Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ পথে ও প্রান্তরে — ২
ভ্রমণপ্রবন্ধ

পথে ও প্রান্তরে — ২

সুদেষ্ণা মিত্র

লক্ষীকান্তবাবু বেশ জোরেই গাড়ি ছোটালেন। চারপাশের শীতের ঠান্ডা আমেজ আর হাল্কা কুয়াশামাখা পরিবেশ ভীষণ ভালোলাগায় আমাকে বহুক্ষণ ভরিয়ে রাখলো। দিল্লীর ব্যস্ত শহুরে জীবন থেকে কলকাতায় প্রথম পা রাখলেই আমি যেন বাঁধন ছাড়া এক আনন্দের জীবন ফিরে পাই; তারপর যদি প্রিয়জনদের সঙ্গে এমন জায়গাতে যাওয়া হয় যা অজানা অচেনা, তাহলে একদম সোনায় সোহাগা। উত্তেজনার শুরু হয়েছিল ভোরবেলা ছটা কুড়ির ব্ল‍্যাক ডায়মন্ড ধরার সময় থেকেই। আমাদের পাঁচজনের গ্রুপ সেই ভোর পাঁচটা থেকেই রেডি, উবেরের ভরসা না করে চটপট ট‍্যাক্সিতে বসে বেরিয়ে পড়লাম হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে। শেষ শীতের ভোরের কলকাতা সবে ঘুম থেকে উঠেছে, আলসেমি তখনো কাটেনি। বহুদিন বাদে ভোরের কলকাতা দেখে নতুন করে ভালো লেগে গেলো কলকাতাকে। সেই উত্তজনার রেশটুকু আরো বেড়ে গেলো আসানসোল থেকে বরন্তীর যাত্রা পথের অভিজ্ঞতায়। দেড়ঘন্টায় নানা বাঁক,এবড়ো খেবড়ো কাঁচাপাকা রাস্তা  ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে – মাঝে মাঝেই সামনে এসে পড়ছে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে, ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো গবাদি পশু, গাড়ির ধুলো আর তার স্পীড দেখে হকচকিয়ে যাওয়া স্থানীয় মানুষজন। সার সার মাটির ঘর আর ধানী জমি হয়তো সব গ্ৰামেরই বৈশিষ্ট্য কিন্তু প্রতিটি বাড়ির মাটির দেওয়াল নানারকম নক্সা বা আলপনায় সাজানো এ জিনিষ আগে আমার নজরে পড়েনি। ইচ্ছে ছিলো এই আলপনা ক‍্যামেরাবন্দী করবার, কিন্তু লক্ষীকান্তবাবু বারণ করলেন। হয়তো ব‍্যাক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করা হবে তাই।

মুরাডি, সানতুরি আর বরন্তী। মুরাডি গ্ৰাম আর রেলওয়ে স্টেশন, সানতুরি হলো পুলিশ স্টেশন। পাহাড়, লেক আর ড‍্যাম সংলগ্ন অঞ্চল এই তিনের সমাহারে বরন্তী এক কথায় অসাধারণ। এসে পৌছোলাম হোটেল ‘মহুলবন’। আমাদের পছন্দসই সব হোটেল বা রিসর্টগুলি ছিল ড‍্যাম বা জলাশয় সংলগ্ন এলাকায়। কিন্তু এই ‘সীজনের’ সময় আমরা বুকিং পাইনি। অগত‍্যা মহুলবনই আমাদের আশ্রয়। মন ভরে গেল। ছোটো ছোটো কটেজ আর বড় একটা বাংলো নিয়ে তৈরী এই হোটেলটি বেশ নিরিবিলি। সামনেই বিরাট সবুজ পাহাড়। সামনের রাস্তা সোজা চলে গেছে লেকের দিকে। মালপত্র রেখে আমরা ঘরের সামনের ব‍্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। যতদূরে চোখ যায় শুধুই সবুজ। চারিদিকে শিমুল আর পলাশের ছোঁয়া যদিও তখন সেভাবে ফুল ফোটেনি কিন্তু শুনেছি এখানে নাকি বনে আগুন ধরেছে মনে হয়, যখন শিমুল পলাশে রাঙা হয়ে ওঠে চারপাশ। রাস্তা ধরে মাঝেই সাঁওতাল নারী-পুরুষ যাচ্ছে, নয় হেঁটে নয় সাইকেল চড়ে। রাস্তার ঠিক ওপারেই বিশাল সবুজ পাহাড়। তার নীচে দু-চারজন স্থানীয় মহিলা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে। হোটেলের পেছন দিকে একটা মেঠো পথ যা গ্ৰামের দিকে চলে গেছে। পাশে একটা ছোটো পুকুর সেখানে কাপড় কাচছে দু একজন। অদ্ভুত কিছু দৃশ্য যেন মনে হচ্ছিল আমাকে পুরো প্রকৃতির সাথে একাত্ম করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে নাম না জানা পাখীদের অচেনা ডাক দুপুরের নিস্তব্ধতাকে মূহুর্ত্তের জন্যে ভেঙে দিচ্ছিল‍। নানা সাহিত্যে রাঢ় বাংলার যে বর্ণনা আমি পেয়েছি চোখের সামনে তা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল। ইতিমধ্যে চা এসে গেল। এবার যে যার ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার পালা।

হোটেলেই জলখাবার লাঞ্চ ডিনার ছাড়াও বিকেলের চা আর পাকৌড়ার ও ব‍্যবস্থা আছে। হোটেলের ছেলেটি আমাদের বললো “সূর্যাস্ত দেখে নিন আজ লেকে, তবে বেশী অন্ধকার হওয়ার আগে ফিরে আসবেন।” দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম লেকে। গেলাম একটু ঘুরে মেঠো পথ ধরে। চলতে চলতে চোখে পড়লো বুনো ফুলের থোকা, বেলা শেষ হয়ে আসছে তাই সেদিনের মতো কাজ সেরে সার বেঁধে গবাদি পশু নিয়ে পথ চলতি মানুষ জন।  চারিদিকের শান্ত ব‍্যস্ততা র ছবি ক‍্যামরায় ধরে রাখলো আমার ভাই। একসময়ে এসে দাঁড়ালাম বেতি, মুরাডি আর বরন্তী পাহাড় দিয়ে ঘেরা রামচন্দ্রপুর ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের বরন্তী জলাশয় বা লেকে। সূর্য তখন অস্তমিত। লেকের ঝিকিমিকি জল আর দুই পাহাড়ের ছায়া অভাবনীয় এক পরিবেশের সৃষ্ঠি করেছিল। ঠাণ্ডা হাওয়া শরীরে জেঁকে বসবার আগেই সূর্য হারিয়ে গেল দুই পাহাড়ের মাঝে। অন্ধকার যেন ঝুপ করে এসে পড়লো। সোলার লাইটের আলোয় পথ চলতে চলতে আমরা এগিয়ে চললাম আদিবাসীদের গ্ৰামের দিকে, ক্ষীণ শব্দে থেকে তখন ভেসে আসছে মাদলের আওয়াজ।

পুরুলিয়ার শিল্প সংষ্কৃতির বিরাট এক জায়গা জুড়ে রয়েছে পূজা পার্বণ বা পরব। নৃত্য গীত এদের সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির শেষে একমাত্র বিলাসিতা। আমরা যে সময় গেছি তার কিছুদিন আগেই শেষ হয়েছে “ভানুসিংহের পুজো”। ভানুসিংহ হলেন গৃহপালিত পশুর দেবতা। সেই পরবের রেশ তাদের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে। তাই এই নাচ আমরা দেখতে পেলাম। নাহলে সাধারনতঃ পর্যটকদের অনুরোধে রিসর্ট বা হোটেলের মালিকরা এই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। যাতে গরীব মানুষগুলোর একটু রোজগার হয়। নানা রকম সবুজ আর সাদা লাল শাড়ী পরা মাথায় একধরনের সাদা ফুল গুঁজে‍ মাদল আর শিঙার সাথে সাঁওতাল রমনীদের নাচ, অদ্ভুত এক ছমছমে পরিরেশ সৃষ্টি করলো আলোআধাঁরীতে।

গ্ৰাম ছেড়ে যখন বেড়িয়ে এলাম তখন চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আরো দু একটা পরিবার ছিল। তারাও আমাদের মতোই, ছুটি কাটাতে এসেছেন। বাঁধ পেরোতেই সোলার লাইটের আলো আর পাওয়া গেলো না। নিকষ কালো অন্ধকার আমাদের ঘিরে ধরলো যদিও দলে ভারী থাকায় খুব অসুবিধে হলো না। যদিও মামী বারবার ঐ হোটেলের ছেলেটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে বলেছিল বেশী দেরী না করতে। মাঝে মাঝে নিশাচর পাখীর ডাক, সাইকেলের আলো আর ঘন্টির আওয়াজ রাতের স্তব্ধতাকে মুছে দিচ্ছিল। দূরে দেখা গেলো “মহুলবনের” আলো।

– ক্রমশঃ –

লেখিকা পরিচিতি

 

সুদেষ্ণা মিত্র

এডিটর, দু ~কলম

Author

Du-কলম

Join the Conversation

    1. ki j valo laglo porte ki bolbo.. kotodin barir baire paa rakhina..tor lekhar hat dhore boronti ghure elam..chobi alada kore bolar moto valo..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!