Home সামাজিক, গল্প ধনতেরাস
সামাজিকগল্প

ধনতেরাস


সুমিতা বেরা


বাবুলাল… এই বাবুলাল… দোতলার জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে রোহিত ডাকছে! বাবুলাল … এই বাবুলাল… বাবুলাল তখন খুপরি চায়ের দোকানে বসে রুটি সেঁকছিলো। আর ওর বৌ বেলে বেলে দিচ্ছিলো… খোলা দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে বাবুলাল জিগ্যেস করলো —-কি বলছিস? রোহিত রুটি চিবোতে চিবোতে বললো — শোন,আর চারটে রুটি দিয়ে যা… বাবুলাল জিগ্যেস করলো –এখনই? রোহিত বললো —হ্যাঁ , একটু তাড়াতাড়ি দিয়ে যা… বাবুলাল উনোন থেকে গরম তাওয়াটা নামিয়ে চারটে গরম রুটি ঠোঙায় ভরে ঢিলে হয়ে যাওয়া লুঙ্গিটা টাইট করে বেঁধে বৌকে বললো —-বাদ বাকি রুটি গুলো সেঁকে ফেলো, আমি আসছি.. ওদের পাঁচ বছরের ছেলে ছোটন তখন দোকানের এক কোনে বই নিয়ে বসে পড়ছিলো আর আধো ঘুমে আধো ঘুমে সব দেখছিলো।

গলিরাস্তার ধার ঘেঁষে রোহিতদের দোতলা বাড়ি… তার বিপরীতে বাবুলালের ছোট খুপরি চায়ের দোকান… বাবুলাল রোহিত একই পাড়ার আশৈশব তুই তোকারির বন্ধু… ওর দোকানে দিনের বেলা চা বিস্কুট পাউরুটি ইত্যাদি বিক্রি হলেও সন্ধ্যে থেকে শুধু রুটি বানায় বাবুলাল আর ওর বৌ দুজনে মিলে.. অফিস ফেরতা এপাড়া ওপাড়ার বাবুরা বাবুলালের দোকানের গরম রুটি কিনে বাড়ি যায়… তাই অনেক বাড়িতেই রুটি করার ঝামেলা নেই… রোহিতের মত অনেক অফিস ফেরতা লোকই বাবুলালের দোকানের রুটি কিনে নিয়ে যায়।

বাবুলালের ছেলে ছোটন, ছোট হলে কি হবে অনেক বোঝে! আধো ঘুমে এতক্ষন ও সব দেখছিলো। ও জানে বাকি রুটিগুলো ওদের খাবার জন্য বানানো হচ্ছিলো, তার থেকে বাবা চারটে রুটি দিয়ে এলো ! তার মানে আজ মা বাবা ভাত রুটি মিশিয়ে খাবে… ও বললো –“মা খিদে পেয়েছে খেতে দাও”… ওর মা তখন উনোনে কড়াই বসিয়ে ওবেলার তরকারিটা গরম করছিলো… বললো —হ্যাঁ বাবা দিচ্ছি… মুড়ির টিন বের করলো… তারপর তিন জন একসাথে খেতে বসলো.. ছোটন দেখলো —- মা বাবা মুড়ি রুটি ভাগাভাগি করে খাচ্ছে! এই ভাবে ভাগাভাগি করে দারিদ্রের মধ্যে চলে ওদের সংসার। রোজ রোজ এই শুকনো তরকারি আর রুটি খেতে ছোটনের ভালো লাগে না. কিন্তু তবুও ও কিছু বলে না… এই তো সেদিন পল্টুদের বাড়িতে খেলতে গেছিলো, ওর মা ছোটনকে এক বাটি পায়েস দিয়েছিলো খেতে… কি মিষ্টি আর সুস্বাদু! ছোটন বাড়ি এসে বায়না করেছিলো — মা অমন পায়েস বানিয়ে দাও না .. মা রোজ ই বলে দেবো দেবো… কিন্তু বানিয়ে দেয় না! ওদের চায়ের দোকানে দুধ চিনি সব আছে তবুও দেয় না! ছোট্ট ছোটনের অভিমান হয়েছিল… কিন্তু মায়ের মলিন মুখ দেখে এখন আর বায়না করে না… ছোটন ছোট হলে কি হবে! ও অনেক কিছু বোঝে।

খেলতে গিয়ে ছোটন দেখেছে —— পল্টুদের বাড়ি কেমন সাজানো গোছানো! পল্টুর কত্ত খেলনা! কত্ত জামা! ওর বন্ধু পিন্টুর মায়ের কতো নতুন নতুন শাড়ি , গা ভর্তি গয়না! ওর মায়ের তো মোটে তিনটে শাড়ি ঘরের দড়িতে ঝোলে! দুটো খারাপ শাড়ি বাড়িতে পরে… ভালো শাড়িটা ছোটন কে স্কুলে দিতে যাওয়ার আনার সময় পরে মা। ওর বাবার পরনে বারো মাস খালি একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি! ওর ও তো মোটে দুটো জামা…! ছোটন অনেক বুঝতে শিখেছে…! বুঝতে শিখেছে —- ওদের ঘর সবার ঘরের চেয়ে মলিন।! তাই ও কোনো বায়না করে না…।

কালীপুজোর আর দু দিন বাকি, ছোটনদের পুজোর মাঠে প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হয়ে গেছে… ছোটনদের এখন পুজোর ছুটি চলছে স্কুলে… ছোটন তাই সকাল সকাল একটু পড়াশোনা করেই ছুট লাগায় মাঠে… ওর পাড়ার অনেক বন্ধু আসে পল্টু মিন্টু পিন্টু আরও অনেক ছেলে জড়ো হয় সেখানে, ওরা মাঠে ছুটোছুটি করে… বাঁধা বাঁশ ধরে ঝোলে… হৈহুল্লোড় করে…

ছোটনের বাপ্ দোকানে থাকে। সেই ফাঁকা সময়ে ছোটনের মা ওদের বাসি ঘর ঝাঁট দিয়ে মুছে পরিষ্কার করে নেয়। তারপর তো সারাদিন দোকানে থাকতে হয়…

প্রতিদিনের মতো সেদিনও জল ন্যাতা দিয়ে ছোটো ঘরটা মুচ্ছিলো ছোটনের মা… এমন সময়ে মা… ও… মা…. মা.. ছোটন ডাকছে…! ছোটনের মা ঘর মুছতে মুছতে খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেলো —– দোকানের পাশ দিয়ে ছোটন ছুটতে ছুটতে আসছে.. মা.. ও.. মা.. ছোটনের মা বালতিতে জল ন্যাকড়াটা রেখে দরজার সামনে এসে জিগ্যেস করল —কি হয়েছে ছোটন ? ছোটন হাঁফাতে হাঁফাতে আস্তে করে বললো —-জানো মা আজ ধনতেরাস…! ওর মা বললো —কি! ছোটন ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বললো —— আজ ধনতেরাস! জানো মা! পল্টু বলছিলো —— এই দিনে কিছু জিনিস কিনলে নাকি সুখ সমৃদ্ধি হয়! ধনদৌলত সমৃদ্ধি হয়! মা, সমৃদ্ধি মানে কি? ছোটনের মা তো অবাক! জিগ্যেস করলো —— তুই এসব জানলি কি করে?  ছোটন বললো —— বা রে! পল্টু তো বললো , —– ওর মা নাকি ওর বাবা কে বলছিলো —- বাজারে যাবে জিনিস কিনতে, এই দিন নতুন জিনিস কিছু কিনলে সুখ সমৃদ্ধি হয়, ধন দৌলত সমৃদ্ধি হয়… তারপর আবদারের সুরে বললো —— বলো না মা, সমৃদ্ধি মানে কি? ছোটনের মা মৃদু হেসে বললো —– সমৃদ্ধি মানে হোলো বেড়ে যাওয়া… বৃদ্ধি পাওয়া… সুখ সমৃদ্ধি, টাকাপয়সা সমৃদ্ধি! ও তুমি এসব এখন বুঝবে না… ছোটন চোখ বড়ো বড়ো করে, মায়ের হাঁটু দুটো আরও জোরে চেপে ধরে আবদারের গলায় বললো —-মা তুমিও যাও না আজ বাজারে… কিছু জিনিস কিনে আনো… তাহলে দেখবে আমাদের ও অনেক টাকা পয়সা সমৃদ্ধি হবে.. সুখ সমৃদ্ধি হবে!

ছোটনের মা একটু হেসে বললো — ঠিক আছে, তুমি এখন খেলতে যাও.. আমাকে কাজ করতে দাও.. ছোটন আনন্দে লাফাতে লাফাতে মাঠের দিকে গেল.. ছোটনের মা ঘর মুছতে মুছতে ভাবলো —সত্যি কি এই দিনে কিছু কিনলে লক্ষ্মী লাভ হয়? সুখ সমৃদ্ধি হয়? এই তো গতবছর পাপাইয়ের মা ধনতেরাস এর দিন এসে বলেছিলো… বাজারে যেতে… এই দিন নাকি নতুন কিছু কিনলে ঘরে সুখ সমৃদ্ধি হয়… ধনদৌলত বৃদ্ধি পায়… যেতে বলছিলো.. তা সে বছর ছোটনের মা যায়নি —- ঘরে খাবারের পয়সাই জোটে না, তার আবার জিনিস কেনা! কিন্তু এই বার ছেলে বায়না করেছে ….

ঘর লাগোয়া এক চিলতে বারান্দাটা মুছতে মুছতে ছোটনের মা চিন্তা করলো — সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে লক্ষ্মীর ভাঁড়ে কিছু পয়সা জমানো আছে ওটা ভেঙে বিকেলের দিকে একবার হাতিবাগান বাজারে যাবো..।

সেই মতো তাড়াতাড়ি খাওয়া, কাজকর্ম সেরে ধোওয়া ভালো কাপড়টা পরে ছোটনের মা লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে জমানো খুচরো টাকাপয়সাগুলো একটা ছোট হাত ব্যাগে ভরে দুপুর দুপুর বেরিয়ে পড়লো ছোটনের বাবার অনুমতি নিয়ে..

হাতিবাগান বাজার ওদের বাড়ি থেকে বেশি দূর না. ছোটনের মা হাঁটা পথেই যখন শ্যামবাজারে এসে পৌঁছলো, তখন দেখলো —ধনতেরাসের ভিড় লেগে গেছে! ফুটপাথের দুদিকে হকাররা রকমারি জিনিসের সম্ভার সাজিয়ে বসেছে.. ছোট ছোট জামাকাপড়ের দোকান ও চোখে পড়ছে। যত এগোচ্ছে হকারদের চিৎকার কানে আসছে ——আসুন…আসুন. হরেক মাল বিশ টাকা! খদ্দেরদের ভিড়ও চোখে পড়ার মতো! মহিলাই বেশি, ছোট বড়ো ব্যাগ হাতে সঙ্গীর সাথে কথা বলতে বলতে সবাই এগোচ্ছে….! ছোটনের মাও হাতিবাগান বাজারের দিকে এগোতে লাগলো, অবাক হয়ে দেখছে! ভরা বিকেলে বাজার গমগম করছে!! ছোটবেলায় হালখাতা বা চৈত্র সেলে মায়ের সাথে আসতো বাজারে … তখনও ফুটপাতের দুইধার, ছোট বড়ো দোকান এমন কি সোনা রুপোর দোকানেও ভিড় উপচে পড়তো! কিন্তু ধনতেরাসে এত্ত ভিড়…! আগে তো কোনো দিন ধনতেরাসের নামও শুনিনি!! যাই হোক ছোটনের মা হকারের চিৎকার, লোকজনের ভিড়, দাম দরাদরি অতিক্রম করে ক্রমশ এগোতে লাগলো… এগোতে এগোতে হঠাৎ তার ছোট একটি স্টীলের বাসনপত্রের দোকানে চোখ আটকে গেল! দোকানে ঠাকুরের ছোট ছোট থালা গ্লাস আরও নানান জিনিস ঢেলে বিক্রি হচ্ছে! দোকানি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে খদ্দের ডাকছে! দোকানের পিছনদিকে সাজিয়ে রাখা খোপ কাটা স্টীলের থালার দিকে চোখ আটকে গেল তার… পায়ে পায়ে সে দোকানটার সামনে এসে দাঁড়ালো.. দোকানি বললো —–“আসুন আসুন দিদি.. একদম সস্তায় সব পেয়ে যাবেন..!”. আগের থেকেই দোকানে আরও দুচার জন মহিলা থালা বাটি নেড়েচেড়ে দেখছে! দরদাম করছে..।

ছোটনের মায়ের দৃষ্টি ওই চকচকে খোপ-কাটা থালাটার দিকে… দোকানি আবার জিগ্যেস করলো —কি নেবেন দিদি ? হাঁড়ি, খুন্তি কড়াই… সব আছে … কি নেবেন।? ছোটনের মা চুপ..,তখনও তার দৃষ্টি সেই খোপ কাটা থালাটার দিকে.. দোকানি সেটা লক্ষ্য করে বললো —-দিদি ওই থালাটা দেখাবো? বলে থালাটা বের করে ছোটনের মায়ের হাতে দিলো.. ছোটনের মা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে থালাটা দেখতে লাগলো..! ভারি সুন্দর মাঝারি সাইজের থালাটা…! মনে মনে ভাবলো –ছোটু যে পুরোনো সানকিটাতে ভাত খায়… ওটা বড্ডো পুরোনো, রংচটা… এই খোপ কাটা থালাটা দেখলে ও খুব খুশি হবে ! অনেক দরদাম করে ছোটনের মা থালাটা কিনে নিলো অবশেষে। দোকানি খবরের কাগজে মুড়ে থালাটা যখন ছোটনের মায়ের হাতে দিলো তখন সন্ধ্যে আসন্ন! বিদায় সূর্যের আলো ছাপিয়ে তখন কৃত্রিম আলোয় রাস্তাঘাট দোকান পাট সব ঝলমল করে উঠেছে! নতুন থালাটা নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে কল্পনায় সে দেখতে পেলো! ——- চকচকে নতুন খোপ কাটা থালাটা হাতে পেয়ে ছোটনের মুখ আনন্দে ঝলমল করছে! প্রথমে থালা- আয়না ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারকতক নিজের মুখ দেখবে! তারপর ছুট্টে বাবার কাছে গিয়ে বাবার মুখ দেখবে, তারপর মায়ের মুখ দেখবে! তারপর যে প্রশ্নটা ছোটন তার মাকে করবে! তার উত্তর দেওয়ার জন্য ছোটনের মা মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিলো।

“মা এই থালার বড়ো খোপটায় কি দেবে? মা বলবে –ভাত দেবো বাবা… আরও যে ছোট তিনটে খোপ আছে! একটাতে ডাল একটাতে তরকারি , তারপর বাকি খোপটায় হাত দিয়ে বলবে —-এই খোপটায় কি দেবে মা?.. ওমা বলোনা কি দেবে? ছোটনের মাও আস্তে আস্তে বিশ্বাস করে নিয়েছি যে —– “ধনতেরাসে কিছু কিনলে লক্ষ্মী ঘরে আসে , সুখ সমৃদ্ধি হয়! ধন দৌলত সমৃদ্ধি হয়…!” ছোটনের মা কতোকটা ঘোরের মাথায় বলে দেবে,—–“ওই খোপটায় মাছ দেবো রে..” ছোটন অবাক হয়ে জিগ্যেস করবে —-মাছ? মাছ দেবে? আমি রোজ মাছ খাবো? বলো না মা, আমি রোজ মাছ খাবো?

সন্ধ্যে হয়ে গেছে.. তবুও যেনো সন্ধ্যে হয়নি..! আসন্ন কালি পুজো আর ধনতেরাসের জন্য রাস্তা ঘাট এখন আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক! একটা অনন্য ভালোলাগায় ছোটনের মায়ের মন ও ঝলমল করছে..! অনাস্বাদিত ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে খবরের কাগজে মোড়া খোপ-কাটা থালাটা শক্ত করে ধরে ছোটনের মা ঘরের দিকে এগোতে লাগলো…।

সমাপ্ত

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!