অঞ্জন বসু চৌধুরী
এ লেখা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কিছু চিঠির সংকলন। যা আমার কাকু অঞ্জন বসু চৌধুরী এই ব্লগ খোলার সময় আমায় উৎসাহ জানিয়ে লিখেছিলেন। এই লেখায় বর্ণিত চরিত্রগুলি সবাই আমার প্রিয়জন। ঘটনাগুলি এক একটা নস্টালজিয়া। তাই ওনার অনুমতি নিয়ে লেখাগুলো অপরিবর্তিত রেখে আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। ~ সুদেষ্ণা মিত্র
চিঠি – ৫
বাবা, জিতেন জামাইবাবু (বড়দির স্বামী) আর দেবুদা (সেজদির স্বামী) এরা অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলো। দেবুদা প্রকৃত অর্থে রাজপুত পরিবারের ছেলে ছিলেন। আমরা দেখেছি, দেবুদার বোন সাধনাদি, অন্ত্যন্ত সুন্দরী ছিলো, চোখ দুটো একদম টানা টানা, সুন্দর লম্বা চেহারা (যে কোনোও ফিল্ম তারকা ধারে কাছে আসবে না, এতোটা সুন্দরী ছিলো)। তার বিয়েতে, কোনোও কারণে বর ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারেনি, তার পরিবর্তে বরের তরবারি পাঠিয়ে দিয়েছিলো, যার সঙ্গে সাধনাদির বিয়ে সম্পূর্ণ হয়। যাক সে সব কথা। বাস্তবে রাজপুতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়েই বিয়ের উপস্থাপণা।
বাবা ও জিতেন জামাইবাবু একসঙ্গে দেশের স্বাধীনতার জন্যে ব্রিটিশ পুলিশের লাঠি খেয়েছিলেন আর জেলেও গিয়েছিলেন।
দেবুদা খুব হাসি খুশি ও মজাদার মানুষ ছিলেন। দেবুদা প্রাইভেটে তাম্রলিপ্ত রাজ্য পরিবহনের ম্যানেজার ছিলেন কিন্তু মাঝে মাঝেই বাসের সাথে বেরোতে হতো তাঁকে। প্রায় হাতে প্রাণ নিয়ে চাকরি করা। কিন্তু কোনো অনুযোগ ছিলো না। সন্ধ্যাবেলাই বাড়ির রকে বসে দেদার আড্ডা, হাসি এইসব চলতো। লোকে খুব ভালোবাসতো দেবুদাকে।
দেবুদার আর একটা অনন্য সাধারণ প্রতিভা ছিলো। দাদা যাত্রা ও নাটক করতেন। ঐতিহাসিক যাত্রা, রামায়ণ ও মহাভারতের চরিত্র করতেন। কখনোও কৃষ্ণর চরিত্রে তো কখনো কংসর চরিত্র বা কখনোও রাম বা কখনোও ভীমের চরিত্রে অভিনয় অভিনয় করতেন। বড় প্রাণবন্ত অভিনয় ছিলো সে সব। বয়স্ক মহিলারা অভিনয় দেখতে দেখতে হাপুস নয়নে কাঁদতেন আর প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করতেন। দিদিমা, ঠাকুমারা খুব ভালোবাসতেন দাদাকে। দাদা নিজেও খুব ভালো গল্প বলতে পারতেন। যখন গল্প বলতেন, তখন যাকে বলে একেবারে স্পেলবাউন্ড অবস্থা।
দেবুদা ও তার আর এক বন্ধু পাঁচু মাঝে মাঝেই বুড়িদের নিয়ে প্রয়াগে তীর্থ করতে যেতো। বুড়িমাদের কাছে তাদের ঠিকানা (হারিয়ে যদি যায়, সেই জন্যে) ছিলো “দেবু পাঁচু ভীমার বাজার”। ব্যাস এইটুকুই যথেষ্ট ছিলো। একবার প্রয়াগ তীর্থ সেরে বুড়িমায়েরা দেবুদার সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে নেমেছেন বাড়ি ফেরার জন্যে। বুড়িমা বলছে, “দেবা, একটু দাঁড়া, গঙ্গায় ডুবটা দিয়ে নিই, তারপরে ঘরে ফিরবো।” দাদা বলছে, “বুড়ি তোর প্রয়াগের গঙ্গায় ডুব দিয়েও শান্তি হয়নি, এই পচা গঙ্গায় ডুব দিবি?” ঠাকুমা দাদার থুতনি ধরে আদর করে বললো, “মা কখনোও পচা, অপবিত্র হয়? তাও আমার নিজের দেশের গঙ্গা মা?” দাদা আর কোনো কথা বলতে পারলো না। বুড়িমার দাবী মেনে নিয়েই বাড়ি ফিরলো …
পুনশ্চ
পরিবারের কথা লিখতে বসে বুঝতে পারছি, এই লেখা শেষ হওয়ার নয়, মনে হয় শুধু লিখতেই থাকি। কিন্তু সব লেখারই শেষ থাকে, তাই আমাকেও লেখার রাশ টানতে হচ্ছে।
সর্বোপরি বলি যে, পাঠকে্রা মাফ করবেন, অমি ভালো ভাবে গুছিয়ে লিখতে বা হয়তো বুঝিয়ে বলতে পারছি না, কিন্তু একটা সময় আছে যখন আমাদের প্রত্যেকেরই বয়স হবে আর তখন কিন্তু পরিবারের এই কথাগুলোই থেকে যাবে আমাদের স্মৃতি রোমান্থনের জন্যে।
ধন্যবাদ, সবাই ভালো এবং সুস্থ থাকবেন।
এসব ঘটনার বেশীরভাগই আমার জন্মের অনেক আগেকার। আজকের এই হাই-টেক যুগে “হাম দো হামারা দো” নীতিতে বিশ্বাসী আমাদের এ সব ঘটনার কথা শুনলে খুব অবাক লাগে, মনে হয় মানুষের জীবন কতো সহজ-সরল অথচ কতোটা আনন্দময় হতে পারে। সেই মানুষগুলোর মধ্যে ছিলো না কোনোও আড়ম্বর, ছিলো না দেখনদারী, ছিলো শুধু আন্তরিকতা আর বুকভরা ভালোবাসা যা পরবর্তী প্রজন্মের চলার পথে প্রতিটা ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করেছে। এটাই তো বাঙালী তথা সমগ্র ভারতবাসীর চিরকালীন সংস্কৃতি, যা আজ লুপ্ত হয়ে এলেও মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে আমাদের সকলকে এক অনাবিল আনন্দ সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ~ সুদেষ্ণা মিত্র