লেখিকা: তপতী রায়
অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগণা জেলার একটি শহর দুমকা, সম্পূর্ণরূপে সাঁওতাল পরিবেষ্টিত একটি জায়গা। চ্যাপটা নাক, কালো চুলের নিটোল চিকন শরীরে এদের পরিচয়। খুবই সৎ, প্রচণ্ড দারিদ্রতা থাকা সত্ত্বেও এরা কখনোও কোনোও কুকাজ করেনা। পাহাড়ী এলাকা, কৃষিকাজ কম হয়, আঁকাবাঁকা লাল মাটির রাস্তা ধরে গিয়ে পাহাড়ের তলায় এদের গ্রাম।
শহরের মধ্যে নানা জাতের লোক থাকে। তাদের বলা হয় দ্বিগু। কোনোও কালে এটা বাংলার মধ্যে ছিল, কিন্তু পড়ে বিহারের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাই বাংলার প্রভাব আশেপাশে বেশ দেখা যায়। মহুয়া গাছের ছড়াছড়ি, মহুয়া ফুলের গন্ধ এক অদ্ভুত মাদকতাময় আমেজ ধরায় এখানের আকাশে বাতাসে।
এহেন শহরে ঐতিহ্যবাদী বাংলা সংস্কৃতিকে, বাংলা শিক্ষা ও সাহিত্যকে প্রবাসে থাকা বাঙালীদের মধ্যে প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে কিছু ক্লাব গঠন করা হয়। আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেকার কথা যখন সেইসব ক্লাবের ছেলেমেয়েরা মিলে নাটক, গানবাজনার অনুষ্ঠান করতো। বাংলার উন্নতি প্রকল্পে বদ্ধপরিকর সেই সময়ের ছেলেমেয়েরা, বয়স্করা যখন চণ্ডালিকা বা কোনোও নাটক করতো তখন মনে হয়না কোনোও বাঙালী বাদ যেত উপস্থিত থাকতে। মাঝে মধ্যে বাংলা সিনেমা দেখানো হতো। দুপুর এগারোটার সময়ে শুরু হতো। কোনোও বাঙালী বাদ যেতো না তাতে। যেন মনে হতো, কোনোও বাড়ির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছে সকলে মিলে। সে এক অপূর্ব অনুভূতি। যারা মাঝে মাঝে কলকাতা যেতো, তারা নতুন বই বেরোলেই নিয়ে আসতো। অধীর আগ্রহে সবাই অপেক্ষা করতাম কবে সেটা পড়তে পাবো। বইটা আসার পর থেকে নানা পাড়া ঘুরে বেড়াতো। শংকরের ‘জন অরণ্য’ বা ‘চৌরঙ্গী’ গিলে খেতাম সবাই মিলে। স্কুল-কলেজে বাংলা ভাষা পড়ানোর ব্যবস্থা ছিল। লাইব্রেরী ছিল সেখানে, বাঙালীরা বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করতো। বাড়িতে অফিসে বাংলা ভাষার ব্যবহার হতো।
কলকাতার মতো অত সুযোগ সুবিধা ছিল না। কিন্তু বাবা-মায়েরা উপযুক্ত সুবিধার অভাবেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে মঞ্চে আনার যথাযথ প্রচেষ্টা করতেন। এর এক্মাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ও বাঙালীর সর্বান্তকরণ বিকাশ। তাদের আগামী প্রজন্ম যেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে পারে এই উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁরা নানা অনুষ্ঠান করতেন। যার ফলে ছোটবেলা থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি প্রেম জেগে ওঠে। বৈঠকখানার ঘরে সাজানো শরৎ রচনাবলী, বিভূতিভুষণ, বনফুল, তারাশঙ্কর, আশাপূর্ণা দেবী এদের গল্পগুলো যেন মনে নেশা ধরিয়ে দিতো। আর কলেজ জীবনে যখন প্রোফেসর গাঙ্গুলীবাবু দরাজ গলায় রবীন্দ্রনাথের মুক্তি কবিতাটি পাঠ করতেন তখন নেশাচ্ছন্ন ব্যক্তির মতো নির্বাক হয়ে শুনতাম,
জানি নাই তো আমি যে কী, জানি নাই এ বৃহৎ বসুন্ধরা
কি অর্থে যে ভরা।
শুনি নাই তো মানুষের কী বাণী
মহাকালের বীনায় বাজে। আমি কেবল জানি,
রাঁধার পরে খাওয়া আবার খাওয়ার পরে রাঁধা –––
বাইশ বছর এক চাকাতেই বাঁধা –––
অথবা
অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ,
সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।
প্রলয়ে সৃজনে না জানি এ কার যুক্তি,
ভাব হতে রূপে, অবিরাম যাওয়া-আসা –––
বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি,
মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা ৷৷
কবিতাগুলির প্রত্যেকটি শব্দ ও পংক্তি মনে এক অদ্ভুত ভাব জাগায়, পুরানো স্মৃতি মনের কোণে কোণে উঁকি দিয়ে যায় আর কবিতার বিষয়বস্তু বাংলার প্রতি শুধু প্রেম নয়, আবেগ ও নেশা জাগায়। এহেন বাংলার প্রেমে না পড়ে কি পারা যায়? আজ এই পর্যন্তই …
তপতী রায়
জন্ম ও পড়াশুনা অধুনা ঝাড়খণ্ডে। বিবাহসূত্রে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেছি। উপস্থিত রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরে গত পঁচিশ বছর ধরে বাস করছি। জয়পুরের প্রচুর বাঙালী আছেন এবং তাঁদের মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা যথেষ্টই আছে। আজ আমি গর্বিত বাঙালী বলে ও জয়পুরের বাসিন্দা বলে।