সুজিত চট্টোপাধ্যায়
সেদিন ভূতচতুর্দশীর মাঝরাত্তির। চারদিক মিশমিশে কালো অন্ধকার। চালতা গাছের ডালে সরু লিকলিকে বিদঘুটে আকৃতির লম্বাটে ঠ্যাং ঝুলিয়ে যে বসেছিল সে মামদোভুত।
মদন, আজ বাজারে চিকেন বিক্রি করে বেশ ভালোই রোজগার করেছে। অন্যসময় মেরে কেটে হাতে থাকে শ’তিনেক। আজ এক্কেবারে হাজার। সুতরাং মনে খুশির বান। সেই খুশি বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে গিয়ে এতখানি রাত হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি মদন।
বাড়িতে বউ, মেয়ে আর মা। সংসারে পুরুষ এই একজনই; মদন। বাড়িতে সবাই তাকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলে। বিশেষ করে সাত বছরের মেয়ে মানু। সন্ধ্যেবেলা পড়াশোনা শেষ করে বাবার সঙ্গে খেলতে, গল্প শুনতে ভারী ভালো লাগে মানুর। ভুতের গল্প হলে তো কথাই নেই। মদন তাই পারতপক্ষে দেরী করে না, কাজ শেষ হলেই বাড়ি ফেরে। কিন্তু আজ বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
আড্ডায় একবার জমে গেলে বেরিয়ে আসা খুবই মুশকিল। আসলে আড্ডা ব্যাপারটাই এমন। কেমন যেন নেশা লেগে যায়। সবকিছুই যেন মূল্যহীন অপাংক্তেয় হয়ে যায় এই জমে যাওয়া আড্ডার কাছে।
আগামীকাল কালী পুজো। মানুর আবদার মেটাতে আতসবাজি কিনেছে মদন। তুবড়ি রঙমশাল ফুলঝুরি চরকি। মানু নিশ্চয় এগুলো দেখবে বলে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। অভিমান করেছে বাবার ওপর।
মদন জোরে জোরে পা চালিয়ে চলতে শুরু করলো। সামনের মাঠটা পেরোলেই বাড়ি।
মাঠটা বড্ড অন্ধকার। জনমানবহীন। সঙ্গে আলো নেই। আন্দাজেই পথ পেরতে হবে। যদিও চেনা পথ তবুও অন্ধকার বাধা সৃষ্টি করবেই।
ঠিকই তাই হলো। তারাতাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ সজোরে ঠোক্কর লাগলো।
না না, পায়ে নয়। কপালে। ঠকাস্ করে কী যেন একটা শক্ত মতন কপালে ঠুকে গেল।
ব্যাথা পায়নি তেমন, কিন্তু বেশ অবাক হলো। মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো মদন কিন্তু কিছুই দেখতে পেলনা। চালতা গাছ আছে ঠিকই কিন্তু তার কপালে আঘাত করতে পারে এমন কিছুই নেই। তাহলে কী হলো ব্যাপারটা ?
মদনের বুক ছ্যাঁক করে উঠলো। মনে পড়ে গেল, মাঠের মাঝখানে এই চালতা গাছে বাস করে মামদো ভুত। তার ওপর আজ ভূতচতুর্দশী। মা, বউ দুজনেই আজ সন্ধ্যের আগেই ঘরে ফিরতে বলেছিল বারবার।
ঠিক তখনই একটা ভাঙা ভাঙা গলায় কে যেন বললো,,
“তোর কপালে যেটা ঠুকে গেল, সেটা আমার পায়ের বুড়ো আঙুল।”
মদন হতবুদ্ধি হয়ে এলোমেলো তাকিয়ে বক্তার হদিস করতে না পেরে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে বললো,
“কে তুমি?”
উত্তর এলো, “আমি মামদো। মামদো ভুত।”
মদনের শরীরে কাঁপুনি এলো। হায় হায়, আজ বুঝি রেহাই নেই! শেষমেশ ভুতের পাল্লায়!
মদন আর কিছু ভাবতে পারে না। দে ছুট। ছুটে পালানোই বাঁচার একমাত্র পথ। মামদোও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। সেও ছুট লাগালো, তবে পায়ে পায়ে নয়; উড়ে উড়ে। উড়ছে আর বলছে,
“দাঁড়া মদন, কথা আছে। ভয় নেই। তোর ভালোর জন্যেই বলছি। দাঁড়া। নইলে মরবি।”
মদন বুঝলো ভুতের সঙ্গে এঁটে ওঠা যাবে না। তারচেয়ে কি বলতে চায় শোনাই যাক। যা আছে কপালে। মদন দাঁড়িয়ে পড়ে ভোঁস ভোঁস করে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,,,
“বেশ, দাঁড়ালুম, নাও কী বলবে তারাতাড়ি বলে ফেলো আমার তাড়া আছে।”
মামদো ফ্যাক্ ফ্যাক্ করে ভুতের হাসি হেসে বললো,
“তাড়া আছে? কিন্তু তোর যে ফাঁড়া আছে। তার কী হবে?”
মদন চোখ কপালে তুলে বললো,,
“ফাঁড়া ! কিসের ফাঁড়া কেন ফাঁড়া?”
মামদো আবারও একটু হেসে নিয়ে বললো,
“আরে সেই কথা বলবো বলেই তো সন্ধ্যে থেকে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে আছি। যদিও একথা তোকে জানাবার দায়িত্ব আমার নয়, তবুও কে জানে কেন মনে হলো তোকে সাবধান করেদি। তাই বলছি শোন, তোর সামনে সাংঘাতিক বিপদ। এখন কী করে কী করবি তাই বল।”
“আরে দূর মশাই কি বিপদ তা-ই জানলুম না, কী করবো মানে কী? একটু গুছিয়ে-গাছিয়ে বলো তো দেখি, যাতে আমি সহজ করে বুঝতে পারি।”
“শোন তবে ভালো করে। তোর কপালে ফাঁড়ার খাঁড়া ঝুলছে। তুই যদি আজ রাতে পথে ঘাটে রাত কাটাস্, তাহলে নির্ঘাৎ অপঘাতে মৃত্যু হবে তোর।”
“এ তো ভারী মুশকিল। তুমি কি আমাকে পাগল ভেবেছ না-কি সন্ন্যাসী? আমার ঘর পরিবার থাকতে হঠাৎ করে পথেঘাটে থাকতে যাবো কোন দুঃখের কারণে শুনি? আমি এক্ষুনি বাড়ি যাবো।”
“তা নিশ্চয়ই যেতে পারিস। কিন্তু তুই বাড়ি গেলে তোর বউ আজ রাতেই মরবে। এবার ভেবে বল কী করবি? বউয়ের মৃত্যুর কারণ হ’বি? যদি তা ই চাস তবে যা ঘরে। বউ ম’লে তোর সংসার সামলাবে কে, বাচ্চা মেয়েটার কী হবে, এই বয়সে সে মাতৃহারা হবে শুধু তোর জন্যে। পাপের বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে সারাজীবন, পারবি?”
“ওরে বাবা, এ তো একেবারে বিচ্ছিরি ব্যাপার। না না ধুস্স্! এরকম হয় নাকি? সব মিথ্যে কথা। আমাকে মিছিমিছি ভয় দেখাবার জন্যে এইসব কথা বানিয়ে বানিয়ে বলছো। কি ঠিক কি-না ?”
“মোটেই না। ভুতেরা মিথ্যে কথা বলে না এসবই তোর ললাট লিখন। এই ভূতচতুর্দশী রাতে এমনই হবার ছিল তোর। যাক গে, এখন বল কী করবি ? মানে, মরবি … না কি বউকে মারবি? “
মদন মাটিতে উবু হয়ে বসে দু’হাতে মাথা চাপড়াতে লাগলো। সে কিংবা বউ যে-ই মারা যাক না কেন, তাদের সাধের সংসার ছারখার হয়ে যাবে। বুড়ি মা, বাচ্চা মেয়ে, কে দেখভাল করবে তাদের? খুব কান্না পাচ্ছিলো কিন্তু এখন কান্নাকাটি করলে সময় থেমে থাকবেনা। রাত শেষ হবার আগেই একটা ফয়সালা করে ফেলা চাই নইলে মহাবিপদ।
ছোট্ট মানুর মুখ চোখের সামনে ভাসছে।
হঠাৎ মদন বললো, “আচ্ছা মামদো ভুত ভাই, আমি শুনেছি যেখানে বিপদ আছে সেখানেই বিপদ মুক্তির উপায় আছে। তাই যদি সত্যিই হয় তাহলে নিশ্চয়ই এর থেকে বেরুনোর উপায় আছে। ওহে ভুত মশাই, সবকিছু আগাম জানিয়ে তুমি যখন এতো বড়ো উপকার করলে, তখন আরও একটু উপকার করে দাও বাবা মামদো। এই ভয়ংকর বিপদ থেকে রক্ষা করে দাও ভাই আমার।”
“না রে মদন পুরোপুরি মুক্তির উপায় নেই। কাউকে মরতেই হবে।”
মদন এই কথায় খুব রেগে গেল, বললো,
“ইয়ার্কি না-কি, মামদোবাজি পেয়েছো? মরতে হবে! কেন মরতে হবে শুনি! এ কেমন ধারা বিচার? বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ মরতে হবে! চালাকি পেয়েছো? আমি মোকদ্দমা করবো, তোমাকে হাজতবাস করিয়ে ছাড়বো, ভুত ব’লে যা খুশি তাই করবে, দেশে আইন কানুন নেই ভেবেছো?
রাগের মাথায় চিৎকার করে এতগুলো কথা বলে মদন হাঁপাতে লাগলো। মামদো তার এইসব কথা শুনে আবারও খানিকটা হেসে নিয়ে বললো,
“ওরে মদন রাগ করে কী করবি বল। ভূত সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাছাড়া দ্যাখ, তোর কপালে তো আমি কিছু লিখিনি। যা লেখালিখি করবার সে সবই ঐ তেনাদের হাতে। আরে বাবা, আমিও তো এককালে তোদের মতই ছিলুম। এখন মরে গিয়ে কর্মদোষে মামদো ভুত হয়ে গেছি আমার কী দোষ? যাক, মাথা ঠান্ডা করে শোন। ফাঁড়া কখনও বলে কয়ে আসে না। তবু তো তোর কপাল ভালো রে, আমার থেকে সব জেনে নিয়ে পছন্দ মতো একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিস। নইলে এতক্ষণে কী হতো একবার ভেবে দ্যাখ। শোন, নিজের বা তোর বউয়ের মৃত্যু যদি না চাস তাহলে তোর মা’কে মরতে হবে।”
মদন আর্তনাদ করে ওঠার মতো বললো, “অসম্ভব, এ হতে পারে না। আমি নিজের প্রাণ বাঁচতে মা’কে হত্যা করার পাপ কিছুতেই করতে পারবো না। তার চেয়ে আমি মরবো সে-ও ভালো।”
মদন হাউ হাউ করে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলো। মামদো তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
“দ্যাখ মদন, ফাঁড়া সর্বদাই নিষ্ঠুর নির্মম। সে ভালো মন্দের হিসেব রাখে না। ছোট বড়ো শিশু বৃদ্ধ জ্ঞান করে না। তাই তোর মেয়ে কে …”
মামদোর কথা শেষ হলো না। মদন একটা হেঁচকি তুলে ধপ্ করে পড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমার সব যাক্, যথাসর্বস্ব যাক্, ইহকাল পরকাল সব সব যাক শুধু আমার প্রাণের অধিক মানু থাক্। সে বিনা এ জীবনের কী দাম? আমার মরণ ভালো। তাই হোক আমার মরণ হোক, ঈশ্বরের দেওয়া ফাঁড়ার অবসান হোক।”
মামদো আবারও তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,,
“বেশ , তাহলে আরও একটা উপায় দিচ্ছি, এতে নিশ্চয়ই তোর আপত্তি থাকবে না। বরঞ্চ খুশিই হ’বি। “
“কি উপায়?”
“তোর সবচেয়ে বড়ো শত্রু যে, তাকে মরতে হবে। কি রাজি?”
মদন এখন একটু সামলে উঠেছে তবুও ধরা গলায় বললো ,,,
“সত্যি কথা বলতে আমার কোনও শত্রু নেই। আমার শত্রু বলতে যদি কেউ থেকে থাকে তবে সে আমি নিজে। নইলে আমার ভাগ্যে এমন ভয়ানক ফাঁড়া লেখা হবে কেন? তবুও আমার অজান্তে যদি আমার কোনও শত্রু থেকেও থাকে, আমি কিছুতেই নিজের স্বার্থের কারণে তার মৃত্যু কামনা করতে পারি না। কেননা তা অমানবিক, অধার্মিকতা।”
“তাহলে এখন কী করনীয়?”
” হে মামদো, ভেবে দেখলাম আমার কর্মফল আমারই ভোগ করা উচিৎ। তাই আমি সারারাত পথেঘাটে থেকে অপঘাত মৃত্যুবরণ করতে চাই।”
এখন কার্তিক মাস। হেমন্তের হিমেল বাতাসে গা শিরশির করে। হালকা শীতের পরশ। মামদো এবার মোলায়েম স্বরে বললো,
“জানিস্ তো নিশ্চয়ই, এই ভূতচতুর্দশী তিথি আমাদের মানে ভুতেদের বড় খুশীর দিন। তাই মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম একজন মানুষকে আমাদের সেই খুশির একটু ভাগ দিয়ে যাবো। কিন্তু বড্ড বেকায়দায় পরলাম মানুষ খুঁজতে গিয়ে। প্রতি বছর এই ভূতচতুর্দশী তে পৃথিবীতে আসি আর মানুষ খুঁজে বেড়াই। আজও সন্ধ্যে থেকে অনেককেই পরীক্ষানিরীক্ষা করে বুঝলাম, কেউ স্বার্থপর, কেউ নির্মম নির্দয়, কেউবা ভয়ানক লোভী এবং মিথ্যুক। একমাত্র তোর মধ্যেই স্নেহময় পিতা, দায়িত্ববান স্বামী, মাতৃভক্ত সন্তান, মানবিক ক্ষমাশীল অজাতশত্রু মানুষের উজ্জ্বল সন্ধান পেলাম।”
মদন তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে নিয়ে বললো,
“ওঃ! তার মানে তুমি এতক্ষণ আমার পরীক্ষা নিচ্ছিলে?”
“পরীক্ষা না নিলে আসল নকল বুঝবো কেমন করে ? তবে, পরীক্ষায় তুই পাশ। তাই তোর হাতেই দিয়ে যেতে চাই হীরে-জহরতের রত্ন ভান্ডার যা শত শত বৎসর ধরে আমি আগলে রেখেছি।”
মদন অবাক হয়ে বললো,
“আমি? মানে আমাকে দেবে! কিন্তু কেন?”
“প্রতিজ্ঞা করে ছিলুম সত্যিকার মানুষের সন্ধান পেলে, তার হাতে সঁপে দেবো। কয়েকশো বছর সেই মানুষ খোঁজার কাজ করতে করতে বুঝলাম, মানুষ খুঁজে পাওয়া সহজ কথা নয়। মানুষের মতো দেখতে আর মানুষ এক কথা নয়। যাক্! এতদিনে আমার মুক্তি হলো। এই নে, যত্নে রাখিস্। ভালো কাজে ব্যবহার করবি আর মনকে অহংকার মুক্ত রাখবি।
মামদো ভুত বাতাসে মিলিয়ে গেল। “মানুষ” মদন ঐশ্বর্যের কলসি মাথায় নিয়ে ঘরমুখো হলো।।