কালীপদ চক্রবর্ত্তী
এদেশীয় ভূতের গল্প
আমাদের এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত রহস্যের বিষয় মনে হয় ‘ভূত’। মানুষের মধ্যে এই ভূত নিয়ে চিরকাল ধরে একটা আগ্রহ আমরা দেখতে পাই। ভূত! শব্দটাই বেশ অদ্ভুত। এই শব্দটা শুনলেই শরীরটা বেশ শিহরিত হয়। মনোজগতে বিচিত্র আলোড়ন-এর সৃষ্টি হয়। ভূত কি? এর সঠিক ও গ্রহণযোগ্য উত্তর দেওয়া অসম্ভব। এ প্রশ্নের এককথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তর দেওয়া অসম্ভব। সবার একই চিন্তা – ভূত কি সত্যিই আছে, নাকি নেই। এ নিয়ে কত লেখা যুগ যুগ ধরে প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু কেউই সঠিক করে কিছু বলতে পারেননি। অবশ্য আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়টাকে স্বীকার করে না। আবার এমন হাজারো ঘটনা আছে যেগুলোর কোনও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারেনি। আর তখনই দ্বিধা বাড়ে তাহলে কি সত্যি বলে কিছু আছে? পৃথিবীর নানা জায়গার উপকথা, গল্প এবং সংস্কৃতিতে আমরা ভূতের উল্লেখ দেখতে পাই। বলা হয়, হল আত্মা বা স্পিরিট। একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার অদৃশ্য উপস্থিতি। অবশ্য এও বলা হয় যে এর বিবরণ সর্বত্র এক নয়। কোথাও বায়বীয়, কোথাও জলের মত, কোথাও ছায়া আবার কোথাও তারা পশু পাখির আকারে দেখা দেয়। নামের এই অদৃশ্য অলৌকিক এবং কাল্পনিক অবয়বটির প্রতি কমবেশি আমাদের সকলেরি খুব অনুসিন্ধিৎসা আমরা দেখতে পারি।
কয়েক বছর আগে অর্থাৎ ২৪শে মে, ২০১৬ টি ভি-তে দাদাগিরি দেখছিলাম সে সময় স্বয়ং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, উনি যখন ইংলন্ডে খেলতে গিয়েছিলেন তখন হোটেলের যে ঘরে শুয়েছিলেন সেখানে রাতে কলঘরে জল পড়তে শুনেছিলেন এবং পরের দিন ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে জানতে পারেন যে ওই ঘরে অনেকদিন আগে ওই হোটেলের মালিক আত্মহত্যা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বিখ্যাত ক্রিকেট খেলোয়াড় ব্রেটলিরও নাকি সেই একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
আমাদের বাংলা সাহিত্যে ভূত প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। কোথায় নেই ভূত? ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে ভূত। শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূতের গল্পগুলো তো এখনও বিখ্যাত হয়ে আছে। তার লেখা গুপীগাইন বাঘাবাইন, কুঁজো ভূত আর ভূত পেত্নীর গল্পগুলো-তো আজও আমাদের সকলের মুখে মুখে। সত্যজিৎ রায়ও লিখেছেন ভূত নিয়ে। এরকম আরও অনেকে আছেন যারা ভূত-পেত্নী নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে ভূতের অভাব নেই বলা যায়।
তবে আমাদের দেশের ভূত আবার নানা জাতের হয়। অনেকে রেগে গেলেই আবার ভূতেদের নাম করে গালিও দিয়ে থাকেন। যেমন ধরুন পেত্নী। এটি বাংলার অতি পরিচিত ভূতের নামে। যে ভূত এক অতৃপ্ত নারী আত্মা। অবিবাহিত নারী। বেশধারণ করায় বেশ অভিজ্ঞ। খুব রাগী আর কখনও নাকি পেছন দিকে ঘোরেন না।
আর ডাইনীর নাম তো আমাদের সকলের কাছে খুবই পরিচিত। ইনিও নারী ভূত। ওনার অবশ্য মরণোত্তর দশা নয়। তিনি জাদু বিদ্যায় খুব পারদর্শী। বলা হয়ে থাকে শিশুদের রক্ত খেয়ে নাকে বহু বছর বেঁচে থাকতে পারে।
আর যেসব ভূত গাছে গাছে বিচরণ করে তাদের গেছো ভূত বলে। তারা গাছেই বসবাস করে।
আরেক প্রকার ভূত আছে যারা গাছে থাকেন এবং নারী। তার নাম শাঁকচুন্নি। তবে তার বিশেষত্ব হল তারা কিন্তু যে কোনোও গাছেই থাকে না। তারা আম গাছে বাস করেন। তার বেশভূষা চিরায়ত বাংলার নারীদের মত। তারা নাকি ধনী নারীদের ভর করে বিবাহিত জীবনের সুখ লাভ করেন।
বাংলা সাহিত্যে ‘চোরাচুন্নি’ নামে এক ধরণের দুষ্ট ভূতেদের উল্লেখ আছে। বলা হয়ে থাকে কোনও চোর মরে গেলে কারও কারও আত্মা চোরাচুন্নিতে পরিণত হয়। এরা নাকি পূর্ণিমা রাতেই বেশি উৎপাত করেন।
মেছো-ভূতের নাম তো জেলেদের কাছে খুবই পরিচিত। ভূতেদের মধ্যে নাকি মাছ খাওয়া ভূতও আছে। যেখানে মাছ আছে সেখানেই তাকে দেখা যাবে। বাজার থেকে মাছ কিনে ফেরার সময়ও তাকে পিছু নেয় এই ভূতেরা। সুযোগ পেলেই পথে কোনও নির্জন স্থান এলেই ভয় দেখিয়ে মাছ নিয়ে পালিয়ে যায় এই ভূতেরা। এদেরই বলা হয় মেছো ভূত।
দেও বা দেউ ভূতের নাম গ্রামেই বেশি শোনা যায়। কারণ সেখানে জলাশয়ের সংখ্যা বেশি। এরা নাকি জলেই থাকে। বিশেষ করে নদীর জলে। এই ভূতেরা নাকি মানুষদের জলে ডুবিয়ে মারতে বেশ অভিজ্ঞ। সাঁতার না জানা লোকেরা এ ধরনের ভুতের থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মুসলমান সম্প্রদায়রা ‘জিন’ নামে অশরীরী জীবের বিশ্বাসে বিশ্বাসী। আরবিতে ‘জিন’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল এমন কিছু যা গুপ্ত, অদৃশ্য, অন্তরালে বসবাসকারী বা পর্দার আড়ালে থাকা কিছু। এই জিনদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে জিনদের বশীভূত করেন বা জিন-মুক্ত করেন যারা, সেসব পারদর্শী ব্যক্তির কথা মুসলমান সমাজে প্রচলিত আছে। বাঙালি মুসলমান সাহিত্য-সিনেমায় জিনদের উপাখ্যান বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
মুসলমান বিশ্বাস মতে জিন আর শয়তান অভিন্ন। দুষ্ট জিনদের প্রধান হল ইবলিশ শয়তান। অবশ্য শয়তানের বংশধর জিনদের মধ্যে কিন্তু সবাই দুষ্ট নয়, এদের মধ্যে অনেক ধার্মিক জিনও আছে। ধার্মিক জিনেরা কিন্তু মানুষের ক্ষতি করেনা।
অনেকেই বলেন পরীরা জিনের নারী রূপ। এরা সুদর্শন পুরুষদের প্রেমে পড়ে এবং প্রেমিককে ভুলিয়ে নিয়ে যেতে চায় পরী-স্থান নামে অন্য এক সুন্দর রাজ্যে। অবশ্য অনেকে আবার বলেন পরীরা ছোটদের খুব ভালবাসে এবং তাদের সাহায্য করতেও এগিয়ে আসেন।
আর গ্রাম-গঞ্জের মানুষ নিশি-র নাম শোনে নি এরকম হতেই পারেনা। নিশি মানে রাত। এদের নাকি রাতের বেলায় আগমন হয়। এদের মোহনীয় শক্তি আছে। প্রিয় মানুষের গলা নকল করে বাইরে নিয়ে যায় এবং তাকে নিশি-ভূতে পরিণত করে।
কানা-ভুলো ভূতেরা পথিককে বিভ্রান্ত করে এক ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়। এই ভ্রম বশত পথিক তার গন্তব্য স্থান ভুলে যায় এবং অন্য কোথাও পৌঁছে যায়। এভাবেই অজানা, অচেনা জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাকে মেরে ফেলে। রাতের বেলা বিশেষ করে গ্রামের জনশূন্য মাঠের রাস্তার পাশে এই ভূত শিকারের অপেক্ষায় বসে থাকে। একা কোনও পথিক বা দলছুট কোনও লোককে শিকারে পরিণত করে।
এছাড়াও আছে মামদো-ভূত। অনেকে বলেন মুসলমান কেউ ভূত হলে হিন্দুরা তাদের মামদো-ভূত বলে ডাকে।
ব্রহ্মদৈত্যরা নাকি উপকারী ভূত। সাদা ধূতি ও পৈতে পরে তারা ঘুরে বেড়ায়। এরা নাকি পবিত্র আত্মা। বলা হয় ব্রাহ্মণরা পৈতের ঘরে মারা গেলে নাকি ব্রহ্মদৈত্য হয় এবং এরা প্রধাণতঃ বেল গাছেই থাকে।
আলেয়ার আলো বলে প্রবচন আছে। জলাভূমিতে এদের অগ্নিশিখার মত এদের দেখা যায়। সেই শিখাকেই আলেয়া নামে ডাকা হয়। রাতের বেলা এদের দেখে জেলেরা নাকি জ্ঞান হারিয়ে মারাও যান।
যারা বাঘের আক্রমণে মারা যায় তাদের অনেকের আত্মা নাকি বেঘোভূতে পরিণত হয়। নামটা শুনে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এরা সুন্দরবনেই বেশি দেখা যায়। সুন্দরবনে যারা মধু সংগ্রহ করতে যায় তাদের ভয় দেখানোই নাকি এদের প্রধান কাজ।
স্কন্ধকাটা ভূতকে কবন্ধ ভূতও বলা হয়ে থাকে। এই ভূতেদের মাথা থাকে না। এই মুণ্ডহীন ভূতেরা খুব ভয়ানক ধরণের হয়। বলা হয়ে থাকে, যেসব মানুষ রেল-দুর্ঘটনা বা ওই ধরণের কিছুতে মাথা কাটা পড়ে মারা যায় তারাই স্কন্ধকাটা হয়। এই ধরণের ভূতেরা সবসময় তাদের হারানো মাথার সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। অন্য মানুষকে আক্রমণ করে নিজের বশবর্তী করে এবং তাকে মাথা খোঁজার কাজে লাগায়।
এরকম নানা জাতের আনা ধরণের ভূতের গল্প ও লোককাহিনী লোকেদের মুখে মুখে প্রচার হয়ে চলেছে। বর্ষার দিনে বা রাতের বেলা লাইট নিভিয়ে ভূতের গল্প শুনতে শুনতে বেশ রোমাঞ্চকর একটা অনুভূতি হয়।
বাংলা সাহিত্যে যে পরিমাণে ভূত নিয়ে বই আছে সে অনুযায়ী সিনেমা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে যেগুলো আছে সেগুলো মানুষের মনে বেশ দাগ কাটে। যেমন ‘গুপীগাইন আর বাঘাবাইন’ বা ‘যেখানে ভূতের ভয়’ ইত্যাদি। এছাড়া আবাসন সমস্যা নিয়ে পরিচালক অনীক দত্ত বানিয়েছেন ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’। তবে এই সিনেমাগুলো খুব একটা লোমহর্ষক নয়, অনেকটা হাস্যরসাত্মক। ‘গল্প হলেও সত্যি’ ও ‘বাঙালি ভূতের গপ্পো’ ও ভূত নিয়ে। এমন এক সময় ছিল যখন দাদু, ঠাকুমারা নাতি, নাতনিদের নিয়ে জমিয়ে ভূতের গল্প শোনাতেন। আজকাল তাতে ভাঁটা পড়েছে। বাস্তবে ভূত থাকুক আর নাই থাকুক, আমাদের সংস্কৃতিতে ভূত যেন অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। তাইতো আজও শিশু-কিশোরদের বইগুলো এমনকি বড়দের ম্যাগাজিন ও গল্পের মধ্যেও ভূতের দেখা পাই। ভূত আমাদের সাহিত্যে বেঁচে আছে এবং থাকবে।
সাদা ভূতের কথা
আমাদের দেশের মত অন্যান্য দেশের লোকেরাও ভূতে বিশ্বাস করে।গত ১৮ই মে, ২০১৬ তারিখের একটি বিদেশী সংবাদ পত্র পড়ে জেনেছিলাম, মালয়েশিয়ার একটি স্কুলে নাকি ভূত দেখা গেছে। কালো দেহের কিছু একটা স্কুলে চিৎকার করতে থাকে। বিষয়টিকে অবশ্য স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো ‘গণ আতঙ্ক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৮ই মের প্রায় এক সপ্তাহ আগে। একজন শিক্ষক সেখানে ‘অতিপ্রাকৃত’ কিছুর অস্তিত্ব টের পান। আর তারপর থেকেই শুরু হয় গণ আতঙ্ক। পরপর তিনটি আতঙ্কজনক ঘটনা ঘটার পর মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলের কোটা ভারু শহরের ওই স্কুলটি বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। স্কুলের প্রিন্সিপাল সিতি হাওয়া মেট জানান, সবাই একই রকম একটি কালো দেহ দেখার কথা জানিয়েছেন। জানা গেছে ৫০ জন শিক্ষার্থী এবং ১১জন শিক্ষক একই অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। অনেকে স্কুলের ক্যান্টিন এবং হলে একই রকম ভৌতিক দেহের উপস্থিতি টের পেয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি সামলে নিতে সাময়িকভাবে স্কুল বন্ধ করে ঘটনার রহস্যোদঘাটনে তৎপর হয়েছেন। তারা তান্ত্রিক, ওঝা থেকে শুরু করে অতিপ্রাকৃত-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং মনঃচিকিৎসক-এর পরামর্শ নিতেও ছাড়ছেন না।
আমরা দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এরকম কিছু ভূতুরে বাড়ীর সন্ধান পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি অন্যতম প্রদেশ হল লুসিয়ানা। মিসিসিপি নদীর তীরবর্তী সেইন্ট ফ্লান্সিসভিল এই অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট একটি শহর। আর ছোট্ট এই শহরটি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠেছে অদ্ভুত বিষয় নিয়ে তদন্তকারী সংস্থা TAPAS এর এক গবেষণার পর। কারণ সংস্থাটি তাদের গবেষণার তদন্তে প্রমাণ করেছে যে ফ্রান্সিস-ভিল-এ অবস্থিত “মার্টলস প্লান্টেশন” বর্তমান আমেরিকার সবথেকে কুখ্যাত ভূতুরে বাড়ি। এই বাড়িটি ১২টি প্রেতাত্মার অস্তিত্ব ও ১০টি মার্ডারের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। ২০০১-২০০২ সালে এই বাড়িটির ওপর ‘আনসল্ভড্ মিসট্রিস্’ (Unsolved Mysteries) নামে একটি সিনেমাও তৈরি হয়। রবার্ট স্ট্যাক- বলেছেন যে এই সিনেমাটির শুটিং-এর সময় তারা নানা রকম অদ্ভুতসব অসুবিধের সম্মুখীন হয়েছিলেন।
মার্টল’স-এর পরিবেশ এমনিতেই বেশ গা ছমছমে। মাঝে মাঝেই কোথা থেকে যেন একরাশ শীতল হাওয়া এসে ঘিরে ধরে বাড়িটিকে। ফটোগ্রাফেও কখনও কখনও ফুটে ওঠে অশরীরীদের অবয়ব। তাই ওখানে গেলে আজও পর্যটকদের মনটা ভূতের ভয়ে একটু হলেও কেঁপে ওঠে।
জেনারেল ডেভিড ব্রাডফোর্ড (General David Bradford) ছিলেন ‘হুইস্কি বিদ্রোহ’-এর নেতা। তিনি এই বিদ্রোহের জন্য তিনি “হুইস্কি ডেভ” নামেই পরিচিত হয়েছিলেন। ১৭৯৪ সালে তিনি এই প্লান্টেশনটি গড়ে তুলেছিলেন। তিনি এই বাড়িটি বানিয়েছিলেন টিউনিকা-ইণ্ডিয়ানদের একটি কবরস্থানের ওপর। ডেভ-ই প্রথম প্লান্টেশন এলাকায় ভুতের দেখা পান। তিনি দেখেছিলেন একটি নগ্ন ইণ্ডিয়ান তরুণীর প্রেতাত্মা রাতের অন্ধকারে প্লান্টেশন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য স্থানীয় লোকেদের ধারণা যে বর্তমানে মার্টল’স-এ যে সব ভূতেদের দেখা যায়, তারা কেউই ইণ্ডিয়ান নয়, বরং তারা ব্রাডফোর্ডের মৃত পুত্র-কন্যা এবং প্রপৌত্র-কন্যাদের আত্মা। ব্রাডফোর্ডের কন্যা সারাহ মাটিণ্ডা বা সারাহ মাথিলডা (Sara Mathilda) বিচারক ক্লার্ক উডরফ (Clark Woodruff)-কে বিয়ে করেছিলেন। ক্লো (Chloe) নামের এক ক্রীতদাসী ছিল ঊডরফের রক্ষিতা। কিন্তু একসময় ক্লো-র উপর থেকে উডরফের মন উঠে যেতে থাকে। তাতে ক্লো একটু ভয় পেয়ে যায়। ভাবতে থাকে তাহলে কি তাকে আবার মাঠের কাজে ফিরে যেতে হবে? তার এই ভয় থেকে উদ্ভূত সন্দেহ যাচাইয়ের উদ্দেশে ক্লো, ঊডরফের ঘরে আড়িপাতা শুরু করে। কিন্তু ভাগ্য তার পক্ষে ছিলনা । একদিন আড়িপাততে গিয়ে পিছনফিরে পালাতে গিয়ে মালীর গায়ের ওপর গিয়ে পরে এবং চিৎকার চেঁচামেচিতে উডরফ ক্লো-কে হাতে নাতে পাকড়াও করে। এর মূল্য বাবদ ক্লো-কে তার বাঁ কানটি হারাতে হয়। শুধু শাস্তি দিয়েই উডরফ ক্ষান্ত হন না। তিনি ক্লো-কে রান্নাঘরের কাজ়ে ফেরত পাঠান। অর্থাৎ ক্লো উপপত্নীর স্থান হারিয়ে রাঁধুনিতে পরিণত হয়। সে সময় নিজের দৈহিক বিকৃতি ঢেকে রাখতে ক্লো তার মাথায় একটি সবুজ পাগড়ি (টারবান) বেঁধে রাখতো। ক্লো ছিল খুব বুদ্ধিমান। তাই সে হতাশ না হয়ে ঊডরফ পরিবারে তার নিজের স্থান পুনরুদ্ধার করার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে এবং একদিন সে সুযোগ পেয়েও যায়। একদিন ক্লো-কে ঊডরফ তার পরিবারের জন্য একটি স্পেশাল কেক তৈরি করতে দায়িত্ব দেন। ক্লো কিছু বিষাক্ত ল্যাভেন্ডার পাতা সংগ্রহ করে সেগুলো কেকের সাথে মিশিয়ে দেয়। ক্লো ভেবেছিল এতে ঊডরফের শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়বে এবং তাদের সেবা যত্নের জন্য ক্লো-কে পরিবারে ফিরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু ঈশ্বর এবারও ক্লো-কে নিরাশ করে। আন্দাজে ভুল থাকায় কেকে বিষের মাত্রা বেশি হয়ে যায় এবং ফলস্বরূপ সেই রাতেই সারাহ মাটিণ্ডাসহ তার দুই সন্তান বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
অন্যসব ক্রীতদাসেরা এই ঘটনা জেনে গেলে তারা ক্লো-কে প্লান্টেশনের একটি গাছে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। তারপর মৃতদেহের সাথে পাথর বেঁধে মিসিসিপি নদীতে ফেলে দিয়ে আসে। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত অশরীরী ক্লো-কে মার্টল’স প্লান্টেশনের ঘরে বাইরে সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এর পর থেকেই নানা অদ্ভুত ঘটনা আশে-পাশের লোকেরা লক্ষ্য করেছেন। মার্টল’স-এ রাত কাটানো অনেক দর্শনার্থী বৃষ্টির রাতে বাড়ির বারান্দায় দু’টি শিশুকে খেলা করতে দেখেছেন বলে দাবি করেছেন।
অবশ্য অন্যরা বলে থাকেন, ১৮২৩ সালে, সারাহ ঊডরফ (মাটিণ্ডা) ইয়েলো ফিভারে মারা গিয়েছিলেন এবং ১৮২৪ সালের জুলাই মাসে তার ছেলে ও আগস্ট মাসে মেয়েও ইয়েলো ফিভারে মারা যায়।
মার্টল’স-এর ভূতুরে গল্পগুলোর মধ্যে ক্লো-র গল্প সবথেকে বেশি প্রচলিত। এ ছাড়া শোনা যায় যে তাদের বাড়িটির প্রবেশ দরজার কাছে একটি ঘরে বাস করত সিভিল যুদ্ধের এক সৈনিক। যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত আঘাতের ফলে সে একসময় মৃত্যু বরণ করে। জীবদ্দশায় সৈনিকটি ছিল একজন তুখোড় ধূমপায়ী। সে যে ঘরে বাস করত সেখানে আজও নাকি মাঝে মধ্যে তামাকের তীব্র গন্ধ পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে বর্তমানে মার্টল’স- ধূমপান পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
অন্য একটি কাহিনীতে বলা হয়, উইলিয়াম উইন্টার নামে এক ব্যক্তি ১৮৭১ সালে প্লান্টেশনে বসবাস করার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। ঘটনার সময় তিনি স্টাডি-রুমের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আততায়ী জানালা দিয়ে তাঁর দিকে গুলি ছুঁড়লে সিঁড়ি-কোঠার ১৭ নং ধাপে তাঁর মৃত্যু হয়। কারও কারও মতে আজও রাতের বেলা উইন্টার-এর পায়ের শব্দ ১৭ নং সিঁড়িতে এসে থেমে যায়। এ ছাড়া, কোন একসময় উপরতলার একটি ঘরে একজন বালিকা ইয়েলো ফিভার-এ আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তার মূর্খ পিতা-মাতা চিকিৎসার জন্য এক স্থানীয় ওঝাকে ডেকে এনেছিল। কিন্তু ওঝার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মেয়েটি মৃত্যুবরণ করে। এতে মাতা-পিতা ক্রুদ্ধ হয়ে গিয়ে ওঝাকে ঘরের ভেতরেই ঝাড়বাতির সাথে ঝুলিয়ে দেয়। ১৯২৭ সালে এক ডাকাতির ঘটনায়, প্লান্টেশনের কেয়ারটেকার-নির্মমভাবে খুন হয়েছিল। প্লান্টেশন-এর বর্তমান মালিক দাবী করেন, এখনও সেই কেয়ারটেকারকে মাঝে মাঝে প্লান্টেশনে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকজনদের ভেতরে আসতে নিষেধ করতে দেখা যায়।
ভূত শুধু আমাদের বাংলায় বা ভারতবর্ষই নয়, ভূতের রাজত্ব এই বিশ্বের সর্বত্র। আমেরিকা বা ব্রিটেনও এ ব্যাপারে কম যায় না। আমেরিকায় হ্যালুইন উৎসবের কথা তো সকলেরই জানা। চীনারা তো সাড়ম্বরে বার্ষিক ভূত উৎসবও পালন করে। তবে এইসব অশরীরী, ভূতেরা আমাদের আশেপাশের জ্যান্ত ভূতেদের থেকে কম ক্ষতিকারক বলে অনেকেরই ধারণা।
সমাপ্ত
আজকের বিজ্ঞানের যুগ অতিপ্রাকৃতকে মানতে চায় না। কিন্তু তা বলে অতিপ্রাকৃত যে নেই, সে তো জোর দিয়ে বলা যায় না। কিছু না কিছু তো আছেই, তা না হ’লে এতো মানুষ “ভূত আছে” বলেন কেন? হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসে। কিন্তু শুধু সেই কারণেই যুগ যুগ ধরে এতো ভূতের গল্প, ভূত নিয়ে রীতিমতো চর্চা হয়ে চলেছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। আত্মার অস্তিত্ব অনেক বড় বড় মহাপুরুষও স্বীকার করে গেছেন, আমরা তো নগন্য মাত্র।