অত্রিয় মজুমদার
বইপাড়া। তার মধ্যে বই পোকা আর কলেজ স্টুডেন্টদের ভিড়। এই পাড়াতেই আছে বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি আর সেই ভয়াবহ কলকাতা ইউনিভার্সিটি। সকাল ৮-টা থেকে সন্ধ্যে ৯-টা অবধি খুবই গম-গম করে বইপাড়া। তারই মধ্যে দুটো বই-এর স্টলের মাঝখান থেকে গড়ে উঠেছে কফি হাউজ। আলো-ছায়া মাখানো, পিক আর ময়লা দিয়ে সুসজ্জিত একটা আদ্যিকালের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেই চলে আসা যাবে একটা শব্দ-ডোবানো গুনগুন আওয়াজ-এ নিমজ্জিত একটা জীবন্ত শহরে। এটাই সেই বিখ্যাত কফি হাউজ। মনে পড়ে যায় মান্না দের সেই গান ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই”।
কিন্তু তাই কি? কফি হাউজের সেই আড্ডাটা কি সত্যিই আর নেই?
সারি সারি কাঠের টেবিল আর চেয়ারের মধ্যে ছোট ছোট দলের সমাবেশ ঘটেছে। তারই মাঝখান থেকে কঠোর, আবেগশূন্য রোবট-এর মতো হেঁটে চলছে কফি হাউজের পরিবেশকেরা। এটাই কফি হাউজ। এখানে জায়গা পাওয়া যতটা দুষ্কর, ঠিক ততটাই কঠিন নিজের আওয়াজ বন্ধুর কানে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু তাও কোন ভাবে এই গুঞ্জনের মধ্যেও কেমন যেন নিজের আওয়াজটা ছড়িয়ে পড়ে আর বন্ধুর কানেও পৌঁছে যায়। এটাই হয়ত কফি হাউজের ম্যাজিক।
কলেজ যাওয়ার নাম করে চারটে বন্ধু মাঝের টেবিল দখল করে নিয়েছে। মুখে দ্বিতীয় সিগারেট ধরানো। দুঘণ্টা ধরে তারা এখানেই আছে। তাদের আড্ডা নানা দিকে নানা দেশে গড়িয়ে যায়। কখনও তাদের কলেজের নতুন আসা সুন্দরী এক প্রোফেসরকে নিয়ে কথা। কত বয়স হবে তার? বিয়ে-থা হয়েছে? কখনও আবার ইংরাজি ও বাংলা কবিতার পার্থক্য নিয়ে চর্চা। তার মধ্যেই চলে আসে আইপিএল-এর স্ক্যামের প্রসঙ্গ ও।
অম্লান-এর কাছে এসব স্ক্যামের জবাব সব আছে। মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে – অম্লান টাকার অভাব খুব কাছ থেকেই দেখেছে। কলেজে ওঠার পর বামপন্থী ছেলে-মেয়েদের সাথে মিশে একটা সুরাহা হয়েছে। টাকা এবং টাকার জন্যে যে ভেদাভেদ সেটাই সব অসুবিধার মূল। কখনও কখনও সে যাদবপুর ছেলে-মেয়েদের সাথেও কথা বলে – তাদের সাথে মিছিলে বেরোয়। বন্ধুরা সবই জানে – বাধাও দেয় না, যোগও দেয় না। পরিবারের থেকে লুকিয়ে অম্লান তার সব কাজ করে। এক এক সময় নিজের কিছু জমানো টাকা দিয়ে বাড়ির সামনের ভিখিরীদের খাবার বিতরন করে। তাতে তার মা-বাবার ভারী রাগ।
অম্লান বুঝতে পারে না কেন। তারাও তো মধ্যবিত্ত – এই টাকার জন্যেই তো তাদের সব অসুবিধে। কিন্তু এই প্রশ্নেরও উত্তর অম্লানের গুরু, মার্ক্স লিখে গেছেন। ভবিষ্যতের ভয় এবং ভ্রম – এই দুটোর শিকার হয়েছে ওর মা-বাবা। অম্লান এই দুটোর ফাঁদে কখনও পড়বে না। সে একদিন বড় হয় এন-জি-ও খুলবে। সব গরীবদের সাহায্য করবে।
অম্লানের বন্ধুরা শুধু মাথা নাড়ে। ওর সাথে তর্ক করার মতো ওদের জ্ঞানও নেই, ইচ্ছেও নেই। অম্লান নিজের স্বপ্নের জগতেই বাস করুক। এদিকে ডিসুজা সেই নির্বাক হয়েই বসে আছে আর মাঝে মাঝে নিজের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ৩.৩০ বাজে। আরও আধ ঘণ্টা।
ডিসুজার পিছনের টেবিলে আরও একটা দল জট বেঁধেছে। তার মধ্যে একটা ছেলে গিটার-এ টুং-টাং করছে। সামনে শুকিয়ে যাওয়া স্যান্ডউইচ পড়ে পড়ে মাছিদের পেট ভরাচ্ছে। অরিজিতের বন্ধুরা তাকে টুং-টাং বন্ধ করে কিছু একটা বাজাতে বললো। প্রায় চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিলো। অরিজিত একটু লাজুক হয়ে, একটু ভাও খেয়েই, গিটারটা পায়ের উপর বসাল। তারপর শুরু করল –
“যেখানে শুরুর কথা বলার আগেই শেষ
সেখানে মুখ ডুবিয়ে খুঁজতে চাওয়া আমারই অভ্যেস…
… একবার বল নেই, তোর কেউ নেই
…কেউ নেই, কেউ নেই”
দলের সবাই অরিজিতের গান শুরু হতে না হতেই তালের সাথে হাত-তালি দিতে লাগলো। অরিজিত তখন গানের জগতেই মুগ্ধ। অন্য টেবিলে বসে থাকা নির্বাক ডিসুজা সেই গানের শব্দে যেন নিজেকে খুঁজে পেলো। মাথা নাড়াতে থাকে গানের তালে, মুখ খুলে নিঃশব্দে গাইতে থাকে। কিছুক্ষণ ঘড়ির দিকে তাকায় না। অন্য আরেক টেবিল থেকে নেশাচ্ছন্ন অয়ন চেয়ে থাকে অরিজিতের দিকে। গানটা কেমন করে তার চোখ ঝাপসা করে তুলেছে। অরিজিতের পাশে বসে স্নেহা। গানের সাথে সে হাত-তালি দিচ্ছে। ঠোঁটের পাশের মিচকি হাসি তার মুখ রাঙিয়ে দিয়েছে।
বইপাড়া থেকে দুজন এসে ঢুকে পড়লো কফি হাউজে। প্রায় সমবয়েসী ছেলে আর মেয়ে। হাতে ব্যাগ, তাতে কিলো কিলো বই। বইয়ের ভারে দুজনেরই ঘাম ছুটে গেছে। মুখে একটা চাপা উত্তেজনা আর ভয়। কত টাকা চলে গেল? বাড়িতে বই রাখার তো জায়গাও নেই? কোনোদিনও কি এতো বই পড়তে পারবে?
নিচে কোনো জায়গা না পেয়ে জোর করে দেহটাকে ঠেলে ওরা সেই পিক আর ময়লা লেপিত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল – কফি হাউজের দোতলায়। এখানেও সেই একই মৌচাকের গুন-গুন শব্দ। ভিড় প্রায় একই, শুধু কয়েকটা সীট ফাঁকা। এই মধ্যবর্তী তলা থেকে নিচের তলা টাও ভালো ভাবে দেখা যায়। সেইখান থেকেই কিছু লোক উপরে এই ছেলে আর মেয়েটার দিকে তাকাল। প্রেমিক-প্রেমিকা? নাকি ভাই-বোন?
কোনটাই নয়। ওদের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব। বইয়ের পাতার মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছে নিখিল আর নয়নার সম্পর্ক। যখন কোন নতুন বই পরে মনটা দুরুদুরু করে সেই বইটার ব্যাপারে কারুর সাথে কথা বলার জন্যে – তখন নিখিল আর নয়না একে অপরকে কাছে পায়। কখনও আবার একটাই বই দুজনে একই সময় বসে পড়ে আর ভাবে অন্যজন কোন পাতায় আছে, কোন ভাবনাতে মগ্ন হয়ে আছে। “আমরা কি একই জিনিস ভাবছি?” বইপাড়া তাদের মিলনের স্থান। আর বইপাড়াতে এলে তো ওদের কফি হাউজে ঢুকতেই হয়।
নিখিল আর নয়না, দুজনেই লেখক হতে চায়। অনেক বই পড়েছে তারা। এখনকার দিনে পুরোদমে কলমও চালায় তারা। উপন্যাস, কবিতা, নাটক, কিছুই ছাড়ে না। একবার শুধু প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষা। প্রকাশকেরাও এখনকার দিনে একটু আলাদা রকম। ব্যবসা ছাড়া কিছুই বঝে না। ভাল লেখার দাম কি তারা বুঝতে পারবে? এই যুগে নাকি জীবনানন্দ দাশ বা জেমস জয়স কখনই প্রকাশিত হতে পারত না।
নিখিলের অনেক স্বপ্ন। তার মাথায় বিভিন্ন গল্প, বিভিন্ন ভাবে লেখার ফর্মুলা আছে। সে তার প্রথম বইতেই দুনিয়া কাঁপিয়ে দেবে। হয়ত বুকার প্রাইজটাও পেয়ে যাবে। আর একটু বয়স হলে ওর হাতে নোবেল দেখাটাও অসাধ্য কিছু নয়। নয়না অতটা কিছু ভাবেনি। দুনিয়া বদলানো তার কাজ নয়। কলকাতা তার প্রাণের শহর। সেটা নিয়েই সে কিছু লিখতে চায়। বইপাড়া নিয়ে কিছু। বা কফি হাউজ নিয়ে।
দিল্লী ফেরত দিদি তার ভাইকে নিয়ে কফি হাউজের দোতলায় ঢুকেই জায়গা পেয়ে গেল। প্রত্যেক বারই মে-জুনে সে নিজের শহর, কলকাতায় ফিরে আসে কিছুদিনের জন্যে। আর প্রতিবারই বইপাড়া ঘুরে কফি হাউজে যায় ভাইকে নিয়ে। এবারটা প্রায় মিস হতে যাচ্ছিল। দিল্লী ফেরত যাবে পরশু।
দিদির হাতের থলিতে রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংকলন। তার দিন শুরু রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে আর রাতে একটা কবিতা দিয়ে শেষ। কিন্তু তার ভাইয়ের আবার রবীন্দ্রনাথ পছন্দ নয়। কোন এক সময় রাজর্ষি আর শেষের কবিতা পড়ার পর যে বিস্বাদ জমেছে, সেটা এখনও রয়ে গেছে। এখন ভাই ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে কলেজে পড়ছে। বাংলা সাহিত্য এখন সে কিছুটা ভুলেই গেছে। কিন্তু দিদি যে সেটা মানতে চায় না। এখনও জিজ্ঞেস করে রবীন্দ্রনাথ কি দোষ করেছিল? ঘরে বাইরে পড়লে তোর মত নিশ্চয়ই পালটাবে।
ভাইয়ের কফি হাউজের প্রতিও কোন ভালবাসা নেই। শুকনো স্যান্ডউইচ, তেল ছ্যাপছাপে কাটলেট একদম পছন্দের নয়। তবুও দিদির জন্যে ভাইও চলে আসে কফি হাউজে। দিদি অর্ডার দিল: কাটলেট, স্যান্ডউইচ আর দুধ-কফি। ভাই নিলো ব্ল্যাক কফি। কফি হাউজের দুধ-কফিটা ভাইয়ের জঘন্য লাগে। অনেক বেশি চিনি দিয়ে কি রকম সরবতের মতো করে দেয়। কিন্তু এই সরবতই দিদির প্রিয়। যেন তার ফ্যাকাশে জীবনে একটা মিষ্টতা নিয়ে আসে। যখনই কফি হাউজে আসে তখন তার এই দুধ-কফি চাই-ই চাই। এই মে-জুন মাসের কলকাতা, এই দুধ-কফি, বইপাড়া, কফি হাউজে ভাইয়ের সাথে আড্ডা – সবই যেন একটা উৎসব দিদির কাছে।
চারটে বাজলো। প্রেসিডেন্সিটে একটা বাংলার ব্যাচ-এর ছুটি হল। সুজাতা তার বান্ধবীদের নিয়ে এসে পড়ল। কলেজ আজ যেন শেষই হতে চাইছিল না। শেষে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ক্লাসটাতে তো সুজাতা প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। চোখে এখনও তার ঢুলু-ঢুলু ভাব। কফি হাউজে ঢুকেই চেনা ওয়েটারকে ধরে চার কাপ কফির অর্ডার দিয়ে দিল। ভাগ্য ভালো – নিচে জায়গায়ও পেয়ে গেল।
ঘড়িতে চারটে বাজে। নির্বাক ডিসুজার চোখ চলে গেছে দরজার দিকে। সুজাতা আসছে তার বান্ধবীদের নিয়ে। ডিসুজারও ভাগ্য ভালো। আগের দিনের মতো সুজাতাকে আবার মধ্যবর্তী তলায় যেতে হলো না। নিচেই জায়গা পেয়ে গেল সে। ঠিক ডিসুজার চোখের সামনের টেবিলেই বসলো। আজ সুজাতাকে দেখে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। অনেকক্ষণ কলেজ করেছে। অনেক পরিশ্রম করেছে কলেজে হয়তো। আজ মনে হয় না সুজাতা বেশিক্ষণ থাকবে কফি হাউজে।
সুজাতার পাশের টেবিল দখল করেছে তিনটি বয়স্ক লোক। তাদের বাড়ি – শ্যামবাজার। প্রত্যেক দুপুরে চারজন এসে জুটে যায় কফি হাউজে। আসে পাশে জোয়ান ছেলে-মেয়েদের মাঝখানে কোন অসুবিধে হয়ে না। কফি হাউজ কোন বয়সের মাপ দেখে না। সবাই এখানে নিমন্ত্রিত। আজ অমল আসতে পারেনি। গত সপ্তাহ তার মারাত্মক স্ট্রোক হয়েছিল। তারপর থেকে ঠিক করে কথাও বলতে পারে না, না পারে কিছু মনে রাখতে। অমল আর মনে হয় না আসতে পারবে। বাকিরা যখন তার বাড়ি গেছিল – সে তাদের চিনতে পারেনি। নিখিলেশ অনেক কষ্ট করেও অমলকে ভুলতে পারছে না। আড্ডা যেদিকেই ঘুরুক না কেন – সেটা ফুটবলের মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়েই হোক, বা রাজনীতি – কোন না কোন ভাবে অমল তার মধ্যে জড়িয়েই পড়ছে। নিখিলেশ একাই থাকে – তার ছেলে আর বউমা অন্য ফ্লাটে চলে গেছে। রেখে গেছে একটা আয়াকে, তার দেখা-শোনা করার জন্যে। নিখিলেশকে এখন খুব কঠোর ভাবে ফোনে শাসন করে ছেলে – এটা খাবে না, এখানে যাবে না, ইত্যাদি। ভাগ্য ভালো এখনও কফি হাউজের যাতায়াত বন্ধ করেনি। গতকাল অশোকের নাতি হয়েছে। আমেরিকা থেকে তার মেয়ে ছবি পাঠিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও সে ফোনে ভিডিও কল করতে গিয়েও পারেনি। অমল নিশ্চয়ই শিখিয়ে দিতে পারত। ছবি দেখেই সন্তুষ্ট হতে হয়েছে অশোককে। কবে যে ওরা কলকাতায় আসবে, কে জানে।
তিনজন এদিক ওদিক অন্যদের দিকে তাকাতে থাকল। উপরে দেখতে পেল একটা ছেলে আর মেয়েকে ঢুকতে – হাতে ভর্তি ভর্তি বই। প্রেমিক-প্রেমিকা? নাকি ভাই-বোন? এখন তো আবার ছেলে মেয়েদের মধ্যে নানা রকম সম্পর্ক হয়। ওদের হাতে বইগুলো দেখে খুবই ভালো লাগলো। কলেজের সময় চারজনই বইপাগল ছিল। বইপাড়ায়ে প্রত্যেক সপ্তাহে আসত। আর এলেই আড্ডা দিতে হতো কফি হাউজে। তখনকার সময়ে তো অনেক লেখকদেরকেও বইপাড়াতে দেখা যেত। এই অমলই তো গল্প করে – ছোটবেলায় কাছেই ফ্রেন্ড কাফেতে নাকি শিবরাম-এর সাথে আড্ডা দিত। চাঁদাও নাকি চেয়েছিল। জানা নেই। অমল তো আবার ছোটবেলা থেকেই বড্ড গুলবাজ। কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে, কে জানে?
তিনজনের চোখ চলে গেল দিল্লির দিদির কাছে। দিল্লী দিদি তখন খাবার ছেড়ে সেলফি তোলার চেষ্টা করছে। ফোন নিয়ে একবার এদিক ঘোরায় তো একবার ওদিক। একবার তো পরিবেশকের হাতের ট্রে-টাও ফেলে দিছিল। কিন্তু পরিবেশক কিছু বলার আগেই, দিদি তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে নিঃশব্দে সব দোষ তার দিকে ঠেলে দিল। ভাইকে দেখে মনে হোল না যে, সে এতো ছবি তোলার জন্যে ইচ্ছুক। কিন্তু দিদির ইচ্ছে – ভাইকেও অগত্যা মেনে নিতেই হচ্ছে। তিনজনের মুখটা কেমন হয়ে গেল। কিসব আদিখ্যেতা! এই ফোনটাই এসে সব নষ্ট করে দিয়েছে। আগেকার দিনে কত আড্ডা দেওয়া হতো। এখন শুধু ফোন নিয়েই মারপিট। এই সেলফি জিনিসটা নিখিলেশদের কোনোদিনই আকর্ষণ করতে পারেনি। কিন্তু আজ একটু নতুন করে দেখতে চাইল। হয়তো এটাই নতুন যুগের স্মৃতি। আগেকার দিনের কাল-সাদা ফটোর মতো। আগে জানলে হয়তো সুস্থ অমলের সাথেও একটা শেষ স্মৃতি রাখা থাকতো।
সুজাতার চোখ মাঝে মধ্যেই ওর পাশের টেবিলের বয়স্ক লোকগুলোর উপর যাচ্ছিল। দেখল তার মধ্যে একজন নিজের ফোনটা বার করে হাতটা লম্বা করে নিজের সেলফি তুলতে যাচ্ছে। প্রথমতায় হাতটা দুম করে এগিয়ে দেওয়াতে তো বাকি বন্ধুরাও একটু হতচকিত হয়ে গেল। তারপর তারাও একটু চ্যাঁচামেচি করে বলতে থাকল কেমন করে ধরলে সবাই ফ্রেমে আসবে – এ ভাবে ধরলে, না ওভাবে ধরলে। ওদের কাণ্ড দেখে সুজাতা মিচকি হেসে ফেললো।
সুজাতার ওই মিষ্টি হাসি দেখে, ডিসুজার বুক আবার ধড়ফড় করে উঠল। না, আজও সে কিছু করবে না। হয়তো কোনোদিনই সে কিছু করতে পারবে না। সুজাতাকে সে এই ভাবেই কিছুদিন দেখবে। আর তারপর সেও চলে যাবে, আর ডিসুজাও চলে যাবে। আস্তে আস্তে ভুলে যাবে সুজাতাকে। আর সাহস করে করবেই বা কি ডিসুজা? হঠাৎ করে গিয়ে দুম্ করে কথা বলতে পারবে নাকি? আর সুজাতাও বা কেন শুনবে কোন অচেনা মানুষের অচেনা কিছু কথা? না না – এমনই ঠিক আছে। কয়েক সময় কাপুরুষতাকেও বাহাদুরী বলে চালানো যায়।
রাত ঘনিয়ে আসে, কিন্তু কফি হাউজের সেই আড্ডার গুঞ্জন চলতেই থাকে। কতক্ষণ চলে, কে জানে। আবার রাতে কখন অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে যায় এই গুঞ্জন, সেটাও জানা নেই। আবার সকালে উঠে সেই কফি হাউজে গেলে আবার শোনা যাবে সেই রাতের গুঞ্জন। যেন আড্ডা আগের রাতে থামেনি। সারা রাত ধরে কফি হাউজের আড্ডাটা চলতে থেকেছে। যেন যুগ-যুগান্ত ধরেই চলে এসেছে। পরের দিন সকালে গেলে আবার দেখা যাবে কিছু নতুন লোকেদের, আর অনেক পুরনো বন্ধুদের। আর রয়ে যায় কিছু পুরনো পেয়ালার টুং-টাং শব্দ, সেই চেনা কাটলেটের গন্ধ, গরম কফিতে হাফ্-উফ্ ফুঁ দেওয়া, আর অশরীরীর মতো টেবিলের ফাঁক দিয়ে গলতে থাকা পরিবেশকেরা।
কোন এক সকালে অম্লান নিজের গাড়ি নিয়ে এই বইপাড়া দিয়ে শিয়ালদার দিকে যাচ্ছে। বইপাড়ার ভিড়টা আর কমলো না। সেই রাউডি বস্তির ভিড়ের মতনই রয়ে গেল – সেই আগেকার মতো। অম্লানের সময়ের অভাব। সে এখন সি.এ.। আজ বউ-বাচ্চাকে নিয়ে রাজধানী ধরে দিল্লীতে রওনা দেবে। শুধু একবার এই বইপাড়াটা পেরোলে হয়।
অম্লান নিজের পুরনো কথা ও স্বপ্ন সবই ভুলে গেছে। কবে যে ওর ভ্রম ভাঙ্গল, সেটা সে নিজেও মনে করতে পারে না। একবার নাকি মা-বাবার সাথে খুব ঝগড়া হয়েছিল। ভালই হয়েছিল হয়ে। তারপর থেকে অম্লান পড়াশোনায় মন দেয়। বাড়ি থেকেও বেরোয় না, কফি হাউজেও যায় না। কখনও কখনও বন্ধুদের সাথে সময় করে, একদম কাঁটা ধরে কথা বলে। সময়ের দাম তখন থেকেই বুঝতে শুরু করেছে। তাই সে এখন সি.এ.।
গরীবদের ভোলেনি এখনও। চ্যারিটিতে এখনও টাকা দেয়। গরীবদের কাছে তো সে টাকা পৌঁছে যায়। হয়তো। অম্লান অতো খোঁজ নেয় না। অন্তত সে কিছু ট্যাক্স-ছাড় পেয়ে যায়। সেটাই যথেষ্ট। বন্ধুদের সাথেও এখনও ভালই সম্পর্ক রেখেছে। বিনামুল্যে ট্যাক্স ফাইলিং-টা যে করে দেয় সবার। শুধু ডিসুজার কোন খবর জানে না। খোঁজও করেনি। সে তো সব সময় চুপচাপই থাকতো।
ডিসুজা দক্ষিণ কলকাতার একটা পুরনো বাড়িতে ভাড়া নিয়ে থাকে। বিয়ে-থা হয়ে গেছে। একটা মেয়েও আছে। এক সময় চাকরি করতো। কিন্তু চাকরি-তে তার মন বসেনি। এখন সে বাড়িতেই থাকে। বউ প্রতিভা তার স্বামীর চাকরি জীবনের বেদনা দেখেই তাকে বলেছে বাড়িতে থাকতে। সে ম্যানেজার, বাড়ির টাকা সেই জোগাড় করে দেবে।
ডিসুজা কবি। অনেক কষ্ট করে, এবং বউয়ের সাহায্য নিয়েই সে নিজের কবি হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে। সেটা ও বারবারই ওর বইতে বলে। সমালোচকেরা তার এই সততার অনেক গুন-গান গেয়েছে। এক সময় তার কবিতার বইয়ের ও অনেক প্রশংসা করেছে। কিন্তু এখন বলে যে কবিতাগুলো খুবই একঘেয়ে। সব সময় শুধু ব্যর্থ প্রেম, না বলা কথা আর স্বপ্নের জগৎ নিয়ে। একটু আলাদা করা যায় না কি?
তবুও ডিসুজা কবিতার বইয়ের এখনও অনেক চাহিদা। বলা হয়, সব কলেজ স্টুডেন্টদের বালিশের পাশে একটা করে ডিসুজা কবিতার বই থাকেই।
দিল্লীর দিদি আজ কফি হাউজে। হাতে ব্ল্যাক কফি। এতো বয়সে এসে তার এখন সুগার। সেই প্রিয় দুধ-কফি আর তার চলেনা। সামনে ফাঁকা চেয়ারের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে সে হাসছে। তিন বছর আগেও ওখানেই ওর ভাই বসতো। এখন সে আমেরিকা-তে। রিসার্চ করছে। ডিসেম্বরে আসে আর দিল্লিতেই দেখা করে যায়। দিদি এখনও মে মাসেই কলকাতায় আসে। এলে একবার কফি হাউজের দর্শনটাও করে যায়। এবার প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। আজকেই তো দিল্লিতে যাওয়ার দিন। তাও কিছু একটার টানে একবার কফি হাউজে ঢুঁ মেরে যাওয়ার ইচ্ছে হলো। ট্রেনটা ঠিক সময় ধরতে পারবে? হ্যাঁ। আজ আর ওকে কফি হাউজে আটকে রাখার কেউ নেই।
অরিজিত মাঝেমধ্যেই গিটার নিয়ে কফি হাউজে আসে। এখানে তার অনেক স্মৃতি। কফি হাউজের সাথেই জুড়ে আছে তার প্রথম প্রেমের কথা। এক সময় এই গিটার হাতেই কফি হাউজকে মাতিয়ে রাখত অরিজিত। প্রথমে তার প্রতিভা সীমিত ছিল তার বন্ধুর দলের মধ্যেই। এক এক সময় বাইরের লোকেরাও বাহবা দিয়ে যেত। এমন ভাবেই একদিন সুজাতার সাথেও ওর কথা হতে শুরু করে। সুজাতা এক সময় গান গাইত – এখন পড়ার চাপে সেটাকে ছাড়তে হয়েছে। অরিজিত অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সুজাতাকেও তার সাথে গাইতে বলল। শুরু হোল ওদের ডুয়েট। বেশ অনেকদিন-ই চলল। অরিজিতের মাঝে মধ্যে সুজাতার বাড়িতেও যাতায়াত চলেছিল। তবে কেন জানা নেই, সুজাতার সঙ্গে স্নেহার সাথেও জড়িয়ে পড়ল অরিজিত। যৌবনের পাপ বলা যায়। হয়তো ভেবেছিল জানতে পারবে না সুজাতা। কিন্তু সে জানতে পেরেছিল।
স্নেহা এখন ক্যানাডাতে। এক এক সময় কথা হয়ে অরিজিতের সাথে ফেসবুকে। সুজাতা তাকে ক্ষমা করেনি। হয়তো করবেও না। অরিজিত জানে। সুজাতার বড্ড জেদ।
সুজাতার খবর খুব কম লোকই জানে। বাবা-মায়ের ঠিক করা একজন ডাক্তারকে বিয়ে করেছে। ভালবাসা থেকে তার ভরসা অনেক দিন আগেই উঠে গেছে। বন্ধুত্ব কি সেটার খবরও সে রাখেনি। জানে কিছুটা নিজের দোষেই। সুজাতার বড্ড জেদ। তাই সে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে পুনে। কিছু চাহিদা বলেও কিছু নেই। টাকার অভাব নেই। খেতে পায় ভালই, আর শরীর ও মনের দিক থেকেও সন্তুষ্ট। প্রেম-বন্ধুত্বর আর দরকার কি? একটা ছেলে আছে – তাকে নিয়ে বেশ কিছুদিন ভালই কেটেছিল। এখন ছেলে টিনেজার – নিজেই ঘরেই থাকে। সুজাতা আর আগের মতো নেই। অনেকেই সেটা বলে। সুজাতা বদলে গেছে। একমাত্র তার জেদ তাকেই ধরে রেখেছে। ওটাই এখন ওর একমাত্র সম্বল। ওটাই এখন সুজাতা।
দিল্লীর দিদি কফি হাউজের থেকে তড়িঘড়ি করে বেরোতে গিয়ে একটা পরিবেশককে প্রায় ধাক্কাই দিয়ে দিল। তার মুখ ভয় এবং লজ্জায় ম্লান হয়ে গেল। সরি সরি বলতে বলতে দরজার দিকে যেতে লাগলো। এমন কি পাশে একটা হাতে বইয়ের প্যাকেট নিয়ে একটা মেয়ে ঢুকছে, তাকে দেখেও সরি সরি বলে দিল।
মেয়েটা একটু হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল অচেনা মহিলাটির দিকে। তারপর ঢুকে পড়ল কফি হাউজে। না, এখনও বদলায়নি কফি হাউজ। সেই হাজারো না-জানা কথার গুঞ্জন এখনও রয়ে গেছে সেই ঘরে। এখনও রয়ে গেছে সেই চিরকালীন চলতে থাকা আড্ডা। শুধু বদলে গেছে লোকেরা। কত রকম ঘটনাই না ঘটে যায় এই কফি হাউজে। মেয়েটা নিচে একটা ফাঁকা টেবিলে চেয়ে থাকল। ওখানেই হয়তো এক সময় বসে থাকতো কোন এক বয়স্ক দল আর দেখে যেত প্রতিদিন কেমন করে কফি হাউজের এই নতুন ভিড়ে তারা হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো এই কফি হাউজেই কোন ছেলে ভেবে যেত নিজের ভালবাসার কথা কোন মেয়েকে জানাবে, কিন্তু মনে দ্বিধা নিয়ে কিছু না বলা কথা বুকে নিয়েই ফিরত সেই রাত। সকালে আরও সাহস নিয়ে সে আসবে। এইখানেই কোন মেয়ে নিজের অজান্তে অনেক ভালবাসা পায় ও নির্দ্বিধায় ঠেলে দেয়। আর এই সবের মধ্যেই যেন কোন ভাই-বোন নিজেদের শেষ কথা ফুরায়।
বহু বছর আগে বইপাড়ায় এলে মেয়েটা কফি হাউজে আসত। হাতে কিলো কিলো বই আর মুখে থাকত চাপা উত্তেজনা আর ভয়। সাথে থাকত তার বন্ধু – নিখিল। বই নিয়েই মেতে থাকতো দুজনে। স্বপ্ন – লেখক হবে। নিখিলের স্বপ্ন দুনিয়া বদলাবে আর নয়নার স্বপ্ন কলকাতাকে নিজের বইতে অমর করে তুলবে।
সেই নিখিল আজ নেই। দু-বছর আগে অ্যাক্সিডেন্টে সে হারিয়ে গেছে। নয়না তখন চেন্নাইতে। ছুটি নিয়ে এসেছিল। নিখিলের দেখা পায়নি। শুধু ওর ডাইরি আর লেখা নিয়ে ফেরৎ চলে গেছিল নয়না। বইয়ের মতোই শব্দের মধ্যে নিখিল নিজেকে লুকিয়ে রাখত। নয়নাও তাকে চিনতে পারে তার লেখা শব্দগুলোর মধ্যে দিয়েই। অনেক কিছুই সে নয়নাকে বলতে পারেনি। নয়নাও তাকে অনেক কিছু বলতে পারেনি।
কিন্তু নয়নার কাছে নিখিল হারিয়ে যায়নি। বরং নতুন করে গড়ে উঠেছে নয়নার হাতে। বইয়ের পাতায়। নয়না কলকাতার উপর বই ছাপাবে। একটা লম্বা সিরিজ। সেই সিরিজের প্রধান চরিত্র নিখিল। নয়না কলকাতাকে অমর করতে চায় না আর। সে নিখিলের চোখ দিয়ে নতুন এক কলকাতা গড়ে তুলতে চায়।
তখনও রয়ে যাবে এই কফি হাউজ।
হয়ত অনেক বছর পর, কলকাতা যখন জনশূন্য হয়ে পড়বে তখন এখানেই চলে আসবে সেই নিখিল। তখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আগাছায় ভরা একটা ভাঙ্গাচোরা মহল মাত্র। প্রিন্সেপ ঘাটকে গ্রাস করেছে গঙ্গা। নেই গড়ের মাঠ, নেই নন্দন। বইপাড়াও খুব শান্ত। এই ফাঁকা শহরের ভেতর দিয়েই নিখিল খুঁজে পেয়ে গেল কফি হাউজ। পিক আর ময়লা দিয়ে সুসজ্জিত একটা আদ্যিকালের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল সেই শান্ত কফি হাউজে। ভেতরে কোন আলো নেই। শুধু ঝিঁঝিঁর একটানা সুর।
তারই মধ্যে নিখিল শুনতে পেল মানুষের কণ্ঠস্বর। কফি হাউজের ভেতর থেকে আসছে সেই না-জানা কথার গুঞ্জন। যেন এই দেওয়ালের ভেতর থেকে এই গুঞ্জনকে বেরোতে দেওয়া হয়নি। কত যুগ ধরে যেন এই ঘরেই শব্দধ্বনিগুলো প্রতিফলিত হতে থেকেছে।
যেন মৃত নগরীতে একটা জীবন্ত আর্তনাদ।
এটাই কফি হাউজের সেই আড্ডা। সব সময়ের সেই আড্ডা।
চিরকালীন সেই আড্ডা …
Atriya Majumdar
Books, movies, and the overanalysis of everything defines the world of Atriya Majumdar.
He has a lot to say, but then he doesn’t say much.
Also read: লেখকের অন্যান্য লেখা
Bahh bhalo likhechish.