তে আবহাওয়া খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। সেক্ষেত্রে সেলা পাশ পার হওয়া দুঃসাধ্য হতে পারে। আমরা আর দেরী না করে ভারী প্রাতঃরাশ করে যতো শীঘ্র সম্ভব আমাদের যাত্রা শুরু করলাম।
কন্কনে ঠাণ্ডা হাওয়া, পথিপার্শ্বে জমে থাকা বরফ, কুয়াশা আর আকাশ ঢাকা ঘন মেঘের মধ্যে দিয়ে রাস্তা ক্রমশঃ উপরে উঠছে। হঠাৎ এ কি! কাচ বন্ধ গাড়ির চারিপাশে সাদা সাদা ও কি এসে পড়ছে? তুষারপাত হচ্ছে না কি? কি আনন্দ! কি আনন্দ!
আমরা সব গাড়ি থেকে নেমে সেই তুষারধারায় ভিজতে লাগলাম। আমার স্বপ্ন তাহলে এতোদিনে সত্যি হলো! আমিও সকলের সঙ্গে সেই তুষার ধারায় আনন্দ নিতে লাগলাম। ভাগ্যিস আনু এইসময়ে অরুণাচল আসার Plan করেছিলো। ও যে আমাকে এমনভাবে চমকে দেবে আমি ভাবতেও পারিনি।
এরপর সেলা পাশ। চতুর্দিকে উড়ছে বিভিন্ন রঙের ধর্মীয় পতাকা – লুংদার। সামনেই এক কংক্রীটের তোরণ – পার হয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম সেলা পাশে। সামনেই তুষারাচ্ছাদিত এক বিস্তীর্ণ প্রান্তর, তারই মধ্যে দণ্ডায়মান এক বরফাবৃত পর্বতশ্রেণী আর একটু দূরে আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে দেখছি মেঘ কুয়াশায় মাখা কালচে জলের এক জলাশয় – সেলা লেক বা প্যারাডাইস লেক। একেবারেই ঠিক নাম – প্যারাডাইস লেক! সত্যিই তো, আমরা এখন প্যারাডাইস বা স্বর্গেই তো রয়েছি।
কুয়াশা আর মেঘের চাদরে চারিদিকে ধোঁয়াশা, দূরের কিছুই আর দৃশ্যমান নয়। পায়ে পায়ে আমরা এগিয়ে চললাম সেলা লেকের দিকে। শুনলাম, রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে সেলা লেকে এসে পড়ে পাশের পর্বতশ্রেণীর ছায়া – সে না কি এক অপূর্ব দৃশ্য।
কতোক্ষণ কেটে গেছে, জানি না। কিন্তু এবার ফিরতে হবে। রাস্তা খারাপ, তাওয়াং পৌঁছতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। আমরা সকলেই তখন মোহগ্রস্ত, নিশ্চুপ। তুষারপাত হয়েই চলেছে। গাড়ি ধীরে ধীরে নিচে নামছে। রাস্তার পাশের বরফের মাঝে মাঝেই তখন দেখা যাচ্ছে ফার্ণ গাছের সারি।
অবশেষে সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে সূঁচফোটা কন্কনে ঠাণ্ডা আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে আমরা এসে পৌঁছলাম তাওয়াং।
এখানে এক গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা আনুই করেছিলো। কথা ছিলো তাদের ফোন করলে তারা দিক নির্দেশ করে দেবে। কিন্তু হা হতোস্মি! আনুর Post Paid মোবাইলও তখন বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনোও রাস্তাই আর খোলা নেই।
সারাদিনের পথক্লান্ত আমরা সেই বৃষ্টির মধ্যে কন্কনে ঠাণ্ডায়, সন্ধ্যাবেলায় হোটেল খুঁজতে বেরোলাম। অরুণাচল ট্যুরিস্ট বাংলো পূর্ণ। আমাদের এমন হোটেল চাই – যেখানে রয়েছে সংলগ্ন বাথরুম সহ চারটি দ্বিশয্যাবিশিষ্ট আরামদায়ক ঘর।
অবশেষে তেমন একটা মোটামুটি চলনসই হোটেল পাওয়া গেলো – কিন্তু অসুবিধা একটা রয়েই গেলো। তারা লাঞ্চ বা ডিনার দিতে পারবে না। লাঞ্চ আমাদের দরকার নেই, কিন্তু রাতের ডিনার? অবশ্য তারা পাশের হোটেল থেকে আমাদের রাতের খাবার এনে দিতে রাজি হলো।
ঘরে লেপ কম্বল, বাথরুমে গীজার সবই ছিলো। আমরা আসার সঙ্গে সঙ্গে ওরা প্রত্যেক ঘরে একটা করে লম্বা রুম হীটার জ্বালিয়ে দিয়ে গেলো। আমরা সকলে ফ্রেশ হয়ে, পাশের হোটেল থেকে আনা রুটি, তরকারী খেয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে চা-বিস্কুট খেয়ে, সারাদিনের মতো তৈরী হয়ে বাইরে এলাম। ইচ্ছে, বাইরে থেকে Heavy Breakfast সেরে রওনা হবো তাওয়াং আবিষ্কারে।
উদিত সূর্যের দেশ অরুণাচলের Beauty Spot তাওয়াং-এর উচ্চতা প্রায় ১০,০০০ ফুট। এটি এমনই এক শৈলশহর যার তুলনা অন্য কোনোও পাহাড়ী শহরের সঙ্গে হয় না। শহরের উত্তরে রয়েছে উত্তুঙ্গ পর্বতশ্রেণী আর দক্ষিণে গভীর নদী উপত্যকা।
হোটেলের বাইরে এসে, এ কি দেখছি আমি! তুষারপাতের তো বিরাম নেই! তার মধ্যেই আমরা রওনা দিলাম তাওয়াং বাজারের দিকে। সেখানে একটা চাইনীজ রেস্তোরাঁয় চীনে খাবার খেয়ে, কেক-পেস্ট্রী, বান-রুটি, বিস্কুট, লজেন্স, চকোলেট, কলা ইত্যাদি বেশ কিছু শুকনো খাবার ও কোল্ড ড্রিংক্স কিনে আমরা রওনা দিলাম তাওয়াং-এর লেক দর্শনে।
তাওয়াং-এ রয়েছে বেশ কয়েকটি লেক বা হ্রদ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সাঙ্গেস্টার, মাধুরী ও পি.টি.সো। ভারত-চীন সীমান্ত বুমলার পথে রয়েছে সাঙ্গেস্টার এবং মাধুরী লেক। বুমলা সীমান্তে যেতে সেনাবাহিনীর অনুমতিপত্র লাগে। কিন্তু প্রবল তুষারপাতে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রাস্তা বন্ধ থাকার জন্য আমাদের আর সেদিকে যাওয়া সম্ভব হলো না।
পি.টি.সো লেকের দূরত্ব তাওয়াং থেকে ১৫ কিলোমিটার, উচ্চতা ১৩,৫০০ ফুট। তিব্বতী ভাষায় ‘সো’ শব্দের অর্থ ‘লেক’। তখনও তুষারপাত হয়েই চলেছে। পিচ্ছিল রাস্তায় গাড়ি খুব সাবধানে এগিয়ে চলেছে। দুপাশের জমে থাকা বরফের মধ্যে দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম পি.টি.সো লেকে।
আবারও এসে পৌঁছে গেছি এক বিস্তৃত তুষারক্ষেত্রে। আজও সেই মেঘ কুয়াশায় আচ্ছন্ন কালিমাময় প্রকৃতি, উপর থেকে ঝরে পড়া তুষারের মাঝে কালচে জলের জলাশয়, যা বেষ্টন করে রয়েছে বরফের চাদর ভেদ করে জেগে ওঠা ফার্ণ গাছের জঙ্গল আর তার পিছনে, এদের সকলের অতন্দ্র প্রহরী সেই বরফাবৃত পর্বতমালা। দু-ধাপ নেমে পৌঁছে গেলাম সেই হ্রদের সামনে। মনে হয়, তুষারক্ষেত্রের অগ্রগতির কারণেই পি.টি.সো সংকুচিত হয়ে শুধুমাত্র মাঝের এক ক্ষুদ্র অংশেই নিজের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে।
মন ফিরে আসতে চায় না, তবু ফিরতেই হয়। পথে আসতে আসতেই দেখলাম, মাঝে মাঝেই কোনোও বরফক্ষেত্রের মধ্যে ইতিউতি মাথা উঁচু করে রয়েছে কনিফার বৃক্ষ আর সেখানে চরে বেড়াচ্ছে কুচকুচে কালো বড় বড় লোমে ঢাকা মহিষাকৃতি প্রাণী – ইয়াক। আরো কিছু পথ এগিয়ে দেখলাম, বরফের উপর উঁচু হয়ে রয়েছে কাঠের তৈরী ‘ইগলু’ আকৃতির গোলাকার কিছু ঘর – সম্ভবতঃ খুব ঠাণ্ডায় সেনাদের থাকার জন্য।
তাওয়াং শহরের প্রধান আকর্ষণ প্রায় সাড়ে চারশো বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ বা তাওয়াং মনাস্ট্রি – ভারতের বৃহত্তম ও পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। মঠটি ত্রিতল ও দীর্ঘ প্রাচীর বেষ্টিত। প্রায় কয়েকশো লামার বসবাসের জন্য ভিতরে রয়েছে অনেকগুলি বাড়ি। দুর্লভ প্রাচীন পুঁথিপত্রের এক গ্রন্থাগারও রয়েছে এখানে। কথিত আছে, পঞ্চম দলাই লামার ইচ্ছায় লোদরে গিয়ালৎসো (বেশী পরিচিত মীরা লামা নামে) এই মঠ স্থাপন করেন। তাওয়াং শব্দের অর্থ ঘোড়ার আশীর্বাদ। মীরা লামা মঠের জায়গা খোঁজার সময়ে তাঁর ঘোড়া হঠাৎ হারিয়ে যায়। তিনি এখানে এসে তাঁর ঘোড়া খুঁজে পান ও বুঝতে পারেন এটাই সেই ভাগ্যনির্দিষ্ট মঠ স্থাপনের জায়গা।
মঠটি যেমন বড়, তেমনি দেখতেও সুন্দর। ভিতরে রয়েছে ২৬ ফুট উঁচু ধাতব বুদ্ধ (শাক্যমুনি) মূর্তি। দেওয়াল ও সিলিং-এ নানা রঙে অলংকৃত বৌদ্ধ আলেখ্য, সুন্দর সুন্দর ছবি, অজস্র ফ্রেস্কো।
আমরা যখন প্রবেশ করলাম তখন পর্দার আড়ালে লামারা বুদ্ধমূর্তিকে পূজা বা কিছু নিবেদন করছিলেন। পর্দা সরিয়ে ওনারা বাইরে এসে আমাদের সকলের হাতে সেই প্রসাদ তুলে নিলেন। দেখতে অনেকটা পায়েসের মতো, কিন্তু নোনতা স্বাদের। কি দিয়ে তৈরী আমরা বুঝলাম না।
এখানে একটি সংগ্রহশালাও রয়েছে। সেখানে প্রদর্শিত সামগ্রীগুলি বৈচিত্র্যে এবং ঐতিহাসিক মূল্যে অসাধারণ। রয়েছে – প্রাচীন পুঁথি, থাংকা, ৪০০/৫০০ বছরের পুরনো বাসনপত্র, ধাতুনির্মিত বুদ্ধ এবং বৌদ্ধধর্মগুরুদের মূর্তি, মুখোশ, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র ও দুটি বিশাল গজদন্ত ইত্যাদি।
এবারে চলেছি ভারতীয় সেনাদের বীরগাথা জানতে ও দেখতে Tawang War Memorial-এ। এখানে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ভারতের বীর সৈনিকরা কিভাবে চীনের আগ্রাসন ব্যর্থ করে দিয়েছিলো তারই কীর্তিকাহিনী। ১৯৬২ সালে বমডিলা পর্যন্ত এগিয়ে আসা চীনা সৈন্যদের কিভাবে ভারতীয় সেনানীরা ভারত থেকে বিতাড়িত করে আমাদের দেশ মুক্ত করেছিলো তারই স্মৃতিচিহ্ন। এর জন্য তারা নিজেদের জীবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হয়নি। চারিদিকে সাজানো রয়েছে সেইসব বীর নির্ভীক সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্র ও তাদের সাহসের বিবরণ।
দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ সেই সব বীর সেনানীদের আজ আমি স্যালুট জানাই। তারা না থাকলে আজ কি আমরা এভাবে তাওয়াং-এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারতাম? কে জানে সেখানেই না থেমে সেই চীনা সৈন্যরা আরো অগ্রসর হতো কি না! আমাদের সেনারা বাধা না দিলে আমাদের জীবন কি এমনই নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বেগ থাকতো?
(শেষাংশ পরবর্তী পর্বে)
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
স্টার গুলো পাঁচ টা পরে না কেন জানি না।তোমার লেখা deserves full marks. এই journey টা seems to be more adventurous.দারুণ লিখেছ।
ধন্যবাদ ।
Very well narrated. I too experienced the journey and sceneries … so good was the narration. Keep writing. Eager to read the next part.
Thanks for your inspiring comments .
খুব ভালো একটা উপভোগ্য ভ্রমণ কাহিনী। আমাদের এই tourটা খুবই tedious ছিল। আরও একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে কয়েকবছর যাবৎ অরুনাচলের পরিস্থিতি আদৌ স্বাভাবিক নয়। আমাদের ভাগ্য খুবই ভালো যে আমরা খুব শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ঘুরে বেড়িয়ে এসেছি।
ঠিকই ।
Bhalo hoyeche
দারুণ। খুব informative. একইসাথে আবার খুব উপভোগ্য।
তোমাদের সবাইকেই ধন্যবাদ ।