Home বিনোদন, প্রবন্ধ বহুরূপীর শুরুর দিনগুলি
বিনোদনপ্রবন্ধ

বহুরূপীর শুরুর দিনগুলি

সুদেষ্ণা মজুমদার

কলকাতাকে কেন্দ্র করে বহুরূপী নাট্য সংঘের সূত্রপাত ও নাট্য সংস্কৃতির ইতিহাস। 

এটি কোনো পারিবারিক ইতিহাস নয় বরং একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী নাট্য বিপ্লবের ইতিহাস। পরিবারের কথা আবশ্যিকতার প্রয়োজনে উঠে এসেছে তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। এই লেখা আমার লেখা নয়, দুজন ইতিহাসের আড়ালে ডুবে থাকা মানুষকে তুলে ধরবার তাগিদেই, আমি এই লেখার উপস্থাপনা ও সংযোজন করেছি মাত্র।

অনেকগুলি দশক ধরে বহুরূপীর সাথে, ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল আমাদের পরিবার। জেঠু, বাবা, এবং পিসিদের কাছে শোনা বহু গল্পের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা আমাদের ছোটবেলা, যা আমরা, পরিবারের ছেলেমেয়েরা, আগে কখনো কোথাও ব্যক্ত করিনি। আমরা বাড়ির বড়দের অনুসরণ করেছি মাত্র। তারা নিজেদের রাখতেন স্পট লাইটের থেকে বহু দূরে। তাঁদের একান্ত আপনার মানুষ ছিলেন শম্ভু মিত্র, তাঁদের এই মৌনতা শুরু হয়েছিল যেদিন তাঁদের প্রিয় মানুষটি বহুরূপীর চৌকাঠ পার করে এসেছিলেন সেদিন থেকেই। তারপর, কালক্রমে তাঁদের প্রাণাধিক প্রিয় মেন্টর নিঃশব্দে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন একদিন। চার ভাইবোনের জীবন থেকে মুছে যায় বিরাট এক নাট্য অধ্যায় চিরতরে। আজ আর আমার বড় পিসিমা বা জ্যাঠামশাই  ইহ জগতে নেই, আছেন আমাদের হৃদয়ে আর এই স্মৃতি কথায়।

হঠাৎই হাতে পেলাম, মৃত্যুর এক বছর পূর্বে করা জ্যাঠামশায়ের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার। ভিডিওটি দেখে খুবই উচ্ছসিত বোধ করছি, কি করে একজন মানুষ একানব্বই বছর বয়েসে এরকম অনর্গল ভাবে গুছিয়ে বহুরূপীর ইতিহাস এক নিঃশ্বাসে ব্যক্ত করতে পারেন! আর কি করেই বা তিনি এরকম একনিষ্ট ভাবে নিজের লক্ষ্যে অনড় থেকে গেলেন সারা জীবন! তাই তো তাঁর মৃত্যুতে বহুরূপীর সদস্যরা তাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ব্যক্ত করতে,  অনেকে মিলে গেয়ে উঠেছিলেন: “আনন্দ লোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ, সত্য, সুন্দর”…

পরপর আরও মনে পরে গেলো, মৃত্যুর কয়েকবছর আগে, একটি ম্যাগাজিনে পাবলিশ হওয়া পিসিমার লেখা বহুরূপীর সম্পর্কে একটি অনবদ্য স্মৃতিচারণ। দুজনেই মৃত্যুর কিছু পূর্বে, কোনো এক জমে থাকা অভিমানে না বলা কথা গুলো, শেষ বারের জন্য বলে যেতে চেয়েছিলেন। তাই আমি আজ সেই নিদ্রিত ইতিহাসকে তুলে ধরলাম। 

একটি ছোট্ট ভূমিকা দিয়েই শুরু করি। আমার জ্যাঠামশাই, শ্রী অশোক মজুমদার ছিলেন বহুরূপীর ফাউন্ডিং মেম্বারদের একজন। সাথে ভিডিওর লিংকটি ইউ টিউব এ খুঁজলেই পাওয়া যাবে, এটি ওঁর একানব্বই বছর বয়েসে করা, ওঁর একমাত্র এবং শেষ Recorded সাক্ষাৎকার। পিসিমা  শ্রীমতি মালবিকা মজুমদার চৌধুরী ছিলেন বহুরূপীর অনেকগুলি নাটকের অভিনেত্রী এবং একজন অত্যন্ত সুলেখিকা। ওঁর লেখা কবিতা গুলি ছিল অনবদ্য। একসময়ে ভালো ছবিও তুলতেন। ওঁর আর এক পরিচয় হলো, উনি সনামধন্য লেখক শ্রী নিরোদ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রী ধ্রুব চৌধুরীর স্ত্রী, যিনি নিজে একজন খ্যাতনামা ফটোগ্রাফার এবং লেখক ছিলেন।

এখন বরং গল্পে, গল্পে উঠে আসুক, কলকাতাকে কেন্দ্র করে বহুরূপীর সাথে যুক্ত নাট্য সংঘের সূত্রপাত ও নাট্য সংস্কৃতির ইতিহাস। 

মালবিকা মজুমদার চৌধুরীর লেখা : কৈশোরের বহুরূপীর দিনগুলি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে:

“আমি লেখিকা নই, কোনো এক অনুপ্রেরণায় একদিন বসে গেলাম থিয়েটারের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য  শুভক্ষণ, বহুরূপীর প্রথম দিন গুলির কথা লিখতে”…

আত্মচেতনা ও একটি মহৎ আদর্শকে রূপ দেওয়ার কাজে জন্ম হয়েছিল বহুরূপীর। নেতৃত্ব করেছিলেন শ্রী শম্ভু মিত্র, শ্রী মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শ্রী তুলসী লাহিড়ী, শ্রী গঙ্গাপদ বসু ও  কয়েকজন। আর, কিছু তরুণ-তরুণী তাদের প্রাণভরা উৎসাহ ও আশা নিয়ে যোগদান করেছিলেন সেই কর্মকান্ডে। তারা তাদের স্বাক্ষর রেখে যেতে চেয়েছিলেন, ইতিহাস রচনার সেই বিশেষ মুহূর্তে। বিস্মৃতির তলদেশ থেকে যতটুকু স্মৃতি ভেসে উঠছে, তাই লিপিবদ্ধ করে যেতে চাই আজ। বহুরূপীর রেজিস্ট্রেশনের দিনটি ছিল ১৯৪৯-এর  ১লা মে। তবে ১৯৪৮-এ এই গ্রুপটি গঠিত হয় বিজন ভট্টাচার্যের লেখা, ‘নবান্ন’ নাটক অভিনীত হওয়ার সূত্রে। পরিচালনা করেন, শ্রী শম্ভু মিত্র আর অভিনয়ে ছিলেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, কলিম শরাফী আর কিছু আই.পি.টি.এ.-এর অভিনেতারা। 

১৯৪৯-এ ফিরে আসছি, আমরা সব সদস্যরা জড়ো হয়েছি সেদিন ১১ ই, নাসিরুদ্দিন রোডে।  গ্রুপটি পাকাপাকিভাবে সংঘটিত হয়ে নাম নিলো ‘বহুরূপী’। এই নামটি দিলেন, আমাদের সভাপতি, শ্রী মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। শম্ভু মিত্র ওনাকে মহর্ষি বলে ডাকতেন, আমরাও সবাই ওকে ওই নামেই ডাকতাম।  উনি বাণিজ্যিক মঞ্চ ও রুপোলী পর্দার একজন সুপ্রতিষ্ঠিত এবং অভিজ্ঞ অভিনেতা ছিলেন। সীতা নাটকের অভিনয়ের পর থেকে দর্শকরা ওকে মহর্ষি বলে ডাকতে শুরু করে। আমরা যখন ওকে দেখি তখনও ওঁর বাল্মীকির মতনই, দীর্ঘ চেহারা, বড় বড় চোখ, ঘাড় অবধি শুভ্রকেশ। শ্রী শম্ভু মিত্র হলেন ডিরেক্টর, ট্রেজারার হলেন স্ত্রী মহম্মদ জাকারিয়া, আর সেক্রেটারি হলেন শ্রী অশোক মজুমদার, আমার দাদা।

যাদের আমি ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছিলাম এবারে তাদের পরিচয়ও দেবো। প্রথমে শ্রী শম্ভু মিত্রের কথায় আসি, থিয়েটার জগতে তাঁকে চেনেন না এমন কেউ নেই, এখানে যে পরিচয় দেব তা শুধুই আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা একটি সম্পূর্ণ মানুষ। ব্যায়াম করা, শক্ত সমর্থ সুগঠিত, একটি ব্রোঞ্জের তৈরী মূর্তি যেন। ওঁর ব্যক্তিত্বের যে রূপ, সে রূপটি ফুটে ওঠে তাঁর চোখেমুখে ও ব্যবহারে। এরকম একটি ব্যক্তিত্বকে, না মেনে উপায় নেই, কাজেই উনি খুব অনায়াস লিডারশিপ করতেন, আর এক বাক্যে সবাই ওঁকে মেনে চলত। উনি একাধারে আমাদের নির্দেশক, অভিনেতা ও নাট্যকার সবই। ওঁর, কথা বলায়, রসিকতায়, আবৃত্তিতে ও নাটক নির্বাচনে সব সময় ধরা পড়তো ওঁর হাইলি ইন্টেলেকচুয়াল এন্ড সেনসিটিভ পারসোনালিটি। ওঁর অভিনয়ের ক্ষমতা ও গলার আওয়াজও যে ছিল অসাধারণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। সেই মেঘ ডাকার মতন গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজ ৬০ বছর পরেও কানে ভেসে আসে- আবৃত্তি করছেন,

“ঈশানের পুঞ্জমেঘ 
ধেয়ে চলে আসে 
বাধা-বন্ধ-হারা…”

এবার শ্রীমতি তৃপ্তি মিত্রের কথায় আসি। শম্ভু মিত্রের স্ত্রী, আমরা তাকে বৌদি বা তৃপ্তিদি বলতাম। তিনিও ছিলেন অসাধারণ অভিনেত্রী, নিরহংকারী হাসিখুশি মানুষ, সবার সঙ্গে মিশতে ভালোবাসতেন। আমরা তার সঙ্গে অভিনয় করেছি, গল্প করেছি, ভ্রমণ করেছি। একদিনের কথা মনে পড়ছে, স্টেজ এ শম্ভুদা ও বৌদির যৌথ অভিনয় চলছে, রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায় নাটক হচ্ছে, দ্বিতীয় অধ্যায়ের Scene-এ  সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, অতীন (শম্ভু মিত্র) উস্কো চুল, ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত যুবক, ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে এলার (তৃপ্তি মিত্র) পায়ের কাছে বসে পড়লেন।  কথা শুরু হলো, ইমোশন কাব্যের রূপে ঝরে ঝরে পড়ছে। প্রেমের কি অভিনয়! নিস্তব্ধ অডিটোরিয়াম।

এরপর যাঁর কথা লিখব, তিনি হলেন, শ্রী সবিতাব্রত দত্ত তার ডাকনাম ছিল ঝুনু। আমরা তাকে ঝুনুদা বলে ডাকতাম। তাঁর গানের গলা ছিল যেমন উদ্বাত্ত আর সেই রকমই মন উদার। খেয়ে ও মানুষকে খাইয়ে তিনি ফতুর হয়ে যেতে চাইতেন। তাঁর বেশিরভাগ স্যালারী ব্যয় হতো হাইকোর্ট পাড়ার একটি খাবারের দোকানের বিল মেটাতে। আজ কি খেয়েছো জিজ্ঞেস করলে, লম্বা একটা ফিরিস্তি দিয়ে ঢাকাই পরোটা ও রাজভোগ দিয়ে শেষ করতেন। “রসগোল্লা ছিল না বুঝি?” বললে, উত্তরে শোনা যেত, “রাজভোগ থাকতে রসগোল্লা খেতে চাই কেন”!

এই সময় আরেক জনের পরিচয় দিতে চাইবো, তিনি হলেন কলিম শারাফি। বহুরূপী সংগঠিত হওয়ার আগে থেকেই ওনার পরিচয় ছিল শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে। উনি শম্ভু মিত্রের খুব গুণগ্রাহী ছিলেন। উনি কথাবার্তায় আচার-ব্যবহারে, সম্পূর্ণরূপে একজন রাবীন্দ্রিক মানুষ ছিলেন, সারা জীবন রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে গিয়েছেন। তার জীবন ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেই। পরে যখন ঢাকায় চলে যান, তখন ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। পরে শুনেছি ঢাকায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্কুল খোলেন। কলকাতায় এসে প্রায়ই  কলকাতা রেডিও স্টেশন থেকেও গান গেয়ে যেতেন। যাবার সময় দেখতাম অনেক বই ও স্বরলিপি নিয়ে যেতে। আমার দাদার সারা জীবনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি। কলকাতায় এলে আমাদের বাড়িতে এসে দেখা না করে ফিরতেন না, কখনো কখনো আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। উনিই আমার দাদাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন শম্ভু মিত্রের সঙ্গে। 

শম্ভু মিত্র তখন নতুন একটি আদর্শ নিয়ে আই.পি.টি.এ. ছেড়ে এসেছেন। দাদার ওঁকে খুব ভালো লাগলো, ওঁর সংগঠনের কাজে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। পরে সংগঠনের সকলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দাদা, শ্রী অশোক মজুমদার সেক্রেটারি হন।  যখন বহুরূপীর একটি নিজস্ব পত্রিকা বের হতে লাগল, বহুরূপীর মেম্বারদের লেখা ও বহুরূপীর সব খবরাখবর দিয়ে, আমার দাদা পত্রিকাটি সম্পাদনার দ্বায়িত্ব নিলেন। দাদা বরাবরই খুব প্রগ্রেসিভ ছিলেন। তার ঘরের দেওয়ালে একমাত্র ছবি -স্বামী বিবেকানন্দের। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই দাদার বন্ধু ছিলেন। দ্বার অবারিত থাকায় আমাদের বাড়ি ছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলনক্ষেত্র।

ড্রামা মুভমেন্টের প্ল্যাটফর্ম, বহুরূপীর পরিবেশ ছিল ঘরোয়া। দাদারই ইনস্পিরেশনে গেলাম ওঁদের নাসিরউদ্দিন রোডের বাড়িতে একদিন। শম্ভু মিত্রের সঙ্গে আলাপ হলো। অভিনয় কখনো করিনি আগে, তবে আবৃত্তি করেছি। আমার মা খুব ভালো আবৃত্তি করতেন। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই,  রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে শোনাতেন। ‘শিশু ভোলানাথ’ আর ‘কথা কাহিনী’ শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে যেত। শম্ভুদা বললেন আবৃত্তি শোনাতে, শোনালাম, তাঁর খুব ভালো লাগলো, তিনি বললেন, “তুমি যদি আমাদের সঙ্গে যোগ দাও তাহলে তোমার অনেক কিছু করার থাকবে”। তখন থেকেই আমি একজন সদস্য হয়ে গিয়েছিলাম। খাতায় পত্রে কোথাও সই করতে হয়নি। বয়স তখন ষোলোও হয়নি। গ্রুপের সবাইকে পেয়েছিলাম আপন জনের মত করে, আর নাট্যমঞ্চের মাধ্যমে পেয়েছিলাম দেশাত্মবোধ। নাটক ছাড়াও আমাদের একটি ছোট্ট দল ছিল স্বতন্ত্রভাবে। সেটি ছিল শুধুই আবৃত্তির। রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে শম্ভুদা একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছিলেন। উৎসাহের সাথে তাতে যোগ দিয়েছিলাম, ভালো হওয়ার জন্য আত্মপ্রসাদও লাভ করেছিলাম। পরে নানান জায়গা থেকে ডাক আসতো সূত্রধরের কাজ করার জন্য ও স্বতন্ত্রভাবে আবৃত্তি করার জন্য। এই সফলতার জন্য আমার গুরু শ্রী শম্ভু মিত্রের কাছে আমি চিরঋণী। তাঁর আবৃত্তি আমার কাছে চিরস্মরণীয়। নাটকের কথায় আসি, নবনাট্য আন্দোলনের শুরু নাসিরুদ্দিন রোডে। শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্রের বাড়িতে হল বহুরূপীর সেন্টার। সেখানে একত্রিত হতে হতো সবাইকে। ‘নবান্নের’ পরে প্রথম নাটক, তুলসী লাহিড়ীর লেখা ‘পথিক’। মহড়া শুরু হল। তখন দলের কোন পয়সা ছিল না। আর মেম্বারদেরও তথৈবচ। সবাই শখের থিয়েটার, নবনাট্য আন্দোলন করতে এসেছে। পয়সা কড়ি কেউ চায় না, প্রাণভরা উৎসাহই তাদের একমাত্র অবলম্বন। এমনকি মঞ্চসজ্জা যত দূর সম্ভব সাদাসিধে হতে হবে, মিনিমাম খরচায় হতে হবে।  তখন যে নাটকগুলি সিলেক্ট করা হয়েছিল, তা সাধারণ মানুষের কথা, গরিব-দুঃখীর জীবনের কথা, রাজা রাজরার জীবনের কথা নয়। সবার ঘরে ঘরে যা ছিল, তার থেকেই পোশাক-আশাক হয়ে যেত। আর কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমাদের Art ডিরেক্টর খালেদ চৌধুরি সাহায্য করে দিতেন।  কিন্তু শো করতে হবে, কাজেই শো করা হতো। পারস্পরিক সাহায্যেই হত।  শ্রী তুলসী লাহিড়ীর ‘পথিক’ই হলো বহুরূপীর প্রথম নাটক।

‘পথিক’ নাটকটির স্থান হল গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের উপরে একটি চায়ের দোকানে। একজন বৃদ্ধ (তুলসী লাহিড়ী) ও তার নাতনি চালায় দোকানটি। পথে যারা যাতায়াত করেন, তারা চা খেয়ে যান, কখনো নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেন। দোকানে ধুবনী বলে (গীতা ভাদুড়ি) একটি সাঁওতাল মেয়ে ঝাঁট দেওয়ার কাজ করতো, একদিন তার স্বামীর কুলিয়ারিতে কাজ করতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যায়, ধুবনী দোকানে এসে আছাড় খেয়ে পড়ে। এর পরের দিকে একটি দৃশ্য ছিল, দোকানের ডাকাত পড়ার। তখনকার দিনে মডার্ন ডাকাত মানে, লাঠিয়াল নয়, রিভলবার নিয়ে আসা শার্ট প্যান্ট পরা একজন ডাকাত (সবিতাব্রত দত্ত)  বৃদ্ধ দোকানিকে (শ্রী তুলসী লাহিড়ীকে) এসে ধরে, তারপর ক্লাইম্যাক্সের মারামারিতে আলো নিভে যায়, পরে পুলিশ এসে যায় ইত্যাদি। সেই অভাবনীয় আলোকসম্পাতে ছিলেন শ্রী তাপস সেন। ওই নাটকে ফাইটিং Scene-টাও খুব ভালো হয় বলে মনে আছে। এখানে একটি গল্প বলার আছে, শ্রী সবিতাব্রত দত্ত  খুব অভিযোগ করতেন তুলসী লাহিড়ীর বিষয়ে। বলতেন, “উনি ভালো নাটক লেখেন, অভিনয় করেন কিন্তু কাকে কোন রোলে মানাবে, তা জানেন না”। একদিন বললাম, “সামনের সপ্তাহে ‘পথিক’ Staged হওয়ার সময়ে তুমি এক কাজ করো, Climax-এ যখন ঢুকবে, তখন ওঁকে ধরে খানিকটা ঝাঁকানি দিয়ে দিও”, সেই শুনে খুব উচ্চ হাসি হেসে বলল, “ঠিক বলেছিস!” পরের সপ্তাহে যখন পথিক অভিনয় হচ্ছে, ওই নাটকে আমার কোনো রোল ছিলোনা, হলে বসে দেখছি, তারপর নাটক যখন ক্লাইম্যাক্সে উঠেছে, দোকানে ডাকাত পড়েছে, ডাকাতের ভূমিকায় ঝুনুদা ঢুকে বৃদ্ধকে ধরে এমন জোরে ঝাঁকাতে লাগলেন, যে উনি মুখ চেপে স্টেজের উপর বসে পড়লেন। আলো নিভে গেল। কি হলো! কি হলো! হইচই ব্যাপার!! তারপর যখন সিন পড়লো, দৌড়ে গ্রিন রুমে গেলাম, ঝুনুদাকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যাপার কি?” বলল, “কিছু না রে! ওটা তো পুরো ডেঞ্চার ছিল! ছিটকে গিয়ে স্টেজের উপর একেবারে! খুব ন্যাচারাল হয় নি, বল? আইডিয়াটা তো তোরই ছিল”। ‘পথিক’ Successful হয়েছিল। দর্শকের কাছ থেকে অনেক প্রশংসা পেয়েছিল। 

‘ছেঁড়াতার’ শ্রী তুলসী লাহিড়ীর লিখিত আর একটি ডায়নামিক নাটক। তুলসী লাহিড়ী আর কিছু না লিখে, শুধু ওই একটি নাটক যদি লিখতেন, তাতেও উনি বিখ্যাত হয়ে যেতেন। ওই নাটকের অভিনয়ও ভোলাবার নয়। দর্শকরা অভিভূত হয়ে পড়তেন দেখতে দেখতে। একটি গ্রামের চাষাদের জীবনের কথা – রহিমুদ্দিন ও ফুলজান দুটি সুখী মানুষ, তাদের ঘিরে গল্পটি। প্রথমে যেমনি সুখী ছিল তারা, পরে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে ভয়ংকর দুঃখের রুপ ধারণ করলো তাদের জীবন। নায়ক নায়িকার ভূমিকায় শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র। একটি দিনের কথা বলব তা হল, রহিমুদ্দিন কলকাতায় গিয়েছিল, তার সোহাগের বউ যাতে শহরের মেয়েদের মতন দেখায় তাই ফেরার সময়, সে ফুলজানের জন্য শহর থেকে হাই-হিল জুতো কিনে এনেছে। সেই দেখে ফুলজান বলছে ওসব পরতে পারবে না। হাই-হিল জুতো পরে সে হাঁটতেই পারবে না।  রহিমুদ্দিন তখন তাকে বলছে, “তোকে পরতেই হবে, মানুষ পারে না এমন কোনও কাজ নেই। হাঁটতে না পারিস, আমায় ধরে ধরে হেঁটে অভ্যেস কর”। জুতো পড়ে চলতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, তাই নিয়ে দুজনের কি হাসাহাসি! রঙ্গরসিকতা শেষে রহিমুদ্দিনের বাড়ির উঠোনে হিন্দু-মুসলমান চাষীরা বলাবলি করছে, দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে! তারপর দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। চাষীদের ঘরে ঘরে হাহাকার। গরিব মানুষের ঘরে, মাটির হাড়িতে দুটো চালও পড়ে নেই। কতদিন হয়ে গিয়েছে ভালো করে কিছু খাওয়া হয়নি – পেট জ্বলছে! কি উপায়! কি উপায়! ভাবছে সবাই। রহিমুদ্দিন স্থির করলো, ছেলেটিকে নিয়ে সে শহরে চলে যাবে। গ্রামের একজন স্বার্থান্বেষী বর্ধিষ্ণু মুসলমান ছিল, যে হিন্দু-মুসলমান চাষীদের জব্দ করে লুটে নিত। সে দুর্ভিক্ষ দেখে ভালো মানুষের মতন একটি লঙ্গরখানা খুলেছে, সেখানে দলে দলে লোক খেতে যাচ্ছে।  কিন্তু রহিমুদ্দিন তাকে দেখতে পারে না। তাই রহিমউদ্দিন ও তার পরিবারের কেউ সেখানে যায় না। সে একদিন এলো খবর নেওয়ার আছিলায় – এসে বলল, “খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, আমার ওখানে গেলে পারিস তো!” রহিমুদ্দিন চোখে আগুন নিয়ে তার দিকে তাকালো। তখন থতমত খেয়ে সে বলল, “তুই যদি না চাস, তবে বউকে, ছেলেকে পাঠাস, ওরাও কি না খেয়ে মরবে?” রহিমুদ্দিন মুখে কিছু বলল না কিন্তু শরীরের ভেতর জ্বালা ধরে গেল। পরে যখন ওর মাথা ঠান্ডা হলো, তখন ভেবে দেখল ফুলজানকে শেষ পর্যন্ত ওকে তালাক দিতে হবে। দিলে, সম্মানহানির ভয় থাকবে না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, একদিন রহিমুদ্দিন ফুলজানকে তালাক দিয়ে, চলে গেলো। সে যে কি মর্মান্তিক তা অতীব বিস্ময়ের সঙ্গে দর্শকরা Witness করেছিলেন। আলো কমে গেল, ওদের একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধু আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বলল, “ভাবিজান সন্ধ্যা হয়ে গেছে, শেকলটা তুইলা দেন”। ফুলজান বশিভুতের ন্যায় উঠে দাঁড়ালো। উঠোনে প্রায়ান্ধকার আলোকে ঘুরে ঘুরে কি যেন দেখছে, আর ধীরে ধীরে বলছে, “এ ঘর তো আমার নয়!” বলতে বলতে তার কন্ঠস্বর ভেঙে পড়ছে। আলো নিভে অন্ধকার হয়ে গেল, পর্দা এখানেই নেবে এলো। শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র দুজনেরই অনবদ্য অভিনয়ে, নাটকটি সত্য ঘটনা বলে মনে হত। পরে, ওই নাটকে আমার একটি ছোট রোল ছিল, সেই আমার প্রথম অভিনয়। 

দুর্ভিক্ষ আমি দেখেছিলাম, ১৯৪৩-এর প্রথম দিকে, আমাদের মা মারা যান। কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, একটি অপারেশন হওয়ার কথাও ছিল, কিন্তু সে সময়ে, খিদিরপুর ডকে আর চৌরঙ্গীতে দুটি জায়গায় জাপানিরা বোমা ফেলল। মহাযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। কলকাতার ইভাকুয়েশন শুরু হয়ে গেল। আমাদের মাকে নিয়ে আমরা তখন ঠাকুরদাদার বাড়িতে, বর্ধমান চলে গেলাম। মা’কে বর্ধমান হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। অপারেশন সাকসেসফুল না হওয়ায়, উনি খুব কম বয়সেই চলে গেলেন। আমাদের জীবনটা একেবারে উলটপালট হয়ে গেল। কলকাতার অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হতে, আমরা বর্ধমান থেকে কলকাতায় ফিরে এলাম। তার  কয়েক মাস পরের ঘটনা, দুর্ভিক্ষ শুরু হলো। দলে দলে লোক, নানাদিক থেকে কলকাতায় চলে আসছে খাদ্যের অন্বেষণে – “ফ্যান দাও গো মা!” ডাকে চারিদিক অস্থির। তাদের হাহাকারের সে দৃশ্য ভোলার নয়। যে দেখেছে, যে শুনেছে, তারই প্রাণ হাহাকার করেছে। আমাদের বাড়ির সামনের দিকে কলাপসিবল গেট ছিল, সেখান দিয়ে ভাত দেওয়া হতো, ঠেলাঠেলিতে গেট যেন ভেঙে পড়তো। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ মরে পড়ে থাকতো, সকালে কর্পোরেশনের গাড়ি এসে মৃতদেহ তুলে নিয়ে যেত। সেদিন যে কালের করাল রূপ আমরা দেখেছিলাম, তারই সাক্ষী হয়ে আছি। তুলসীবাবুর হাত দিয়ে তাই  এ দৃশ্য এমন নিখুঁত ভাবে ফুটে উঠেছিল। যেমন নাটক তেমনি অসাধারণ দলগত অভিনয় বহুরূপীকে সার্থকতার দিকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল। 

এরপর বহুরূপী নাম ছড়িয়ে পড়ল কাছে ও দূরে। অনেক দূরে দূরে, নানা জায়গায় অভিনীত হয়েছিল ‘ছেঁড়াতার’। একবার আমরা গ্রামে যাই,  গ্রামের নাম ‘ভোতা’। বেশ কয়েক ক্রোশ রাস্তা গরুর গাড়ি করে যেতে হয়। মাঠের মধ্যে Stage তৈরি করার কাজে অ্যাডভান্স পার্টি আগেই চলে গিয়েছিল। আমরা মেয়েরা, শাঁওলীকে নিয়ে এবং অন্যান্য মেম্বারদের নিয়ে পরের ব্যাচে গেলাম। শম্ভুদা আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। একটি-দুটি নয় অনেকগুলি ছাওনি দেওয়া গরুর গাড়ি সার বেঁধে চলেছে, মাঠের পর মাঠ পার হয়ে, কখনো বা কোনও গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, কখনো বা কোনও গ্রামের ধার দিয়ে কিংবা কোনো শুকিয়ে যাওয়া নদী পার হয়ে। অনেকটা চলার পর, সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে হাড় মুড়মুড়ি বেরাম বোধ করছে, আমরা গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, “আর কতদূর ভোতা?” সে বলল, “ওই তো হোতা”। আবার বহুক্ষণ চলার পর, আবার প্রশ্ন করাতে, সে বলল, “ওই তো হোতা!” এরপর অবশ্য আর কোন প্রশ্ন করা হয়নি। সন্ধ্যে হয় হয় যখন ভোতা পৌঁছলাম। দেখলাম এক ছবির মতন গ্রাম। মাটির বাড়িতে থেকে, মাটির বাসনে রান্না করে, মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে, দিব্যি দিন কেটে গেল আমাদের। পেট্রোম্যাক্স জ্বালিয়ে, মাঠের মধ্যে স্টেজ বেঁধে, দারুন অভিনয় হল – ‘ছেঁড়া তার’. গ্রাম-গ্রামান্তরের থেকে লোক এসেছিলো দেখতে। মনে হচ্ছিল, একটা কিছু হচ্ছে! এই ছিল আমাদের নবনাট্য আন্দোলন।

আমাদের বহরমপুর যাওয়া ছিল একেবারে বিপরীত অভিজ্ঞতা। এবারে রেড কার্পেট পাতা, নবাবের গেস্ট হাউসে থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল আমাদের জন্য। কয়েকদিন নবাবের বাড়িতে থেকে, নবাবী রান্না খেয়ে, দারুন কেটেছিল দিনগুলি। আমরা জামশেদপুরে, বার্নপুর, পাটনা এসব জায়গাতেও অভিনয় করি। বহুরূপীর নাম ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে, নাটকের পর নাটক মঞ্চস্থ হতে থাকে। পাটনায় ওখানকার প্রবাসী বাঙ্গালীদের বন্ধুত্বপূর্ণ একটি গোষ্ঠী ছিল তারা সব ব্যবস্থা করেছিলেন। ততদিনে, বহুরূপী যতগুলি নাটক মঞ্চস্থ করেছিল তার সবগুলোই অভিনয় হয়েছে। একটি দোতলা বাড়ি ভাড়া করে, তাতে আমরা সব মেম্বাররা থাকতে শুরু করি। একবার এক জার্নির কথা মনে আছে, সম্ভবত আমরা বার্নপুর যাচ্ছিলাম ট্রেনে করে – কোথাও যাওয়ার সময় কয়েকটি কম্পার্টমেন্ট বুক করা হতো আমাদের জন্য, তার মধ্যে একটিতে মেয়েরা, বয়স্করা থাকতেন, শম্ভু মিত্র আমাদের এসকর্ট করতেন। রাত্রের সফর, কাজেই দৃশ্য দেখে সময় কাটানো যায় না, তবে কারোর চোখে ঘুম নেই! তখন আমরা কয়েকজন মিলে শম্ভুদাকে ধরলাম একটি গল্প শোনাতে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কিসের গল্প?” আমাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, “তৃপ্তিদির সঙ্গে প্রথম আলাপের গল্প”। শুনে বললেন, “ও, এই কথা! কেমন করে, ও কোথায় মনির সঙ্গে দেখা হয়েছিল?” আমরা সমস্বরে হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠলাম। এরপর গল্প শুরু হলো। অনেকক্ষণ অবধি তালগাছ, শ্যাওড়া গাছের শাকচুন্নি, পেত্নী, ব্রহ্মদৈত্য ইত্যাদি চলার পর আমরা বললাম, “কি গল্প শুনতে চাইলাম, আর কী গল্প শোনাচ্ছেন!”  উনি বললেন, “কেন, সাবজেক্টের মধ্যে কোনও অসংলগ্নতা পাচ্ছ কি? তোমরা জানতে চেয়েছিলে,  মনির সঙ্গে কি করে দেখা হয়েছিল, আর কোথায়? তা আমি যে জায়গাটির বর্ণনা করছি….তবে, কোন জায়গার কথা বলছিলাম বলতো?” আমি বলে উঠলাম, “রাজ শেখর বসুর ভূষণ্ডির মাঠ”। হো হো করে উচ্চ হাসিতে কম্পার্টমেন্ট ভরে উঠল। ভেবেছিলাম শাকচুন্নি পেত্নী ইত্যাদির পর, ওখানে একটা জোর দাম্পত্য যুদ্ধ বেধে উঠবে, অথচ দেখলাম তৃপ্তিদি বেশ গল্পটি উপভোগ করছেন এবং মুচকি মুচকি হাসছেন। 

কালক্রমে, বহুরূপী Teamwork একটা নিদর্শন হয়ে দাঁড়ালো। হল হাততালিতে ফেটে পড়তো সর্বত্র। নাটকের পর নাটক Successful হতে থাকে। বেশিরভাগ সময় নাটক Houseful যেত। জনপ্রিয়তা ছিল Phenomenal. নাম ছড়িয়ে পড়ে এমনকি বম্বে দিল্লি পর্যন্ত। দিল্লীতে All India Fine Arts And Crafts Societies এর হলে মঞ্চস্থ হয় অনেক নাটক। Stage Setting করেন খালেদ চৌধুরী। তখনকার দিনে, ভারতবর্ষে এমন সুন্দর Stage Setting And Lighting আগে কখনো দেখা যায়নি। এ বিষয়ে আলোকসম্পাতের অসাধারণ ক্ষমতা ছিল শ্রী তাপস সেন আর তার শিষ্য সিতাংশু মুখোপাধ্যায়ের। সেটিং এর আইডিয়া গুলিকে নবনির্মাণ স্বরূপ করে তুলতে পেরেছিলেন তারা, তাই নাটকগুলিও প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পেরেছিল। দিল্লিতে অন্যান্য নাটক ছাড়া রক্তকরবী অভিনীত হয় বেশ কয়েক বার।

প্রতি শনিবারে, একটি আসর বসতো আমাদের বাড়িতে। শনিবার সব অফিস Half-Dayর পর ছুটি হয়ে যেত। দাদা চলে আসতেন বাড়ি,  তারপর বন্ধুরা সবাই একে একে এসে জড়ো হত। এর মধ্যে অনেক বন্ধুই বহুরূপীর মেম্বার ছিলেন। দাদা আমার থেকে ১২ বছরের বড়। দাদার বন্ধুরা প্রায় ততটাই বড়, কাজেই নামের পরে, সবাইকে দাদা বলতে হতো। ওঁরাও ছোট বোনের মতন সবাই স্নেহ করতেন, তুই বলে কেউ কেউ সম্মোধন করতেন। আমার কাজ ছিল চা-জলখাবার করে দেওয়া। তার সমাধান হলে, আড্ডায় যোগ দেওয়া। আড্ডাটি জমে উঠত খুব কবিতায়, গানে, নাটকের আলোচনায়। সন্ধ্যার পর আসর ভাঙতো, কিন্তু সেই আসর মনের মধ্যে উৎসাহের রেশ রেখে যেত। ভাইফোঁটার দিনে, ওদের সবার নিমন্ত্রণ থাকতো। হিন্দু এবং মুসলমান নির্বিশেষে সবাই খুব খুশির সঙ্গে যোগদান করতেন ও কত উপহার রেখে যেতেন। একবার মনে আছে, ঢাকা থেকে কলিমদা এলেন কলকাতায় গান গাইতে, তখন আমার কাছে সঞ্চয়িতা ছিল না, অনেক সময় কবিতা আবৃত্তি করে বেড়াতাম, খাতায় লিখে, সেই দেখে কলিমদা বললেন, “আমাকে বলিস নি কেন সঞ্চয়িতা নেই?” ফিরে যাওয়ার সময়, নিজের জন্য কিছু স্বরলিপি কিনলেন ও আমার জন্য সঞ্চয়িতা কিনে দিয়ে গেলেন। সেই সব স্নেহের উপহার কখনো কি ভুলে যেতে পারি!

কিছুদিনের জন্য বম্বে গিয়েছিলাম, ফিরে আসতেই, দাদা বললেন, “শম্ভুদা একটা নাটক লিখেছেন, তোমাকে ডেকেছেন তার নাটকে একটা Important রোল করার জন্য, শীঘ্রই ওটি মঞ্চস্থ করার কথা ভাবছেন”। কাজেই দৌড়ালাম শম্ভুদার কাছে। গিয়ে শুনলাম, নাটকের নাম- ‘উলুখাগড়া’- এক ইউরোপিয়ান নাট্যকারের লেখার এডাপশন। নাটকটিতে সাতটি ক্যারেক্টার, গৃহকর্তার অভিনয় করেছেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য আর গৃহিণী করুণা – তৃপ্তি মিত্র, সংসারে তার কথার দাম নেই, অসহায় একাকি একটি মানুষ, বাড়িতে করার কিছু নেই, তাই তিনি একটি ক্লাবে যান সময় কাটানোর জন্য, সেখানে অভিনয়ও করেন। ওই ক্লাবে একজন মেম্বার আছেন, যিনি করুণার প্রতি আসক্ত, কিছুটা বিকৃত স্বভাবের, এককথায় – ভিলেন। এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন গঙ্গাপদ বসু। ওই ধরনের রোলে তার অভিনয় অতুলনীয় ছিল। সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ এ তাঁর অন্যতম কাজের জন্যই সবাই তাকে চেনেন। ওই বাড়ির মেয়ে, মিনতি, আমি শ্রীমতী মালবিকা মজুমদার। তার বন্ধু সুরেশ, অভিনয়ে অমর গাঙ্গুলী। মিনতির ভাই বিনোদ, Light-Hearted, Easy Going শম্ভু মিত্র, তার বান্ধবী নীনা, তিনি মডার্ন মেয়ে, অভিনয় করেছিলেন গীতা বা কখনো শ্রীমতি কল্যাণী মজুমদার (আমার বৌদি)। শম্ভুদার কাছে বৃত্তান্ত শোনার পর, Part মুখস্ত করব কি! পুরো লেখাটাই মুখস্ত করে ফেললাম ভয়েতে। নিখুঁত অভিনয়ের বিষয়ে আর সময়ানুবর্তিতা বিষয়ে উনি খুবই পার্টিকুলার ছিলেন। সবাই যেমন ভয় পেতো ওঁকে, আবার তেমনি সমীহও করতো। যাই হোক, নাটক শুরু হলো, শম্ভুদা ডাইরেক্ট করছেন, আমরা Follow করছি। প্রথম Scene-টি হলো ড্রইংরুমে- একটি সোফাতে বসে, মিনতি বই পড়ছে আর তার বাবা ঘরের একটি কোণে রাখা ক্যানভাসে ছবি আঁকছেন ও মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। এরপরে করুনার প্রবেশ, কিছু কথাবার্তা তারপরে বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে, মিনতির ভাই বিনোদের প্রবেশ। নীনা তার পোষাকে অতীব মডার্ন, ৬০/৬৫ বছর আগে, ওরকম ছোট পোশাকে কলকাতায় কাউকে দেখা যেত না, তখন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরাও লম্বা স্কার্ট পড়তেন।  ঘরের কোণে রাখা একটি টেবিলে বসে, পা দুলিয়ে দুলিয়ে সে খানিক উফ আফ করে চলে যাবে…এরপরের Scene- আধো অন্ধকার ঘরে করুণা একা Soliloquy করে তার ক্লাবের পার্ট মুখস্ত করছেন, হঠাৎ তার ক্লাবের বন্ধু, তারিফ করতে করতে প্রবেশ করলেন ও সোফায় এসে বসলেন এবং তারপর, কথাবার্তার মাধ্যমে প্রেম নিবেদন করলেন। গৃহস্বামী ঘরে এসে পড়ে এই দৃশ্য দেখে, আগন্তুকের কলার চেপে ধরলেন এবং বাড়ির বাইরের দরজা দেখিয়ে দিলেন। পরের Scene- ড্রয়িং রুমে সোফাতে মিনতি বসে আছে আর একটি সোফায় সুরেশ, তারা দুজনে দুজনকে প্রশংসার চোখে দেখে, দুজনে এরপর এগোবে কিভাবে সেকথা এখনো তাদের বলা হয়নি, সেই জায়গায় সুরেশের বারে বারে ভুল হচ্ছে, সুরেশ (অমর গাঙ্গুলী) বকুনি খেলেন শম্ভুদার কাছে। শম্ভুদা যে শুধু তাকে বকলেন তা নয়, উপরন্তু আমার উদ্দেশ্যে বললেন, এই মেয়েটিকে আমার কিছু বলে দিতে হয় না। খুবই Embarrassing Situation! একজন বকুনি খেলো, আর অন্যজনের প্রশংসা হলো। ভদ্রলোক তখনকার মতন রাগ করলেন। অবশ্য পরবর্তীকালে, অমর গাঙ্গুলী নানান ভূমিকায় সার্থকতা সঙ্গে অভিনয় করে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তবে সেদিন আমার কিছু Confidence বেড়েছিল।

নাটকের কথায় ফিরি, করুণা দেবীর সেই পরিচিত ব্যক্তিটি কিছু গুন্ডা নিয়ে একদিন প্রতিশোধ নিতে বাড়িতে এসে ঢুকলেন, কদর্য ভাষায় মারামারিতে তুমুল ব্যাপার ঘটে গেল। পরে পরিবেশ শান্ত হলে দেখা গেল, করুণা দেবী বিষ খেয়েছেন। মিনতি দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে বলছে, “এ তুমি কি করলে?” সবাই মিলে ধরে এনে তাকে সোফায় শুইয়ে দিলো, জড়িত স্বরে করুণা কিছু কথা বললেন, এর পরে, “খোকা, খোকা কোথায়?” বলতে বলতে, তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। এখানেই সমাপ্তি- পর্দা পড়ল, ‘উলুখাগড়া’ দারুণ হলো। সবার অভিনয় ভালো হয়েছিল। Hall ফেটে পরলো হাততালিতে। শম্ভু মিত্রের ‘বিনোদ’ দেখবার মতন হয়েছিল। তিনি সর্বদা হিরোর রোল করে এসেছেন, এবার একটা হালকা ছেলের অভিনয় করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। বাকি রইল মালবিকা মজুমদার, উইংস এর পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসছি, সজোরে পৃষ্ঠে করাঘাত করে শম্ভুদা বললেন, “বুলু দারুন হয়েছে, তোমার মিনতি”।  অডিটোরিয়াম থেকে অনেকে দেখা করতে এলেন, অভিনন্দন জানালেন, পরে সুপ্রভা দেবী এলেন, “বড় সুন্দর হয়েছে তোমার রোলটি” বলে, জড়িয়ে ধরে আদর করে গেলেন। সেদিনের সার্থকতা আজও, এতো বছর বাদেও অনুভব করতে পারি। পরেরদিন কাগজে দেখা গেল খুব ভালো রিভিউ হয়েছে। এরপর প্রায়ই অভিনীত হয়েছে ‘উলুখাগড়া’, বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন হলে সর্বদাই একই টিম ছিল। প্রায় ছয় বছর অভিনয় করার পর, একদিন সময় এলো বহুরূপী ছেড়ে চলে যাওয়ার- শম্ভুদাকে জানালাম, উনি খুব গম্ভীর হয়ে রইলেন, সব শুনে একটু রাগ করলেন। একেবারে স্তব্ধ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, গুরুকে প্রণাম করে, বিদায় নিয়ে,  ১১ এ, নাসিরউদ্দিন রোডের বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন মনে হয়েছিল, জীবনের একটি উজ্জ্বল অধ্যায় এখানেই শেষ হলো।

স্মৃতিচারণে : শ্রীমতি মালবিকা মজুমদার চৌধুরী (“দিগঙ্গন” পত্রিকায়  প্রকাশিত। বইমেলা সংখ্যা ১৪১৯)

ছবি : শ্রী শম্ভু মিত্রের ছবিটি ওঁর ওয়েবপেজ থেকে সংগৃহিত। মালবিকা মজুমদার চৌধুরী ও অশোক মজুমদারের ছবিদুটি পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত।

তথ্য সূত্র : শ্রী অশোক মজুমদারের ভিডিও সাক্ষাৎকার: https://youtu.be/dm2um27jaiw

সংযোজনায় : সুদেষ্ণা মজুমদার।

লেখিকা পরিচিতি

 

 

সুদেষ্ণা মজুমদার

যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নাতক এবং জন-সংযোগে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা পাশ করে, সমাজসেবা মূলক প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন ও পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে প্রশিক্ষণ বিভাগে দীর্ঘ সময় কর্মদক্ষতা অর্জন করার পর, একজন শখের চিত্র-গ্রাহক এবং লেখিকা। বর্তমানে চেন্নাই নিবাসী।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply to Jimmy Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!