সঞ্চারী গোস্বামী মজুমদার
ম্যানিপুলেশন অর্থাৎ একজন মানুষকে নিজের কথামতো ভুল দিকে প্রভাবিত করা।
আর কখনো কখনো ম্যানুপুলেশন খুব একটা নগণ্য ব্যাপার হয় না। আমাদের ভাবনার অনেক আগে গিয়ে অনেক মানুষ ম্যানুপুলেশন এমনভাবে করে যাতে একটা মানুষ খুব সহজেই তার কথা বিশ্বাস করে বসে। এমনটা ভালোবাসার ক্ষেত্রেও হতে পারে।
অনেক সময় আমরা সত্যিটা সামনে থাকলেও দেখতে পারিনা। তার একমাত্র কারণ হল আমরা একজন মানুষের মিথ্যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করি। এই মানুষগুলো নিজেদের কথায় আমাদের মনে বিশ্বাসের জন্ম দেয় এমন ভাবে যে সত্যি মিথ্যের তফাৎ করাটা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
আর যখন সবশেষে সত্যিটা সামনে আসে তখন তার আর কিছুই করার থাকেনা। মন ও বিশ্বাস দুটি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।পরে যখন বুঝতে পারে যে এতদিন তারা মিথ্যের জালে ফেঁসে ছিল তখন তাদের আর কিছুই করার থাকেনা।
আমার মনে হয় জীবনে মানুষ চেনার ক্ষেত্রে আমাদের সব সময় চোখ কান খোলা রাখা উচিত। ভালোবাসার মানুষের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। আদৌ কেউ আমাদের ভালবাসে কিনা তা নিয়ে খুব ভেবেচিন্তে এগোনো উচিত এবং সত্যি মিথ্যে তফাৎ নিজেদের বুদ্ধির দ্বারা করা উচিত। এবারে দেখে নেওয়া যাক কি কি উপায়ে প্রকৃত ভালোবাসা আর ম্যানিপুলেশনের মধ্যে তফাৎ বুঝবেন:
১. খবর রাখার নামেই সবসময় নিয়ন্ত্রণ করবে
আমাদের ভালোবাসার মানুষ চায় যে আমরা সুস্থ থাকি ভালো থাকি। প্রয়োজনে তারা আমাদের খোঁজ নেয় বা আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে বাড়ির বাইরে পা রাখা মাত্রই কাউকে সর্বক্ষণ ফোন করতে হবে বা মেসেজ পাঠাতে হবে। যে সে কি করছে বা কোথায় আছে সব মিনিটে মিনিটে যা নিয়ে যেতে হবে। এটা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ নয়ই বরং নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা।
২. ভালোবাসার অংশ নিয়ন্ত্রণ করা
অনেক সময় আমরা এটা শুনতে পাই আমাদের ভালবাসার মানুষের থেকে যে আমি তোমার বেশি করে খবর নিই, তোমার কথা জানতে চাই সব সময়, সেটা অবশ্যই তোমাকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে নয়; “এটা তোমায় খেয়াল রাখা, ভালোবাসি বলে।” এই নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের অনেক বেশি অস্বস্তি বোধ হয় আর আমাদের সব সময় মনে হয় কেউ আমাদের শাসনে রেখেছে। যার ফলে আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সবসময় হস্তক্ষেপ হয় চলে। কিন্তু সত্যি কারের ভালোবাসা নিয়ন্ত্রণের কোনো জায়গা নেই। আর যেখানে নিয়ন্ত্রণের দোহাই দেওয়া হয় ভালোবাসায়,সেটা আদৌ কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে আমার।
৩. সবসময় বলা তারা আমাদের ছাড়া বাঁচতে পারবে না
এটা সত্যি যে ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা খুবই কষ্টকর। আর সেটা প্রকাশ করার মধ্যে ও কোনো ভুল নেই। কোন রোমান্টিক মুহূর্তে আপনার প্রিয় মানুষটি আপনাকে এমন একটা কথা বলতেই পারে। কিন্তু এটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে এই কথা বলার মধ্যে কোনরকম ভয় দেখানো হচ্ছে কিনা? কথায় কথায় আমি মরে যাব বা আত্মহত্যা করবো তোমাকে না পেলে,এই ধরনের কথা কিন্তু মোটেও রোমান্টিক নয়। এরকম কথা শুনলে বেশি না ভেবে এক মুহূর্তেই এটা ভেবে নেওয়া উচিত যে এই মানুষটি একদমই ঠিক নয়। আর তার থেকে দূরে চলে যাওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
৪. সবসময় দোষী সাব্যস্ত করা
মানুষ মাত্রই ভুল হয় আবার অনেক সময় বোঝার ভুল হতে পারে। সে যাই হোক মানুষের মধ্যে ভুল ত্রুটি থাকবেই আর সম্পর্কেও মনোমালিন্য হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোন ছোট ছোট কারণে বারবার দোষারোপ করা, সামান্য ব্যাপারকে অসামান্য করে সেখানে দোষারোপ করা। যেমন-” তুমি যদি আমায় সত্যিকারের ভালবাসতে তাহলে আমার কাছে ২৪ ঘন্টা থাকার চেষ্টা করতে”। এই ধরনের কথার মাধ্যমে খুব বেশি মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। এইরকম ধরনের স্বভাবের মানুষের থেকে দূরে থাকুন আর ভালোবাসা আশা করাটা বন্ধ করুন কারণ এরা ম্যানিপুলেশন করে বেশি, ভালোবাসার থেকে।
৫. যা করছি আমাদের জন্য
অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি যে অনেক জিনিস আমাদের ভালোবাসার মানুষ করে যাতে আমাদের সম্পর্কের বিশেষ করে খুব ভালো হয়। অবশ্যই সেটা দরকারী একটি সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে সব কাজই সবাই ভালোবাসার দিকে তাকিয়ে বা ভালোবাসার মানুষের দিকে তাকিয়ে করে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা বুঝতে পারি যে এটা আমাদের মিথ্যা বলা হচ্ছে। যে কাজগুলো আমাদের ভালোর জন্য বলেছে করছে সেটা অ্যাকচুয়ালি সে তার নিজের ভালোর জন্য করছে আর আমাদের বলে সবার সামনে দেখাচ্ছে। এরকম বুঝলে আমার মতে সরে আসা উচিত সেই মানুষের থেকে।
৬. আমি খুব চিন্তিত তোমায় নিয়ে
আগেই বলেছি যে ভালোবাসা মানে নিয়ন্ত্রণ করা নয়। সে ক্ষেত্রে পরোয়া করা আর নিয়ন্ত্রণ করা দুটো একদমই আলাদা ব্যাপার। যখন সেই মানুষটা সত্তিকারের পরোয়া করবে সে বারে বারে মেসেজ বা কল করে কারণ ছাড়া সর্বদা খবর নেওয়ার চেষ্টা করবে না। এই ধরনের ব্যবহার কে পাগলামো বললে খুব একটা ভুল হবে না। তারা যখন বুঝতে পারে যে আপনি এই ব্যবহারে বিরক্ত হচ্ছেন তখন তারা আপনার প্রতি কতটা চিন্তিত সেটা কে জাহির করে নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করবে সর্বদা। এই ধরনের ইনসেন বিহেভিয়ার করা মানুষদের থেকে দূরে থাকলেই ভালো।
৭. কাজ করে শোনাবে
মানুষ মানুষকে সাহায্য করে অনেক কারণে। সেটা করাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর ভালোবাসার মানুষের জন্য মানুষ কি না করে! কিছু মানুষ যেমন আছে তারা নিজের কথা ভেবে সবসময় কাজ করে বলে আমাদের জন্য ভাবছি। তেমনি আবার কিছু মানুষ আছে যারা কোন কাজ যদি করে সবসময় সেটা শোনায় আর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার চেষ্টায় থাকে। বারবার করে এটা জাহির করে যে সে একটা কাজ করেছে এবং তার জন্য আপনি সর্বদা কৃতজ্ঞ থাকবেন বা কথার কথায় এমনি শুনিয়ে যাবে যে সে এত কিছু করে চলেছে। এই ধরনের মানুষ আজও কাউকে কখনো ভালো রাখতে পারে না।
৮. সবকিছু পছন্দ মতন করতে হবে
প্রত্যেকেই নিজেদের জীবন নিজেদের নতুন করে চালাতে। সেই স্বাধীনতা প্রত্যেক মানুষেরই থাকে এবং সেটা থাকা উচিত বলেও আমার মনে হয়। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সামান্য স্বাধীনতাটুকু পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এমন হয়ে যায় যে ফোন বা মেসেজ তো করতেই থাকে তার সাথে কি কি করবে সারাদিনে কি না করবে সবই তারা প্রায় বলে দেয়। কোন বন্ধুর সাথে মিশবে,কোন জামা পরবে, কি কাজ করবে, ইত্যাদি সবই তাদের পছন্দ মতন করতে হবে। এমন একটা অস্বস্তিকর সম্পর্ককে বেশি দিন টিকিয়ে রাখা সত্যিই কষ্টকর।
৯. প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে তুলনা
একাধিকবার প্রেমে পড়া কোন অপরাধ নয়। কিন্তু সমস্যা হল যে বর্তমান প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকার তুলনা। হ্যাঁ অনেক সময় আমরা কথা প্রসঙ্গে কিছু কিছু কথা বলে থাকি যেটা তুলো না হলে গায়ে লাগেনা। কিন্তু একটি সময় এরপরে যখন বারেবারে কথায় কথায় প্রাক্তন প্রেমিকের বা প্রেমিকার তুলনা টানতে থাকি তখন সেটা আর হালকাভাবে নেওয়া যায় না। সে ভালোর দিকে হোক বা খারাপের দিকেই হোক সবসময় এটাই মনে হয় যে প্রাক্তন প্রেম বর্তমানের সাথে একসাথে হয়ে একটি সম্পর্কের মধ্যে বাস করছে। স্বাভাবিকভাবেই সেটা বেশি দিন সহ্য করে চলাটা কঠিন।
১০. অপ্রয়োজনীয় উদারতা
উদারতা একটা বিরল গুণ যেটা খুব কম মানুষের মধ্যে থাকে। কিন্তু অকারনে কেউ যদি এগুলো দুর্ব্যবহার করে তবে সেটা কিছুতেই ভালো হতে পারে না। হ্যা, সম্পর্কে এই গুণের প্রয়োজনীয়তা আছে তবে সেটা জায়গা মতো। কেউ যদি ক্রমাগত যেচে পড়ে বলে যে আমাদের কি গুন আছে এবং আমাদের জন্য কি কি ঠিক, আমরা কোন কোন মানুষের সাথে মিশতে পারি,আমাদের কি ধরনের কাজ করা উচিত তবে সেটা ঠিক নয়। অনাবশ্যকভাবে অন্যের থেকে বড় করা, অন্যদেরকে ছোট করা তাও মিথ্যে অজুহাতে, মিথ্যে প্রশংসা এবং রাগের কারণে ও রাগ না করে অতিরিক্ত মিষ্টি করে কথা বলা এগুলোও এক প্রকারের অতিরিক্ত উদারতা দেখানো। অবশ্যই এগুলো নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে জানলে ভাল লাগে। তবে দেখতে হবে যে সে এগুলো বলে নিজের পছন্দমত চালাবার চেষ্টা করছে, নাকি সত্যি বলছে আমাদের ভালোর জন্য।
ভালোবাসার মানুষকে সত্যিই খুব প্রয়োজন এবং তার মতামতও খুব দামী। তবে দেখতে হবে সে মানুষের সাথে থেকে আমাদের জীবনে কি কি উন্নতি হচ্ছে? আমরা কি আদৌ খুশি? সত্যিকারে ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকলে আমরা খুশি হয়ে থাকবো, আমাদের জীবনে অনেক বেশি পজিটিভিটি থাকবে আর আমরা যেকোন ডিসিশন নিজের মতন করে নিতে স্বাধীন থাকবো। সর্বোপরি আমাদের মধ্যে বিশ্বস্ত তারা অনেক বেশি থাকবে। এই জিনিসগুলো যদি একটি সম্পর্কের থাকে তাহলে ভালোবাসা না ম্যানুপুলেশন সেটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হবে না।
Sanchari Goswami Majumdar
Loves to teach and practice dance. Likes to read books.