ঊর্মি বসুন্ধরা দুহিতা
স্কুলজীবনে আমার কমল মিত্র টাইপ বাবার কাছে ‘প্যাশন’ শব্দটা কি করে যেন ‘ফ্যাশন’ হয়ে যেত আর তারপরেই শুনতে হত অমোঘ বানী, “এসব বাঁদরামি এখানে চলবে না” … ব্যাস! প্যাশনের সলিল সমাধি। ছোটবেলায় বাস কন্ডাক্টার থেকে খেলোয়াড়, আঁকিয়ে মায় অভিনেত্রী – সবদিক খাবলা খাবলি করেও এই মধ্যযৌবনে এসেও বুঝলাম না, প্যাশন ব্যাটা কোনদিকে ঘাপটি মেরে আছে। বাচ্চা বয়সে হয়নি তো কি হয়েছে … এখন কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি নেই। প্রবল বেগে কলম চিবিয়ে লিখে চলেছি … খুঁজে চলেছি প্যাশনটা ঠিক কোনদিকে।
তবে একটা কথা কিন্তু সার বুঝেছি এই বয়সে। মেয়েদের আটপৌরে জীবনে এই শব্দটার সত্যিই কি কোন অস্তিত্ব আছে? ঘরে বাইরে নিজেকে বলি দিতে দিতে নিজেরাই কখন নিজেদের প্যাশনকে গলা টিপে মেরে ফেলি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঠিক করে দেয়া করুণায় মোড়া একফালি স্বাধীনতার উঠোন ডিঙিয়ে বাইরের বড় এক আকাশের নীচে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাওয়াটাই প্যাশন … চোখে চোখ রেখে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাওয়াটাই বোধহয় প্যাশন।
আমরা যারা সুবিধাভোগী শ্রেণীভুক্ত তারা যাও বা ছিটেফোঁটা মুক্তির স্বাদ পাই। কিন্তু নিম্নবর্ণের, গরীব , দলিত মেয়েদের কাছে এই শব্দটা এক মর্মান্তিক ব্যাঙ্গ ছাড়া কিছুই নয়। এদের বেঁচে থাকার কাহিনী যত কম বলা যায়, ততই ভালো। এখনও যে উচ্চবর্ণের মালিকের খামারে দলিত মেয়েরা কাজ করেন, সেখানে মালিক মনে করে, ওই মেয়েদের শরীরেও আর পাঁচটা সম্পত্তির মতো তাদের অধিকার। তাদের শরীর ভোগ করতে দেওয়াটাও তাদের কাজের অঙ্গ। পান থেকে চুন খসলেই, দলিত মেয়েদের উলঙ্গ করে গাধার পিঠে চড়িয়ে সারা গ্রাম ঘোরানোটা এখনো গ্রামীণ ভারতের প্রচলিত সাধারন শাস্তি। এখনো তাদের সমাজের নানাবিধ রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠানের অজুহাত দেখিয়ে পুরোহিত ও উচ্চবর্ণের পুরুষ দ্বারা তাদের ধর্ষিত হতে হয়। মনু সংহিতাকে হাতিয়ার করে ধর্মের অজুহাত দিয়ে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে জন্মের কারণেই মানুষ বিভাজিত এবং সেই বিভাজন যেহেতু ‘ভগবান’ করে দিয়েছেন, তাই এতে মানুষের কোন হাত নেই। কেউ কেউ অন্য চিন্তাভাবনাকে সম্বল করে লড়াই করে এগোতে পেরেছেন, কেউ আবার অপমানে বঞ্চিত নিজেকে শেষ করে খবরের শিরোনামে এসেছেন। আমি দূর থেকে ওই মানুষগুলোর প্যাশনকে অন্ধকারের অতলে ডুবে যেতে দেখি।
আমাদের সমাজে বাবারা সব মুক্ত প্রাণী। তাদের কলমও মুক্ত, প্যাশনও তাই। তারা প্রকাশ্যে যা খুশি বলতে কইতে পারে, হাফ-প্যান্টুলুন পরে স্যান্ডো গায়ে দিব্যি চরে বেড়াতে পারে। কিন্তু আমি যা খুশি লিখতে পারি না, যা প্রাণ চায় করতে পারি না। তাহলেই আমার কাছের মানুষেরা, দূরের শুভাকাঙ্ক্ষীরা উদ্বেগে আকুল হয়ে হাঁ হাঁ করে উঠবেন। জীবনে কত কিছুই তো লিখতে চেয়েছি, কত কিছুই করতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি এনাদের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে। কত গল্প না বলাই থেকে গেল কারণ এই সমাজব্যবস্থা আমাদের নিজেদেরও বাধ্য করে নিজেদের কলমকে সংযত করতে। এও একধরনের ‘নিষেধ’। সামাজিক অনুশাসনের কল্যাণে একই অভিজ্ঞতা ছেলেদের জন্য এক চেহারা নেয়, মেয়েদের কাছে অন্য। শিল্পের জগতে, বিজ্ঞানের জগতে, মনন জগতে সবেতেই আমার মতো সাধারণের গতিবিধিতে সমাজের সংশয়, প্রতিরোধ আপনা আপনি গড়ে ওঠে। যুক্তি, বুদ্ধি, মেধা সবই যেন ছেলেদের নিজস্ব সম্পত্তি। তাও আমার মতো নাছোড় মেয়েরা হাল ছাড়ে না।
আমরাও প্যাশনকে ছাড়ি না, প্যাশনও আমাদের মতো হাঁদা গঙ্গারামদের ছাড়ে না … বলে,
“হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে,
দেখা হবে তোমায় আমায় অন্য গানের ভোরে ... ।।”
Bhalo laglo
Thank you
Thank you