রোমান্টিকগল্প

দেখা

  লেখিকা: কুসুমিকা সাহা


 

ঝড় উঠবে …

ছোটবেলায় ঝড় উঠলে মা বলত চুপ করে বোসো একজায়গায় সবাই, ভাইবোনেরা খাটের ওপর জড়ো হত ঠিকই, কিন্তু তিয়াস ছটফট করত, একটু সুযোগেই মায়ের চোখ এড়িয়ে ছুট্টে দরজার কাছে, ওখানে কান চেপে ধরলে ঝড়ের শোঁ শোঁ আওয়াজে অদ্ভুত লাগত তিয়াসের, একটা বন্ধ দরজা অনেকগুলো দরজা খুলে দিত যেন, যেন বোতল বন্দী কোনও দৈত্য এক … ফুঁসছে, অসহায়ভাবে ছটফট করছে বেরিয়ে আসার জন্যে … যেন অন্য কোনও পৃথিবী অজস্র বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষায় আছে কারও আসার …

ছোটবেলার ভাবনার মত ছোটবেলার ঝড়ের রূপও বুঝি এতটাই সরল ছিল, মায়ের শাঁখের ফুঁয়ে নিমেষে থেমে যাবে, এই ভরসায় ঝড়ের গায়ে কান পাততেও ভয় লাগত না তার …

একটু বড় হলে ছাদে যেত, ঝড় ওঠার ঠিক আগে, আকাশ যখন কালো করে আসত.. দুহাত বড় করে ছড়িয়ে দিয়ে আকাশের চোখে চোখ রেখে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিত.. হুঁহ্‌হ্‌ অতই সোজা বুঝি? ভয় পাওয়াও দেখি …

আজ তবে এত অস্থিরতা কেন … ভয়, অনিশ্চয়তা সব যেন গ্রাস করেছে তিয়াসকে … এই সাততলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কিছুতেই চাইতে পারছে না ঝড় উঠুক … কিছুতেই তার সাধের নীড়খানি এলোমেলো করে দেওয়ার একরত্তি সুযোগও দিতে চাইছে না কোনও বাউন্ডুলে বাতাসকে …

স্বপ্ন দেখতে চিরটাকাল ভালবাসে তিয়াস, বিশ্বাস করতে ভালবাসে, এই ফ্ল্যাটের প্রতিটি দেওয়াল তার স্বপ্ন দিয়ে বোনা, বিশ্বাস দিয়ে গড়া … অর্চিকে ভালবেসে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিল সেদিন, বাপির মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ডুকরে উঠেছিল, জানত ওই কঠিন মুখের আড়ালে কতটা ভাঙচুর চলছে … তবু এই বিশ্বাস ছিল যে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, সময় লাগলেও সামলে নেবে ঠিক … মা শুধু আস্তে করে বলেছিল …” সংসার করতে চলেছ, সে যা দেবে তোমায়, দাবী রাখবে আরও শতগুণ, দিতে শিখো।” কথাটা কানে লেগেছিল বহুদিন … তারপর সত্যিই যখন সে কথা উপলব্ধি করেছে, তখন মা চলে গেছেন বহুদূরে … তাঁর আজীবন উজাড় করে দিতে থাকার স্পর্শটুকু রেখে … আজ মায়ের কথা মনে পড়ছে বড্ড, কানে বাজছে “দিতে শিখো” … “দিতে শিখো” … ওই কোলে মাথা রেখে একবার যদি নিঃস্ব করে দিতে পারত নিজেকে …

দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল … পাঁচটা দশ … অর্চি অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে কি?

এলোমেলো পায়ে বারান্দায় এলো, পাখির মত দুহাত মেলে দিয়ে বড় করে শ্বাস নিল একবার … একটু শান্ত করে দাও ভগবান, আকুল প্রার্থনা নিয়ে সামনে চাইল …

ঘন কালো শান্ত গুমোট আকাশ … সব তছনছ করে দেওয়ার আগের মুহূর্তের নৈঃশব্দ্য নিয়ে তিয়াসের দিকে তাকিয়ে …

মেঘ ডাকছে …

হাতঘড়ি দেখল অর্চি। ইশ! বড্ড দেরী হয়ে গেলো। দুপুরে ফোন করেছিল তিয়াস। একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলছিল। গলাটা একটু ধরাও লাগছিল। নাহ! উঠে পড়তে হবে এবার, বৃষ্টিও নামবে বোধহয়, এখনই না বেরিয়ে গেলে বৃষ্টিতে আটকে পড়তে হবে। ভেবেছিল আজ ফেরার সময় চাইনিজ কিনে নিয়ে যাবে কোনও রেস্টুরেন্ট থেকে, খুব ভালবাসে ও, আগে আবদার করত প্রায়ই …

অর্চি বোঝে তাকেই স্পেস দিচ্ছে, কিন্তু তবুও খুব মিস করে এগুলো অর্চি … ওই ঝলমলে ছটফটে ভাবটাই টানত খুব … সে নিজেও তো সময় দিতে পারে না এখন একদম … অফিস, প্রোমোশন সবের পিছনে ছুটে এখন দৌড়টুকুই বেশি জীবনে … তবে সেসবও তো তিয়াসের জন্যেই, তিয়াসের সিদ্ধান্তের যেন কোনও অপমান না হয়, আক্ষেপ না থাকে … এই দশ বছরে জীবনের এক একটা হার্ডল পেরিয়েছে যখন সফলভাবে, তিয়াসের মুখের ওই খুশির ঝলকটুকু কি তৃপ্তিই না দিতো …

মুখার্জির রেখে যাওয়া ফাইলটার দিকে চোখ গেল। না না, ওসব কাল হবে। আজ পৌঁছবেই সে সময় মত। ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অর্চি। গাড়ি স্টার্ট করে এফ এমটা অন করল, রোজের অভ্যেস এও। রাস্তায় একবার শুধু দাঁড়াবে খাবারটা তুলতে, সাতটা ওবধি পৌঁছেই যাবে ঠিক৷ ড্যাশবোর্ডের ওপর রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল … নন্দিনী … তার পার্সোনাল আ্যসিস্ট্যান্ট নন্দিনী … ভুরু দুটো সামান্য কুঁচকে গেল অর্চির … আবার কি বলবে … সেদিনই তো সব কথা হল খোলাখুলি … তিয়াসের জায়গায় … অসম্ভব, অর্চির স্বপ্নেও আসে না এমন।

অর্চির সহমর্মিতাকে ভুল জায়গায় দাঁড় করিয়েছে নন্দিনী।

ফোনটা সাইলেন্ট মোডে রেখে সামনের রাস্তায় চোখ রাখল। উইন্ডস্ক্রিনে দু এক ফোঁটা ঝরে পড়ল কি?

আজ সকাল অবধিও ঝলমলে রোদ্দুর ছিল…

অফিস যায়নি নন্দিনী, ছুটি নিয়ে বসে আছে বাড়িতে, গত দুদিন খুব এলোমেলো কেটেছে … ওভাবে অর্চিদাকে নিজের কথা জানানোটা উচিত হয়নি তার। অর্চিদা তিয়াসদির সম্পর্ক সে খুব কাছ থেকে দেখেছে, জানে তার গভীরতা, কে জানে হয়তো তাই অবচেতনেই নিজেও পেতে চেয়েছিল তার আস্বাদ … একটুও না রেগে, যথাযথ সম্মান দিয়েই অর্চিদা ফিরিয়ে দিল তাকে … নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতেই হত, তাই..

সন্ধ্যে হয়ে গেছে এত ঘুমিয়েছে … গা-টাও ম্যাজম্যাজ করছে … কফি নিয়ে এসে সোফায় গা এলিয়ে মোবাইলটা হাতে নিল নন্দিনী … ইন্সটাগ্রাম খুলে আজ সকালে পোস্ট করা সেদিনের ছবিটাই দেখছিল। তিয়াসদির লাইক … হঠাৎ বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠল নন্দিনীর। ছবিটা বড় করে দেখল। হ্যাঁ, যা ভেবেছে ঠিক তাই …

সেদিন রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছিল নন্দিনী, নিজের নতুন কেনা সানগ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে খুব কায়দা করে টেবিলের ফুলদানিটা ব্যাকগ্রাউন্ডে সাজিয়ে সেটার একটা ছবি তুলতে যাবে, পেছন থেকে অর্চিদার গলা..”সরি, একটু দেরী হল” …

ছবিটা উঠেছিল এবং ভারী সুন্দর উঠেছিল,। আগে খেয়াল করেনি, কিন্তু এখন হঠাৎ দেখল ওই সানগ্লাসের ওপর অর্চিদার রিফ্লেকশন … হে ভগবান …
ছবিটা তড়িঘড়ি ডিলিট করেই অর্চিদাকে ফোন করল নন্দিনী … উফ অর্চিদা ফোনটা ধরো প্লিজ … সে যে জেনে বুঝে এমন করেনি …

শহরের বুকে এ মরসুমের প্রথম কালবৈশাখী এল আজ … কোথাও অপার বিশ্বাসের শাঁখ বাজল কি?


কুসুমিকা সাহা

 

সারাদিন কাটে সংসারের নানা কাজে।
লেখা আর গান তার ভালোবাসা।
সিনেমা দেখতে এবং তার পর্যালোচনা করা তার অন্যতম শখ।

 


 

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!