Home সম্পাদকের পছন্দ, গল্প নগ্ন তার গল্প
সম্পাদকের পছন্দগল্প

নগ্ন তার গল্প

লেখক: দেবরাজ দাস


(১)

জায়গাটি ভারি সুন্দর, সৌনক! আমরা আরো একবার এখানে আসব, কেমন?

(২)

অক্টোবরের সবে শুরু। সেবার পুজো একটু দেরীতে। মাসখানেক আগে থেকেই আকাশ আগমনী গাওয়া শুরু করেছিল। অনেকদিন ধরেই হিয়া বায়না ধরেছিল বেড়াতে আসার। হয়ে উঠছিল না। সময় বের করতে পারছিল না সৌনক। সৌনকের এইসময়টায় একটু ব্যস্ততা থাকে। ছবি তোলার ব্যস্ততা। সেপ্টেম্বর- অক্টোবরের এই সময়তে নিয়মকরে শরত আসে, আকাশের রং বদলায়, কাশফুলের ঘ্রাণ পৌঁছে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘায়। উৎসবের আভাসে মেতে ওঠেন উৎসবপ্রিয় মানুষ। কুমোরটুলিতে মাটির তাল পাকানো শুরু হয়। উৎসব নিয়ে শরতের এই সামগ্রিকতা সৌনকের ছবিতোলার পাগলামিকে মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে দেয়। কলকাতার একটি নামকরা ফটোগ্রাফি ইন্সটিটিউশনের প্রাক্তন ছাত্র সে। খুব যে সাকসেসফুল ফটোগ্রাফার, তা নয়! এখনো ঘষটে চলেছে বলা চলে। দুইএকটি ছবির প্রতিযোগিতায় হালে শিকে ছিঁড়েছে। এছাড়া, রিসেন্টলি একটি বিদেশী কন্টেস্ট থেকে কিছু অর্থপ্রাপ্তি ঘটেছে যার ভারতীয় মূল্য পঞ্চাশ হাজারের একটু কম। ফ্রিলান্স ফটোগ্রাফার হিসেবে কয়েকটি পত্রিকার হয়ে কাজ শুরু করলেও জমি শক্ত হয়নি এখনও। হাল ছাড়লে চলবে না, লেগে থাকতে হবে- এই বিশ্বাস নিয়েই কল-সেন্টারের চাকরিটা ছেড়ে সৌনক রয়ে গেল এই জগতে; শিল্প সৃষ্টির নেশায়। কাছের বন্ধুরা যখন সবাই চাকরির বাজারে ইঁদুর দৌড়ে মত্ত, সৌনকও প্রথমটায় ছুটেছিল কিছুদিন। পাড়াতুতো এক মামার সুপারিশে কল-সেন্টারের চাকরিটা জুটেছিল। কিন্তু ঐ অবধিই। একেই একটা নড়বড়ে চাকরী তারউপর বছরে এতগুলো ছুটি! হয় কখনো? হয় না! হলও না শেষমেশ। চাকরীটা চলে গেল! সৌনক অবশ্য লজ্জার খাতিরে সবাইকে জানিয়েছিল চাকরীটা ও নিজেই ছেড়ে দিয়েছে পোষাচ্ছিল না বলে। টারমিনেশন লেটারটা হাতে পেয়েই হিয়া’কে কল করে বলেছিল, “চাকরীটা আমার গেছে বেলা তুমি শুনছো? এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না!” অর্থাৎ ইচ্ছেমত যেকোনো জায়গায় ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যেতে আর কোনো বাঁধা রইল না। এই এতবড় একটা দেশ, সেই দেশের যাবতীয় বহুত্বকে ছবিতে ধরার স্বপ্ন নিয়ে সেই থেকে পথ চলা শুরু। ভারতবর্ষের মত বহুত্বেভরা এত বিশাল দেশকে এক জীবনে ক্যামেরায় ধরা সম্ভব না। তবু একচতুর্থাংশও যদি ছবিতে বেঁধে রাখতে পারে তাই বা কম কি? বাড়িতে তাক ভর্তি ছবির বই। বেণু সেন, রঘু রাই, ব্রেশো, স্টিভ ম্যাকারি, রিহান সহ আরো বহু বিখ্যাত আলকচিত্রীদের বই বাঁচিয়ে রেখেছে ভিতরের তাগিদ। মাসের প্রথম সপ্তাহে বাড়িতে নিয়মকরে চলে আসে বেশ কিছু জার্নাল, অবশ্যই ফটোগ্রাফির হাল হকিকত সংক্রান্ত। তবে এত বইপত্র, পত্রিকা ইত্যাদি প্রায় সবই হিয়ার কিনে দেওয়া। নইলে সৌনকের এত সাধ্য কোথায়? হিয়ার চাকরিটা একটু খটমট ধরণের, মানে গতানুগতিক চাকরীর মত নয়। মাস্টার্সে ইউনিভার্সিটি তে টপ করার পর আরো অনেকের মত হিয়ার মা- বাবাও প্রায় নিশ্চিত ছিলেন মেয়ে অধ্যাপিকা হবে। কিন্তু তা হয়নি। এম.ফিল পড়াকালীন হিয়া যুক্ত হয় ‘স্যাফো’র সাথে এবং তখনই হিয়া তার সিদ্ধান্তের কথা বাড়িতে জানায়! ‘স্যাফো’ একটি সংস্থা এবং এরা কাজ করে সামাজিক বৈষম্য, মূলত লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে। এরা বিশ্বাস করে এই সমাজটি সমকামী, রুপান্তরকামী মানুষদেরও। এদের উপর এযাবৎ চলে আসা অবহেলা- অত্যাচারের অবসান ঘটিয়ে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এরা অবিচল। হিয়ার এই চাকরীটা মেনে নিতে পারেনি কেউই। মায়ের একটু সিম্প্যাথি থাকলেও বাকি আত্মীয় পরিজন, এমনকি হিয়ার রুমমেট মানসীও বিস্তর বিরোধিতা করেছে একটা সময়ে। বাবা তো প্রথম থেকেই হিয়ার এই চাকরীর বিরোধিতা করে এসেছেন। এই বিরোধিতা শেষ অবধি মনোমালিন্যে পর্যবসিত হলো। ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে হোমো-সেক্সুয়ালদের জন্য কাজ করছে এই ভাবনা সব আটপৌড়ে বাড়িতে মেনে নেবে কেন? কিন্তু হিয়া বড় শক্ত মেয়ে। এত সহজে হেরে যাওয়ার নয়। বর্ধমান থেকে কলকাতায় পড়তে আসা হিয়া সেদিন বুঝতে পারেনি ছাত্রাবস্থায় আশ্রয় নেওয়া বাবুঘাটের পাশে এই ছোট্ট মেস বাড়িই তার পাকাপাকি আস্তানা হয়ে যাবে। আগে ছুটি পেলে প্রায়ই বর্ধমানের বাড়িতে যেত। কিন্তু আজকাল তা আর হয়না। কাজের দায়িত্বও বেড়েছে। আজকাল প্রায়ই কলকাতা থেকে অফিসের কাজে ছুটে জেতে হয় বিভিন্ন জেলায়, তাও আবার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে।

(৩)

এবছর ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারটা অবশেষে সেটল করা গেল। যদিও দু’দিনের, তাই বা কম কি? অনেক ভেবে ঠিক হল ওরা বরন্তী যাবে। সৌনক অবশ্য এর আগেও বরন্তি এসেছে। কলেজের বন্ধুদের সাথে। নিজেদের টিউশনির টাকা জমিয়ে চার বন্ধুর সেই প্রথম জঙ্গলে বেড়াতে আসা। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিটির মতো। সৌনক’রা প্রথম যখন এসেছিল, তখনও বরন্তি টুরিস্টস্পট হিসেবে আজকের মত এতো পরিচিতি পায়নি। থাকবার জায়গা বলতে ছোট্ট ছোট্ট কিছু কটেজ সবে তৈরি হয়েছিল, তাও আবার সব কটেজে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। ইনফ্যাক্ট সৌনকদের রাত্রি কাটাতে হয়েছিল মোমবাতি জ্বেলে। ভাগ্যিস সাথে মশারি এনেছিল। বাকি বন্ধুরা একটু গাইগুই করলেও সৌনকের কিন্তু ভীষণ মনে ধরেছিল জায়গাটি। কটেজের বারান্দায় বসে জোনাকিভরা গাছগুলোর কুহক প্রায় হিপ্নোটাইজ করে রেখেছিল ওকে। রাত্রের জঙ্গলের শুনশান নীরবতার মাঝে ঝিঝি-র ডাক, রাঁধুনি মোতিলালের ঘরে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হ্যারিকেনের আলোয় মৃদু স্বরে বাজতে থাকা রেডিও এবং রেডিওর গানের সাথে গুনগুন করে গলা মিলিয়ে মোতিলালের বউ এর কলপাড়ে বাসন মাজবার ঠনঠন শব্দ- এই সব মিলিয়ে যে আবহ তৈরী করেছিল, তার মাঝেই সৌনক প্রায় জেগেই কাটিয়ে দিয়েছিল গোটা রাত্রি। কটেজের বারান্দায় প্লাস্টিকের ঐ সাদা চেয়ারে বসে সদ্য খেতে শেখা সিগারেট নিয়ে একটা গোটা রাত্রি জেগে কাটিয়ে দেওয়ার রোমাঞ্চ আজও সৌনক ভুলতে পারেনি। সেই পুরোনো অনুভূতিগুলো আরো একবার ঘেঁটে দেখবার জন্য পুনরায় বরন্তি! হিয়া অবশ্য সমুদ্র পছন্দ করে, তবে জঙ্গল নিয়েও কোন আপত্তি নেই। বরন্তির নাম শুনে থাকলেও এটাই হিয়ার প্রথমবার। তার চেয়েও যেটা বড় তা হলো এই প্রথম ওদের দুজনের একসাথে কোথাও বেড়াতে আসা। হিয়ার বাড়িতে সৌনকের সাথে এই সম্পর্কের কথা কেউ জানে না। হিয়া-ই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এ ব্যাপারে কিছু না-জানানোর। হিয়া প্রায় নিশ্চিত ছিল, পেশার মতোই ভালোবাসার মানুষটিকেও বাড়িতে মেনে নেবে না। সৌনকের বাড়িতে এটা নিয়ে বিশেষ কোনও সমস্যা হয়নি কারণ বাড়িতে বৃদ্ধা মা ছাড়া আত্মীয় বলে আর কেউ নেই।

(৪)

-জায়গাটি ভারি সুন্দর, সৌনক! আমরা আরো একবার এখানে আসব, কেমন?
বরন্তির লেকের জলে পা ডুবিয়ে অনেকক্ষণ দূরের আকাশের দিকে বুঁদ হয়ে তাকিয়ে ছিল হিয়া। সম্বিত ফিরল সৌনকের ডাকে।
-ভালো লেগেছে তাহলে? আমি অবশ্য জানতাম তোমার ভালো লাগবে। বরন্তির মধ্যে একটা কুহক আছে, মানুষকে খুব কাছে টানে।
-তুমি লাস্ট এসেছিলে কত বছর আগে?
-উমম, তাও প্রায় তেরো কি চৌদ্দ বছর তো হবেই! আমি সেই পুরনো ম্যাজিক টা আরেকবার রিভিসিট করব বলেই তোমায় বরন্তির ব্যাপারে ইনসিস্ট করছিলাম! অনেক কিছুই পালটে গেছে সময়ের সাথে, তবুও সেই পুরোনো ফ্লেভারটা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি।
-চলো একটু হেঁটে আসি। এমন খোলা আকশের নিচে সবুজ ঘাসে হাঁটবার সুযোগ খুব একটা তো পাওয়া যায় না!
-আচ্ছা বেশ, ঐদিকটায় চলো তাহলে।
-বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়। রোদ্দুরের তাপ এখন অনেকটাই কম। রোদচশমাটা আর পরে থাকবার কোন মানে হয়না। এতক্ষণে সৌনক হিয়ার চোখের কাজল লক্ষ্য করল। হিয়া এমনিতে খুব বেশি সাজগোছ পছন্দ করেনা। তবে কাজল পড়তে ভীষণ ভালোবাসে। বেশ মানায়ও হিয়াকে কাজল পড়লে।
-খালি পায়ে হাঁটব, সৌনক?
হিয়ার ছেলেমানুষি দেখে হেসে ফেলে সৌনক।
– হঠাৎ এমন ইচ্ছে?
-চলো না একটু খালি পায়ে হাঁটি। জোঁকের ভয় নেই তো?
-জোঁক থাকলেও সেটা জঙ্গলের ভিতর দিকটায়। এখানে পরিষ্কার মাটিতে থাকবে না নিশ্চয়ই। তাছাড়া এখন মিড-অক্টোবর। এই সময়ে জোঁক থাকবে বলে মনে তো হয়না। তবে তুমি খালি পায়ে হাঁটলে আমিই বা স্যান্ডেল পড়ে থাকি কিভাবে? চলো তাহলে আড্যাম আর ইভের মত খালি পায়ে হেঁটে বেড়াই।
লেকের ধার বরাবর ভিতরের দিকে কিছুটা হেঁটে গেল ওরা। প্রথমবার যে কটেজ টায় সৌনকের রাত কেটেছিল, সেখানে একবার এসে দাঁড়াল। মূল কটেজটি আর আগের মত নেই। বলাই বাহুল্য, এখন অনেক বেশি ঝা-চকচকে। বারান্দায় সেই প্লাস্টিকের চেয়ারের পরিবর্তে সাজানো নয়নাভিরাম বেতের আরামকেদারা। বারান্দায় সাজানো ল্যাভেন্ডার সহ আরো নানা বাহারি ফুল। মোতিলালের ঘরটাও আগের মত নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল মোতিলাল তার বউ কে নিয়ে দেশে ফিরে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। এখন ওর ছেলে এই কটেজে কেয়ারটেকারের কাজ করে।
কি হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে যে? চলো!
ঐ যে কটেজটা দেখছ, ওখানেই প্রথমবার আমি এসে ছিলাম জানো! তখন সবে কটেজটা তৈরি হয়েছে, এত সাজানো-গোছানো ছিল না মোটেই। ঐ বারান্দায় যেখানে এখন বেতের ইজিচেয়ারগুলো দেখছ, ওখেনেই একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে জোনাকির আলো দেখে আর মোতিলালের গান শুনে বিভোর হয়ে একটা রাত কাটিয়েছিলাম। তখন আমি সবে উনিশ। বুঝতেই পারছ, সেই বয়সের রোম্যান্টিকতা।
-মোতিলাল কে? হিয়া জানতে চায়।
-আসলে তখন তো আজকের মতো হোটেল বা রেস্তোরাঁ এখানে ছিল না! তখন কটেজগুলো দেখাশুনো করার জন্য এখানে লোক রাখা হতো। ওরাই রান্নাবান্না করে দিত, যত্ন করে খাওয়াতো। আমাদের কটেজে রান্নাবান্না করে দিয়েছিল ঐ মোতিলাল। তবে ওর যে ছেলে ছিল তা জানতাম না। সেবারে এসে দেখিনি। কটা বাজল দেখোতো।
ডান হাতের ঘড়িতে সময় দেখল হিয়া। সাড়ে চারটে।
-চা খাবে?
-হ্যাঁ, খেলেই হয়। আর তো বেশিক্ষণ বোধহয় বাইরে থাকা যাবে না! সন্ধ্যে হয়ে এলো। এমনিতেই জায়গাটি বেশ নিঝুম, তার উপর লেট অক্টোবর। তাড়াতাড়িই অন্ধকারের নীরবতা নেমে আসবে মনে হচ্ছে। চলো, চা খেয়ে বরং কটেজে ফেরা যাক। রাত্রের খাবারও তো অর্ডার করতে হবে! রিসেপশন থেকে তো বলেছিল সন্ধ্যে সাতটার মধ্যেই জানিয়ে দিতে।
সৌনক এগিয়ে গেল সামনেই একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে। মাটির বড় ভাঁড়ে বেশ অনেকটা পরিমাণ চা একটা এগিয়ে দিল হিয়ার দিকে। তারপর দাম মিটিয়ে নিজের চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে এসে বসল দোকানের পাশে রাখা কাঠের বেঞ্চে। হিয়াও এসে বসল পাশে।
-পুরোনো কথা মনে পড়ছে খুব, তাই না?
-হ্যাঁ, তা তো বটেই। তখন তো আমার ক্যামেরা ছিল না, নিদেনপক্ষে একটা ছবি তোলা যায় এমন মোবাইল থাকলেও কিছু ছবি তুলে রাখতে পারতাম! সেই পুরনো বরন্তী তো এখন আর নেই! আমার কিশোর চোখে দেখা সেই বরন্তী আরো সুন্দর ছিল। অগোছালো, এলোমেলো সুন্দর। এখনকার বরন্তী অনেক পরিণত। সেই অগোছালো বরন্তীর কোন শরীরী ছবি নেই। মনেই রয়ে গেছে।
-ডোন্ট ফিল ব্যাড ফর দিস! আমার ভীষণ ভালো লাগছে এখানে এসে। এখনকার ছবিগুলো তুলে রেখো। আবার যখন আমরা রিভিসিট করবো তখন এই পুরোনো ছবিগুলো থেকে যাবে সাথে।
চা শেষ করে ওরা উঠে পড়লো। সন্ধ্যে নামছে। পশ্চিমে লাল ধরেছে। বরন্তী’তে সান-সেট বড় মায়াবী। লেকের জলে অস্তগামী আকাশের অলৌকিক সুন্দর ছবি সৌনক দেখেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আজ যখন সাথে ক্যামেরা রয়েছে তখন এ সুযোগ ছাড়া যায় না! হোক দেরী, পুরো সূর্যাস্ত না দেখে এবং মনমতো ছবি না তুলে কটেজে ফিরতে চাইলো না সৌনক। হিয়া’ও অবশ্য কটেজে ফেরার কথা সাময়িক ভুলে গেল। নিঃশব্দ বরন্তী, মাথার উপর এক স্বর্গ-খোলা আকাশ, লেকের জলে বিদায়ী আকাশের ম্যভ রঙ ততক্ষণে বশীভূত করেছে হিয়াকে। সৌনক কিছুটা এগিয়ে গেছে সামনের দিকে, পছন্দমতো শট নিতে। ট্রাইপড সেট করে, লেন্সের মুখে পোলারাইজ্‌র বসিয়ে তুলে নিচ্ছে একের পর এক ছবি। কিছুটা দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে সৌনক যেন এই অস্তগামী আকাশের অমৃতস্যঃ পুত্র। সাধকের সাধনায় ভঙ্গ হতে পারে ভেবে হিয়াও কিছুটা দূর থেকেই সৌনক’কে দেখছে। এত বড় আকাশ আজ অনেকবছর পর এভাবে দেখতে পাচ্ছে হিয়া। কোলকাতায় এ-সুযোগ তো খুব বেশি মেলে না! অক্টাভিও পাজ্‌ এর কবিতার সেই লাইনটি মনে পড়ছে হিয়া’র- “Unknowing I understand: / I too am written,” এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘটেছে, কিংবা ঘটে চলেছে অবিরাম, অবিরত তার প্রত্যেকটিই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রত্যেকটি জন্ম, প্রতিটা মৃত্যু, সমস্ত আগমন এবং প্রত্যাগমন পুর্বনির্ধারিত।
ঘোর কাটল সৌনকের ডাকে।
-হিয়া একটু এদিকটায় এসো।
হিয়া এগিয়ে গেল সৌনকের দিকে। খুব কম আলো অবশিষ্ট আছে তখন।
-কতবার ডাকলাম তোমায়! শুনতেই পেলে না! কি ভাবছিলে এত মন দিয়ে?
-আমি ঠিক খেয়াল করিনি সৌনক। বল, কি বলবে? এখনই কটেজে ফিরব না কিন্তু! প্লিজ! আরেকটু থাকি! এখন একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না। রাত্রের খাবারের কথা আমি ফোনে জানিয়ে দিয়েছি।
-না, না! আমিও যাওয়ার কথা বলছি না। আমি ডাকলাম তোমার একটি ছবি তুলব বলে। অবশ্যই যদি তুমি চাও তবেই…
-না চাওয়ার কিছুই নেই। র‍্যাদার, আই উড্‌ লাভ তো পোজ ফর দিস! কিন্তু এত কম আলোয় ছবি হবে কিছু?
-তুমি এতো চাপ নিচ্ছ কেন? সে দায়িত্ব আমার। তোমার কুর্তির রঙটা এই মুডে এক্কেবারে আইডিয়াল! তোমাকে যেভাবে দাঁড়াতে বলছি সেভাবে একটু দাঁড়াও তো! ফলো মাই ইন্সট্রাকশন, ডিয়ার। লেট্‌স ড্রিঙ্ক দিস সানসেট টু দ্য লিজ্‌!
সদ্য উড়তে শেখা প্রজাপতির মত আনন্দে ছুটে গেল হিয়া। দিনের শেষ আলোয় হিয়ার কয়েকটি ছবি তুলল সৌনক। আলো এখন প্রায় নিভু নিভু। আর্টিফিশিয়ল লাইট ব্যবহার করতে না চেয়ে সৌনক ডেকে নিল হিয়াকে। এখন আর ছবি তোলা যাবে না। তারচেয়ে বরং বাকি সময়টুকু আকাশ দেখে কাটিয়ে দেওয়া বেটার।
পাশাপাশি বসে রয়েছে দুজন। হিয়া আলতো করে সৌনকের কাঁধে মাথা রেখে ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখছে এক এক করে। সৌনকের দৃষ্টি আটকে রয়েছে দূরে ঐ মালভূমির মত টিলার দিকে। অন্ধকার নেমে এসেছে। ঝিঝি’র ডাক শোনা যাচ্ছে। এমন সময় সৌনক কথাটি বলল-
-তোমার কয়েকটি ন্যুড’স তুলতে দেবে, হিয়া?
-সৌনক!!!

(৫)

অন্ধকার হয়ে গেছে। সৌনক মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে কটেজের দিকে ফিরতে লাগল। হিয়া সৌনকের হাত ধরে ছিল। খুব বেশি কথা বলছে না দেখে সৌনক একটু রিপেন্ট করছিল মনে মনে। হিয়াকে ওভাবে কথাটা না বললেই পারতো হয়তো! হিয়ার নিশ্চয়ই কথাটা খারাপ লেগেছে!
-সরি, হিয়া! আমি কিন্তু কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কথাটি বলিনি। বুঝতে পেরেছি, তোমার কথাটি খারাপ লেগেছে। তারপর থেকেই তুমি কেমন চুপ করে আছো। এক্সট্রিম্‌লি সরি, আই মাস্ট হ্যাভ ব্রোকেন দ্য লিমিট!
-‘লিমিট’ আমরা অনেক আগেই ভেঙেছি সৌনক। আর সেই জন্যই এখানে একসাথে আসতে পেরেছি, একই ঘরে একসাথে থাকছি। এইসব ভিক্টরিয়ন ম্যরালিটি নিয়ে আমি ভাবিনা, তা তুমি ভালোভাবেই জানো। একঘরে একসাথে না-থাকলেও আমাদের রেজিস্ট্রি পেপারগুলো মিথ্যে নয় নিশ্চয়ই। সমাজ চাপানো সম্পর্ক নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না!
-তাহলে এমন চুপ করে গেলে কেন? তোমার অনিচ্ছায় নিশ্চয়ই তোমাকে পোজ্‌ দিতে আমি বাধ্য করবো না, এটুকু বিশ্বাস আছে নিশ্চয়ই?
-ডোন্ট কপ্লিকেট সৌনক! আমি এসব কিছুই ভাবছি না! আসলে আই ওয়াজ্‌ নট প্রিপেয়ার্ড। তুমি আচমকা প্রস্তাবটি দেওয়ায় একটু আননার্ভড হয়ে গেছিলাম। ইট্‌স ওকে নাউ!
-বাঁচালে! খুব গিল্টি ফিল করছিলাম।
-কাম্‌ অন, গ্রো আপ! এতে গিল্ট ফিল করার কিছু নেই। আফটারল, ইয়ু’ভ টেক্‌ন মাই কন্সেন্ট এবং শরীর নিয়ে আমার কোনো কমপ্লেক্স-ও নেই। তুমি জানো সেটা।

কটেজের সিঁড়ির দু’পাশে নাম-না-জানা কিছু ফুল গাছ লাগান রয়েছে। তালা খুলে হিয়া’রা রুমে ঢুকল। সৌনক কাঁধ থেকে ক্যামেরার ভারি ব্যাগটা নামিয়ে একটু আরমোড়া ভেঙ্গে নিল। সারাদিন ক্যামেরার ব্যাগ বয়ে বেড়ানো নেহাৎ কম পরিশ্রমের নয়!
“তুমি আগে যাবে নাকি আমি যাব?” সৌনক জানতে চাইল।
“লেট মি গো ফার্স্ট। ক্লান্ত লাগছে। একটু ফ্রেশ না হলেই নয়!” হিয়া জানাল।
-দেখো আবার, স্নান করো না যেন! নতুন জায়গা, এখানকার জল কিন্তু বেশ ঠাণ্ডা। সর্দি-জ্বর বাধিয়ে বসো না।
-না রে বাবা, সবসময় এত জ্যাঠামো করো না তো! আমার ফেস-ওয়াশ’টা ব্যাগে আছে, একটু এনে দাও প্লিজ!
হিয়া বাথরুমে ঢুকে গেলে সৌনকও টি-শার্টটা চেঞ্জ করে বারান্দায় বেতের চেয়ারটায় এসে বসল। বারান্দাজুড়ে বেশ কিছু অর্কিড রয়েছে। সৌনকদের রুমের ঠিক পাশের রুমটায় কোনো বোর্ডার না থাকায় একদিকে ভালোই হয়েছে। একটু বেশি প্রাইভেসী পাওয়া গেছে। বেতের চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুঝে রইল। একটা ছোট্ট মিনিট দশেকের ন্যাপ নিলে মন্দ হয়না। ক্লান্তিতে সৌনকের একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। হিয়া এসে কপালে ঠান্ডা হাত রাখায় সম্বিত ফিরে পেল।
-ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম? খুব টায়ার্ড লাগছে, না? রুমে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও না-হয়।
– আরে না, না! চোখটা একটু লেগে এসেছিল আরকি! তোমার হয়ে গেছে?
-হ্যাঁ, তুমি যাও। একটু ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি কি একটু চায়ের অর্ডার দেব? হিয়া’র পারফিউমটা সৌনকের বেশ পছন্দ।
-হ্যাঁ, চায়ের সাথে স্ন্যাক্সও কিছু বলে দিও। পকোড়া গোছের কিছু যদি পাওয়া যায়! খুব খিদে পেয়েছে। আমার বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। তুমি একটু বারান্দায় বোসো না-হয়। অড্‌ ফিল করলে ঘরে এসে বোসো , জানালা দিয়ে শিউলির গন্ধ পাবে।
সৌনক চলে গেলে হিয়া দুটো চা আর শিঙাড়ার অর্ডার দিয়ে বারান্দায় এসে বসল। ঘড়িতে মাত্র সাড়ে সাতটা বাজলেও বরন্তীর জঙ্গলে এখনই যেন মধ্যরাত্রি। দূরে, বহুদূরে বিক্ষিপ্ত কিছু আলো টিমটিম করে জ্বলছে। হিয়ার মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় যখন মাঝে মাঝে রাত্রের ট্রেনে মামাবাড়ি থেকে ফিরত, তখন লাইনের ধারে এমন ছোট ছোট আলো দেখে কল্পনার গভীরে হিয়া হারিয়ে যেত। কটেজের সামনে অনতিদূরে পাকুড় গাছে ততক্ষণে জোনাকিদের বাসর জমেছে। মানুষের গলার স্বর খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। দূরে কোথা থেকে একটি গানের কথা হাল্কা ভেসে আসছে, মোবাইল বাজছে সম্ভবত। অন্ধকারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পুরনো দিনের বেশ কিছু স্মৃতি আলগা খেলা করে যেতে লাগল হিয়ার মনে। স্ট্রিম অব কনশাসনেসের মত অনেকগুলো ভাবনা মনের ভিতর ইতিউতি পাক খেতে লাগল। দুর্গা প্রতিমা জলে পড়লে মায়ের চুলগুলো যেভাবে জলে ভাসতে থাকে, অনেকটা তেমনভাবে- অগোছালো, ভাসাভাসা, এলোমেলো। ক্লাস এইট- অষ্টমীর সকাল- অঞ্জলী হয়ে গেছে- ভোগের প্রসাদ- পাড়ার এক দাদা বাড়ি বয়ে প্রসাদ দিতে এলো- হিয়া বাড়িতে তখন একা- সেই সুজোগে পিছন থেকে হিয়ার অন্তর্বাসহীন বুক খামচে ধরেছিল ভোগ বিতরণ করতে আসা দুটো ভোগী হাত। ভয়ে- লজ্জায়- যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে কেঁদেছিল হিয়া অনেকগুলো দিন। বছর তিনেক বাদে সেই পাড়ার দাদা এসেছিল বাড়িতে। বিয়ের নিমন্ত্রণের কার্ড দিতে। বাড়ির সবাইকে নিমন্ত্রণ করে হিয়া’কে দেখে বলেছিল, “এসো কিন্তু অবশ্যই!” নিজের ঘরে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে ছিল সেইদিন, সারাদিন। কোনদিনও কাউকে বলতে পারেনি এই ঘটনার কথা। স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে কলেজ, তারপর ইউনিভার্সটি তারপর…
চোখ বুঝে এল হিয়ার!
-উফফ, শান্তি। স্নানটা করেই নিলাম বুঝলে! জল দেখে আর রেজিস্ট করতে পারলাম না। জ্বর-টর নিশ্চয়ই আসবে না, বলো?
-জ্ঞানপাপী! তাহলে আমায় নিষেধ করলে কেন?
-চলো তাহলে! আরেকবার! এবার নাহয় একসাথেই…
-ফাজলামি না করে বোসো। চা বলেছি অনেকক্ষণ আগে। পকোড়া পাইনি, শিঙাড়া দিয়ে কাজ চালাতে হবে কিন্তু!
সৌনক পাশের চেয়ারে বসল। খুব ফ্রেশ লাগছে এখন। সাথে খিদেও চাগাড় দিয়েছে বেশ ভালোরকম! লজের দেখাশুনো করে যে ছেলেটি সে এসে চা, শিঙাড়া আর মুড়িভাজা দিয়ে গেল। রাত্রের খাবার ন’টা নাগাদ দিয়ে যাবে, জানিয়ে গেল।
-তারপর বলো, বরন্তি কেমন লাগছে? চা’য়ে একটা সিপ নিয়ে আরাম গলায় সৌনক জিগ্যেস করলো।
-দারুণ! সত্যিই এই অন্ধকারের মধ্যে একটা কুহক আছে। ভীষণ কাছে টানে।
-আমি ভীষণ শান্তি পাই এখানে এসে। যদিও মাত্র দু’বার-ই এসেছি। দূরে ঐ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে হয় জীবনে যেন কোন ব্যাথা নেই! খামোখা আমরা এত অভিযোগ করি, অভিসম্পাত দিই।
-জানো, এখানে বসে অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ২০১৭’র শান্তিনিকেতন মনে পড়ে? কঙ্খালিতলা?
-ওহ গড, ভুলতে পারি? আমার তখন টিউশনির টাকা জমিয়ে কেনা একটা দশ-হাজারী পয়েন্ট-এন্ড-শ্যুট ক্যামেরা। কঙ্খালিতলায় বসে মন্দিরের পিছনে আদিবাসীদের নদী পার হওয়ার ছবি তুলছি। এমন সময় সামনে এগিয়ে এলো এক ছিপছিপে তরুণী। নাম হিয়া বোস। ইংরাজীর ছাত্রী। সাথে আরেক সুন্দরী বান্ধবী। আমায় এসে ভীষণ ম্যানারড্‌ গলায় বলল, “এক্সকিউজ মি, আমাদের একটা ছবি তুলে দেবেন?” তার হাতে একটি ডি-এস-এল-আর। আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
-আর তুমিও ওমনি ক্যামেরার অটো-মোড অন করে আমাদের কয়েকটি ছবি তুলে দিলে। বুঝতেই দিলে না তুমি তখন জানতেই না কিভাবে ম্যানুয়ালে ছবি তুলতে হয়!
-আজ এত বছর পরে হঠাৎ পুরনো কথা? এখানে এসে মন খারাপ হয়ে গেল নাকি?
-সৌনক, একটা সত্যি কথা বলবে? আমি একদম অনেস্ট উত্তর চাইছি!
-এনিথিং সিরিয়াস? শিঙাড়া, মুড়ি কিছুই তো খেলে না! ঠান্ডা হয়ে গেল তো। খিদে পায়নি?
-সত্যি করে বলো, তুমি যে আমার নিউড্‌স তুলতে চাইলে, তা কি শুধুই শিল্পের টানে নাকি সবটা শুধুই যৌনতার আকর্ষণ?
-যৌনতার টান যে একেবারে অনুভব করছি না তা নয়, মিথ্যে বলবো না! ইনফ্যাক্ট, এখানে এসে যখন এই ইচ্ছেটি চাগাড় দিয়ে উঠলো, তখন তাতে যৌনতার টান আছে বইকি! তবে তোমায় নিয়ে যে পর্ণ তুলবো না, সেটুকু আমি জানি! এ নিয়ন্ত্রণ আমার থাকবে নিশ্চয়ই। ছবির তো নিজস্ব একটি শরীরী ভাষা আছে, সেই ভাষা নিশ্চয়ই প্রমাণ করবে শিল্প না যৌনতা।
-বুঝলাম, উঠি চলো! বড্ড মশা এখানে। আমায় একটু সময় দাও সৌনক! এর আগেও আমরা অনেকবার কাছাকাছি এসেছি, কিন্তু সেই ব্যাপারটা এক্কেবারে আলাদা ছিল! কিন্তু ক্যামেরার সামনে নিজেকে অব্জেক্টিফাই করাটা বেশ কঠিন। যতই হোক, প্রত্যেকটি ক্যামেরাই তো আসলে পুরুষ! কেমন যেন মনে হচ্ছে অচেনা একজন আমায় দেখতে পাবে!

(৬)

-নগ্নতা’কে তুমি কিভাবে দেখ হিয়া?
– প্রশ্নের বিপরীতে কিছু একটা প্রশ্ন তোমায় করতেই হবে তাই না! তাও আবার মেটাফিজিক্যাল প্রশ্ন! বড্ড বাজে অভ্যেস! মেল শভিনিজ্‌ম!
-আঃ রেগে যাচ্ছ কেন? আচ্ছা সহজ করে বলি তবে। উত্তর দেবে কিন্তু। সংকোচ করো না। যদিও সংকোচ করার মতন মেয়ে তুমি নও। আমাকে একটু ভেবে বলো তো, আমরা পোশাক পরিধান করি নাকি পোশাক আমাদের নগ্নতা’কে পরিধান করে?
– কি গম্ভীর ব্যাপার! এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এত সহজ নয়।
-তবুও একটা কিছু পারসেপসন তো নিশ্চয়ই আছে! সেটাই বলো নাহয়।
-দেখো আমার মনে হয় নগ্নতা অকৃত্তিম। পোশাক দিয়ে যে আইডেন্টিটি প্রকাশ পায় তা পুরোপুরি ম্যানিপুলেটেড, কারপেন্টার’ড।
-ঠিক বলেছ। আমিও তোমার সাথে একমত। তবে এখানে একটা ছোট্ট গণ্ডগোল আছে, বুঝলে?
-কি?
-ধরো আমরা সবাই একটা নগ্ন শরীর নিয়ে জন্মাচ্ছি। সুতরাং সেই অর্থে ন্যূডিটি একেবারে প্রাইমাল বা যাকে বলে আদিম, আদ্য। কি, তাই তো? কোন অসুবিধা নেই তাতে। এবার ধরো, জন্মের পর থেকেই সমাজ বা সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে আমাদের শেখান হয় নগ্নতাকে ঢাকতে এবং সেখানেই চলে আসে পোশাক। তার সাথে যুক্ত হয় ধর্ম। নগ্নতা’কে এই যে পোশাক দিয়ে ঢেকে রাখবার প্রবণতা সেটাও তো প্রাইমাল এবং সেইজন্য সর্বজনীন। তাহলে নগ্ন’তা যদি ইউনিভার্সাল হয়, পোশাক’ও কি নয়?
-ঠিক। কিন্তু নগ্নতা’র মধ্যে একটা, যাকে বলে, সেমনেস কাজ করে। সেখানে কোন ধর্মের বিভেদ নেই, সেন্টার-মার্জিন নেই। দুটি নগ্ন শরীরকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে তুমি বলতে পারবে কে ‘হ্যাভ’ দের দলে পড়ে এবং কে ‘হ্যাভ-নট’ এর দলে? কোন শরীরটা সেন্টারে এবং কোনটা মার্জিনে?
-এখানে কিন্তু একটু ভুল হচ্ছে হিয়া। সেই নগ্ন শরীরটিই ফটোগ্রাফ্‌ড হয় যে শরীর যৌনতার চাহিদা তৈরি করতে পারে। রোদে পুড়ে ঝলসে গেছে যে নারীশরীর কিংবা খেতে না পেয়ে শুকিয়ে যাওয়া, কিসমিস চামড়ার কোন নারীকে নিয়ে কোনদিন কোন ছবি দেখছ? আমি দেখি নি, অন্তত ইদানীংকালের ফটোগ্রাফিতে তো নয়ই! যৌনতা যেমন ফান্ডামেন্টাল নিড, নগ্নতাও কিন্তু ততটাই শ্বাশ্বত, অকৃত্তিম। আমার আপত্তির জায়গাটি কোথায় জানো, ইদানীংকালের নগ্নতার যা ছবি দেখি তাতে ‘সুন্দরের’ ধারণাটি ভীষণভাবে আর্টিফিশিয়ালি ইঞ্জেক্ট করা। এই নগ্নতা বড় একপেশে, বড্ড বেশি মাস্‌-প্রোডিউসড্‌। আমি বলতে চাইছি, নগ্নতা যদি নারীশরীরের অকৃত্তিম অহংকার হয়, সেই অহমিকার প্রতিফলন সকল শরীরেই তো সমান হওয়া উচিত। একজন ওয়েল-টু-ডু নারীর স্তন যেমন একতাল মাংসপিণ্ড, বরন্তীর জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে আসা হতদরিদ্র নারীর স্তনযুগলও সেরকমই মাংসের দলা। কিন্তু, ফটোগ্রাফি, অন্তত আমাদের জেনারেশনের ফটোগ্রাফি, বারবার ফিরে যাচ্ছে প্রথম নারীশরীরে। দ্বিতীয় জনের নগ্নতাকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি না বা শিল্পের আঙ্গিনার জন্য উপযুক্ত বলে মনেই করছি না কারণ সেটি যৌনতার ক্যাপিটালিস্ট ধারণাটিকে স্যাটিস্‌ফাই করে না অর্থাৎ সহজ কথায় সেই শরীর দেখে আমার যৌন হরমোন ক্ষরিত হয়না। ফটোগ্রাফির নামে এই হায়ারার্কী আমি মেনে নিতে পারি না। আই সিমপ্লি কান্ট স্যান্ড দিস্‌।
-তুমি এর আগে তো কখনো ন্যূড তোলো নি। তোমার সাবজেক্ট নয় বোধহয়!
-না, তা ঠিক নয়। বলতে পারো সেভাবে সুযোগ পাইনি।
-সুযোগ তো পেয়েছিলে গতবছর। তবে পিছিয়ে এসেছিলে কেন?
-আমি পারলাম না সেদিন জানো। আর ওটাকে সুযোগ-ই বা বলি কিভাবে? ওটা’কে তো এক্সপ্লয়েট করা বলে। সৌগতদা’র বাড়িতে ওর পার্সোনাল স্টুডিয়োতে সেদিন ওয়ার্কশপ চলছিল সেমি-ন্যূড শটের। আগমনীর থিমে শ্যূট্‌ শুরু হবে। রেজিস্ট্রেশন হয়ে গিয়েছে। একঝাক আলোকচিত্রিদের ভিড়। পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছিল আমার। সৌগতদা’র বাড়িতেই প্রতি বছর দুর্গাপুজো হয়, তুমি তো জানোই। বাড়ির দুর্গা প্রতিমাকে’ই ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সামনে বসানো হয়েছে সেমি-ন্যূড পেইড মডেলকে। মেক-আপ কমপ্লিট। লালপেড়ে সাদা শাড়িতে সাজানো হয়েছে মেয়েটিকে। প্রায়-উন্মুক্ত বক্ষ, আলতা-হাতে ধরে রাখা পদ্ম। আলো বসানো হয়ে গেছে, স্টেজ সেটিংও প্রায় শেষ। মেক-আপ আর্টিস্ট শেষ মুহূর্তের টাচ দিতে ব্যস্ত। আমি তখনও বুঝতে পারছি না ঠিক কোথায় দাঁড়াব! তখনও মডেল হিসেবে সেদিনের এমপ্লয়েড মেয়েটিকে ভালভাবে আমি দেখিই নি। ক্যামেরায় মাউন্ট সেট করে আমি সদ্য আলো মাপতে নিয়েছি এমনসময় কথাটা কানে এলো।
-কোন কথা?
-শুনলাম মেয়েটির বাড়ি ছিল বীরভূমে। ওর বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করতো কেরালায়। বছর পাঁচেক আগে সারা পৃথিবীর মতো আমরাও যখন প্যান্ডেমিক এর সাথে লড়ছি, সেই সময়কার একটা ঘটনা নিশ্চয়ই মনে আছে?
-অনেক কিছুই ঘটেছিল সেই সময়। স্পেসিফিক কোন ঘটনার কথা বলছ?
-মাইগ্র্যান্ট লেবার’রদের একটি দল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় ক্লান্তিতে রেললাইনে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ঘুম আর তাদের ভাঙ্গেনি।
-হ্যাঁ! মনে আছে। ইন-ফ্যাক্ট আমাদের জেনারেশন কোনোদিন-ই সম্ভবত এই ঘটনার কথা ভুলতে পারবে না! একটি ট্রেন ঘুমের মধ্যেই তাদের বুকের উপর দিয়ে চলে যায়! পরেরদিন লাইনের পাশে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল তাদের খন্ড-বিখন্ড বডি-পার্টস এবং কয়েকটুকরো লাল-রুটি। Last Supper!
-সেই দলে মেয়েটির বাবা’ও ছিল। তারপর যা হয় আরকি! হাত বদল, রাত বদল হয়ে মেয়েটি বিক্রি হয়ে যায়! তারপরেরটুকু সহজেই অনুমেয়। “গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য স্ট্রাগ্‌ল।“ এর আগেও নাকি মেয়েটিকে হায়র করা হয়েছিল বিভিন্ন জায়গায় ন্যুড-শটের জন্য। আমি বাদে বাকি-রা সবাই তখন ছবি তোলা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু আমার কেমন যেন হাতটা কেঁপে গেল! বারবার মনে হতে লাগল এই মেয়েটি যদি পরিস্থিতির শিকার না হত, তবে স্বেচ্ছায় কি এতগুলো মানুষের উৎসাহী চোখের সামনে নিজের নগ্নতাকে এভাবে প্রকাশ করতে পারত? পারত কি লেন্সের যে অ-কৃত্তিম পুরুষ গেজ্‌ তার সামনে নিজের যা কিছু ব্যক্তিগত তাকে এভাবে পাব্লিক করতে? পারলাম না। পিছিয়ে এলাম। মন সায় দিল না। বারবার মনে হচ্ছিল একটা কিছু ভুল হচ্ছে। মনের ভিতর দোটানা নিয়ে কোনো শিল্পকর্ম হয় না।
-তুমি তোমার বিবেকের কাছে অনেস্ট ছিলে। কিন্তু মনে রেখো মানবসভ্যতার ইতিহাস কিন্তু এযাবৎ শিল্পের ভাষাটুকুই বুঝে এসেছে এবং আগামীতেও তা-ই বুঝবে। পিছনের গল্পটুকু নিয়ে খুব বেশি ভাব্বার সময় নেই। আমার মনে হয়, যদিও এটা একান্তই আমার মত, তুমি সেদিন ভুল ভেবেছিলে। আর্ট ক্লাসের কথা ভাবো। সেখানে কি হয়? ন্যূড মডেল কে সামনে রেখেই তো ছবি আঁকা হয় সেখানে। সেখানে তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখতে শেখান হয় নারী শরীরের প্রত্যেকটি ভাঁজ, প্রতিটি বিহঙ্গ। এমন কতবার ঘটেছে যে যিনি সেখানে বসে আছেন নগ্ন হয়ে পোজ দিয়ে, তার হয়তো তখন ১০৩ টেম্পারেচার। কিংবা বসে থাকতে থাকতে হয়তো হঠাৎ অনুভব করেছেন তার ঋতুস্রাবের যন্ত্রণা শুরু হয়েছে, আনএস্কপেক্টেডলি! তবুও দাঁত চেপে তাকে বসে থাকতে হয়েছে, অন্তত যতটুকু পারা যায়! কিন্তু আমরা ক’জনই বা এই খবরগুলো জানতে পারি বলো? আলোভরা গ্যালারীগুলোতে যে মেয়েটির শরীর প্রদর্শিত হল শিল্পের দোহাই দিয়ে, তার যন্ত্রণার খবর কেউ রাখল কি? ইতালীয় পেইন্টার Caravaggio তো দেহকর্মীদের ভাড়া করতেন তার ন্যূড চিত্রের জন্য। এতে অসুবিধে কোথায়? পেইন্টিং যা পারে, ফটোগ্রাফিতে তা কি সম্ভব? তুমি কিভাবে নগ্নতার ছবি তুলবে যদি নগ্নতা’কে তুমি সামনে দেখতে না পার? তাছাড়া, সেদিন যে মেয়েটিকে টাকার বিনিময়ে আনা হয়েছিল, সেই মেয়েটির কাছে এটা তো একটি পেশা, ওর উপার্জনের মাধ্যম।
-এটা নিয়ে যে পরে ভাবিনি, তা নয়! তবুও সেদিন ভিতরের সাড়া পাইনি।
-ভালো করেছ। মনের সাথে জোড় খাটিয়ে শিল্পকর্ম হয় না। যাকগে, বাদ দাও। চলো একটু হেঁটে আসি! যাবে?
-এখন? এই অন্ধকারে? বরন্তী এখন গভীর ঘুমে।
-চলো না, একটু লেকের ধার দিয়ে হেঁটে আসি। মোবাইলের ফ্ল্যাশ-লাইট তো আছে। আমি সাথে করে একটা টর্চলাইটও এনেছি। তাছাড়া রাস্তার আলোগুলো একেবারে মন্দ নয়। অসুবিধে হবে না। চলো না…
-এগুলো কি পাগলামি? ঠিকাছে চলো। তবে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে মাথায় রেখ। এটা কিন্তু পুরী কিংবা দীঘার সি-বিচ না। জঙ্গলের একটা নিয়ম আছে।
-না, না। মিনিট দশেকের মধ্যেই না হয় চলে আসা যাবে।

____

 

-উদ্দেশ্যহীন এভাবে হেঁটে চলার অর্থ কি? সৌনক জিগ্যেস করল।
-জীবনে সবকিছুই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, মিস্টার আলোকচিত্রী। ‘অকস্মাৎ’ বলেও একটা শব্দ আছে এ পৃথিবীতে।
-সেকি! হিয়া বোস? জঙ্গলে এসে কি হল আপনার? জীবন দর্শন?
-তা জানি না! তবে আমার খুব খুব আনন্দ হচ্ছে। ঠিক আনন্দ নয়, বরং বলা ভালো ভীষণ শান্তি পেয়েছি এখানে এসে। কি অপার্থিব নীরবতা! আড়ম্বরহীন অথচ কি প্রচন্ড দার্ঢ্যপূর্ণ! আমার সত্যি বিশ্বাসই হচ্ছে না এই মোহ কাটিয়ে কালই আমাদের ফেরত যেতে হবে। কাল বিকেলের ট্রেন, তাই না?
-হ্যাঁ, সেরকমই তো ঠিক হয়ে রয়েছে। আমার অবশ্য কোন কাজ নেই। তুমি দেখ, অফিসে ফোন করে জদি ম্যানেজ করতে পার তাহলে নাহয় আরেকটি দিন আমরা থেকে যেতে পারি। আশপাশটাও একটু ঘুরে দেখা যাবে। টিকিট ক্যান্সেল করে নতুন টিকিট করা এমন কোন ইস্যু নয়!
-আমিও তাই ভাবছি, জানো! যেতে ইচ্ছে করছে না। আরও কিছুখন না-হয় থেকে গেলাম এখানে। তবে আমি অন্য কোথাও যেতে চাইছি না। এখানেই- এই লেক, এই জঙ্গলেই- আরেকটি দিন কাটাব।
-বেশ, তাই হোক। তবে তোমার ছুটির কি হবে?
-দাঁড়াও, আমি এখনই ভাস্বতী’দি কে একটা ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে দি। নইলে তুমিই না-হয় একটু কথা বলে নাও না।
-আমি কথা বলব? তোমার কলিগের সাথে? তাই হয়? ব্যাপারটা বাজে দেখাবে।
-আরে না না। তাছাড়া ভাস্বতি’দি তমাকে বেশ পছন্দই করে। তুমি ফোন করলে ও খুশীই হবে। ছুটি টাও ম্যানেজ হয়ে যেতে পারে।
-ইয়ার্কি হচ্ছে, তাই না? যাও, তুমি কথা বলে নাও। আমি এখানেই বসছি। ঐদিকটায় যাও, এখানে নেটওয়ার্কের সমস্যা হতে পারে।
হিয়া কয়েকবার কানেক্ট করবার চেষ্টা করল। কানেক্ট হল না কল’টা। নেটওয়ার্কের সত্যিই সমস্যা হচ্ছিল। হিয়া মোবাইল হাতে একটু হেঁটে গেল লজের দিকে। ওখানে একটু বেটার নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। মিনিট পাঁচেক বাদেই ফিরে এল।
-কাজ হল?
-হ্যাঁ। ছুটি ম্যানেজ! যদিও আসল কারণটা বললাম না ইচ্ছে করেই। অনর্থক গসিপ করত ফোনে। তাহলে, এবার নিশ্চিন্ত। এখানেই বসে থাকবে নাকি একটু হাঁটবে?
-একটু বসিই বরং।
-ঠিক হ্যাঁয়, হুজুর! কি ভাবছিলে বসে বসে?
-সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছুই না। ওই এলোমেলো, ছাপছাড়া কিছু ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে।
হিয়া সৌনকের কাছে এসে বসল। অনেকটা কাছে। অন্ধকারে বরন্তী একেবারে নিস্তব্ধ। এমন মাত্রাতিরিক্ত নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ যথেষ্টই বাঙময় হয়ে ধরা দেয়। পুজো আসতে আর খুব বেশীদিন বাকি নেই। শরতের ওশ মাখা জঙ্গল থেকে ইতিউতি উঁকি দিচ্ছে জোনাকি। শিউলির গাছগুলো থেকে গন্ধ নেমে আসছে। জামার বুকের বোতামটা আলগা করে লেকের পাশে ভেজা ঘাস-নুড়ির উপর হিয়ার কোলে মাথাটা এলিয়ে দিল সোনক। মাথার উপর কি সুবিশাল অন্ধকার! এই গহন অন্ধকার মানুষকে আদিম করে, খুলে ছড়িয়ে দেয় যাবতীয় কৃত্তিম মোড়ক। নিজের ভেতরের নগ্ন পরতকে উদ্ভাসিত করে নিজের কাছে। ফাঁদ পেতে রাখে মানুষের যাবতীয় প্রিমিটিভিটি জাপ্টে ধরবে বলে। এই অন্ধকার’কে যদি ধরে রাখা যেত ক্যামেরায়। নিকষ, পিচ্ছিল, অনবরত এই অন্ধকার…
হিয়ার পারফিউম’টা সত্যিই অনবদ্য। চোখ বুজে আসে সৌনকের।
-একটা কথা জিগ্যেস করব, সৌনক?
-হুম…
-ফাল্গুনীর সাথে আমায় আলাপ করিয়ে দেবে একদিন?
-কি করবে বলো ওর সাথে আলাপ করে? তাছাড়া আমার সাথে এখন তো আর তেমন যোগাযোগ নেই। ও রয়েছে ওর মতো। আমি রয়েছি আমার জীবনে।
-মনে পড়ে না ওর কথা? দেখতে ইচ্ছে করে না? একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তো তোমরা নিজেদের মধ্যে রাখতেই পারতে।
-তাতে কি লাভ হতো বলো? তোমার সেটা ভালোলাগত? প্রশ্ন উঠত না মনে? তাছাড়া, কবেকার একটা সম্পর্ক! মাঝখানে এতগুলো বছর চলে গেল। বুড়ো হয়ে গেলাম। যে সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেল সেটা নিয়ে…
-সম্পর্ক কি সত্যিই কোনদিন ভাঙ্গে, সৌনক? দুটো মানুষ হয়ত একসাথে থাকে না, একই বিছানায় শোয় না, কথা হয়না; এমনকি দেখাও হয়ত হয়নি আর কোনদিন- তবুও কি একেবারে ভুলে যাওয়া যায়? মুখের মিছিলে চেনা সেই মুখ আবছা হয়ে যায় ঠিকই, তবে নামটাও কি সত্যিই ভুলে যাওয়া যায়? অন্তরের অন্দরে কোথাও কি সে বাস করে না? এত সহজেই কি সবকিছু ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়া যায়? আমি সত্যিই বুঝতে পারিনা, জানো! দুটো মানুষের সাময়িক সম্পর্ক পরিণতি পেল না বলে, তারা পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের বানানো নিয়মগুলো অনুযায়ী একসাথে থাকতে পারল না বলে কিংবা নিজেদের সুবিধেমতো আলাদা হয়ে গেল বলে তাদের মধ্যে কি আর কোন যোগাযোগ থাকতে নেই? যে মানুষটিকে একদিন “ভালবাসি” বললে, তার জীবনটা এখন কোন খাতে বইছে সেটা জানবার সামান্যতম অনুসন্ধিৎসাটুকুও অস্বাভাবিক?
ফোন বেজে উঠলো সৌনকের। লজের রিসেপ্সন থেকে করেছে। রিসিভ করল সৌনক
-লজ থেকে ফোন করেছে। উঠতে হবে গো! অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। চলো ওঠা যাক।
-সৌনক!
-হ্যাঁ, বলো
স্থির জলের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে হিয়া।
-কি হলো, হিয়া? লজে ফিরতে হবে তো। চলো…
-আমি রাজি।
ঝোড়ো হাওয়ায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল কোথাও! ভিজে হাওয়া এসে লাগল মুখে। বুক-খোলা অবিন্যস্ত জামা উড়ে যেতে চাইল শরীর ছেড়ে। বৃষ্টির তোড়ে ছিঁড়ে উড়ে গেল বোগেনভিলার পাপড়ি। কম্পাসহীন জাহাজগুলো ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেল সেইসব বন্দরে যেখানে তাদের কখনোই যাওয়ার কথা ছিল না। নৈশব্দ ভেঙে ছুটে এলো অর্বুদ অর্বুদ শব্দ। বইপাড়ার ভিজে গলিতে হাতধরে বৃষ্টিতে ভিজল বহুবছর-বাদে-হঠাৎ-দেখা-হয়ে-যাওয়া দু’জন। লকগেট খুলে ঢুকে পড়ল অচেনা কত স্রোত। শান্ত বরন্তীর বুক জুড়ে যেন জয়ের অলকানন্দা; “হৃদি ভেসে যায়…”

—-

অনতিদূরে একটি জোনাকি গাছ। জালানা দিয়ে বেশ দেখা যায়। একে একে দরজা ও জানালাগুলো বন্ধ করল সৌনক। নিশুতির কুহক চাউর হচ্ছে একটু একটু করে। বাইরে অন্ধকার তখন স্যাঁতস্যাঁতে মেঘের মত চেপে ধরেছে। ঘরের ভিতর সৌনক তখন আলো সাজাতে ব্যস্ত; সেইটুকু আলো যা দিয়ে হিয়া’কে নতুন ভাবে উদ্ভাসিত করা যায়। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল হিয়া। আবরণহীন অথচ বর্ণময়।
-একটু তাড়াতাড়ি, সৌনক। অস্বস্তি হচ্ছে একটু। ব্যাপারটা বেশ কঠিন।
-অসুবিধা হলে থাক নাহয়?
-না ঠিক আছে, তবে একটু তাড়াতাড়ি…
আলো সেট হলে সৌনক হিয়াকে নির্দেশ দেয়। সৌনক লেন্সের পিছনে, সামনে অধীর অপেক্ষায় হিয়া। হিসেবের চৌকাঠ পেরিয়ে পার হয়ে গেল বেশ কিছুটা সময়। দুজনের কারোর মুখেই কোনো কথা নেই; শব্দেরা যেন পথ ভুলেছে। একটা অস্বস্তি সৌনকেরও হচ্ছিল বৈকি! নগ্নতার যে প্রচলিত ছবি সৌনক দেখেছে, সেরকম ছবি সে তুলতে চায়নি। কিন্তু আশ্চর্য! অচেনা ছবিগুলো যেগুলো সৌনকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেগুলো হঠাৎ যেন মিলিয়ে যেতে লাগল…

আচমকা লেন্সের ক্যাপ বন্ধ করে দিল সৌনক।
-হচ্ছে না হিয়া। চলে এসো।
-সেকি? কী হলো হঠাৎ?
-হাত কাঁপছে হিয়া। শরীর জেগে উঠছে। এটা যৌনতা, শিল্প নয়। আমি নগ্নতায় শিল্পের ভাষা খুঁজতে চেয়েছিলাম, যৌনতা নয়।

আলো নিভিয়ে হিয়ার মাঝে এসে দাঁড়ায় সৌনক। অন্ধকারে ঢেকে নেয় হিয়াকে; পোশাকে ও পৌরুষে। জানালার আলতো সরানো পর্দা দিয়ে নাম-না-জানা এক আলোর ভগ্নাংশ এসে ঢুকছে ঘরে। চোখ বুজে আসছে হিয়ার ক্লান্তিতে, শান্তিতে কিংবা স্মৃতিতে! সেই ক্লাস এইট- অষ্টমীর সেই সকাল- অঞ্জলী- ভোগের প্রসাদ- পাড়ার সেই দাদা- হিয়া একা- অন্তর্বাসহীন বুক- দু’টো ভোগী হাত…
নীরবতা কাটল হিয়ার প্রশ্নে।
-সৌনক, এবছর অষ্টমী কবে?

*******

শিউলির গন্ধে কেটে গেল বাকি রাতটুকু।

 


 

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!